Wednesday, March 30, 2011

নাৎসি পার্টি

0 comments
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। পরাজিত-বেদনাহত-ক্লান্ত জার্মানি মুখথুবড়ে পড়ে আছে। সম্মুখযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হয়নি। জার্মানির পরাজয়ের কারণ ঘরের শত্রু বিভীষণ। আর সেই বিভীষণের দল হলো ইহুদি সম্প্রদায়। তার সঙ্গে আছে বুলিসর্বস্ব কিছু মার্কসবাদী। তারা পেছন থেকে দেশকে ছুরি মেরেছে। সুতরাং দেশকে দাঁড় করাতে হলে সবার আগে তাদের সমূলে উৎপাটন করা দরকার_ এমন ধারণা নিয়েই ১৯২০ সালে জার্মান ইতিহাসে আবির্ভূত হয় একটি দল, যার নাম 'ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি'। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় 'নাৎসি পার্টি'। এডলফ হিটলার ছিলেন দলটির প্রধান। নাৎসি পার্টির উত্থানে যেমন ছিল চমক এর পতনেও বিস্ময়ের কমতি ছিল না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের চরম লাঞ্ছনা মিলল ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে। রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা, অর্থনৈতিক দুর্যোগ, সব মিলিয়ে জার্মানিতে তখন বিরাজ করছিল চরম অরাজক অবস্থা। ১৯১৯ সালে ন্যাশনাল জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একটি দলের উত্থান ঘটল গুপ্তভাবে। হিটলার তখন যুদ্ধফেরত সামান্য এক জার্মান সৈনিক। সদ্যগঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির একটি টিমটিমে মোমবাতির মতো তার ক্ষীণ আলো বিকিরণ করছে। মাত্র সাড়ে সাত মার্ক দলের মূলধন। এই দলে ভিড়ে গেলেন হিটলার। দলীয় সম্পৃক্ততা তাকে এনে দিল কার্যকরী সভার সাত নম্বর সদস্যপদ। আস্তে আস্তে দলের সব কর্তাব্যক্তির ওপর হিটলারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল। হিটলারের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে মরচে ধরা মানুষগুলো যেন গতিশক্তি ফিরে পান। ১৯২০ সালে হিটলারের উদ্যোগে দলের নাম সামান্য পরিবর্তন করে রাখা হলো, 'ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি' বা 'নাৎসি পার্টি'। ১৯২১ সালে দলের চেয়ারম্যান হলেন হিটলার। অগি্নময় ভাষায় বক্তৃতা আর মৌলিক পরিকল্পনার সাহায্যে জনসাধারণের এক বিরাট অংশের কাছে পেঁৗছে গেলেন হিটলার। এদিকে জেলখাটা খুনি, মদ্যপ, জুয়াড়ি আর লম্পটদের নিয়ে গঠিত হলো নাৎসি দলের ঝটিকা বাহিনী। অন্য রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ পণ্ড করা আর রাজনৈতিক গুপ্তহত্যাই ছিল এ বাহিনীর প্রধান কাজ। ১৯২৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী 'বিয়ার হল ক্যু' পরিচালনা করে। কিন্তু ক্যু ব্যর্থ হলে হিটলারের ঠাঁই হলো জেলে। ৯ মাস জেল খেটে প্যারোলে ছাড়া পেলেন। জেলে বসে হিটলার লিখেন তার বিখ্যাত বই 'মাই ক্যাম্প'। এ সময় নাৎসি বাহিনীতে বিরাজ করছিল চূড়ান্ত সাংগঠনিক দুর্বলতা।

১৯২৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নাৎসি দল ৪৯১টি আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি আসন লাভ করে। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলেও পার্লামেন্টে নাৎসি দলের আধিপত্য ছিল না। ১১টির মধ্যে মাত্র ৩টি মন্ত্রণালয় পেল নাৎসিরা, তাও আবার একটি দফতরবিহীন মন্ত্রী। একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নাৎসিরা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে। রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী গঠনের নামে প্রায় ২০ হাজার নাৎসি সদস্য ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীতে। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের জন্য আরেকটি চূড়ান্ত নির্বাচন দরকার। সব শক্তি নিয়ে নাৎসিরা নেমে পড়ল ভোটযুদ্ধে। তৃতীয় রাইখ সরকার গঠনের প্রাক্কালে 'ল অব ইনাবলিং' পাস করিয়ে হিটলার অর্জন করেন চরম ক্ষমতা। নাৎসি ব্যতীত জার্মানির অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হলো। 'হেইল হিটলার! হেইল হিটলার!' রবে অভিনন্দিত করা হলো বর্বর রক্তপিপাসু হিটলারকে।

প্রেসিডেন্ট হিন্দেনবার্গের মৃত্যুর এক ঘণ্টার মধ্যে হিটলার প্রেসিডেন্টের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিলেন। হেইল হিটলার হলেন জার্মানির সর্বেসর্বা। 'এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা!' নাৎসিদের এ স্লোগানকে ধারণ করে হিটলার হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন স্বৈরশাসক। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরাজয়ের পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসকও চিরবিদায় নিল। হিটলারকে ছাড়া অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল নাৎসি পার্টি। পরবর্তীতে সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা হলেও ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২০ সালে যে ধূমকেতুটি জার্মান আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল, ১৯৪৫ সালে সেটি ঝরে পড়ল ধূমকেতুর গতিতেই। শুধু এই দুরন্ত কাহিনী বুকে ধরে রয়ে গেল মহাকাল, ইতিহাস।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

Tuesday, March 29, 2011

মেরুদণ্ডে ব্যথা

0 comments
ব্যাক পেইন বা মেরুদণ্ডে ব্যথা কথাটি অনেকের মুখ থেকে প্রায়ই শোনা যায়। বলে, বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে থাকার কারণে সোজা হয়ে দাঁড়ানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। সত্যি, মেরুদণ্ডে ব্যথা মানে পুরো শরীরই অকেজো। কারণ সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে না পারলে কাজকর্ম করা মোটেও সম্ভব নয়। এক গবেষণা থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা আশি ভাগ মানুষই কোনো না কোনোভাবে মেরুদণ্ডের ব্যথায় আক্রান্ত। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশের মানুষই কমবেশি এ রোগে আক্রান্ত। হয়ত অনেকেই ধরে নিয়েছেন, এ রোগের বুঝি কোনো ওষুধ নেই। হ্যাঁ, আছে। তবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি সেবনীয় ওষুধের চেয়ে খুব দ্রুত যে ওষুধে এ রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় তা হলো ব্যায়াম। কেউ যদি নিয়মিত সকাল-বিকাল নিয়ম মতো ওঠবস করে, হাঁটা-চলাফেরা করে কিংবা দৌড়ায়, তবে দ্রুতই রোগটি থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। ব্যায়াম করলে শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। এর ফলে বুক এবং উদরের মধ্যবর্তী মাংসপেশি স্বাভাবিক থাকে; মেরুদণ্ডের স্তম্ভগুলোও স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। চিকিৎসকদের মতে, মেরুদণ্ডের ব্যথা নিরাময়ে এটিই সবচেয়ে ভালো দাওয়াই। কাজও করে ভালো।

-আশরাফুল আলম মিলন

তামান সাফারি পার্ক, ইন্দোনেশিয়া

0 comments
সাফারি শব্দটি শুনলেই মনে হয় নিসর্গ আর প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহার। যেখানে প্রাণীদের অবাধ বিচরণ। অন্যদিকে দর্শনার্থীরা বন্দি। ইন্দোনেশিয়ার তামান সাফারি পার্ক এর ব্যতিক্রম নয়। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন আবু তাহের

জাকার্তা সফরের স্থানীয় গাইড বড় ভাই শামসুল আলম যখন ঘোষণা দিলেন, আজকে আমরা 'তামান সাফারি' দেখতে যাচ্ছি। আঁতকে উঠে তীব্র প্রতিবাদ জানালাম, সুদূর ইন্দোনেশিয়ায় এসেও হাতি, বাঘ, সিংহ দেখতে যাব? আমার কাছে সাফারি মানেই বন্যপ্রাণী দেখা। তাছাড়া দেশের একমাত্র সাফারি পার্ক দেখেছি। কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় অবস্থিত এ সাফারি পার্কে খাঁচাবন্দি বেশকিছু বন্যপ্রাণী রয়েছে। তা বেশ কয়েকবারই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এরপরও জাকার্তা শহরে এসে ফের সাফারি দেখার কোনো মানে হয় না। আরও অনেক কিছু দেখার রয়েছে এ শহরে। তিনি জানালেন, তামান সাফারি না দেখলে ভ্রমণের স্বাদই অপূর্ণ থেকে যাবে। তার এ কথায় রাজি হতেই হলো।
সকালে যাত্রা শুরু করলাম 'তামান সাফারি'র উদ্দেশে। জাকার্তা শহর থেকে ৭৮ কিলোমিটার দূরে। বোগর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার। গাড়িতে মাত্র ২ ঘণ্টার পথ। বোগর শহর পার হওয়ার পর পাহাড়ি উঁচু ভূমি। হাইওয়ের দু'পাশে পর্যটকদের জন্য সারি সারি হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস। রয়েছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ, কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন পণ্যের সমাহার নিয়ে দোকান। রকমারি স্যুভেনির এবং হাতে তৈরি পণ্য নিয়ে সড়কের দু'পাশে পর্যটকদের জন্য পসরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় আদিবাসী নারী-পুরুষ। রয়েছে কাঠ, বেত ও বাঁশের তৈরি হ্যান্ডিক্রাফট, পোশাক আরও কত কী। এখানে পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য বিদেশি কোনো পণ্য নেই। স্থানীয় লোকজন তাদের তৈরি করা পণ্য নিয়ে পসরা বসিয়েছে দীর্ঘ সড়কের দু'পাশ ধরে। হতবাক হলাম ইন্দোনেশিয়ার এ পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় দেখে।
সমতল থেকে ১২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় একটি সাফারি কীভাবে পর্যটকদের স্বর্গভূমি হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সাফারি পার্ককে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাটি হয়ে উঠেছে পর্যটকদের তীর্থস্থান। খাড়া পাহাড় ধরে উপরে উঠে গেছে মসৃণ সড়ক। শত শত গাড়ি ছুটে যাচ্ছে আকর্ষণীয় এ পর্যটনকেন্দ্রের দিকে। সড়কের দু'পাশ ধরে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, ভিলা, রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান কোনোটিই খালি পড়ে নেই।
ইন্দোনেশিয়ান ১ লাখ ২৫ হাজার রুপিয়া দিয়ে (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক হাজার) টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম সাফারি পার্কে। ভেতরে উন্মুক্ত বন্যপ্রাণী দর্শনের সুযোগ ছাড়াও পর্যটকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। 'তামান সাফারি পার্ক'-এর পুরোটা ঘুরে সব ইভেন্ট উপভোগ করতে গেলে দু'তিনদিন সময় লেগে যেতে পারে। পর্যটকরা এখানে কেবল সাফারি বা বন্যপ্রাণী দেখার জন্য আসছে না, তারা আসছে পাহাড়ের নিসর্গকে আত্মস্থ করতে। প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে। এখানে বনের ভেতরে রাত কাটাতে রয়েছে আধুনিক সব ব্যবস্থা। সুদৃশ্য কটেজে মাত্র ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায় থাকার সুন্দর ব্যবস্থা পর্যটকদের প্রলুব্ধ করে। রয়েছে পাহাড়ের ট্রেইল ধরে হাঁটার দীর্ঘ রোমাঞ্চকর পথ। অবশ্য টিকিট কেটেই পাহাড়ি এ পথে হারিয়ে যেতে হবে। এখানে বিনোদনের জন্য রয়েছে অসংখ্য রাইড, বন্যপ্রাণীর খেলা, এডুকেশন শো, রেইন ফরেস্ট দেখার ব্যবস্থা।
উপন্যাসের বা সিনেমার 'কাউবয়' চরিত্রও এখানে বাস্তবে দেখতে পাবেন। কাউবয়দের এ উপস্থাপনা অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর। তীর থেকে ধনুক ছুড়ে শত্রুকে বিদ্ধ করা কিংবা বোমা দিয়ে একটি ভবনকে চোখের সামনে আগুনের ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা বাস্তবেই ঘটে। এ ধরনের শো দেখে পর্যটকরা শিহরিত এবং আনন্দে উদ্বেলিত হয়। মোটরসাইকেল রেইস, কালচারাল শোর ব্যবস্থা, কেনাকাটার জন্য শপিংমলসহ কী নেই এখানে।
ইন্দোনেশিয়া সরকার তাদের প্রকৃতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। পাশাপাশি আয় করছে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারপ্রধানও এ ব্যাপারে অতি সচেতন, বুঝতে কষ্ট হয় না। জাকার্তা শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এলাকাজুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি দফতর ও আবাসস্থল। রাষ্ট্রপতি ভবনের এ বিশাল এলাকাজুড়ে অসংখ্য শতবর্ষী বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার হরিণ। সবুজ মাঠে অসংখ্য হরিণের বিচরণ দেখার মতো দৃশ্য। এখানেই ঘটছে তাদের বংশবৃদ্ধি। যে দেশের সরকারপ্রধান এ ধরনের প্রকৃতিপ্রেমিক, সে দেশটির প্রকৃতি ও পরিবেশ হতে পারে সহজেই অনুমেয়।
ই-মেইল : taher_bd@hotmail.com

Sunday, March 27, 2011

কল্যাণপুর, মিরপুর; ঢাকা

0 comments
কল্যাণপুর মিরপুর সংলগ্ন একটি জনপদ। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের বড় একটি অংশ এ এলাকায় বাস করে। এক সময় এখানের জনজীবন খুবই সাধারণ ছিল। প্রচুর গাছপালাবেষ্টিত ছিল এ এলাকা। দিন দিন গাছপালা ধ্বংস করে গড়ে উঠছে আকাশ ছোঁয়া সব ভবন। ধীরে ধীরে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কল্যাণপুর মিরপুরের অন্যান্য এলাকার মধ্যে এখনও শান্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। সাধারণ জনগণের অভিমত সন্ত্রাস কিংবা কারও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই এখানে নেই। এখন কতদিন এমন থাকবে এটাও শঙ্কা এলাকাবাসীর। এ অঞ্চল ঘুরে এসে লিখেছেন জিসাদ ইকবাল

ওয়ার্ডভুক্ত(১১)এলাকা : কল্যাণপুর, দক্ষিণ পাইকপাড়া, মধ্য পাইকপাড়া, সায়েন্স ল্যাবরেটরি স্টাফ কোয়ার্টার, ডি-টাইপ সরকারি কলোনি, কল্যাণপুর হাউজিং স্টেট
জনসংখ্যা : ২ লাখ প্রায়
ভোটার সংখ্যা : ৬০ হাজার
ভোটকেন্দ্র : ৮টি
থানা : মিরপুর
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : হাইস্কুল চারটি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দুটি, কিন্ডারগার্টেন ২০টি
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মসজিদ ২০টি, মাদ্রাসা ৬টি, গির্জা ১টি
অন্যান্য : পানির পাম্প চারটি, ক্লাব দুটি :অনুশীলন সংসদ ও অগ্রদূত সংসদ, বিআরটিসি বাস ডিপো, সড়ক গবেষণাগার, র‌্যাব-৪ এর কার্যালয়, ইবনে সিনা হাতপাতাল ও কলেজ, গ্গ্নুকোমা রিসার্চ ইনস্টিটিউট

বিহারিদের গণহত্যা
১৯৭১ সালে কল্যাণপুর একটি জনবিরল এলাকা ছিল। চারদিকে ধানক্ষেত আর কৃষিজমির মধ্যে দু-একটি ঘরবাড়ি ছিল। তখনকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুর বিহারি অধ্যুষিত এলাকা ছাড়াও কল্যাণপুরের মধ্য পাইকপাড়াতেও বিহারিদের বসবাস ছিল। এলাকাবাসী জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিরা কল্যাণপুরের বিভিন্ন বাড়িতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়। অনেক বাড়িতে লুটতরাজ ও গণহত্যা চালায়। তখন অনেক বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও সমর্থক সন্দেহ করে অনেককে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে নির্জনে ছুরি, তলোয়ার দিয়ে গণহত্যা করত বিহারিরা। এখনও বিহারিদের গণহত্যার নিদর্শন রয়েছে অনেক স্থানে, বাড়িতে। বর্তমান কল্যাণপুরের ১২ নম্বর রোডের রিতা ভিলায় একই পরিবারের ১৩ জনকে হত্যা করার কথা জানায় এলাকাবাসী। ২ নম্বর রোডের মেলোডি হাউস, ১৩ নম্বর রোডের কলেল্গাল হাউসে লুকানো অবস্থায় একজনকে হত্যা করে বিহারিরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারিদের হাতে নিহতদের স্মরণে শহীদ মিনার রোড এবং অনুশীলন সংসদ মাঠে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।


কল্যাণপুর পোড়া বস্তি
গৃহায়ন ও গণপূর্তের হাউজিং বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জায়গায় কল্যাণপুর পোড়া বস্তি। ১৯৮৯ সালের দিকে বস্তিটি আগুনে পুড়ে যায়। এরপর থেকে পোড়া বস্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে বরিশাল, ভোলা অঞ্চলের লোকজনের বসবাস বেশি। ২০০৩ সালে বস্তি উচ্ছেদ করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই আবার পুনর্বাসন হয় এখানেই। বস্তিবাসীর নাগরিক সংকট লেগেই আছে। বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও গ্যাস, পানির রয়েছে তীব্র সংকট। তেমনি রাস্তা, স্যুয়ারেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই বস্তির ভেতরে। অন্যদিকে পোড়া বস্তি নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। তাদের অভিযোগ, এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা, চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা রয়েছে পোড়া বস্তিকে ঘিরে। দক্ষিণ কল্যাণপুরের বাসিন্দা আকতারুজ্জামান বলেন, পোড়া বস্তিতে নীরবে জমজমাট মাদক ব্যবসা চলছে। আপনি একবার শুধু তাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন তারপর থেকে আর এখানে আসতে হবে না, মোবাইল ফোনে কল দিলেই ঠিকানামতো মাদক পেঁৗছে যাবে। কী চাই গাঁজা, ফেনসিডিল না ইয়াবা। আর মাদকসেবীরা নেশার টাকা জোগাড় করতে এলাকায় ছিঁচকে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বস্তির প্রবেশপথে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভাঙাড়ি দোকান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসাবাড়ি থেকে চুরি হওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র এসব ভাঙাড়ি দোকানে কেনাবেচা চলে।

অনুশীলন সংসদ
১৯৭২ সালে এলাকার কিছু যুবক খেলাধুলা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্ভাসিত হয়ে গড়ে তোলেন অনুশীলন সংসদ নামে একটি ক্লাব। যে ক্লাবটি আজ ওয়ার্ডবাসীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনে কাজ করে যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক রেজাউল করিম বাবুল প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি থেকে ১৯৭৬ সালে ক্লাবের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সামাজিক বন্ধনের টানে প্রতিদিন নবীন-প্রবীণ বাসিন্দাদের পদচারণায় মিলনমেলায় পরিণত হয়। খেলাধুলার পাশাপাশি শহীদ মিনারে ফুল প্রদান, শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিত, দুস্থ অসহায়দের চিকিৎসাসেবা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশবাসীকে সহায়তা করা হয়। এ ছাড়াও ক্লাবের উদ্যোগে মাঠে প্রবীণ ব্যক্তিদের সকালবেলা হাঁটাচলা ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা, ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণ এবং শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। ওয়ার্ডবাসীর নাগরিক সংকট দূর করতে এবং রাস্তা প্রশস্ত করতে ক্লাবের সদস্যরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন সবসময়।

বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে কল্যাণপুর খাল
ওয়ার্ডের সীমানা রয়েছে কল্যাণপুর খাল। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর নজরদারির অভাবে খালের দু'পাশ অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। তেমনি তরল ও কঠিন বর্জ্য পরিষ্কার না করায় দূষিত হচ্ছে খালের পাশপাশের পরিবেশ। এলাকাবাসী জানায়, কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে খালের জায়গা একটু একটু করে দখল নিচ্ছেন বাড়ির মালিকেরা। এসব দখল এখনই ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে উদ্ধার করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। কল্যাণপুর প্রধান সড়কের ব্রিজ থেকে খালের দু'পাশে হাঁটাচলার জন্য ফুটপাত নির্মাণ ও খালের সীমানায় বৃক্ষরোপণ করা হলে খালটি বিনোদন কেন্দ্র পরিণত হবে।

ঢাকায় একাত্তরের বধ্যভূমি

1 comments
দেশের স্বাধীনতার জন্য বলি হওয়া অসংখ্য শহীদের স্মৃতি ধারণ করে আছে বধ্যভূমিগুলো। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় অনেক বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পরিণত হয়েছিল একটি বধ্যভূমি ও গণকবরে। আরও যেসব বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান মিলেছে ঢাকায়_ সেগুলো হলো তেজগাঁও এতিমখানা, সাভারের ভায়াডুবি ব্রিজ, কালীবাবুর গ্যারেজ সংলগ্ন খাল, কামালপুর বাজার কালভার্ট, নবাবগঞ্জের বর্ধনপাড়া গ্রাম, কলাকোপা গ্রাম, আমিরবাগ, বারানিবাগ, সাতগাঁও, চরাইল, পোস্তগোলা, কেরানীগঞ্জের মধ্য কেরানীগঞ্জ, মান্দাইল খালের পাশে, কালীগঞ্জ, শুভাঢ্যা, নগরগঞ্জ, কালিন্দী, জিঞ্জিরা, আদাবর, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজ, মহাখালী যক্ষ্মা হাসপাতাল, এমএনএ হোস্টেল, তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরের পাশে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কুর্মিটোলা বিমানবন্দর, আদমজীনগরের শিমুলপাড়া, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, নারিন্দা খেলার মাঠ, সূত্রাপুর লোহার পুল ও সায়েদাবাদ আউটফল বধ্যভূমি
ছবি: রেজওয়ান
'মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান'_ গানটি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য বলি হওয়া অসংখ্য শহীদের স্মৃতি ধারণ করে আছে বধ্যভূমিগুলো। সারাদেশে রয়েছে চিহ্নিত বা অচিহ্নিত অসংখ্য বধ্যভূমি। তবে ঢাকায় বধ্যভূমির সংখ্যা বেশি। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় অনেক বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেগুলো এখনও আছে, সেগুলোর চিহ্নও মুছে যেতে বসেছে। ঢাকায় এ পর্যন্ত ৭০টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পেয়েছে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। এর মধ্যে রাজধানীর মিরপুরেই রয়েছে ২৩টি। ৭০টির মধ্যে কেবল ১০টি বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এর সবই প্রায় মিরপুরে। মিরপুরের এ ১০টির মধ্যে মাত্র একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। অবশিষ্টগুলো এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। রায়েরবাজার বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই অসংখ্য মানুষের লাশ এনে স্থানটিকে রীতিমতো গণকবরে পরিণত করা হয়েছিল। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি এ বধ্যভূমিটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর মানুষ সেখানে লাশ দেখে ভিড় করে। সেদিন রায়েরবাজারের বিভিন্ন গর্ত থেকে প্রচুরসংখ্যক লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকেরই লাশ ছিল বেশি। কিছু মানুষের লাশ এতই বিকৃত ছিল যে, শনাক্ত করার উপায় ছিল না। যাদের শনাক্ত করা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, ডা. ফজলে রাব্বী প্রমুখ। ২৫ মার্চ থেকে মূলত গণহত্যার কালরাত শুরু হয়। হানাদাররা এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, অধ্যাপকদের বাসভবন ঘেরাও করে। তারা জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মুনিরুজ্জামান, তার দুই আত্মীয় ও এক প্রতিবেশী যুবককে গুলি করে। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা বেঁচে থাকলেও বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়। হানাদাররা কামান, রকেট লঞ্চার, মর্টার নিয়ে ঢাবির ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) আক্রমণ করে। সকালে গোলাগুলি থামে। ইকবাল হলে পড়তে থাকে এক স্তূপ লাশ। জগন্নাথ হলেও চলে গণহত্যা। মূলত তৎকালীন সব আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হানাদারদের ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। তাই তারা সব আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হলে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদেশেই অসংখ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। ঢাকায় সেসব গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা যেমন_
রায়েরবাজার বধ্যভূমি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য শিক্ষক ড. মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, শিল্পী আলতাফ মাহমুদসহ বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে আলবদর ও রাজাকাররা স্বাধীনতার মাত্র একদিন আগে। তাদের সবাইকে হত্যার পর রায়েরবাজারের নিচু ডোবায় লাশ ফেলে দেয় ঘাতকরা। ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আবিষ্কৃত বধ্যভূমির নাম রায়েরবাজার বধ্যভূমি। এখানে ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকে হত্যা করা মৃতদেহ এনে ফেলত হানাদার বাহিনী। রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন ও এ স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়েছে।
মুসলিম বাজার বধ্যভূমি : ১৯৯৯ সালের ২৭ জুলাই মিরপুর মুসলিম বাজারের পাশে নূরী মসজিদের বর্ধিতাংশ নির্মাণের জন্য মাটি খননের সময় বধ্যভূমিটির সন্ধান পাওয়া যায়। এ বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য হাড়গোড়, মাথার খুলি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, এখানে একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন : রাজারবাগ পুলিশ লাইন ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। এখানে বধ্যভূমিও আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এখানকার পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে প্রায় ২ হাজার বাঙালি পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। এরপর নয় মাসব্যাপী হত্যাযজ্ঞে স্থানটি পরিণত হয় গণকবর আর বধ্যভূমিতে।
জগন্নাথ হল : হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থানরত নিরপরাধ ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে জগন্নাথ হলের ৩ শিক্ষক, ৩৪ ছাত্র ও ৪ কর্মচারীকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় হানাদার বাহিনী। এছাড়া পাশের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেও (তৎকালীন ইকবাল হল) বহু ঘুমন্ত ছাত্রকে হত্যা করা হয়।
রমনা কালীবাড়ি : ২৯ মার্চ বাঙালি ইপিআর অফিসার ক্যাপ্টেন আজাদসহ ২০ ইপিআর সদস্যকে এখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ কালীমন্দিরের সিংহ দরজার কাছে ৫০-৬০ জনকে হত্যা করা হয়। এখানে মধুদার লাশও পাওয়া যায় ।
সূত্রাপুর লোহার পুল : পাকসেনা ও তাদের দোসররা বহু মানুষকে সূত্রাপুর লোহার পুলের ওপর এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ পুলের ওপরই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. হরিনাথ দেকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা।
জগন্নাথ কলেজ : পাকসেনা ও তাদের দোসররা পুরো ৯ মাস এ কলেজে থেকে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে অগণিত মানুষ হত্যা করে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শনিবার কোতোয়ালি থানা পুলিশ স্থানটি খুঁড়ে ৭টি কঙ্কাল উদ্ধার করে।
ছবি: প্রথম আলো
সেনানিবাস ও বিমানবন্দর এলাকা : ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন শত শত লাশ নিয়ে আসত। তারপর গর্ত করে বুলডোজার চালিয়ে সেসব লাশ মাটিচাপা দিত।
ইস্কাটন গার্ডেন : এখানে বিভিন্ন গর্ত থেকে মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। ঢাকা পতনের কিছু দিন আগে সান্ধ্য আইন জারি করে বিভিন্ন স্থান থেকে মহিলাদের ধরে এনে এখানে অত্যাচারের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
রাইনখোলা : স্বাধীনতার পরপরই এ বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করা হয়। একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে রাইনখোলা এলাকায় বধ্যভূমিটির সন্ধান পাওয়া যায়।
মিরপুর বাঙলা কলেজ : একাত্তরে মিরপুরের বাঙলা কলেজের পুরোটাই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। শিক্ষক কমনরুমের দক্ষিণে একটি, অধ্যাপকদের বাসভবনের গেটের সামনে একটি এবং ছাত্রাবাসের পশ্চিমে দুটি কুয়া ছিল। এ কুয়াগুলোয় ফেলা হতো শহীদদের লাশ। অনার্স ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর সংলগ্ন এলাকা ও কলেজের পেছনে রয়েছে গণকবর।
কালাপানি : মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের শহীদবাগে অবস্থিত কালাপানি বধ্যভূমি। এখানে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বিহারি এবং পাকবাহিনীর দোসররা হত্যা করে বহু মুক্তিকামী মানুষকে। এখান থেকে ১৯৭২ সালে উদ্ধার করা হয়েছিল ৮১ বস্তা দেহাবশেষ ও অসংখ্য লাশ।
শিরনিরটেক ও কাউয়িন্দা : মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের উত্তরদিকে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন স্থানটিই শিরনিরটেক। তার পাশে কাউয়িন্দা গ্রামেও ৫০০ থেকে ৫৫০টি লাশ দেখেছেন স্থানীয়রা।
গোলারটেক : মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পেছনের এলাকাটির নাম গোলারটেক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এটি ছিল মূলত হিন্দুপাড়া। একাত্তরে গোলারটেক গ্রামটিই হয়ে ওঠে বাঙালি নিধনযজ্ঞের চারণভূমি। সৌধের ঠিক উত্তরে অবস্থিত গণকবরে রয়েছে ১৮ শহীদের লাশ। এখন যেখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
আলোকদি : মিরপুরের প্রায় শেষ প্রান্তের গ্রাম আলোকদি। একাত্তরের ২৪ এপ্রিল মধ্যরাতে এ গ্রামের নিরীহ জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের এ দেশীয় দালাল, রাজাকার ও বিহারিরা। তারা এ গ্রামের ২-৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে।
শিয়ালবাড়ি : মিরপুরের সনি সিনেমা হলের মোড় থেকে উত্তরে হাজি রোডের শিয়ালবাড়ি গ্রাম। তখন প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বাস ছিল এ গ্রামে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর সেই গ্রামটি হয়ে পড়েছিল বিরানভূমি। এখানে একটি গণকবর রয়েছে।
সারেংবাড়ি : মিরপুর শাহ্আলী মাজারের উত্তরে রয়েছে সারেং মনির উদ্দিন শাহের একটি মাজার। সারেংবাড়ি গ্রাম নামে পরিচিত এ এলাকায় ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশন স্যুয়ারেজ ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গেলে বেরিয়ে আসে মানুষের হাড়, মাথার খুলি, চশমা, জুতা, গুলির খোসা, বন্দুকের অংশ, হাতের চুড়ি ইত্যাদি।
জল্লাদখানা : মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পাওয়ার হাউসসংলগ্ন জল্লাদখানা বধ্যভূমি। ১৯৯৯ সালে কূপটি খননের পর উদ্ধার করা হয় ৭০টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি হাড় ও ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী। পরে সেসব তিনটি ট্রাকবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধে।
তেজগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ ইনস্টিটিউট : এখানকার ২৮, ৩৩ ও ৩৭ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টার প্রাঙ্গণে মাটি খুঁড়ে বেশ ক'জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে এসব হতভাগ্য বাঙালিকে হত্যা করা হয়।
ধানমণ্ডি বালিকা বিদ্যালয় : মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধানমণ্ডি বালিকা বিদ্যালয়কে বাঙালি নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্রে পরিণত করা হয়।
ধলপুর ডিপো : ধলপুর ময়লা ডিপো নামে পরিচিত স্থানটির বড় বড় গর্তে হাজার হাজার মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

দেশব্যাপী ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ এবং সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্থান তথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত দেশের ৩৫টি স্থানে বধ্যভূমি চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা এবং অন্যান্য সুপারিশের মাধ্যমে এ ১৭৬টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টির জন্য সরকারি জমি পাওয়া গেছে। বাকি ১৪৭টির জন্য জমি কিনতে হবে, যার অর্থায়ন হবে প্রকল্প ব্যয় থেকে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৭১ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি বধ্যভূমির জন্য ১০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে ২০১৩ সালের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই আমরা বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, একসঙ্গে এত বধ্যভূমির কাজ হাতে না নিয়ে দুই-তিন ধাপে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

- রিবেল মনোয়ার

শাঁখারীবাজারের মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ

0 comments
২৬ মার্চ থেকে পুরো এপ্রিল পর্যন্ত পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে শত শত অসহায় সাধারণ শাঁখারীকে। বাড়িঘর সবকিছুই পুড়ে ছাই। শাঁখারীবাজারের বাতাসে শুধু মৃত মানুষের গন্ধ আর ধ্বংসাবশেষ। ২৬ মার্চ বিকেল ৪টা ৪৯ মিনিটে পাকবাহিনী ৪০, শাঁখারীবাজারে গুলি করে হত্যা করে। ২৬ মার্চ বিকেলে পাকসেনারা ৪৭, শাঁখারীবাজারে সর্বপ্রথম তাদের বাড়িতে হামলা চালায়।

২৮ মার্চ দুপুর ১২টা থেকে ১টার সময় ৩৬, শাঁখারীবাজারের ডা. নিশিহরি নাথকে যখন পাকসেনারা হত্যা করে তখন শাঁখারীবাজারের বাসিন্দারা চলে যান বুড়িগঙ্গার ওপারে জিনজিরায়।


মহান মুক্তিযুদ্ধে শাঁখারীবাজারের আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য শহীদ স্মৃতিসৌধ সমিতি ১৯৭১ সালে শাঁখারীবাজারে নির্মাণ করে 'শহীদ মিনার'।

Saturday, March 26, 2011

মৃত্যু কী

58 comments
মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। জীবনের সঙ্গে মৃত্যু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে মৃত্যু যেন শুধু বড়দের জন্য। ছোটদের এ বিষয়ে তেমন কিছু জানানো হয় না বা বলা হয় না। অবশ্য হালে এ ব্যাপারটা কিন্তু একদম বদলে গেছে।
ছোট ছোট বাচ্চারা যখন প্রশ্ন করে বাবা-মায়েদের, 'দাদু বা নানু কীভাবে মারা গেছে?' তখন বাবা-মায়েদের বিপদে পড়তে হয়। কারণ মৃত্যু কী, কেনই বা মৃত্যু আসে, বা মৃত্যু কেন স্বাভাবিক তা বোঝাতে হিমশিম খান তারা। সম্প্রতি এক জার্মান মনোবিজ্ঞানী বাচ্চাদের জন্য বিশেষ একটি প্রোগ্রামের আয়োজন করেছেন। এ প্রোগ্রামে বাচ্চাদের মৃত্যু সম্পর্কে নানা বিষয় জানানো হয়, দেওয়া হয় নানা তথ্য। কোলোন শহরের অদূরেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৫ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য আয়োজন করা হয়েছিল বিশেষ এ কোর্সের। এ কোর্সের মেয়াদ পাঁচদিন। কোর্সের নাম 'হসপিস মাখ্ট শুলে' অর্থাৎ যে মানুষটি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি তার সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটানো। সেই কোর্সে প্রতিদিনই বাচ্চাদের একবার করে জানানো হয় মৃত্যু হচ্ছে খুবই স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকে এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কেউ মারা যেতে পারে রোগে ভুগে, কেউ দুর্ঘটনায়, কেউ আবার নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনতে পারে। যেভাবেই হোক না কেন মৃত্যু অবধারিত। বিভিন্ন ধরনের মেঘের রঙের মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের বোঝানো হয়েছে।
বেঁচে থাকার অর্থ হলো সাদা মেঘ। অসুস্থ মানে অন্ধকার এবং মৃত্যু মানে কালো মেঘ। এই হচ্ছে প্রধান তিনটি রঙ। এসব বাচ্চাকে বলা হয়েছিল পাঁচদিনে তারা কী দেখেছে, জেনেছে তা নিয়ে একটি লেখা জমা দিতে। কী লিখেছে তারা? একটি ছেলে জানাল, 'আমার দাদা এখন বসবাস করছে কালো মেঘের মধ্যে। কারণ তিনি মারা গেছেন। আমি সাদা মেঘের মধ্যে কারণ এখানে আমার সব বন্ধু-বান্ধব আর খেলার সাথী রয়েছে।'
একটি মেয়ে জানাল, 'সাদা মেঘে আমি লিখেছি আমাদের স্কুলে একটি নতুন টয়লেট বসানো হয়েছে। স্কুলের বাগানে ফুল ফুটছে। আর অন্ধকার মেঘে আম্মুর কথা লিখেছি। কারণ আম্মু অসুস্থ।' মনোবিজ্ঞানী বেটিনা হাগেডর্ন ডুরেন শহরে ১৩ বছর ধরে এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। হসপিস মাখ্ট শুলের কোর্সটি তিনিই চালু করেছেন ২০০৫ সালে। তিনি বলেন, এর মূল কারণ হলো হঠাৎ পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যুর খবর অথবা তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই ও এ ধরনের খবর মানুষ মেনে নিতে পারে না। অনেকে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেটিনার কথায়, 'মৃত্যু প্রসঙ্গে বাচ্চারা প্রশ্ন করলে বেশিরভাগ বাবা-মা-ই জানেন না, কী উত্তর দিতে হবে। তারা মনে করেন, এ বিষয়ে বাচ্চাদের কিছু বলা ঠিক নয়। আমরা কিন্তু বাচ্চাদের সঙ্গে ভয়ভীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। এমনকি জন্ম-মৃত্যুর নানা দিক নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করি, অনেক কিছু বুঝিয়ে দিই। মৃত্যু অবধারিত। প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু একবার আসবেই। তাই খুবই স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে ছায়ানটের স্কুল কার্যক্রম নালন্দার নবম শ্রেণীর ৪ শিক্ষার্থীকে (অরভি, সৌরভ, অনিন্দ্য নাহার, দীপ্ত) এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানিয়েছে, এটা আমরা এক ধরনের ভীতিকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জানি। যা সমাজ বা ব্যক্তির জন্য স্বস্তিকর নয়। তাই এটা পদ্ধতিগত শিক্ষার মধ্যে থাকলে ভালো হয়। জন্মটা যেমন একটা জৈব প্রক্রিয়া মৃত্যুটা তার স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি। মানবজাতি তার জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে সুদীর্ঘ সময় ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেঁচে আছে। জ্ঞানবিজ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার জন্য আমরা এগিয়ে চলেছি।
এটা অনুধাবন করলে সমাজের মঙ্গলকামনা আমাদের মধ্যে দৃঢ় হবে। জীবনকে পরিমিতিবোধ ও লোভ থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হব।

-এনামুল হক মনি

স্মৃতিসৌধ

0 comments
কত রক্ত আর কত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, তা অজানা নেই কারও। সেসব রক্তঝরা প্রাণের প্রতি, জানা-অজানা লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই দেশের নানা স্থানে বিভিন্ন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। কিন্তু আমাদের একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ আছে। সাভারে নির্মিত এই সৌধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ আমাদের অস্তিত্ব আর জাতীয়তাবোধের প্রতীক। আমাদের ইতিহাসের স্মারক। প্রতিবছর স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসে জাতীয়ভাবে এ স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু এই জাতীয় স্মৃতিসৌধ শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণের জন্যই নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের আরও ইতিহাস। যে ইতিহাস, যে ঘটনা আমাদের স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে দ্রুত গতিতে এবং স্বল্প সময়ে। আমরা হয়ে উঠেছি অপ্রতিরোধ্য। একটি স্বাধীন দেশের নেশায় বাংলার নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। শিল্পীর ভাবনা আর ইতিহাস চিন্তায় নির্মিত আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে থেকে এর গঠন বোঝার উপায় নেই। যারা শুধু স্মৃতিসৌধের সামনের ছবি দেখেছেন, তারা কখনোই এর গঠন সম্পর্কে জানতে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না এটা কীভাবে আর কী ইতিহাস মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। এটা বুঝতে হলে সৌধের খুব কাছে যেতে হবে, পাশ থেকে দেখতে হবে। ভালোভাবে। দেখলেই বোঝা যাবে স্মৃতিসৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজ নিয়ে গঠিত। আমরা অনেকেই জানি না, এই সাত জোড়া ত্রিভুজের মানে কী।
স্কুলের পাঠ্যে বা পত্রপত্রিকায় বারবার সাধারণভাবে যেটুকু তথ্য প্রকাশ করা হয়, তা হলো জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এটি ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে সাভারে অবস্থিত। এর স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন।
এছাড়া অনেকেই এর যে তথ্যগুলো জানেন তা হলো স্মৃতিসৌধের উচ্চতা ১৫০ ফুট। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে বড়গুলো ক্রমানুসারে সাজানো। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও এর চেয়ে বেশি কিছু জানে না। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে তাদের জানানোর ব্যবস্থাও করা হয়নি। এছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার সীমাবদ্ধতা, জানার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ সম্পর্কে থেকে গেছে অজ্ঞ। হয়তো অনেকে বলবেন, স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে সব তথ্যই আমি জানি। কিন্তু জানার মানুষ আমাদের মধ্যে ক'জন আছে?

অনেক বয়স্ক মানুষও জানেন না, জাতীয় স্মৃতিসৌধের সাত জোড়া দেয়াল স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ভিন্ন পর্যায় নির্দেশ করে। পর্যায়গুলো হলো_
১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,
২. ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,
৩. ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন,
৪. ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,
৫. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন,
৬. ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং
৭. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করেই সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে।

-সঞ্জয় চক্রবর্ত্তী

বেঙ্গির মার এক এন্ডার মসজিদ, নবীগঞ্জ

0 comments
বাংলাদেশে প্রথম নবীগঞ্জে এক এন্ডা (ডিম) থেকে মসজিদ। লোক মুখে প্রচার পৃথিবীতে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন বেঙ্গির মা নামে এক মহিলা। ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ প্রবাদ বাক্যটি যেমন সত্য তেমনি লক্ষ্য যদি থাকে আপনার অটুট একদিন সফলতা আসবেই।

নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাথগঞ্জ ইউনিয়নের প্রজাতপুর গ্রামের তৎকালীন এক কৃষক সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা ১৯০২ ইং, ১৩০৭ বাংলায় প্রজাতপুর ও লালপুর দুটি গ্রামের মাধ্যবর্তী স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ নির্মাণের শেষে এলাকাবাসীকে জড়িত করে মসজিদটির নামকরণ করেন ‘এক এন্ডা (ডিম)র মসজিদ’। তখন মসজিদের নামকরণ নিয়ে জনতার মধ্যে প্রশ্ন জাগলে তিনি ঘটনাটি খুলে বলেন। বেঙ্গির মা এলাকাবাসীকে জানান তিনি একটি মুরগীর ডিম মসজিদের নামে মান্যত করে রাখেন। ঐ ডিমটি থেকে মুরগীর উতলে দিলে তা থেকে একটি বাচ্চার জন্ম হয়। পরবর্তীতে ঐ বাচ্চাটি বড় হলে তা থেকে আরো ৭টি ডিম হয়। পরবর্তীতে ঐ ৭টি ডিম থেকে ৭টি বাচ্চার জন্ম হয়। এভাবে এক পর্যায়ে মুরগীর খামাড় গড়ে তুলেন। ঐ খামাড়ের মুরগী বিক্রি করে বেঙ্গির মা টাকা জমাতে থাকেন। তৎকালীন সময়ে তিনি এক লক্ষ টাকা জমা করে মসজিদটি তার স্বামীর মাধ্যমে নির্মাণ করে দেন। বেঙ্গির মা ছিলেন নিঃসন্তান। ঘটনা এলাকায় জানাজানি হওয়ার পরে মসজিদটির নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। মসজিদ নির্মাণের শত বছর অতিবাহিত হলেও এখন এ কাহিনী সবার মুখে মুখে। অনেকই মনে করেন একটি এন্ডা (ডিম) থেকে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। তাও আবার একজন মহিলা কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ সবাইকে অবাক করেছে। প্রজাতপুর ও লালপুর গ্রামবাসী ২০০৯ সালে মসজিদটির বর্ধিত অংশ সংস্কার করেছেন। কিন্তু বেঙ্গির মার মুল মসজিদটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে। চলতি বছরে মসজিদটি নতুন করে রং করা হয়েছে। এক এন্ডা (ডিম) এর মসজিদের খতিব মাওলানা আলমাছ উদ্দিন বলেন আমি মসজিদ নির্মাণে বেঙ্গির মার এক এন্ডার গল্প শুনে অবাক হয়েছি ইচ্ছা থাকলে মানুষ কিনা করতে পারে। তার ছেলে সন্তান না থাকলেও এই মসজিদটি পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন স্বাক্ষী হয়ে রবে। বেঙ্গির মার প-পৌত্র প্রজাতপুর গ্রামের রাকিল হোসেন বলেন আমার পুর্ব পুরুষ নিঃসন্তান সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি পরিদাদী বেঙ্গির মা একটি এন্ডা থেকেই এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এলাকাবাসী কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মসজিদের সুন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য সংস্কার করেছেন। মসজিদের মোতাওল্লী লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হারিছ তিনি দেশের বাহিরে থাকায় থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি। প্রজাতপুর গ্রামের প্রবীণ উলফর উল্লা বলেন আমাদের গ্রামের বেঙ্গির মা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সারাজীবনেও ভুলার মত নয়। আমি বেঙ্গির মার কাছথেকে শুনেছিলাম তিনি একটি ডিম থেকে একটি মুরগীর খামাড় গড়ে তুলেছিলেন। ঐ খামাড়ের একটি টাকাও তার সংসারের কাজে ব্যয় করেন নি। সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। মানুষটি (বেঙ্গির মা) মরে গেলেও এখনও সবাই তার কথা আলোচনা করে। এটা বিশ্বের নজীর হয়ে থাকবে। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন বাংলাদেশে কেন বিশ্বের কোথাও এক এন্ডা (ডিম) থেকে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা আমি কখনও শুনিনি। আমার জানা মতে পৃথিবীতে এই প্রথম আমাদের গ্রামের এক এন্ডা থেকে মসজিদ হয়েছে। মসজিদটি পরিচালনায় কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা হলেন, বেঙ্গির মার বংশধর রুপ উদ্দিন সভাপতি, লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হারিছ মোতাওয়াল্লী, ব্যবসায়ী হেলিম উদ্দিন ক্যাশিয়ার সদস্য রাকিল হোসেন ও শামীনুর মিয়া প্রমুখ। কমিটির একাধিক সদস্যের মতে বেঙ্গির মার এক এন্ডার মসজিদটি পর্যটকদের জন্য একটি আচার্য্যজনক স্থাপত্য হিসাবে সরকার রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব নেবে।
-এম এ আহমদ আজাদ

Friday, March 25, 2011

হোরাস

0 comments
হোরাস ছিল আকাশের দেবতা । মিশরীয় রা ওসিরিস এর মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম হোরাস কে জাতীয় দেবতা স্বীকৃতি দেয় ।
হোরাসের শরীর মানুষের মত হলে ও মাথা ছিল বাজপাখির মত । মিশরীয় দের কাছে হোরাস দেবতা হেরু নামে পরিচিত,যার অর্থ হল- দূরবর্তী একজন । তাদের মতে হোরাসের এক চোখ ছিল সূর্যের আরেক চোখ চাঁদের । নতুন চাঁদ উঠার সময়ে হোরাস নাকি অনেক ভয়ংকর হয়ে যেতেন । সবাই কে সমানে শাস্তি দিতেন । এরপর আবার,চাঁদ নিয়মিত আকাশে দেখা দিলে হোরাস পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতেন ।
মিশরীয় দের অনেক অন্ধ বিশ্বাস ছিল দেবতা হোরাস কে নিয়ে । তাদের মতে,হোরাস ছিল দেবী আইসিসের একমাত্র সন্তান । আইসিস ওসিরিস এর মৃত্যুর পর অলৌকিক ভাবে গর্ভবতী হন । হোরাস কে দেবী আইসিস চেমিস নামক দ্বীপে বড় করে তোলার জন্য নিয়ে যান , কেননা সব সময় ই হোরাসের জীবন সংশয়ের মধ্যে ছিল তার কুমতলবী চাচা সেথ এর কারণে । আইসিস হোরাস কে অনেক কষ্ট করে রক্ষা করেন ।
হোরাস বড় হয়ে সেথ এর সাথে মিশর রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেন । এই যুদ্ধে হোরাসের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় । ঐ চোখ পুনরায় হোরাস ফিরে পান এবং এই চোখ মিশর রক্ষার প্রতীক হয়ে যায় তখন থেকে । ঐ যুদ্ধের পরে হোরাস কে মিশরীয় রা সারা বিশ্বের শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নেয় ।
এডফু শহরে সব চাইতে বেশী সুরক্ষিত মন্দির দেবতা হোরাসের নামে রয়েছে । নিচে ঐ মন্দিরের সামনের হোরাস মূর্তি দেখা যাচ্ছে ।

লেখেছেনঃ বৃষ্টিধারা

Thursday, March 24, 2011

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

0 comments
ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা এবং ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কথা জাতির সামনে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ২০০১ সালের ১৫ মার্চ সেগুনবাগিচায় স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। ১ দশমিক শূন্য ৩ একর জমির ওপর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনকালে সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কিছু সংরক্ষণ, সংগ্রহ এবং তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণসহ আন্তর্জাতিক মানের একটি গ্রন্থাগারও স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়।

-তোফাজ্জল হোসেন রুবেল, শেখ হাসান

মোগল ঈদগাহ

0 comments
মোগল আমলের একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপত্যের নিদর্শন হচ্ছে ধানমণ্ডির আবাসিক এলাকার সাতমসজিদ রোডের ৭/এ-(পুরনো ১৫) তে অবস্থিত ঈদগাহটি। এটি বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার রাজধানীতে পরিণত হওয়ার পর এর মর্যাদা পরবর্তী এক শতাব্দী পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। এ সময় প্রশাসনিক সদর দফতর ছিল ঢাকায়। এখানে ছিল সুবেদারের বাসস্থান ও কার্যালয়। এ সময়ের মধ্যে মোগলদের দ্বারা বিভিন্ন মসজিদ, ঈদগাহ এবং সরাইখানা নির্মিত হয়। বাংলাদেশের স্থাপত্যরীতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। একটি দেশের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও কৌশল নির্ভর করে সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিশেষ করে পৃষ্ঠপোষকতার ওপর। পাথর ও মার্বেলের অভাব এবং প্রচুর পলিমাটি দ্বারা ইট তৈরি স্থাপত্যরীতি বা 'ব্রিক স্টাইল'-এর উদ্ভব হয়। এই ঈদগাহটিতেও অন্য মোগল স্থাপত্যগুলোর মতো পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ধানমণ্ডির ঈদগাহটি মাটি থেকে ৪ ফুট উঁচু একটি সমতলভূমিতে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ২৪৫ ফুট প্রস্থ, ১৩৭ ফুট। বিস্তৃতি তিন দিকে। পশ্চিমে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর, যেখানে রয়েছে মিহরাব ও মিম্বার। তখন এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত পান্ডু নদীর একটি শাখা। এই শাখা নদী জাফরাবাদে সাতগম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হতো বুড়িগঙ্গার সঙ্গে। সে আমলে ঈদের দিন এই ঈদগাহটিতে শুধু মোগলরাই যেতেন। সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে ছিল না। সুবাদার, নাজিম ও অন্য মোগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে।

-হাফিজ মোল্লা

ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার

0 comments
আমি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি এবং কলেজ বিল্ডিংয়ের উল্টা দিকে মেয়েদের হোস্টেলে থাকি। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ থেকেই ঢাকা শহর ভাষা আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র-জনতার সভা হয়েছে। ২১ তারিখ এসেম্বলিতে সভা হবে। ২১ তারিখ ছেলেরা এসেম্বলি হতে দেবে না ঠিক করেছে। সরকার ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করল। ছাত্র-জনতা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল ১৪৪ ধারা ভাঙবে ২১ ফেব্রুয়ারিতে।
সারাদিন মেডিক্যাল কলেজের রাস্তায় চলছে মিছিল ও স্লোগান। শুনলাম ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। মন্ত্রীদের এসেম্বলি হলে আসতে দেবে না। এসেম্বলি হল মেডিক্যাল কলেজের খুব কাছে ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ এবং তার সামনের রাস্তায় দারুণ উত্তেজনা, স্লোগান, পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি চলছে। হঠাৎ বেলা ৩টার দিকে গুলির শব্দ শোনা গেল। ছাত্র-জনতা আতঙ্কিত হয়ে যে যেদিকে পারল ছুটতে লাগল। আমরা মেয়েরা হোস্টেল থেকে বের হইনি। হোস্টেলের বারান্দা থেকে সব দেখা যাচ্ছিল। তখন ডিরিকশন হলের পেছনে ছেলেরা মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল। একজনের মাথার মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল মনে আছে। তখন তার পরিচয় জানতে পারিনি, পরে জেনেছি তা রফিক বা বরকতের লাশ। আমরা শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিলাম। একজন সাদা কাপড় পরা বৃদ্ধা এবং অল্প বয়সী মহিলা কাঁদতে কাঁদতে ডিরিকশন হলের পেছনে বারান্দার দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল হোস্টেলের সামনে দিয়ে।

এই প্রথম '৪৭ সালের স্বাধীন দেশে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের মন অসহ্য ঘৃণায় ভরে উঠল। ছেলেদের হোস্টেল তখন বাঁশের ব্যারাকে ছিল। গুলির পর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে যোগ দিলে তার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। ২২ ফেব্রুয়ারি দারুণ উত্তেজনা। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে গেল। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেল। এলাকাজুড়ে চলতে লাগল মুহুর্মুহু স্লোগান, ছেলেদের হোস্টেলে দিনভর জ্বালাময়ী বক্তৃতা। রাতজুড়ে তা চলতে থাকল।

২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে দারুণ উত্তেজনা। আমাদের হোস্টেল থেকে ২০০ গজ দূরে যেখানে ছাত্রদের শাহাদাতবরণের ঘটনা ঘটেছে সেখানে একটি 'স্মৃতিস্তম্ভ' তৈরি হয়েছে এবং সবাই তাতে ফুল দিচ্ছে, আমরা মেয়েরাও গিয়ে ফুল দিলাম। এক ভদ্রমহিলা, সোনার চেইন খুলে দিলেন সে কি দারুণ উত্তেজনা। ঢাকা শহর ভেঙে পড়ল মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে। শহীদ শফিউর রহমানের পিতা প্রথম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। ২৫ তারিখ সাংবাদিক আবুল কালাম সামছুদ্দিন সেটা আবারও উদ্বোধন করেন। শহীদ মিনারটি খুবই সুন্দর ছিল। ১০ ফুট লম্বা ও ৬ ফুট চওড়া। তার চারদিক শাড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। নিচের অংশটা লাল সালু কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। উপরের অংশে দুটি পোস্টার লাগানো হয়। একটা ছিল 'স্মৃতিস্তম্ভ', আর একটা ছিল 'শহীদ স্মৃতি অমর হোক' দুটো পোস্টারই আমার স্বামী প্রয়াত ডা. বদরুল আলমের হাতে লেখা। আমরা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা সেটা প্রত্যক্ষ করলাম।

তবে বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে সে জায়গাটি ঘিরে রাখা হয়। ১৯৫৭ সালে যখন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ারে যাই, তখন বাঁশের খুঁটি ও দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পড়াশোনা করার জন্য চলে যাই ইংল্যান্ডে। দেশে ফিরে আসি ১০ বছর পর ১৯৬৭ সালে। এসে দেখি একুশের ভাষা আন্দোলন তখন অনেক জোরদার হয়েছে। ১৯৭১ সালে একদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আমার ছেলেকে উদয়ন স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল ডা. মোত্র্তুজার সঙ্গে। আমাদের দেখে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে দৌড়ে এলেন। তখন তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল অফিসার এবং ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি আমার স্বামীকে বললেন, বদরুল ভাই একটা অন্যায় কাজ করে ফেলেছি। আপনি যে প্রথম শহীদ মিনারের নকশা করেছেন এবং আপনার আঁকা নকশা অনুসারে প্রথম শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছিল সে কথা আপনার পারমিশন না নিয়ে আমার বইয়ে লিখে ফেলেছি। বইয়ের নাম 'ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।'

আমার স্বামী হাসতে হাসতে বললেন, আমি কিছু মনে করিনি। শহীদ মোর্ত্তুজা আজ নেই। অনেক খুঁজেও তার সেই বইটি পাইনি।

বাংলা ভাষার ইতিহাসে শহীদ মিনার এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ শহীদ মিনার তিন দিন পর ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাঙালির মনে যে দাগ কেটেছিল ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি পালন প্রতি বছর এবং এর ফলশ্রুতি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা এবং বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এটিই আমাদের গর্ব।

-ডা. আফজালুননেসা

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

0 comments
আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে শয়তানের ত্রিভুজ বলা হয়। এটিকে পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান বলে মানা হয়। কারণ এ পর্যন্ত এখানে যত রহস্যময় ও কারণহীন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, অন্য কোথাও এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করে শয়তান বা পাপাত্মাদের ত্রিভুজ।
জাদুকর পিসি সরকারের জাদুর কারিশমায় অনেক কিছু ভ্যানিশ হওয়ার গল্প আমাদের জানা। কিন্তু এই ম্যাজিকে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া জিনিস হুবুহু রয়েই যায়। মাঝে কেবল আমাদের বুদ্ধি আর ইন্দে য়গুলোকে বোকা বানানো হয়। কিন্তু কুখ্যাত শয়তানের দ্বীপ কিংবা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে কেন্দ্র করে প্রচলিত গল্প কিংবা ঘটনাগুলোর রহস্য আজো উন্মোচিত হয়নি।

'এলেন অস্টিন' জাহাজটির কথাই ধরা যাক। এ জাহাজের মাঝি-মাল্লারা যেভাবে হারিয়ে গিয়েছিলেন তার হদিস আজো কেউ করতে পারেনি। ফিরে পাওয়া যায়নি তাদের। মধ্য আটলান্টিকে পাড়ি দেওয়ার সময় এলেন অস্টিন জাহাজের নাবিকরা একটু দূরে একটি খালি জাহাজ ভাসতে দেখে ভীষণ অবাক হন। ঠিক করলেন, নিজের জাহাজের মাঝি-মাল্লাদের পাঠিয়ে একটু দেখে আসা যাক। পাঠালেনও সেই মতো। মাঝিরা জাহাজের কাছাকাছি পেঁৗছতেই ঘনকুয়াশা চারদিক ঢেকে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কি হলো? কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে কুয়াশা কেটে গেল। খালি জাহাজটি দেখা গেল। কিন্তু মাঝি-মাল্লারা গেল কোথায়? তারা তো ফিরছে না! ঘটনার রহস্য সমাধান করতে আরও একটি দলকে পাঠানো হলো। ওই দলটিও জাহাজে পেঁৗছামাত্র শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। এবারও কিছুই দেখা গেল না। ঝড় থামার পর দেখা গেল সব ভ্যানিশ। মাঝি-মাল্লাদের আর দেখা গেল না। এমনকি জাহাজটিও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে! চারদিকে তোলপাড় পড়ে গেল। চলল অনেক খোঁজাখুঁজি। কিন্তু কোথাও এর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা শয়তানের ত্রিভুজের রহস্য এমনই। এখানে কোনো বিমান কিংবা জাহাজ হারিয়ে গেলে তার ধ্বংসাবশেষ কোনো চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে কোনো মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় না। কোনো কিছুরই নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ত্রিভুজ অঞ্চলে এমন অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেছে মানুষ, জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ। এরকম অসংখ্য অন্তর্ধানের গল্প বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা রহস্যাবৃত অঞ্চলে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন, এসব অন্তর্ধানের কারণ নিছক দুর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার চলতি উপকথা অনুসারে এসবের পেছনে দায়ী অতি-প্রাকৃতিক কোনো শক্তি বা ভিনগ্রহের প্রাণীর উপস্থিতি। জায়গাটির রহস্যময়তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, বানানো হয়েছে অসংখ্য ডকুমেন্টারি। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা শোনা যায়। আবার যেসব দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল, আবার অনেক কিছুই লেখক দ্বারা অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আসলে কি?

ক্যারিবীয় সাগরের এক কল্পিত ত্রিভুজ এলাকা হলো শয়তানের ত্রিভুজ। আটলান্টিক মহাসাগরের তিন প্রান্ত দিয়ে সীমাবদ্ধ ত্রিভুজাকৃতির একটি বিশেষ এলাকা যেখানে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়। এর মূল নাম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। তবে এর কুখ্যাতির জন্য একে শয়তানের ত্রিভুজ বলা হয়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল যে তিনটি প্রান্ত দ্বারা সীমাবদ্ধ তার এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, আরেক প্রান্তে পুয়ের্তো রিকো এবং অপর প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ অবস্থিত। ত্রিভুজাকার এ অঞ্চলটির মোট আয়তন ১১৪ লাখ বর্গ কিলোমিটার বা ৪৪ লাখ বর্গ মাইল। এটি ২৫-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৫৫-৫৮ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। অবশ্য এই বিন্দু নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।

বেশিরভাগ লেখক-গবেষকই এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছেন সীমানা বরাবর মিয়ামি, সানজুয়ান, পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিক আর বারমুডা নিয়ে তৈরি একটি ত্রিভুজ বা বলা ভালো একটি ট্রাপিজিয়াম আকৃতির চতুর্ভুজ। তবে বেশিরভাগ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছে দক্ষিণ সীমানায় বাহামা দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে এবং ফ্লোরিডা উপকূলের আশপাশে। কত জাহাজ ও বিমান হারিয়ে গেছে এ এলাকায় যেগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়নি আজও।

বিভিন্ন লেখকের বর্ণনায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিস্তৃতিতে ভিন্নতা রয়েছে। এই ত্রিভুজের ওপর দিয়ে মেক্সিকো উপসাগর থেকে উষ্ণ সমুদ্র স্রোত বয়ে গেছে। এখানকার আবহাওয়া এমন যে, হঠাৎ ঝড় ওঠে আবার থেমে যায়, গ্রীষ্মে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ অঞ্চল বিশ্বের ভারী বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলকারী পথগুলোর অন্যতম। জাহাজগুলো আমেরিকা, ইউরোপ ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত করে। এছাড়া এটি হলো প্রমোদতরীর বিচরণক্ষেত্র। এ অঞ্চলের আকাশপথে বিভিন্ন রুটে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত বিমান চলাচল করে। ত্রিভুজের বিস্তৃতির বর্ণনায় বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন মত দিয়েছেন। কেউ মনে করেন, এর আকার ট্রাপিজয়েডের মতো, যা ছড়িয়ে আছে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা, বাহামা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ইশোর (অুড়ৎবং) পূর্ব দিকের আটলান্টিক অঞ্চলজুড়ে। আবার কেউ কেউ এগুলোর সঙ্গে মেক্সিকো উপসাগরকেও যুক্ত করেন। তবে লিখিত বর্ণনায় যে সাধারণ অঞ্চলের ছবি ফুটে ওঠে তাতে রয়েছে ফ্লোরিডার আটলান্টিক উপকূল, সান জুয়ান (ঝধহ ঔঁধহ), পুয়ের্তো রিকো, মধ্য আটলান্টিকে বারমুডার দ্বীপপুঞ্জ এবং বাহামা ও ফ্লোরিডা স্টেইটসের দক্ষিণ সীমানা। আর এখানেই ঘটেছে অধিকাংশ দুর্ঘটনা। এ অঞ্চলের রহস্যময়তার একটি দিক হলো, কোনো জাহাজ এ ত্রিভুজ এলাকায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতার তরঙ্গ প্রেরণে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং এর ফলে জাহাজটি উপকূলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়। একসময় তা দিক নির্ণয় করতে না পেরে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়।

সেই কলম্বাসের সময় থেকে শুরু করে এখনো এখানে ঘটছে একই ব্যাপার। এখানে এখনো হারিয়ে যায় জাহাজ, সাবমেরিন কিংবা বিমান। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সবকিছু। এর নামই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অভ্যন্তরে আছে শ'তিনেক কোরাল দ্বীপ। এর বেশির ভাগই জনবসতিহীন। আর এর মধ্যে একটি দ্বীপ হচ্ছে 'বারমুডা'। দ্বীপটি আবিষ্কৃত হয় ১৫৬৫ সালে। এক দুঃসাহসী নাবিক জুয়ান ডি বারমুডেজ দ্বীপের আবিষ্কারক। তার নামানুসারেই এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়। এ এলাকার ধার ঘেঁষে গেলেও দেখা যায় অদ্ভুত কিছু কাণ্ড-কারখানা। মাঝে মাঝে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বাতিল করে দেয়, রেডিও বিকল করে দেয়, কম্পাস ইত্যাদির বারোটা বাজিয়ে দেয়। ক্ষুদ্র আলোক শিখা, ধূমকেতুর পুচ্ছ, সবুজ রঙের কুয়াশা, বিদঘুটে জলস্তম্ভ, প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাক, পথ ভুলে যাওয়া, হিংস ভাবে জাহাজ গিলতে আসা পাহাড় সমান ঢেউসহ ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড-কারখানা। আবার এক মাস আগে যে জাহাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সে জাহাজকেও ভুতুড়েভাবে ভাসতে দেখা যায় এখানে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা শয়তানের দ্বীপকে ঘিরে রহস্যময় ঘটনার কোনো অন্ত নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দুর্ঘটনা হলো ৫টি টর্পেডো বম্বারের দুর্ঘটনা। ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ওই ত্রিভুজ স্থানে যানগুলো রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘটনাটিকে বলা হয় মেরি সিলেক্ট অব দি স্কাই। মেরি সিলেক্ট জাহাজটির অন্তর্ধান কাহিনীও অদ্ভুত। সেটি অবশ্য বারমুডার সীমানার মধ্যে ঘটেনি, তবু এটিকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আকাশে বিমান মহড়া চলছে। এরকম প্রতিদিনই হয়। প্রতিটি বিমানেই পাইলটকে নিয়ে তিনজন ক্রু থাকে। সেদিন ছিল একজন কম। তারিখ ৫ ডিসেম্বর। ফলে আবহাওয়া পরিষ্কার। কন্ট্রোল টাওয়ার বিশেষ জরুরি। ভীত একটি কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছে আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছি। আমরা মাটি দেখতে পাচ্ছি না। টাওয়ার জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের পজিশন জানাও। তাও আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমরা হারিয়ে গেছি। বিকাল গড়িয়ে গেল। তখনো তারা যেই তিমিরে সেই তিমিরেই। ১৩ জন ক্রু নিয়ে একটি বিরাট মার্টিন মেরিনার ফ্লাইং বোট পাঠানো হলো তাদের উদ্ধার করে আনার জন্য। এ ফ্লাইং বোটটি অশান্ত সমুদ্রেও নামতে পারে এবং এমনভাবে তৈরি যে, পানিতে ডুবে না। ফ্লাইট নাইনটির উদ্দেশ্যে কন্ট্রোল টাওয়ার বার্তা প্রেরণ করল-যেখানে আছ সেখানেই থাক। সাহায্য পাঠানো হলো। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মেরিনার আকাশে উঠে কোনো বিমান দেখতে পেল না। এটুকু খবর পাওয়ার পরই ব্যস। মেরিনারের সঙ্গেও আর যোগাযোগ করা গেল না। দমকা হাওয়া। কোথায় যে গেল, কী যে হলো কিছুই বোঝা গেল না। ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করে, তল্লাশি চালিয়ে, হইহই ফেলে দিয়েও বিমানের একটি টুকরারও কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। নেভার বোর্ড অব ইনকুয়ারির বৈঠক বসল। তদন্ত হলো। তদন্তের জন্য যারা বিমান নিয়ে গেল তারা কিন্তু বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যে পথভ্রষ্ট হলো না। তার মানে সব বিমান বা জাহাজের ক্ষেত্রেই যে এমনটি ঘটেছে তা নয়।

১৯৪৯ সালের ১৭ জানুয়ারী স্টার এরিয়েল নামের একটি বিমান লন্ডন থেকে জ্যামাইকা যাচ্ছিল। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে এটি বারমুডার আকাশে উড়ল। তখন আবহাওয়া ছিল স্বাভাবিক ও সুন্দর। আর সমুদ্র ছিল শান্ত। ওড়ার ৫৫ মিনিট পর বিমানটি অদৃশ্য হয়ে গেল। এ নিয়ে অনেক অনুসন্ধান হলো। কিন্তু সমুদ্রের কোথাও বিমানটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেল না। বিমানটি অদৃশ্য হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি রাতে। ১৮ তারিখ রাতে এক অনুসন্ধানী দল জানাল, সেখানকার সমুদ্রের বিশেষ বিশেষ একটি জায়গা থেকে অদ্ভূত একটি আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। এ ঘটনার এক বছর আগে সেখান থেকে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল একটি ডিসি-৩ বিমান। সেটি যাচ্ছিল সানজুয়ান থেকে সিয়ামি। ক্যাপ্টেনের নাম রবার্ট লিংকুইসড। ভোর ৪টা ১৩ মিনিটে বিমানটি থেকে শেষ বেতার বার্তা ভেসে এলো, আমরা অবতরণ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলেছি। দক্ষিণে আর মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে সিয়ামি বিমানবন্দর। আমরা সিয়ামি শহরের আলোকমালা দেখতে পাচ্ছি। সব ঠিক আছে। কোনো গোলমাল নেই। অবতরণের নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। এই শেষ বার্তা পাঠিয়ে বিমানটি অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপর এর আর কোনো হদিস মেলেনি। ১৯৪১ সালে ওই রহস্যময় জায়গাতে অদৃশ্য হয়ে গেল তিনিটি ট্যাঙ্কার, একটি চার ইঞ্জিনের উড়োজাহাজ আর একটি ট্রলার।

আরেকটি বিমান যাচ্ছিল নাসাউ থেকে বাহামার গ্রান্ডটার্ক দ্বীপের দিকে। ওই দ্বীপের কাছাকাছি এসে পাইলট বেতার সংকেতে জানালেন, 'আমি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। দুটি অজানা দ্বীপের চারপাশে চক্কর মারছি। অথচ নিচে কিছুই দেখেতে পাচ্ছি না। এই ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় আছে কি? যারা এই দুর্ঘটনার সাক্ষী তারা দেখতে পেল ওই হালকা বিমানটি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দ্বীপের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মেঘমুক্ত আকাশে হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের একটি রহস্যময় অঞ্চল হলো জলীয়কেন্দ্রের একটি বিন্দু। ফ্লোরিয়া থেকে বাহামার মধ্যে একট অঞ্চলকে বলা হয় রেডিও ডেড স্পট। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেখানে কোনো বেতারতরঙ্গ প্রবেশ করতে পারে না এবং বের হতেও পারে না। এমন একটি বিন্দু আছে যেখানে কম্পাস অচল হয়ে যায়।

১৯১৮ সালে সেখানে ইউএস নেভির কয়েকটি জাহাজ নিখোঁজ হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে সাইক্লোপস জাহাজের অদৃশ্য হওয়া। তাতে ছিল ৩০৯ জন যাত্রী। ১৯ হাজার টন ভারী জাহাজটি বারবাডোস থেকে বাল্টিমোরের দিকে যাত্রা করেছিল। এ জাহাজটি সেখানে অদৃশ্য হয়ে যায়।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের আরেকটি বিখ্যাত ঘটনা হলো ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে অন্তর্ধান হওয়া ফ্লাইট নাইনটিন। আর এটি নিয়ে আমেরিকান লিজান ম্যাগাজিনে লেখা হয়, 'বলা হয়ে থাকে এই ফ্লাইটের দলনেতাকে নাকি বলতে শোনা গিয়েছে_ ডব ফড়হ'ঃ শহড় িযিবৎব বি ধৎব, ঃযব ধিঃবৎ রং মৎববহ, হড় যিরঃব। এর অর্থ হলো_ আমরা কোথায় আছি জানি না, সবুজ রঙের পানি, কোথাও সাদা কিছু নেই। এতেই প্রথম ফ্লাইট নাইনটিনকে কোনো অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। এ নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এই ত্রিভুজ বিষয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেন। তিনি লিখেছিলেন যে তার জাহাজের নাবিকরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক-নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন। তিনি ১১ অক্টোবর, ১৪৯২ সালে তার লগবুকে এসব কথা লিখে রাখেন। তবে বর্তমান বিশেষজ্ঞরা লগবুক পরীক্ষা করে যে মত দিয়েছেন, নাবিকরা যে আলো দেখেছেন তা হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন। আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে।

অন্যদিকে এ বিষয়ে প্রথম খবরের কাগজে রিপোর্ট বেরোয় ১৯৫০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। ইভিডবি্লউ জোন্স লিখিত এই খবর প্রকাশের দু'বছর পর 'ফেইট' ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড 'সী মিস্ট্রি এট আওয়ার ব্যাক ডোর' শিরোনামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন (ইউএস নেভীর পাঁচটি টিবিএম অ্যাডভেঞ্চার বিমানের একটি দল, যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়)-এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভুজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে ফ্লাইট নাইনটিন নিয়ে আমেরিকান লিজান ম্যাগাজিনেও লেখা বেরোয়। এরপর ভিনসেন্ট গডিস 'প্রাণঘাতী বারমুডা ট্রায়াঙ্গল' নামে আরেকটি লেখা লেখেন ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি আরও বিস্তর বর্ণনা সহকারে লেখেন 'ইনভিজিবল হরাইজন' মানে 'অদৃশ্য দিগন্ত' নামের বই। জন ওয়ালেস স্পেন্সার লেখেন 'লিম্বো অব দ্য লস্ট', মানে 'বিস্মৃত অন্তর্ধান', চার্লস বার্লিটজ লেখেন 'দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল', রিচার্ড উইনার লেখেন 'দ্য ডেভিল'স ট্রায়াঙ্গল' বা 'শয়তানের ত্রিভুজ' নামের বই। এছাড়া আরও অনেকেই লিখেছেন। এরা সবাই ঘুরেফিরে একটি বর্ণিত অতিপ্রাকৃত ঘটনাই বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। লেখকদের এসব রচনাকে অতিরঞ্জন বলা হলেও বারমুডার প্রকৃত রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। আর এই বারমুডার আরেকটি রহস্যের সমাধানও দিতে পারেনি কেউ। আর তা হচ্ছে একটি অদ্ভুত জৈবের রহস্যময় উপস্থিতি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গভীর সমুদ্রে যাতায়াত করেছেন টেডি টাকার নামের এক ডুবুরি। কয়েক বছর আগের কথা। একদিন সকালবেলা বারমুডার বেলাভূমিতে টেডি একটি অদ্ভুত বস্তু দেখতে পেলেন। সেটি ছিল ১৫০০ থেকে ২০০০ পাউণ্ড ওজনের উজ্জ্বল সাদা একটি পিণ্ড। স্থানীয় লোকেরা ওই রহস্যময় বস্তুটির নাম দিল বারমুডা ব্লপ। সেটি পরীক্ষা করে টেডি বলেন, 'জিনিসটি যে জৈব পদার্থ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এরকম কোনো প্রাণী কখনও দেখা যায়নি। এই পিণ্ডের একটি টুকরা কেটে নিয়ে গবেষণা করা হলো মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। সেখান থেকে তথ্য পাওয়া গেল, ওই পিণ্ডটি কোনো প্রাণীদেহেরই অংশ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি খুব অদ্ভুত কোনো কোলাজেন টিউমার। আর সেটি অবশ্যই কোনো বড়সড় জলচর প্রাণীর। যেমন তিমি। কিন্তু আরেক দল গবেষক বলেছেন, ওটি একটি প্রকাণ্ড অক্টোপাস। রহস্যময় ব্যাপার হলো_ পিণ্ডটি বেলাভূমিতে পড়ে থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত ভেঙে টুকরা টকুরা হয়ে যায়। অথচ তাতে এতটুকু পচন ধরেনি। বারমুডার এই নতুন রহস্যের মীমাংসা হয়নি। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় সব অন্তর্ধানের কারণ নিয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, ওখানকার সমুদ্রে বা আকাশে আস্ত একটা ফাটল আছে। প্রকৃতির সেই রহস্যময় ফাটলে পড়ে বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যায় চিরকালের মতো। কেউ বলেন, অজানা এক সভ্যতার কথা, যেখানে আগুনের গোলা লাফিয়ে ওঠে। বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় সব জাহাজ ও উড়োজাহাজ। কারো মতে, ওই অঞ্চলে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের জন্য বিশাল জলস্তম্ভ জাহাজ, উড়োজাহাজ সবকিছুকে নিজের গহবরে টেনে নেয়। কেউ বলেছেন, অন্য গ্রহের প্রাণী বা এই জাতীয় কিছু, যা আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য। কেউ আবার ব্যাখ্যা করেছেন ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ মাত্রার। তাদের মতে, সময়ের একটা অনন্ত ফাটল ওই অঞ্চলে সক্রিয় থাকে। ওইসব জাহাজ ও বিমান সময়ের সেই রহস্যময় ফাটলে পড়ে হারিয়ে যায় বর্তমান কালের কাছ থেকে। তারা চলে যায় সুদূর অতীতের কোনো সময়ে। নয়তো ভবিষ্যতের গর্ভে। কেউ আবার চুম্বকীয় তত্ত্বের মাধ্যমে রহস্যটি মীমাংসা করতে চেয়েছেন। তাদের মতে, ওই অঞ্চলে আকাশ ও সমুদ্রের মধ্যে এক তড়িতাহত ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে থাকে। সেখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র। কারো মতে, ওই রহস্যময় অংশে পর্যায়ক্রমে অজানা এই রাসায়নিক যৌগের সৃষ্টি হয়। সেই যৌগ যাবতীয় ইচ্ছাশক্তি ও ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিকে অবশ করে দেয়। সমুদ্রের মধ্যে বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ার ফলে এক অজানা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া চলে। এর ফলে সেখানে রহস্যময় ঘটনাগুলো ঘটেছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা শয়তানের দ্বীপ নিয়ে যতসব রহস্য, সব রহস্যেরই একে একে ইতি টেনেছেন বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও লেখক। অনেকেই একে অতিরঞ্জিত গালগল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আবার অনেকে একটি সেরা বাণিজ্যিক রহস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রশ্ন আসতে পারে রহস্যের আবার বাণিজ্য কিসের? আপাতদৃষ্টিতে রহস্যে কোনো বাণিজ্যিক দিক না থাকলেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। যেহেতু বছরের পর বছর ধরে এ স্থানের রহস্যময়তা কেবল বেড়েই চলেছে তাই এ সম্পর্কে সব ধরনের গুজবই ডালপালা মেলেছে। আর বিশ্বজুড়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল পেঁৗছে যায় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। আর এখানেই তৈরি হয় এর বাণিজ্যিক ভিত্তি। কি সংবাদপত্র, কি টিভি চ্যানেল অথবা বই-পুস্তক_ সবখানেই এর জয়জয়কার। আর এ কারণেই এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের চেয়ে গল্প বলায় আগ্রহী ছিলেন সবাই। এরপরও অনেকে এ বিষয়ে গবেষণার পর কিছু কারণ দেখিয়েছেন। প্রকৃত রহস্য উদঘাটন সম্ভব না হলেও এ কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে রহস্যের জট ভাঙায় কিছুটা হলেও সহজ হবে।

কুসচ এর ব্যাখ্যা :

লরেন্স ডেভিড কুসচ হলেন অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান এবং 'দ্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মিস্ট্রি : সলভড' এর লেখক। তার গবেষণায় তিনি চার্লস বার্লিটজ-এর বর্ণনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনার অসংগতি তুলে ধরেন।

কুসচ-এর গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা হলো_

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে যত সংখ্যক জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয় তার সংখ্যা বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় খুব বেশি নয়।

এ অঞ্চলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় নিয়মিত আঘাত হানে, যা জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু বার্লিটজ বা অন্য লেখকরা এ ধরনের ঝড়ের কথা অনেকাংশেই এড়িয়ে গেছেন।

অনেক ঘটনার বর্ণনায়ই লেখকরা কল্পনার রং ছড়িয়েছেন। আবার কোনো নৌকা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরিতে বন্দরে ভিড়লে তাকে নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়েছে।

আবার কখনোই ঘটেনি এমন অনেক ঘটনার কথা লেখকরা বলেছেন। যেমন_ ১৯৩৭ সালে ফ্লোরিডার ডেটোনা সমুদ্রতীরে একটি বিমান দুর্ঘটনার কথা বলা হয়; কিন্তু তখনকার খবরের কাগজ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।

সুতরাং কুসচ'র গবেষণার উপসংহারে বলা যায়_ লেখকরা অজ্ঞতার কারণে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বানোয়াট রহস্য তৈরি করেছেন।

মিথেন হাইড্রেটস

এখানে দেখানো হয়েছে বিশ্বের যেসব স্থানে গ্যাস হাইড্রেটযুক্ত পলি পাওয়া গেছে অথবা আছে বলে অনুমান করা হয়। কন্টিনেন্টাল সেলভে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট অনেক জাহাজ ডোবার কারণ বলে দেখা গেছে।

কম্পাসের ভুল দিক-নির্দেশনা

কম্পাসের পাঠ নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকাংশে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, কম্পাস থেকে চুম্বক মেরুর দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে এর দিক-নির্দেশনায় বিচ্যুতি আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শুধু উইসকনসিন থেকে মেক্সিকো উপসাগর পর্যন্ত সরলরেখা বরাবর চৌম্বক উত্তর মেরু সঠিকভাবে ভৌগোলিক উত্তর মেরু নির্দেশ করে। ওই ত্রিভুজ এলাকাজুড়ে কম্পাসের এমন বিচ্যুতি সাধারণের কাছে রহস্যময় মনে হয়। কিন্তু এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

হ্যারিকেন

হ্যারিকেন হলো শক্তিশালী ঝড়। ঐতিহাসিকভাবেই জানা যায়, আটলান্টিক মহাসাগরে বিষুব রেখার কাছাকাছি অঞ্চলে শক্তিশালী হ্যারিকেনের কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, আর ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার। রেকর্ড অনুসারে ১৫০২ সালে স্প্যানিশ নৌবহর 'ফ্রান্সিসকো দ্য বোবাডিলা' এমনি একটি বিধ্বংসী হ্যারিকেন ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।

গলফ স্ট্রিম

গলফ স্ট্রিম হলো মেক্সিকো উপসাগর থেকে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা হয়ে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত উষ্ণ সমুদ্র স্রোত। একে বলা যায়, মহাসমুদ্রের মাঝে এক নদী। নদীর স্রোতের মতো গলফ স্ট্রিম ভাসমান বস্তুকে স্রোতের দিকে ভাসিয়ে নিতে পারে। যেমনি ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর 'উইচক্রাফট' নামের একটি প্রমোদতরীতে। মিয়ামি তীর থেকে এক মাইল দূরে এর ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে কোস্টগার্ডকে জানানোর পরই গলফ স্ট্রিমকবলিত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় জাহাজটি।

দৈত্যাকার ঢেউ

হঠাৎ করেই সমুদ্রে দৈত্যাকার ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে, এমনকি শান্ত সমুদ্রেও এমন ঘটতে পারে। তবে একথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে এমন ঢেউ নিয়মিত সৃষ্টি হয়।

মানবঘটিত দুর্ঘটনা : অনেক জাহাজ এবং বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে এর অধিকাংশই চালকের ভুলের কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে। যেমন- কোস্টগার্ড ১৯৭২ সালে ভিএ ফগ-এর নিখোঁজ হওয়ার কারণ হিসেবে বেনজিন-এর পরিত্যক্ত অংশ অপসারণের জন্য দক্ষ শ্রমিকের অভাবকে দায়ী করেছে। তবে রহস্যের কারণ হলো_ অনেক নিখোঁজের ঘটনারই উপসংহারে পেঁৗছানো যায়নি, কেননা এর কোনো ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

ইচ্ছাকৃত ধ্বংসসাধন

যুদ্ধের সময় অনেক জাহাজ শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণে ডুবে গেছে বলেও মনে করা হয়। যেমন মনে করা হয় ১৯১৮ সালে ইউএসএস সাইক্লপস এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর সিস্টার শিপ প্রোটিয়াস এবং নিরিয়াসকে জার্মান ডুবোজাহাজ ডুবিয়ে দেয়। তবে পরবর্তীতে জার্মান রেকর্ড থেকে এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।

জলদস্যুদের আক্রমণে : আবার ধারণা করা হয় জলদস্যুদের আক্রমণে অনেক জাহাজ নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারে। ওই সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে এবং ভারত মহাসাগরে মালবাহী জাহাজ চুরি খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। ১৫৬০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছিল জলদস্যুদের আখড়া। তাই জলদস্যুদের আক্রমণেও জাহাজ নিখোঁজ হতে পারে।

-রণক ইকরাম

Wednesday, March 23, 2011

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন

0 comments
পলাশী যুদ্ধের সময় দিলি্লর মসনদে ছিলেন সম্রাট শাহ আলম। ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রক এই মুঘল অধিপতি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা প্রদেশের এতসব ঘটনার পরও ছিলেন অনেকটাই নির্বিকার। তিনি ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট মাত্র ২৬ লাখ টাকার বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি পদ দান করেন। অন্যদিকে ইংরেজ কোম্পানি নবাবকে বার্ষিক ৫৩ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো। তখন সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে সুবাদার বা নবাবের দু'রকম ক্ষমতা ছিল। একটি দেওয়ানি, অপরটি ফৌজদারি। দেওয়ানি হলো রাজস্ব শাসনের ক্ষমতা। আর ফৌজদারি ক্ষমতা বলতে সামরিক ও আইন-শৃক্সখলা বজায় রাখা। মূলত দেওয়ানি ক্ষমতাই দেশ পরিচালনার মুখ্য শক্তি। কিন্তু সুচতুর ক্লাইভ নানা মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে সম্রাটকে নয়ছয় বুঝিয়ে দেওয়ানি সনদ হস্তগত করে। বাস্তবে এই দেওয়ানি ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পর ফৌজদারি ক্ষমতাও কোম্পানি কৌশলে আয়ত্ত করার প্রয়াস পায়। এরপরই শুরু হলো ইংরেজ কোম্পানির স্বেচ্ছাচারিতা। ফলে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে, বাংলা ১১৭৬ সালে শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত।


গ্রন্থনা : তাহ্মীদুল ইসলাম

Monday, March 21, 2011

বাংলায় ব্রিটিশ রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণ

0 comments
সিপাহি বিপ্লবের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ প্রশিক্ষিত ও প্রভাবশালী নেতৃত্বের অভাব, অর্থের অভাব, সিপাহিদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের সুযোগ না থাকা, একশ্রেণীর দেশীয় ইংরেজ ভক্তের বিশ্বাসঘাতকতা। এ ছাড়া কলকাতা ও ঢাকার শিক্ষিত শ্রেণী ও সম্পদশালী ভূস্বামী এ যুদ্ধকে সমর্থন করেনি। বিপ্লবের ফলে যুদ্ধ শেষে ইংরেজরা নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কেও কয়েকজন দেশপ্রেমীকে ফাঁসি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাদের মাংস কাক-শকুনে খায়। পচে-গলে খসে পড়তে থাকে। বাহাদুর শাহকে গ্রেফতার করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। মুঘল রাজবংশের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কোম্পানির শাসনের ইতি ঘটিয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এই উপমহাদেশটি। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ইতি ঘটিয়ে ব্রিটিশ রাজের অধীনে শুরু হয় ভারতবর্ষের অধীনতার আরেক মহাকাল। লর্ড ক্যানিং ভারতবর্ষের প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত হন। ঔপনিবেশিক শাসনের ৯০ বছরে এদেশে এসেছে রক্তচোষা নীলকর দস্যুরা। তারা বাংলার কৃষকের সোনার ধান ফলতে দেয়নি। জোর করে নীল চাষ করতে বাধ্য করেছে। এই নীলদস্যুদের হাতে নিপীড়ন-নির্যাতনে রক্তাক্ত হয়েছে হাজার হাজার কৃষক। সাধারণ মানুষ। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশজুড়ে নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। কৃষকদের দুর্বার প্রতিরোধের মুখে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ইংরেজ নীল কুঠিয়ালরা নীল ব্যবসা বন্ধ করে দেশে ফিরে যায়।

গ্রন্থনা : তাহ্মীদুল ইসলাম

বিস্ফোরক কি

1 comments
বিস্ফোরক হলো এমন ধরনের পদার্থ যা তাপে কিংবা জোরালো আঘাতে প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ যখন ঘটে তখন তার উপাদানগুলো গ্যাসে রূপান্তরিত হয় এবং এ সময় প্রচণ্ড তাপ ও চাপের সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ বিস্ফোরকের মধ্যে থাকে কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। বিস্ফোরণের পর কার্বনডাই অক্সাইড, বাষ্প ও নাইট্রোজেন গ্যাস বেরিয়ে আসে। বিস্ফোরক প্রধানত তিন ধরনের।

রাসায়নিক বিস্ফোরক : দু'ধরনের রাসায়নিক বিস্ফোরকের একটি হলো নিম্নশক্তির আর অন্যটি হলো উচ্চশক্তির। নিম্নশক্তির বিস্ফোরক খুব দ্রুত বিস্ফোরিত হয়। বারুদ হলো একটি নিম্নশক্তির বিস্ফোরক আবার কর্ডাইট আর একটি নিম্নশক্তির বিস্ফোরক। উচ্চশক্তির বিস্ফোরক হচ্ছে ওইগুলো যাতে অতি দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়ে তাপ ও গ্যাসীয় পদার্থের সৃষ্টি করে। এগুলো তখনই ব্যবহৃত হয় যখন কোনো কিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য বিপুল পরিমাণ বলের প্রয়োজন হয়। ট্রাই-নাইট্রো-টলুইন, পিকরিক এসিড, নাইট্রোগি্লসারিন ইত্যাদি হলো উচ্চশক্তির বিস্ফোরক।

যান্ত্রিক বিস্ফোরক : কার্ডক্স হলো একটি যান্ত্রিক বিস্ফোরক, সিলকরা ধাতব টিউব দিয়ে এটি তৈরি। কার্ডক্স একটি ধীরগতি ও কম শক্তিসম্পন্ন বিস্ফোরক, খনির মধ্যে বড় বড় পাথর ভেঙে টুকরো টুকরো করতে এটি ব্যবহার হয়।

পারমাণবিক বিস্ফোরক : প্রচণ্ড তাপমাত্রার উপর এ বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ নির্ভর করে। ওই তাপমাত্রা কয়েক লাখ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। এ বিস্ফোরক প্রচণ্ড পরিমাণ গ্যাস, তাপ ও আলো উৎপন্ন করে। পারমাণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা হলো এ ধরনের বিস্ফোরক। প্রায় সব যুদ্ধাস্ত্রে বিস্ফোরকের ব্যবহার করা হয়। খনিতে পাথর টুকরো করতে, নদীতে ভাসমান বরফ খণ্ডকে ভাঙতে এবং নদীর উপর বাঁধ তৈরি করতে নানা ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার হয়ে থাকে। রজার বেকন নামে এক ইংরেজ ভিক্ষু ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বারুদ আবিষ্কার করেন বলে মানুষের বিশ্বাস। যদিও এরও কয়েক শতাব্দী আগে চীনা বা আরবীয়রা ওই ধরনের মিশ্রণ তৈরি করেছে যার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। বারুদের আবিষ্কার সেনাবাহিনীর কাছে এক অবদান স্বরূপ প্রমাণিত হয়েছে। নতুন নতুন অনেক অস্ত্রের জন্ম হয়েছে এর থেকে। প্রথমদিকে বারুদ তৈরি করা হতো নিজস্ব প্রয়োজনে যা ছিল খুবই বিপজ্জনক। সপ্তদশ শতাব্দীতে বড় বড় প্রস্তর খণ্ডকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজে বারুদ ব্যবহার হয়। এ ব্যাপারে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়। ১৮৪৬ সালে যখন 'সকনবেন' নামক এক জার্মান রসায়নবিদ তুলোর আঁশকে ঘন নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিড সিক্ত করে 'গান কটন' নামক বিস্ফোরক তৈরি করেন। এর ঠিক এক বছর পর ১৮৪৫ সালে 'অ্যাসকানিয়ো সবরেরো' নামক এক ইতালীয় ব্যক্তি নাইট্রোগি্লসারিন আবিষ্কার করেন। তিনি গি্লসারিনের সঙ্গে নাইট্রিক এসিড ও সালফিউরিক এসিড মিশ্রণ করে এ বিপজ্জনক বিস্ফোরক তৈরি করেন। ১৮৬৬ সালে বিখ্যাত সুইডিশ বিজ্ঞানী 'আলফ্রেড নোবেল' ডিনামাইট আবিষ্কার করে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করেন। অস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডিনামাইট এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিনামাইট ক্রমশ একটি নিরাপদ গান পাউডার এবং নাইট্রোগি্লসারিন হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা ট্যাঙ্কের আবিষ্কার করে এবং সফলতার সঙ্গে তা যুদ্ধে ব্যবহার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমার মতো ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হয়। আমেরিকানরা জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। রকেটের উদ্ভবও ঘটে ঠিক একই সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিস্ফোরক ও যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার এবং তৈরি ইতিহাসে এক নাটকীয় মোড় নেয়।

-প্রীতম সাহা সুদীপ

স্পিচ থেরাপি

2 comments
ধূমপান, তামাক, অ্যালকোহল, পান, জর্দা ইত্যাদি খাওয়ার কারণে স্বরযন্ত্রে এক ধরনের দাগ পড়ে। ফলে কণ্ঠস্বর ফ্যাস ফ্যাস করে, আওয়াজ বের হতে চায় না। কিছু সময় কথা বলার পর স্বর চিকন হয়ে যায়। চাপ দিয়ে কথা বলতে হয় অথবা কথা শোনাই যায় না। এভাবে চাপ দিয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় আর কথাই বলা যায় না। স্বরযন্ত্র সম্পর্কীয় বাম অথবা ডান পাশ্র্বের নার্ভ নিষ্ক্রীয় হলে কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। মানুষ আওয়াজের মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে। যার আওয়াজ যত স্পষ্ট তার কথা শুনতে তত ভালো। কণ্ঠস্বর ফ্যাস ফ্যাস করা বা আওয়াজে অস্পষ্টতা দূর করতে রয়েছে স্পিচ থেরাপি নামক চিকিৎসা পদ্ধতি। বর্তমানে বাংলাদেশেও তা চালু রয়েছে। বিদেশের তুলনায় এখানে খরচও কম। কথা বলার যে কোনো ধরনের সমস্যা যেমন_ তোতলামী, অস্পষ্ট উচ্চারণ, ভাষাগত অমিল এ থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। কণ্ঠস্বরের সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা না করালে সমস্যা আরও জটিল হতে পারে।

মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর
স্পিচ থেরাপিস্ট, তাকওয়া স্পেশালাইজড হসপিটাল, নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা।ফোন : ০১৯১১৭৪৮০৩৭

দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টের প্রতিকার

0 comments
শ্বাসকষ্টজনিত রোগের মধ্যে COPD অন্যতম। দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা (Chronic morbidity) সৃষ্টিকারী এবং মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হিসেবে এই রোগটি বিশ্বব্যাপী পরিগণিত হয়ে আসছে। বহুলোক এই রোগে ভোগে এবং কম বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এটি হলো ফুসফুসের এমন একটি রোগ যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগে। এই শ্বাসকষ্ট দিন দিন বৃদ্ধি পায় যা আর কখনো সম্পূর্ণভাবে আগের অবস্থায় ফিরে আসে না।

যাদের COPD বেশি হয় : এ রোগের জানা কারণগুলোর মধ্যে ধূমপান অন্যতম। সাধারণত যে যত দীর্ঘ সময় ধূমপান করবে তার ঈঙচউ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কর্মক্ষেত্রে জৈব-অজৈব ধূলিকণা বেশি হলে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে যারা কাঠ, শুকনো খড় ইত্যাদি ব্যবহার করেন বায়ুদূষণ বেশি হলে ফুসফুসের সংক্রমণ হলে, যেমন ঘন ঘন ভাইরাস সংক্রমণ যারা অপুষ্টিতে ভুগছে। সাধারণত নারীদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি COPD আক্রান্ত হয়। তা ছাড়া জম্মগতভাবে ফুসফুস ঠিকমতো গড়ে না উঠলে এবং আলফা ওয়ান এনটি ট্রিপসিন (Alpha-one antitrypsin) নামক এনজাইম-এর ঘাটতি হলেও এ রোগ হতে পারে।

রোগের লক্ষণ : শ্বাসকষ্ট ও কাশি COPD রোগের প্রধান লক্ষণ। শ্বাসকষ্ট সাধারণত কমবেশি সবসময় থাকে এবং চলাফেরায় বৃদ্ধি পায়। সঠিক চিকিৎসা না নিলে শ্বাসকষ্ট দিন দিন বাড়তে থাকে। কাশির সঙ্গে কফ থাকতে পারে এবং কোনো কোনো সময় শ্বাসকষ্ট, কাশি এবং কফের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

রোগ নির্ণয় : Spirometry পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ছাড়াও রোগের তীব্রতা পরিমাপ করা যায়, যা সঠিক চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসা : সাধারণত বেশিরভাগ COPD রোগী প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসেন না। তাই কার্যকর চিকিৎসার জন্য দরকার_

* রোগের তীব্রতা নির্ণয় এবং পর্যবেক্ষণ * রোগের কারণসমূহ নির্ণয় এবং সম্ভব হলে কারণসমূহ দূর করাCOPD রোগের সঠিক ওষুধ প্রয়োগ এবং রোগীদের সঠিক পুনর্বাসন (Rehabilitation)

COPD রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, কিন্তু সঠিক চিকিৎসায় রোগের লক্ষণ যেমন : শ্বাসকষ্ট, কাশি ইত্যাদি অনেক কমে যায়, রোগীর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, রোগ বৃদ্ধি এবং জটিলতা হ্রাস পায়।

COPD রোগীর চিকিৎসা সাধারণত ওষুধ দ্বারা এবং বিভিন্ন রকম পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য বিভিন্ন রকম ইনহেলার ব্যবহার করা হয়, যেমন- সালবিউটামল, ইপ্রাট্টপিয়াম, করটিকোস্টবেয়ড ইত্যাদি। জীবাণু সংক্রমণ ঘটলে এন্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে। রোগের তীব্রতা বেশি হলে রোগীকে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি ঙ২ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া রোগীকে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়া রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হলে ঘন ঘন রোগ বৃদ্ধি এবং জটিলতা অনেকাংশে কমে যায় COPD যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি (পযৎড়হরপ) রোগ এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তাই COPD রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায় হলো রোগীকে তার রোগ, রোগের কারণ এবং তার পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া। রোগ বৃদ্ধির লক্ষণগুলো অবহিত করা এবং কখন চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে ধূমপান বর্জনে সাহায্য করা পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়। আমাদের দেশে অনেক চিকিৎসক COPD রোগীকে অ্যাজমা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন এবং সঠিক চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হন। এ ক্ষেত্রে একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞই পারেন একজন COPD রোগীকে অনেকটা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে।

ডা. এ কে এম মোস্তফা হোসেন
পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
ফোন : ০১৭১১-১৭১৬৩৪; ৮৩৩৩৮১১

বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ৬ সেতু

0 comments
কলোরডার রয়েল জর্জ ব্রিজ : যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঝুলন্ত সেতু রয়েল জর্জ ব্রিজ। এর উচ্চতা রীতিমতো শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়। সেতুটি আরাকান নদী উপত্যকায় অবস্থিত। এর উচ্চতা ৯৬৯ ফুট এবং লম্বায় ১২৬০ ফুট।

ফ্রান্সের অ্যাগুইলা ডি মুদি ব্রিজ : সেতুটির উচ্চতা এত বেশি যে, নিচের দিকে তাকানো যায় না। দুই পর্বতের মাঝে সেতুটির অবস্থান। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, সেতুটি আয়তনে ছোট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৬০৫ ফুট উচ্চতায় এর অবস্থান।

সুইজারল্যান্ডের ট্রিফ সাসপেনশন ব্রিজ : এটি সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সুউচ্চ পায়ে হাঁটার ঝুলন্ত সেতু। ট্রিফ ২০০৪ সালে নির্মাণ করা হয়। সুইজারল্যান্ডের গ্রাডমেন শহরের পর্বতমালায় এটি অবস্থিত। সেতুটির উচ্চতা ৩২৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৫৫৮ ফুট।

নর্দান আয়ারল্যান্ডের ক্রিক-এ-রেডি রোপ ব্রিজ : বহু পর্যটক সেতুটির ওপর দিয়ে খুব সহজেই পায়ে হেঁটে পার হয়েছেন। যদিও সেতুটি ভয়ঙ্কর, তবু মাছ শিকারিরা সেতুটি বেশি ব্যবহার করেন। রশির তৈরি সেতুটি পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করে। এটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অ্যানট্রিম কাউন্ট্রির ব্যালিনটয়ের কাছে অবস্থিত। সেতুটি ৬৫ ফুট লম্বা এবং পর্বত থেকে ১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।

কানাডার কেপিলান সাসপেনশন ব্রিজ : সেতুটির উপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়া খুবই ভয়ের। সবুজেঘেরা বনের মাঝে এর অবস্থান। সেতুটির উচ্চতা, সরুত্ব এবং খুব বেশি নড়াচড়া ভয়ের অন্যতম কারণ। ১৮৮৯ সালে প্রথম সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার নর্থ ভানকোভারের কাপিলান নদীর ওপর সেতুটির অবস্থান। ৪৫০ ফুট লম্বা এবং উচ্চতা ২৩০ ফুট।

চীনের সিদু রিভার ব্রিজ : ২০০৯ সালের নভেম্বরে সেতুটি যখন উদ্বোধন করা হয় ওই সময় পর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেতু। চীনের হুবি প্রদেশের জর্জ নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির উচ্চতা ১ হাজার ৫৫০ ফুট।

-নাজমুল হক ইমন

জামালপুরে জামাইমেলা

0 comments
জামালপুরে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঝাওলা গোপালপুরের জামাইমেলা। প্রায় দুইশ বছর থেকে চলে আসা এই মেলাকে ঘিরে পূর্ব জামালপুরের তিনটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে গেরস্থের বাড়িতে বাড়িতে এখন মেয়ে-জামাই নিয়ে চলছে উৎসবের আমেজ। জামালপুরে ঝাওলা গোপালপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে পহেলা চৈত্র থেকে শুরু হয় তিনদিনব্যপী এই ঐতিহ্যবাহী জামাইমেলা। মেলাকে ঘিরে পূর্ব জামালপুরের বাঁশচড়া, নরুন্দি, ইটাইল, ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে ছিল উৎসবের আমেজ। এসব গ্রামের গেরস্থরা মেলা উপলক্ষে নাইওর নিয়ে আসে মেয়ে-জামাইকে। এই তিনটি দিন মেয়ে-জামাইকে নানা উপহার, সালামী দেওয়া ছাড়াও সব ধরনের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এই উৎসব আনন্দে শরিক হতে দূরে বিয়ে দেওয়া মেয়ে আর জামাইরা অপেক্ষায় থাকে সারা বছর। মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি এসে সবকিছুকে ছাড়িয়ে জামাইরা মন ভরে উপভোগ করে শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়ন। প্রায় দুইশ বছর আগে এই মেলার প্রচলন করেছিল এই অঞ্চলে বসবাসকারী সনাতনী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত বারুনি স্নান উপলক্ষে এখানে বসতো চৈত্রমেলা। মেলাকে ঘিরে হিন্দু-মুসলিম সবাই মেতে উঠত নানা উৎসব অনুষ্ঠানে। মেলাকে ঘিরে গেরস্থের বাড়িতে জামাই আগমনের সূত্র ধরে ভারত বিভক্তির পর এই মেলা পরিচিতি পায় জামাইমেলা হিসেবে। এবার বিশাল এলাকাজুড়ে বসা এই মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছুর সঙ্গে গেরস্থের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, ফার্নিচার ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী গোপালপুরের বিখ্যাত নানা রকমের মিষ্টির পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। বিশেষ করে মেলায় প্রতিটি এক কেজি ওজনের বালিশ মিষ্টি দৃষ্টি কাড়ছে সবার।

- শফিক জামান, জামালপুর