Thursday, November 19, 2009

জীবনানন্দ দাশ

'কবিতা ও জীবন একই জিনিষেরই দুইরকম উৎসারণ।'

_জীবনানন্দ দাশ

বাংলা সাহিত্যের দুই যুগন্ধর কবি জন্মেছিলেন একই খ্রিস্টীয় বছর ১৮৯৯-এ, দুই খ্রিস্টীয় শতাব্দীর যৌগিকলগ্নে। একজন কাজী নজরুল ইসলাম ও অন্যজন জীবনানন্দ দাশ। নজরুলের জন্ম ২৪ শে মে আর জীবনানন্দের ১৭ই ফেব্রুয়ারি। বাংলা সাহিত্যে দু'জনেরই আবির্ভাব নতুনকে ধারণ করে। অর্থাৎ প্রচলিত ধারা ও ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তাদের সরব আগমন। নজরুল হুঙ্কার দিলেন_

'তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
[ 'প্রলয়োল্লাস', অগি্নবীণা ]
নজরুল যেমন বাংলা সাহিত্যে নতুনের পতাকা উড়িয়ে প্রবেশ করলেন জীবনানন্দও তেমনি তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই (প্রথম 'ঝরা পালক', দ্বিতীয় 'ধূসর পা-ুলিপি') পুরাতনকে অস্বীকার করলেন। 'অজানা এক বাণী' তিনি শোনাতে চাইলেন :
'কেউ যাহা জানে নাই_কোনো এক বাণী_
আমি বহে আনি :
একদিন শুনেছ যে-সুর_
ফুরায়েছে,_পুরানো তা_ কোনো এক নতুন-কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি,_আমার মতন
আর নাই কেউ!
কলেজে অধ্যাপনার কাজ দিয়ে জীবনানন্দের কর্মজীবন শুরু ও শেষ। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজ সিটি কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু। অধ্যাপনা করেছেন পূর্ববাংলা ও তৎকালীন ভারতের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। উল্লেখযোগ্য- সিটি কলেজ, কলকাতা, বাগেরহাট কলেজ, খুলনা, রামযশ কলেজ, দিলি্ল, ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল, খড়গপুর কলেজ, বাড়িশা কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজ। ঐ কলেজে চাকরিরত থাকাকালীনই তিনি মারা যান।
জীবনানন্দের কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না। তাকে একটি ছেড়ে আরেকটি চাকরি খুঁজতে হয়েছে। চাকরি তথা জীবিকার অভাব তাকে আজীবন কষ্ট দিয়েছে। একটি চাকরির জন্য তিনি হন্যে হয়ে দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। বেকার জীবনে তাকে বীমার দালালি পর্যন্ত করতে হয়েছে। বেশিরভাগ সময় জীবনানন্দকে গৃহশিক্ষকতা করে জীবিকানির্বাহ করতে হয়েছে। এ ছাড়া ছোটভাই অশোকানন্দের কাছ থেকে টাকা ধার করে এক বন্ধুর সাথে ব্যবসার চেষ্টাও করেছেন বছরখানেক। জীবনানন্দ বৈষয়িক ছিলেন না, তাই দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ যখন দিলি্লর রামযশ কলেজের অধ্যাপক তখন তিনি ঢাকা ইডেন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য গুপ্তকে বিয়ে করেন। লাবণ্য খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামের রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা। তাদের বিয়ে হয় ঢাকার ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে। কবির স্ত্রী বিয়ের পর স্নাতক হন এবং শিক্ষকতা করেন। কলেজজীবনে লাবণ্য স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। লাবণ্য-জীবনানন্দের দুটি সন্তান। কন্যা মঞ্জুশ্রীর জন্ম ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে আর পুত্র সমরানন্দের ১৯৩৮-এ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মা কুসুমকুমারী ও বাবা সত্যানন্দের প্রভাবে জীবনানন্দ সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তাছাড়া মা-বাবা দুদিকের পরিবারেই সাহিত্যচর্চার একটি আবহ ছিল। এর সুফলও জীবনানন্দ ভোগ করেছিলেন। জীবনানন্দের লেখা প্রথম কবিতা 'বর্ষ-আবাহন' প্রকাশিত হয় 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় ( খ্রিস্টাব্দ ১৯১৯)। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি লিখতে শুরু করেন। প্রথম জীবনে ছবি অাঁকার দিকেও তার ঝোঁক ছিল। জীবনানন্দের প্রথম দিকের কবিতায় নজরুলের কবিতার ছাপ লক্ষ্যণীয়। একই বছরে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনানন্দের আগেই নজরুলের কবিকৃতি ছড়িয়ে পড়ে।
তবে জীবনানন্দ খুব দ্রুতই তার এ দুর্বলতাটুকু কাটিয়ে ওঠেন এবং নিজস্ব ঢং-এ কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' প্রকাশিত হয় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর জীবনানন্দ এর এক কপি অগ্রজ কবি রবীন্দ্রনাথকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ বইটির প্রাপ্তিস্বীকার করে কবিকে যে চিঠি পাঠান তার ভাষা একজন তরুণ কবির জন্য খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
'তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। _ কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।
বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।'
জীবনানন্দ কিন্তু দমে যাননি। তিনি তার মতো লিখে যেতে থাকলেন। কবিতায় তিনি তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ বর্জন করেন এবং ব্যাপকভাবে পূর্ববাংলার লোকজ শব্দ ব্যবহার করেন। এতে তার একটি নিজস্ব ভাষারীতি গড়ে ওঠে। কিন্তু জীবনানন্দের মতো প্রতিভাবান ও আধুনিক কবির দুর্ভাগ্য, জীবদ্দশায় তিনি প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল উভয় শিবিরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। রক্ষণশীলদের মুখপত্র 'শনিবারের চিঠি' এবং প্রগতিশীলদের 'পরিচয়' ও 'নতুন সাহিত্য' জীবনানন্দের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। মননশীলতার আভিজাত্যের অহঙ্কারী কবি সুধীন্দ্রনাথ (১৯০১-৬০) জীবনানন্দকে কবি বলেই স্বীকার করেননি। 'শনিবারের চিঠি' এবং এর সম্পাদক সজনীকান্ত দাস (১৯০০-৬২) আধুনিক সাহিত্যের বিরোধিতাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩), ননী ভৌমিক প্রমুখ প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকরাও জীবনানন্দ ও তার সাহিত্যকে ব্যাপক আক্রমণ করেছেন। অবশ্য প্রগতিশীল শিবির পরবর্তীকালে তাদের ভুল বুঝতে পেরে নিজেদের শুধরে নিয়েছেন। তবে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দের মতো 'অন্তর্বৃত-অসামাজিক-অভিনব' কবিকে সাহিত্যিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট ছিলেন দু'জন কবি-সমালোচক : বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-৬৯)। বুদ্ধদেব বসু এবং অজিত দত্ত (১৯০৮-৭৯) সম্পাদিত 'প্রগতি', বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'পূর্বাশা', সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-৮৮)সম্পাদিত 'নিরুক্ত' পত্রিকায় জীবনানন্দকে তারা ব্যাপকভাবে তুলে ধরেন।
জীবনানন্দের জীবদ্দশায় তার মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল এবং এগুলোতে মাত্র ১৬২টি কবিতা সংগ্রথিত হয়েছিল। কোন গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর তার খাটের নিচে দুই ট্রাঙ্কভর্তি লেখার পা-ুলিপি আবিষ্কৃত হয়। এগুলো কবির লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ ইত্যাদি। জীবনানন্দের কবিতার সংখ্যা আড়াই হাজারেরও অধিক। তাছাড়া তার ১৪টি উপন্যাস, ৫০টিও বেশি প্রবন্ধ এবং শতাধিক ছোট গল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার ৪৮টি কবিতার খাতা কলকাতা ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া ৬০/৬৫টি খাতায় ডায়েরি লেখার মতো করে তিনি যে 'লিটারারি নোটস' লিখেছিলেন এর পাঠোদ্ধারের কাজ চলছে। ৭০/৮০ বছরের জীর্ণ, ক্ষয়ে যাওয়া এসব লেখার পাঠোদ্ধারের কঠিন কাজটি করছেন জীবনানন্দ-গবেষক ডা. ভূূমেন্দ্র গুহ। এখানে উল্লেখ্য যে, জীবনানন্দের হাতের লেখা খুব অস্পষ্ট, কাটাকুটি এবং জটিল। কলকাতার 'প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন' ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে 'জীবনানন্দ সমগ্র' দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় খ-ে খ-ে প্রকাশ করে চলেছে। এখনও তার অগ্রন্থিত, অপ্রকাশিত লেখা পাওয়া যাচ্ছে। জীবনানন্দের আলোচিত উপন্যাসগুলো হলো- মাল্যদান (জুন ১৯৪৮, কলকাতা), কারুবাসনা (অগাস্ট ১৯৩৩, বরিশাল), জলপাইহাটি (এপ্রিল-মে ১৯৪৮, কলকাতা) এবং বাসমতীর উপাখ্যান ( ১৯৪৮, কলকাতা)।
জীবনানন্দের বিখ্যাত 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তার 'রূপসী বাংলা'র কবিতা 'বাংলার মুখ আমি' এবং 'আবার আসিব ফিরে' আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী বাঙালীদের গভীর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। জীবনানন্দের বহুলালোচিত কাব্যগ্রন্থ 'বনলতা সেন'। এ কাব্যগ্রন্থের বহুলপঠিত 'বনলতা সেন' কবিতাটি নিয়ে অনেক 'মিথ', অনেক কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই নাটোরে বেড়াতে গেলে বনলতা সেনের বাড়িটি খোঁজ করেন। বিভিন্নজন 'নাটোরের বনলতা সেন'কে বিভিন্নভাবে 'আবিষ্কারের' চেষ্টা করেছেন এবং এখনও করছেন। বেশিরভাগ পাঠকের ধারণা, বনলতা সেন শুধুই কবির কল্পনা। কলকাতার প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক (জন্ম বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার অন্তর্গত স্বরূপকাঠী উপজেলার মৈশালী গ্রামে) ও হৃদরোগ সার্জন ডা. ভূমেন্দ্র গুহ সমপ্রতি জীবনানন্দের ডায়েরি থেকে পাঠোদ্ধার করে জানিয়েছেন, 'বনলতা সেন' কবির কল্পনা নয়, রক্তমাংসের মানুষ। কবির কাকাত বোন 'শোভনা', যার ডাকনাম বেবী_ সেই 'বনলতা সেন'। কবির ইংরেজিতে লেখা দিনলিপি 'লিটারেরি নোটস'-এ 'ওয়াই' হিসেবে চিহ্নিত মেয়েটিই শোভনা। জীবনানন্দের বয়স যখন চৌত্রিশের কোঠায় তখন তিনি শোভনা ছাড়া আরও তিনটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। কাকা ফরেস্ট অফিসার অতুলানন্দ দাশের মেয়ে শোভনাকে বিয়ের আগে থেকেই তিনি ভালোবাসতেন। শোভনাও তার 'মিলুদা'কে (কবির ডাকনাম মিলু) এবং মিলুদার কবিতাকে খুব ভালোবাসতেন। জীবনানন্দ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' তার 'বনলতা সেন' শোভনাকে উৎসর্গ করেন। কবি যখন কলকাতা সিটি কলেজের প্রভাষক শোভনা কখন কলকাতা ডায়োসেশান কলেজের ছাত্রী। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন, আনিসুল হক-এর পূর্বোক্ত উপন্যাস এবং দেখুন দৈনিক 'আমাদের সময়' ৭ জুন ২০০৯ সংখ্যা)।
জীবনানন্দ এতটাই প্রচারবিমুখ ছিলেন যে মৃত্যুর পর তার একটি ছবি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এখন সব জায়গায় তার যে একটি মাত্র ছবি দেখা যায় এটি মৃত্যুর পর তার ট্রাংকে খুঁজে পাওয়া একটি গ্রুপ ফটো থেকে কেটে নেয়া। জীবনানন্দ ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় এবং লাজুক স্বভাবের। কোন সভা-সমাবেশ পছন্দ করতেন না। এমনকি সাহিত্যিক আড্ডাও না। তবে সমাজবিমুখ কিংবা রাজনীতিবিমুখ ছিলেন না।
তার কবিতা সমাজ ও ইতিহাসচেতনাকে ধারণ করেছে এবং তা ব্যাপকভাবে। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ নিজেই বলেছেন, 'কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান'। প্রকৃত কবি মাত্রেই অসামপ্রদায়িক। ১৯৪৬-এর ভয়াবহ সামপ্রদায়িক দাঙ্গা জীবনানন্দকে খুব বিচলিত করে। তিনি লিখলেন,
'মানুষ মেরেছি আমি_তার রক্তে আমার শরীর
ভরে গেছে : পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি : আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ করে ঘুমাতেছি_ ...
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, 'ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ_
আর তুমি?' আমার বুকের 'পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে _ রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার :'
('১৯৪৬-৪৭', শ্রেষ্ঠ কবিতা)
'রূপসী বাংলা'র সৌন্দর্যের বিমুগ্ধ রূপকার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও_আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব।'_জীবনানন্দের বাংলা যদি তার সাধের পূর্ববাংলা হয় তাহলে বলতে হয় এই পারে তিনি থাকতে পারেননি। কবি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববাংলা ছেড়ে যান, মৃত্যুর আগপর্যন্ত আসতে পারেননি। একথা বললে অন্যায় হবে না, পশ্চিমবঙ্গে তিনি এক উদ্বাস্তু কবির জীবনযাপন করেছেন। না পেলেন খ্যাতি, না পেলেন মর্যাদা। উল্টো কপালে জুটলো নিন্দা আর অপবাদ। জীবৎকালে তিনি একমাত্র পুরস্কার পান 'নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার'। এ নিয়েও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রবন্ধ লিখে নিন্দার ঝড় তোলেন।
প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের 'নিষ্ঠুর সমালোচনা' করলেও ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার একাট কবিতা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন 'চিত্ররূপময়'। ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ না করলেও জীবনানন্দ রবীন্দ্র্রনাথকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত জীবনানন্দ-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেক আগেই জীবনানন্দকে 'শুদ্ধতম কবি' অভিধা দিয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই জীবনানন্দের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আর প্রমাণিত হচ্ছে দুঃখবাদী হলেও কবি ছিলেন জীবনবাদী। তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলতা, নিরাদর্শবাদিতা, পলায়নপরতা এবং জীবন সম্পর্কে নিরুৎসাহিতার যেসব অভিযোগ ছিল এগুলো ইতোমধ্যে তিরোহিত হয়েছে। তথাকথিত আধুনিকতা যে ধনতন্ত্রের একটি মুখোশমাত্র এটি নিরীশ্বরবাদী জীবনানন্দ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। সত্তরোর্ধ জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ, যিনি কবির মৃত্যুর তিন বছর আগে থেকে তার সানি্নধ্যে ছিলেন এবং ২৮ বছর যাবৎ জীবনানন্দ-গবেষণায় রত তিনি এ বছরের (২০০৯) গোড়ার দিকে বাংলাদেশে এসে এক সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন, 'জীবনানন্দ এক শ' পঞ্চাশ ভাগ জৈবনিক'। আমরা মনে করি, জীবনানন্দের এর চেয়ে বড় কোন মূল্যায়ন হতে পারে না। একই ধারণার সপক্ষে আমরা স্বয়ং জীবনানন্দেরও সাক্ষ্য পাই,
'জীবন ছাড়িয়ে কোন মানবীয় অভিজ্ঞতা থাকা কি সম্ভব? কবির অভিজ্ঞতা যা আকাশ পাতাল সমস্তই উপলব্ধি করে নিতে চায় তাও তো মানবীয়।'
('কেন লিখি', জীবনানন্দ দাশ)
আপাতদৃষ্টিতে জীবনানন্দকে ভাবুক ও গম্ভীর মনে হলেও ব্যক্তিজীবনে পারিবারিক বলয় ও বন্ধুমহলে তিনি পরিচিত ছিলেন কৌতুকপ্রিয় ও সদা হাসিখুশি একজন মানুষ হিসেবে। তার আপাত দুবর্োধ্য কবিতা পড়ে বোঝার জো নেই যে জীবনানন্দ একজন প্রখর রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ, কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের কাছে নিয়মিত সান্ধ্যভ্রমণকালে কবি জীবনানন্দ দাশ ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কলকাতার শম্ভুনাথ প-িত হাসপাতালে নয়দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪, শুক্রবার রাত ১১.৪৫-এ তিনি মৃত্যুর কাছে হেরে যান। অনেকের ধারণা, এটি তার স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা। কিংবা দুর্ঘটনাটি তার মগ্নস্বভাবের জন্যেও হয়ে থাকতে পারে। তবে যতদূর জানা যায়, এসময়টাতে কবি তীব্র আর্থিক সঙ্কট, পারিবারিক অশান্তি এবং লেখক হিসেবে স্বীকৃতিহীনতার বেদনায় ভুগছিলেন। আমরা মনে করি, দিন দিন জীবনানন্দ যত জনপ্রিয় হবেন ততই তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকবে।

Published in SANGBAD

No comments:

Post a Comment