দেশের অধিবাসীদের চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি। এটা কি কখনো ভাবা যায়? আমরা কি কখনো চিন্তা করতে পারি ১৪ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ১৫ কোটি ট্যুরিস্ট আসবে? ২৩ বর্গমাইলের কিছু বেশি আয়তনের দেশ সান ম্যারিনোতে প্রায়ই দেশের জনসংখ্যার চেয়ে পর্যটকের সংখ্যা বেশি থাকে।
আমাদের দেশের একটি থানার সমান এর আয়তন। দেশটির চার দিকেই উত্তর-দক্ষিণ সাপের মতো পেঁচানো দেশ ইতালি। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ দেশটি তার পেটের ভেতরে আগলে রেখেছে ক্ষুদ্র সান ম্যারিনোকে। ভূমি এবড়োখেবড়ো আর খুব একটা উর্বর নয়।
কিন্তু ছোট্ট দেশটির প্রকৃতি নয়নাভিরাম । পাহাড়ের সারির সাথে তাল মেলানো সবুজের সমারোহ অপরূপ সাজে সাজিয়েছে দেশটিকে। মাউন্ট টিটানোর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ থেকে পুরো দেশটিকেই দেখা যায়। আদালতের রায়ে শাস্তি পাওয়া মারিনাস জনহীন প্রান্তরে এসে আবাস গড়ে তোলেন। সে ৩০১ সালের কথা। এখনো দেশটি জনসংখ্যা অর্ধ লাখও হয়নি। শুমারি অনুযায়ী ৩১ হাজার জনসংখ্যার দেশ সান ম্যারিনো। বছরে গড়ে পর্যটক আসে ৩৩ লাখ।
একজন মানুষের বিপরীতে পর্যটকের হার ১০ জনেরও বেশি। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। একটি ল্যান্ডলক দেশে বিপুল পরিমাণ পর্যটক আকর্ষণের বিশেষ কিছু কারণও রয়েছে।
অদ্ভুত রহস্যেভরা ছোট্ট সান ম্যারিনো। সবুজের সমারোহের সাথে তাল মেলানো পাহাড়ের সারি। এরই মধ্যে দিয়ে চলে গেছে তীরের মতো সোজা রাস্তা। ঈষৎ উষ্ণ গ্রীষ্ম আর ভালোলাগা হালকা শীতের শীতকাল এ দেশে। ইউরোপীয়দের প্রিয় নানা ব্রান্ডের মদ পানীয় তীব্রভাবে টানে ইতালি, ফ্রান্স আর ব্রিটিশদের। রাস্তার দুই ধারে সব সময় ট্যুরিস্টদের মিছিল। সর্বোচ্চ পাহাড় মাউন্ট টিটানো রহস্যে ভরা। এর সর্বোচ্চ তিনটি শৃঙ্গে ম্যারিনোরা তৈরি করেছে আকর্ষণীয় তিনটি স্থাপনা।
নাম
রিপাবলিক অব সান ম্যারিনো
জনসংখ্যা
৩১ হাজার
রাজধানী
সান ম্যারিনো
আয়তন
৬১ বর্গকিলোমিটার
প্রধান ভাষা
ইতালিয়ান
মুদ্রা
লিরা
মাথাপছিু আয়
৩০ হাজার ডলার
ধর্ম
খ্রিষ্টান
গড় আয়ু
৭৭ বছর (পুরুষ), ৮৪ বছর (মহিলা)
প্রধান রফতানি
ওয়াইন, সিরামিক, আসবাবপত্র ও খোদাই করা শিল্প
এগুলো থেকে এক পলকে পুরো সান ম্যারিনোকে তো দেখা যায়ই, তার ওপর ইতালির বিস্তৃত অঞ্চলের সৌন্দর্যও অবলোকন করা যায়। তবে এর একটি স্থাপনা ব্যবহৃত হচ্ছে কারাগার হিসেবে। দাগি আসামিরা এখানে থাকে। দ্বিতীয়টিতে তৈরি করা হয়েছে একটি জাদুঘর। আকর্ষণীয় এ জাদুঘরই মূলত পর্যটকদের বেশি টানে। তৃতীয় শৃঙ্গে নির্মিত স্থপনাটি সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত নয়। পুরো দেশটিকে একটি পর্যটক অঞ্চল বলা যায়। পর্যটক আকর্ষণীয় আরো কয়েকটি স্থান রয়েছে। পালাজ্জো দ্যাই ক্যাপিটানি। এখানে একটি টাওয়ার রয়েছে এর নাম বেল টাওয়ার। পালাজ্জো পাবলিকো সরকারের প্রধান অফিসের নাম। রয়েছে মনাসটারি অব সান্তাক্লারা একটি অদ্ভুত সুন্দর পর্যটক স্পট।আশির দশকের আগে দেশটি ইউরোপের রুগ্ণ অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। পর্যটনকে ঘিরে সান ম্যারিনোতে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। এখন এর মাথাপিছু আয় ইতালির মাথাপিছু আয়ের সমান। মানুষের জীবনমানও ইতালির সমপর্যায়ের।
মারিনাস ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার অধিবাসী। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু লিওকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। তারা রিমিনি নামক একটি শহরে মিস্ত্রির কাজ নেন। এক পর্যায়ে তিনি রিমিনির বিশপ নিযুক্ত হন। এক উন্মাদ মহিলা মারিনাসের বিরুদ্ধে স্বামী বিচ্ছেদ ঘটানোর ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ তোলেন। সেখানকার বিচারক তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলে তিনি পালিয়ে জনহীন মন্ট টিটানোতে আশ্রয় নেন। এখানে তিনি মূলত নির্জনবাসী হন। ফকির-সন্ন্যাসীর জীবনযাপন শুরু করেন। গড়ে তোলেন একটি ছোট গির্জা। এটিকে কেন্দ্র করে সান ম্যারিনো সিটির গোড়াপত্তন। তারা ৩ সেপ্টেম্বর ৩০১ সালকে দেশের যাত্রা শুরু হিসেবে বিবেচনা করে। ওই দিনটিই ম্যারিনোবাসীর জাতীয় দিবস। ৩৬৬ সালে তিনি মারা যান। মূলত পঞ্চম শতকের মাঝামাঝিতে এখানে একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। একটি সুসংগঠিত সামাজিক সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল খাদ্য উৎপাদন স্বল্পতাহেতু ব্যাপক দরিদ্রতা।
ইউরোপের তৃতীয় ও বিশ্বের পঞ্চম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এটি। দেশটির আবহাওয়া ভূমধ্যসাগরীয়। গ্রীষ্মকালে বেশি গরম নয়। অন্য দিকে শীতেও কনকনে শীত থাকে না। রাজধানী সান ম্যারিনোতে মাত্র ৪ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। ছোট হওয়ায় বোরগো মাগোরেই নামক পাশেই অবস্থিত শহর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। আশির দশকের শুরুতে দরিদ্র জনপদ সান ম্যারিনোর সরকার পর্যটন উন্নত করার কর্মসূচি হাতে নেয়। অভূতপূর্ব সাড়া পায় তারা। পর্যটকদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় দেশের মোট জনসংখ্যাকে। ৩০ হাজার জনসংখ্যার দেশে প্রতিদিন এর চেয়ে বেশিসংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে স্থানীয় কিছু শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প, হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পের চাহিদা বেড়ে গেছে বহু গুণে। দেশটির প্রধান আকর্ষণ হলো মাউন্ট টিটানো। পাহাড় চূড়া থেকে আড্রিয়াটিক সাগরের বিস্তৃত নীল জলরাশি উপভোগ করা যায়। আমোদ-প্রমোদের জন্য নানান ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন খেলা। হোটেল-মোটেল আর প্রমোদ বিহারের জন্য সহজলভ্য সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
সান ম্যারিনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। তবে ইইউ দেশটিকে ইউরো মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। জাতীয় আয়ের ৫০ শতাংশের বেশি আসে পর্যটন থেকে। আয়ের বাকি অংশও পর্যটন সম্পর্কিত। দেশটিকে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের জন্য পুরোপুরি ইতালির ওপর নির্ভর করতে হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ সান ম্যারিনো। বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা রয়েছে এখানে। ৬০ সদস্যের গ্রান্ড অ্যান্ড ন্যাশনাল কাউন্সিলই সংসদ। এই কাউন্সিল আবার একজোড়া রিজেন্ট ক্যাপটেইন নির্বাচন করেন। সংসদ আর দু’জন রিজেন্ট ক্যাপটেইন মিলে সরকার পরিচালনা করেন। পঞ্চম শতক থেকে আরগেনো নামক একটি পরিষদ দেশ শাসন করত। এরা মূলত পরিবারকেন্দ্রিক একটি পরিষদ। প্রত্যেক পরিবারের প্রধান এ পরিষদের সদস্য হতো। গ্রান্ড অ্যান্ড ন্যাশনাল কাউন্সিল পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। নয়টি নির্বাচনী জেলা থেকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে তারা নির্বাচিত হয়। গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর আদলেই এর সরকার পরিচালনা হয়ে আসছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। রিজেন্ট ক্যাপটেইনরা প্রতি ছয় মাসের জন্য নির্বাচিত হন। স্বাধীন বিচার বিভাগ সান ম্যারিনোর।
এদের ক্ষুদ্র একটি সামরিক বাহিনী রয়েছে। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইতালির কাছে। সরকারি স্থাপনা পাহারা দেয়া, সীমান্ত রক্ষা শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় তারা কাজ করে থাকে। অপরাধ ও খুনখারাবি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে তারা। বিশেষ করে পর্যটকদের নিরাপত্তায় তাদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৩০০।
দেশের ভেতর ২২০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। প্রধান সড়কের নাম সান ম্যারিনো সুপার হাইওয়ে। রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি থেকে সহজে চিহ্ণিত করা যায় কোনটি কোন দেশের গাড়ি। রঙ ও নম্বর দেখে সহজে তা অনুমান করা যায়। তাদের সব সড়ক গিয়ে মিশেছে ইতালির সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা রেললইন স্থাপন করে। এগুলোর চিহ্ণও নেই এখন।
অন্য ইউরোপীয় দেশের মতোই তাদের সংস্কৃতি। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তাদের জীবনাচরণে সবচেয়ে বড় প্রভাবক মাউন্ট টিটানো। এর তিনটি শৃঙ্গকে তারা রীতিমতো পূজা করে।
দেশটির ৩১ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১ হাজার বিদেশী। এরা মূলত ইতালির নাগরিক। অন্য দিকে ৫ হাজার সান ম্যারিনোর নাগরিক ইতালিতে বসবাস করে। তাদের ভাষা ইতালীয়। ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অন্য ভাষাটি হলো ইমিলিয়ানো-রোমাগনোলো।
--জসিম উদ্দিন