সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত সুমধুর...।' কুষ্টিয়ার খোকসার জানিপুরে গড়াই নদী তীরে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটি রচনা করেছিলেন। গড়াইর রূপে বিমোহিত কবি শুধু গড়াইকেই বন্দনা করেননি, বন্দনা করেছিলেন গড়াইকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাকে। কবিগুরুর সেই গড়াই আর আগের অবস্থায় নেই, শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে বিকিরিত করছে ধবল বালুর সোনালি কিরণ। এক সময় পদ্মার অন্যতম প্রধান শাখা নদী গড়াইয়ের পানি প্রবাহ আর তর্জন-গর্জন ছিল সবার চেনা। এখন অতি পরিচিত হিসেবে সবাইকে অবলোকন করতে হচ্ছে বালু মিশ্রিত মৃদু শব্দকে। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের নমুনা ও ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের অশনি সংকেত হিসেবেও মানছেন কেউ কেউ। বিগত কয়েক বছর ধরে, বর্ষার পরপরই কমতে শুরু করে গড়াই নদীর পানি। পানি নিচে নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নাব্য হারিয়ে ফেলা গড়াই পরিণত হয় ধু ধু বালুচরে। নদীটির উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে ভাটির কামারখালী পর্যন্ত দুই তীরে জেগে ওঠা চর নদীর প্রবাহকে করছে বাধাগ্রস্ত। ফলে ক্ষীণ ধারায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীটির পানি প্রবাহ। স্রোতধারার তীব্রতা কমে যাওয়ায় পলি জমতে শুরু করেছে যত্রতত্র। গড়াইকে পুনরুদ্ধার করতে সরকার কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা নিতান্তই প্রশ্নবিদ্ধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বিগত ১৯৯৬-৯৭ সালে সাড়ে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩ বছর মেয়াদি একটি পুনরুদ্ধার খনন প্রকল্প প্রণয়ন করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, সেসময় ৫ লাখ ৮৭ হাজার ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হয়েছিল। ব্যয় বরাদ্দ হয়েছিল ৩ হাজার ৫৪২ টন চাল। একই সময়ে গড়াইয়ের বুকে পানি প্রবাহ সারা বছর সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্য নিশ্চিত হওয়ায় ২২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়সাপেক্ষে আরেকটি পুনরুদ্ধার প্রকল্প শুরু করা হয়। গড়াইয়ের উৎসমুখ তালবাড়িয়া থেকে ড্রেজিং করা হয় ৩০ কিলোমিটার ভাটি পর্যন্ত। ২৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটিতে ১ কোটি ১৫ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণের লক্ষমাত্রা ধার্য করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯-২০০০ সালে পদ্মার মোট পানি প্রবাহের ৯-১০ ভাগ পানি গড়াই দিয়ে প্রবাহিত হয়।
ঘন ঘন ড্রেজিংয়ের ফলে কয়েক বছর নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী নাব্য ফিরে পায় এবং শুষ্ক মৌসুমে পানিধারা সমুন্নত ছিল। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ ও তদারকির অভাবে আবার নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে, ধু ধু বালুচর মরূভৃমিএত পরিণত হয়েছে। হারিয়ে ফেলছে গড়াই তার অতীত ঐতিহ্য।
মনিরুল ইসলাম, খোকসা

No comments:
Post a Comment