সাফারি শব্দটি শুনলেই মনে হয় নিসর্গ আর প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার। যেখানে প্রাণীদের অবাধ বিচরণ। অন্যদিকে দর্শনার্থীরা বন্দি। ইন্দোনেশিয়ার তামান সাফারি পার্ক এর ব্যতিক্রম নয়। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন আবু তাহের
জাকার্তা সফরের স্থানীয় গাইড বড় ভাই শামসুল আলম যখন ঘোষণা দিলেন, আজকে আমরা 'তামান সাফারি' দেখতে যাচ্ছি। আঁতকে উঠে তীব্র প্রতিবাদ জানালাম, সুদূর ইন্দোনেশিয়ায় এসেও হাতি, বাঘ, সিংহ দেখতে যাব? আমার কাছে সাফারি মানেই বন্যপ্রাণী দেখা। তাছাড়া দেশের একমাত্র সাফারি পার্ক দেখেছি। কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় অবস্থিত এ সাফারি পার্কে খাঁচাবন্দি বেশকিছু বন্যপ্রাণী রয়েছে। তা বেশ কয়েকবারই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এরপরও জাকার্তা শহরে এসে ফের সাফারি দেখার কোনো মানে হয় না। আরও অনেক কিছু দেখার রয়েছে এ শহরে। তিনি জানালেন, তামান সাফারি না দেখলে ভ্রমণের স্বাদই অপূর্ণ থেকে যাবে। তার এ কথায় রাজি হতেই হলো।
সকালে যাত্রা শুরু করলাম 'তামান সাফারি'র উদ্দেশে। জাকার্তা শহর থেকে ৭৮ কিলোমিটার দূরে। বোগর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার। গাড়িতে মাত্র ২ ঘণ্টার পথ। বোগর শহর পার হওয়ার পর পাহাড়ি উঁচু ভূমি। হাইওয়ের দু'পাশে পর্যটকদের জন্য সারি সারি হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস। রয়েছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ, কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন পণ্যের সমাহার নিয়ে দোকান। রকমারি স্যুভেনির এবং হাতে তৈরি পণ্য নিয়ে সড়কের দু'পাশে পর্যটকদের জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় আদিবাসী নারী-পুরুষ। রয়েছে কাঠ, বেত ও বাঁশের তৈরি হ্যান্ডিক্রাফট, পোশাক আরও কত কী। এখানে পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য বিদেশি কোনো পণ্য নেই। স্থানীয় লোকজন তাদের তৈরি করা পণ্য নিয়ে পসরা বসিয়েছে দীর্ঘ সড়কের দু'পাশ ধরে। হতবাক হলাম ইন্দোনেশিয়ার এ পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় দেখে।
সমতল থেকে ১২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় একটি সাফারি কীভাবে পর্যটকদের স্বর্গভূমি হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সাফারি পার্ককে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাটি হয়ে উঠেছে পর্যটকদের তীর্থস্থান। খাড়া পাহাড় ধরে উপরে উঠে গেছে মসৃণ সড়ক। শত শত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে আকর্ষণীয় এ পর্যটনকেন্দ্রের দিকে। সড়কের দু'পাশ ধরে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, ভিলা, রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান কোনোটিই খালি পড়ে নেই।
ইন্দোনেশিয়ান ১ লাখ ২৫ হাজার রুপিয়া দিয়ে (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক হাজার) টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম সাফারি পার্কে। ভেতরে উন্মুক্ত বন্যপ্রাণী দর্শনের সুযোগ ছাড়াও পর্যটকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। 'তামান সাফারি পার্ক'-এর পুরোটা ঘুরে সব ইভেন্ট উপভোগ করতে গেলে দু'তিনদিন সময় লেগে যেতে পারে। পর্যটকরা এখানে কেবল সাফারি বা বন্যপ্রাণী দেখার জন্য আসছে না, তারা আসছে পাহাড়ের নিসর্গকে আত্মস্থ করতে। প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে। এখানে বনের ভেতরে রাত কাটাতে রয়েছে আধুনিক সব ব্যবস্থা। সুদৃশ্য কটেজে মাত্র ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় থাকার সুন্দর ব্যবস্থা পর্যটকদের প্রলুব্ধ করে। রয়েছে পাহাড়ের ট্রেইল ধরে হাঁটার দীর্ঘ রোমাঞ্চকর পথ। অবশ্য টিকিট কেটেই পাহাড়ি এ পথে হারিয়ে যেতে হবে। এখানে বিনোদনের জন্য রয়েছে অসংখ্য রাইড, বন্যপ্রাণীর খেলা, এডুকেশন শো, রেইন ফরেস্ট দেখার ব্যবস্থা।
উপন্যাসের বা সিনেমার 'কাউবয়' চরিত্রও এখানে বাস্তবে দেখতে পাবেন। কাউবয়দের এ উপস্থাপনা অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর। তীর থেকে ধনুক ছুড়ে শত্রুকে বিদ্ধ করা কিংবা বোমা দিয়ে একটি ভবনকে চোখের সামনে আগুনের ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা বাস্তবেই ঘটে। এ ধরনের শো দেখে পর্যটকরা শিহরিত এবং আনন্দে উদ্বেলিত হয়। মোটরসাইকেল রেইস, কালচারাল শোর ব্যবস্থা, কেনাকাটার জন্য শপিংমলসহ কী নেই এখানে।
ইন্দোনেশিয়া সরকার তাদের প্রকৃতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। পাশাপাশি আয় করছে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারপ্রধানও এ ব্যাপারে অতি সচেতন, বুঝতে কষ্ট হয় না। জাকার্তা শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এলাকাজুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি দফতর ও আবাসস্থল। রাষ্ট্রপতি ভবনের এ বিশাল এলাকাজুড়ে অসংখ্য শতবর্ষী বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার হরিণ। সবুজ মাঠে অসংখ্য হরিণের বিচরণ দেখার মতো দৃশ্য। এখানেই ঘটছে তাদের বংশবৃদ্ধি। যে দেশের সরকারপ্রধান এ ধরনের প্রকৃতিপ্রেমিক, সে দেশটির প্রকৃতি ও পরিবেশ হতে পারে সহজেই অনুমেয়।
ই-মেইল : taher_bd@hotmail.com

No comments:
Post a Comment