Monday, March 29, 2021

বালিশ মিষ্টির ইতিকথা

0 comments

 ভাতে-মাছে বাঙালির মিষ্টান্নপ্রিয়তার কথা কে না জানে। রসনাবিলাসে তাই শেষপাতে মিষ্টি না হলে কি চলে? তা সে ঘরে বানানোই হোক বা ময়রার তৈরি। বাঙালির মিষ্টির আবার আছে নানা ধরন। স্থানভেদে এর স্বাদ আর তৈরির পদ্ধতিও ভিন্ন। এসব মিষ্টি কেবল জিবে জল আনে না, বরং এর সৃষ্টিকর্ম অনন্য শিল্পকর্ম বটে।

বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির কারণে গবাদিপশুর খাদ্যের আকাল কখনোই হয়নি। গোয়াল ভরা গরু সব সময়ই ছিল বলে বাড়ন্ত হয়নি গরুর দুধ। ময়রারাও তাই মনের সুখে তৈরি করেছেন নানা ধরনের মিষ্টি। করেছেন নানা ধরনের নিরীক্ষা। নতুন পদের স্বাদ ভুবন মাতিয়েছে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এ জন্য দেখা মেলে বাহারি সব মিষ্টি—নামে, স্বাদে, আকারে এরা অনন্য।  

এমনই একটি মিষ্টি হলো নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি। এটা কেবল একটা মিষ্টি নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস আর ঐতিহ্য। এর উদ্ভাবক শ্রী গয়ানাথ ঘোষ। তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এই হালুইকর নেত্রকোনা জেলা শহরের বারহাট্টা রোডে একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার চালাতেন। তাঁর দোকানের নামই ছিল গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার। তিনি গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে কিছু করতে মনস্থির করেন। যার ফলশ্রুতি হলো নতুন এক মিষ্টির উদ্ভাবন। আকারে সাধারণ মিষ্টির চেয়ে আলাদা। স্বাদেও। 

 

দুটো বিষয়ই মিষ্টিপ্রিয় মানুষকে আকৃষ্ট করতে সময় লাগেনি। বরং রাতারাতি তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটা দেখতে অনেকটা কোলবালিশের মতো বলেই এর নাম হয়ে যায় বালিশ মিষ্টি। অনেকে আবার বলে থাকেন গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি। কেবল নেত্রকোনা বা বৃহত্তর ময়মনসিংহ নয়, বরং বালিশ মিষ্টির সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। তবে কোন সালে এই মিষ্টি তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটা আজ আর জানা সম্ভব হয়নি।

দুঃখজনক হলেও ১৯৬৯ সালে অশীতির গয়ানাথ ঘোষ সপরিবার দেশান্তরী হন। চলে যান ভারতে। এরপর আর ফেরেননি। পরভূমে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটালেও সেখানে তিনি আর বালিশ মিষ্টি তৈরি করতেন কি না, তা জানা যায় না।

তবে নিজের উদ্ভাবনকে তিনি বলতে গেলে স্বদেশেই রেখে যান। কারণ, এই মিষ্টি তৈরির গোপন কৌশল তিনি তাঁর প্রধান কারিগর নিখিলচন্দ্র মোদককে শিখিয়ে দিয়ে যান। তবে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি তখন কিনে নেন কুমুদ চন্দ্র নাগ। যদিও মাত্র ছয় বছর বাদে কুমুদ চন্দ্র নাগ বালিশ মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর নিখিলচন্দ্র মোদকের কাছে এই মিষ্টির দোকান বিক্রি করে দেন। এরপর আর হাতবদল হয়নি।  

বরং সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই এই প্রতিষ্ঠান নিখিলচন্দ্রের পরিবারের কাছেই রয়েছে। তবে প্রজন্মান্তর হয়েছে। নিখিলচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর তিন ছেলে বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করে যাচ্ছেন। একইভাবে অক্ষুণ্ন রেখেছেন বালিশ মিষ্টির ঐতিহ্য। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গয়ানাথের ছেলেরাও এখন আর ভারতে বেঁচে নেই। তথ্য সংগ্রহের আর কোনো উপায় নেই।

বর্তমানে এই মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর রতন পাল। তাঁর সহকারী হিসেবে আছেন আরও চার-পাঁচজন কারিগর। রতন পালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরুর খাঁটি ঘন দুধে তৈরি উৎকৃষ্ট মানের ছানার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ ময়দার সংমিশ্রণে বিশেষ ভালো করে মেখে গোলা পাকিয়ে ছোট ছোট মণ্ড তৈরি করা হয়। মণ্ডগুলোকে বিভিন্ন মাপ ও আকারের কোলবালিশের আদলে মিষ্টি বানিয়ে অতি যত্ন ও সচেতনতার সঙ্গে ভেজে ফুটন্ত গরম চিনির রসে রাতভর ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর রাত পোহালে রসে টইটম্বুর ও তুলতুলে এই মিষ্টির ওপর ক্ষীর বা ঘন মালাইয়ের প্রলেপ দিয়ে বিক্রি করা হয়।

এই মিষ্টি বর্তমানে মোট পাঁচ আকৃতির হয়ে থাকে। ১ কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ৫০০ টাকা, ১ কেজি ওজনের একেকটির দাম ৩০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ২০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ১০০ টাকা এবং ২৫০ গ্রামের একেকটির দাম ৫০ টাকা। ৩০০ টাকা মূল্যের মিষ্টি দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চির মতো এবং তৈরি করতে ৪৫০ গ্রাম ছানা লাগে। 

জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য বর্তমানে একই শহরে আদি প্রতিষ্ঠানটির আরও দুটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্টেশন রোড ও ছোট বাজারে। আদি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলাতেই মিষ্টি তৈরি করে শাখা দুটোয় সরবরাহ করা হয়। এই মিষ্টির অনুকরণে ওই অঞ্চলের অন্য মিষ্টির দোকানগুলোও পরস্পর পাল্লা দিয়ে বালিশ মিষ্টি তৈরি করলেও সেই আসল স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। কেননা ব্যবসায়িক স্বার্থে পুরো রেসিপির কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হলেও কারিগরদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, দক্ষতা এবং উপাদানের পরিমাণের ভারসাম্যের সুকৌশল ও রন্ধনশৈলীও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

ওই অঞ্চলসহ আশপাশেরে এলাকা ছাড়াও অনেক জায়গাতেই গায়েহলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, মিলাদ, বিবাহবার্ষিকী কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই মিষ্টি একপ্রকার রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি দূরদূরান্ত থেকে অনেক সময় পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই মিষ্টির টানে। 

নেত্রকোনা জেলা শহরটি ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ দেশের মানুষ ভারতেও আত্মীয়স্বজনের কাছে নিয়ে যান এই মিষ্টি। তাই এই মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা, জনপ্রিয়তা ও দীর্ঘ ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অন্যান্য শহরেও শাখা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমনকি দেশের বাইরেও সরবরাহের ইচ্ছাও পোষণ করছেন।

সূত্র: প্রথম আলো

Sunday, March 28, 2021

আইসক্রিমের গল্প

0 comments

আইসক্রিম হিমায়িত মিষ্টিজাতীয় খাবার। আইসক্রিমের আদি গল্প কিন্তু অতি প্রাচীন বলে জানা যায়। চায়না, ইরান, ইতালি, গ্রিস, ভারত—সব দেশেরই আছে আইসক্রিম নিয়ে নিজস্ব ইতিহাস। তবে সব অঞ্চলেই প্রাচীনকালে মানুষকে আইসক্রিমের জন্য পাহাড় থেকে আনা বা হিমায়িত জলাশয় থেকে খুঁড়ে নেওয়া বরফের ওপরে নির্ভর করতে হতো। সংগৃহীত বরফ বিশেষ উপায়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করা হতো। তাই বরফের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য আইসক্রিম জনসাধারণের নাগালের বাইরেই ছিল বলা যায়।

এরপর যখন আঠারো শতকে রেফ্রিজারেটরে বরফ জমানোর কায়দা জানা গেল, তখনই প্রথম সাধারণ মানুষ কনকনে ঠান্ডা আইসক্রিমের স্বাদ পেল। এরপর যখন উনিশ শতকে আইসক্রিম বানানোর মেশিন আবিষ্কার হয়ে গেল, তখন এই ক্রিমি স্বাদের আধুনিক যুগের চিরচেনা আইসক্রিম যুগের শুভসূচনা ঘটল। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, সাধারণভাবে আমরা সব ধরনের ফ্রোজেন ডেজার্ট বা হিমায়িত মিষ্টিজাতীয় খাবারকেই আইসক্রিম বললেও এগুলোর আছে বৈচিত্র্যময় রকমফের। 

এবার আসা যাক সত্যিকারের আক্ষরিক অর্থেই যাকে আইসক্রিম বলা যায়, তার প্রসঙ্গে। একেবারে মসৃণ, ক্রিমি ও মুখে মিলিয়ে যাওয়া আইসক্রিম বানানোর জন্য হস্তচালিত আইসক্রিম ফ্রিজার প্রথম বানিয়েছিলেন ন্যান্সি জনসন (২৮ ডিসেম্বর, ১৭৯৪– ২২ এপ্রিল, ১৮৯০) নামের এক মার্কিন নারী, ১৮৪৩ সালে। এটি তিনি নিজের নামে পেটেন্ট করেন আমেরিকায়। এ যন্ত্রে সহজে আইসক্রিম বানানো যেত। এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে আইসক্রিম উৎপাদন ও বিপণন শুরু হয়ে যায়।  

আইসক্রিমের ব্যাকরণ অনুযায়ী, অন্তত ১০ শতাংশ দুগ্ধজাত চর্বি বা মিল্কফ্যাট থাকলেই কেবল তাকে আইসক্রিম বলা যাবে। এই মিল্ক ফ্যাট, ডিম, দুধ, বিভিন্ন ফ্লেভারের জন্য মনমতো উপকরণ আর চিনি মিশিয়ে ক্রমাগত ঘুরিয়ে ফেটিয়ে জমিয়ে তৈরি করা হয় আইসক্রিম। এই প্রক্রিয়া চার্নিং নামে পরিচিত। এর ফলে বরফের দানা বা স্ফটিকগুলো বড় হয়ে জমতে পারে না। আর এই সূক্ষ্ম স্ফটিকগুলো মিল্কফ্যাট আর দুধের পানির মসৃণ ফেটানো মিশ্রণ বা ইমালশনের মধ্যে ডুবে থাকে।

পুরো বিশ্বে অসংখ্য ফ্লেভারের আইসক্রিম খেয়ে থাকে বিশ্ববাসী। বিভিন্ন উপাদেয় ফল, দুধ, বাদাম ইত্যাদি ছাড়াও অদ্ভুত অদ্ভুত আইসক্রিম পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশে। যেমন ঝাঁজালো ওয়াসাবি আইসক্রিম, চারকোল দেওয়া মিশকালো আইসক্রিম, উৎকট গন্ধের ডুরিয়ান আইসক্রিম, নোনতা স্বাদের চিজ আইসক্রিম ইত্যাদি। আমাদের দেশে ইগলু আর পোলার কোম্পানির হাত ধরে এই প্রথাগত আইসক্রিম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এখন তো হাডজেন ডাস বা মুভ এন পিকের মতো বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডের আইসক্রিমও পাওয়া যায় এ দেশে। আবার এই ভ্যানিলা আইসক্রিমের ওপরে মচমচে চকলেটের পাতলা আবরণ দেওয়া চক আইস বা চকবার সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও তুমুল জনপ্রিয়। আবার পাতলা ওয়েফার বিস্কুট দিয়ে বানানো কোনে স্কুপ ভরে দেওয়া কোন আইসক্রিমতো আরেক মাত্রা এনে দিয়েছে আইসক্রিমের দুনিয়ায়।

ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ পাশে রেখে এবার বরং প্রধান কয়েকটি হিম হিম আইসক্রিমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

শেভড আইস বা কুচো বরফের আইসক্রিম


বরফকে কুরিয়ে মিহি তুষারের মতো পেঁজা ভাব এনে তাতে ফলের রস, বিভিন্ন পানীয়, সিরাপ, রকমারি ফ্লেভার ইত্যাদি মিশিয়ে প্রথমে হিমায়িত মিষ্টি খাবারের চল হয়েছিল। অঞ্চলভেদে এতে দুধ, বিভিন্ন ফল, বাদাম, মধু, জেলি, গম, চালের আটা বা সাবুর তৈরি বুন্দিয়া, সেমাই বা ফিরনির মতো খাবারও মেশানো হতো। কুচানো বরফ দেওয়া এমন সব মিষ্টি খাবারের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে পারস্য ও আমাদের উপমহাদেশের ফালুদেহ বা ফালুদা, ফিলিপাইনের হালো হালো, জাপানি কাকিগোরি ইত্যাদি। তবে এগুলো ঠিক সে অর্থে আইসক্রিম নয়। বরং পাশ্চাত্য দেশে স্নো কোন বা স্নো বল এবং আমাদের অঞ্চলের গোলা বা চুস্কি আইসক্রিমে কুচানো বরফ চেপে চেপে আকৃতি দিয়ে তাতে বিভিন্ন ফলের রস, রঙিন সিরাপ দিয়ে খাওয়া হয় যুগ যুগ ধরে। আমাদের দেশে সেই চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকেই এই গোলা আইসক্রিম খুবই জনপ্রিয়। ইতালিয়ান গ্রানিতা আইসক্রিমে অবশ্য আগে থেকে ফ্লেভার দেওয়া বরফকেই কুচিয়ে বাটিতে দেওয়া হয় খেতে।

আইস ললি বা কাঠি আইসক্রিম

 

ফলের রস বা দুধ জমিয়ে বরফ করে নিলেই পপসিকল, আইস ললি বা সোজা বাংলায় কাঠি আইসক্রিম হয়ে যায়। এই আইসক্রিমের শুরুর গল্পটি কিন্তু ভারি মজার। সেই ১৯০৫ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ১১ বছর বয়সী ছোট এক ছেলে তার পানিতে গোলানো পাউডার সোডার গ্লাসটি একটি নাড়নকাঠিসহই বাইরে ফেলে গিয়েছিল ভুলে। বরফে ঢাকা সেই স্থানে রাখা গ্লাসটির পানীয় তীব্র ঠান্ডায় জমে একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিল। পরদিন বেরিয়ে কাঠিসহ সেই মিষ্টি মজাদার বরফ খেয়ে অভিভূত কিশোর ফ্র্যাংক এপারসন বড় হয়ে পপসিকলের পেটেন্ট নিয়ে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়ের সূচনা করেছিলেন।

এ ধরনের আইসক্রিম আমাদের দেশে সেই ষাটের দশক থেকেই পাওয়া যায়। বিভিন্ন রং ও ফ্লেভার দেওয়া চিনি-পানি বা দুধ জমিয়ে বাঁশের চ্যাপ্টা কাঠি দেওয়া আইসক্রিম সবার খুব প্রিয় ছিল। পরে অরেঞ্জ ফ্লেভার, লেমন ফ্লেভার, ওভালটিন দুধ আর নারকেল দুধের বেবি আইসক্রিম কোম্পানির আইস ললি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল এ দেশে। এ পথ ধরে ষাটের দশকে ইগলু এসে দেশের আইসক্রিম জগৎটি পাল্টে দিল একেবারেই। পরে ধীরে ধীরে দেশের আনাচকানাচে সব জায়গায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং সুলভে মিলতে লাগল কাঠি আইসক্রিম বা আইস ললি।

কুলফি


 

ঘন দুধ, মালাইয়ের সঙ্গে চিনি, এলাচিগুঁড়া, গোলাপের নির্যাস, পেস্তা, কাজু, কিশমিশ, কাঠবাদাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমের মসৃণ ঘন ক্বাথ মিশিয়ে আইস ললির প্রক্রিয়াতেই ছাঁচে জমিয়ে কুলফি বানানো হয়। তবে এ ক্ষেত্রে দুধের মিশ্রণটি খুব ঘন হওয়ার ফলে এই বরফ জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি কিছুটা ধীরগতির হয়। এতে করে কুলফির বিশিষ্ট মসৃণ ক্রিমি ব্যাপারটি সাধারণ দুধের কাঠি আইসক্রিমের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কুলফি আসলে ফারসি শব্দ, যার অর্থ ঢেকে রাখা বা আচ্ছাদিত। কুলফি আসলেই ঢাকা ধাতব ছাঁচেই জমানো হয় যুগ যুগ ধরে।

জেলাটো

 

ক্ল্যাসিক আইসক্রিমের ইতালীয় সংস্করণ জেলাটোর কথা না বললেই নয়। সারা বিশ্বের আইসক্রিম বোদ্ধাদের কাছে জেলাটোর এক অন্য রকম আবেদন আছে। কথিত আছে, সেই ষোলো শতকেই প্রোকোপিও নামের এক ইতালীয় মিষ্টির কারিগর তাঁর ক্যাফে প্রোকোপে প্রথম জেলাটো পরিবেশন করেছিলেন। জেলাটোতে আইসক্রিমের মতো মিল্কফ্যাট না ব্যবহার করে দুধ দেওয়া হয়। আর আইসক্রিমের মতো অত ফেটানো হয় না। তাই জেলাটোর ফ্লেভার বেশ ভালো রকম বোঝা যায়। জেলাটো কিন্তু আইসক্রিমের চেয়ে আরও একটু নরম অবস্থায় পরিবেশন করা হয়। ইতালিয়ান হিমায়িত ডেজার্ট সেমিফ্রিডোতেও এর ব্যবহার রয়েছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও এখন ক্লাব জেলাটোর মতো অভিজাত জেলাটো পারলার রয়েছে অনেক।

সরবেট


 

ফলের ক্বাথ আর চিনির সঙ্গে কোনো দুগ্ধজাত উপকরণ ব্যবহার না করেই চার্নিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয় সরবেট বা শেরবেট–জাতীয় আইসক্রিম। এতে দুধের চর্বির ইমালশন গঠিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে সরবেটকে মসৃণ আর মোলায়েম করা বেশ কঠিন। এতে চিনির ঘনত্বের ফলে বরফের হিমাঙ্ক নেমে আসার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানটি কাজে লাগানো হয়। এতে চিনির শিরার জলীয় অংশ দ্রুত বরফের স্ফটিক তৈরি করতে শুরু করায় দ্রবণের শিরা আরও ঘন হতে থাকে। আর সঙ্গে যদি ফলের পাল্প বা ক্বাথটি আম, পিচ ইত্যাদি ফলের মতো আঁশযুক্ত ও ক্রিমি হয় অথবা স্ট্রবেরির মতো প্রাকৃতিকভাবে জেল তৈরি করতে পারে, তবে তো কথাই নেই। কিন্তু লেবুর রসের মতো অম্লীয় ও তরমুজের মতো পানিসর্বস্ব ফলের সরবেট তৈরি করতে চিনির বেশি ঘন শিরা আর বেশ খানিকটা মুনশিয়ানার প্রয়োজন পড়ে।

আইসক্রিমের আবেদন আসলে শুধু সর্বজনীন নয়, একেবারে বিশ্বজনীন। গরমকালে হিমশীতল আইসক্রিমের তুলনা আর কিছুর সঙ্গেই দেওয়া যায় না। আইসক্রিম প্রিয়জনের মুখে নিমেষেই হাসি ফোটাতে পারে সুলভে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, জন্মদিন বা যেকোনো খুশির খবর আইসক্রিমের সঙ্গে উদ্‌যাপিত হলে যেন খুশি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাই চলুক হিম হিম আইসক্রিমের জাদু, ভরে যাক খুশি সবার জীবনে। 


সূত্র: প্রথম আলো

Saturday, March 27, 2021

মতুয়া সম্প্রদায়

0 comments

মতুয়া হিন্দু ধর্মীয় একটি লোকসম্প্রদায়। যারা নিম্ন বর্ণ হিসেবে বিবেচিত নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে প্রায় ২১০ বছর আগে জন্ম হয় হরিচাঁদ ঠাকুরের, যিনি এই মতুয়া সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করে মতুয়া মতবাদ। 

মতুয়া শব্দটির অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরিনামে যে মেতে থাকে বা মাতোয়ারা হয়, সে-ই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে সেই মতুয়া। অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস, গুরু-দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তিশ্রদ্ধা, হরিনামে রুচি ও প্রেমে নিষ্ঠা আছে যার, সে-ই মতুয়া।

মতুয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী, তাঁরা বৈদিক ক্রিয়া-কর্মে আস্থাশীল নয়। তাদের বিশ্বাস ভক্তিতেই মুক্তি। তাদের সাধন-ভজনের মাধ্যম হচ্ছে নাম সংকীর্তন। মতুয়া সাধন পদ্ধতির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ ও সত্যদর্শন-ই মূল লক্ষ্য। 

মতুয়া ধর্মপ্রচারককে গোঁসাই নামে অভিহিত করা হয়। নারী-পুরুষ যে কেউ এই ধর্মের প্রচার করতে পারেন। মতুয়ারা প্রতি বুধবার একত্রে সমবেত হয়ে হরি স্মরণ করে, একে বলা হয় হরিসভা। সবাই নাম সংকীর্তন করে এবং ভাবের আবেশে কীর্তন করতে করতে অনেক সময় বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। কীর্তনের সময় তাঁরা যে বাদ্যযন্ত্রগুলো ব্যবহার করে, তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কাঁসর, জয়ডঙ্কা, শঙ্খ, শিঙ্গা প্রভৃতি।


 হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। যশোবন্ত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষ্ণবীয় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন তাতে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর পিতা ও পিতার সতীর্থদের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

প্রথম জীবনে হরিচাঁদ ঠাকুর মাঠে গরু চরাতেন। বয়সের সাথে সাথে তিনি কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। তবে অবতারপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে তিনি সক্রিয় হন ভক্তদের মনরক্ষার কাজে। এ সময় সাফলিডাঙ্গা ছেড়ে ওড়াকান্দিতে বসবাস শুরু করেন।   অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি ভক্তদের রোগ থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন কল্যাণসাধন করতেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। হরিভক্তদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়াদের ভক্তি ও হরিচাঁদ ঠাকুরের শক্তি এ দুয়ে মিলে ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে দেশে দেশে পরিচিত হয়ে ওঠে।  

ধর্মযোগী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়াধর্মের মাধ্যমে অবহেলিতদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ শিক্ষা প্রসারে অগ্রাধিকার দেন। শুধু নিজ সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তেলি, মালি, কুম্ভকার, কাপালি, মাহিষ্য সব সম্প্রদায়ের জন্যই কাজ করে গেছেন। কোথাও স্কুল স্থাপিত হলে তার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা। উচ্চবর্ণ যখন সমাজ-অধিপতি ঠিক সে সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর দলিত মানুষের শিক্ষা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে তিনি প্রথম স্কুল স্থাপন করেন।

গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন মূলত দলিত পিছিয়ে পড়া সমাজের পথিকৃৎ। তিনি এই পিছিয়ে পড়া সমাজকে শিক্ষার আলো জ্বেলে অগ্রগামী করেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। এসব দলিত মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন।

কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি। তারা এখনো নৌকায় চড়ে স্কুলে যায় শিক্ষালাভের জন্য। নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, যানবাহন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। এমনকি অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। 

মতুয়া আন্দোলন মূলত ওড়াকান্দি কেন্দ্রিক হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময়ে মতুয়াদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে যায় বলে জানান স্থানীয় মতুয়াদের অনেকে।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের শিষ্যদের বড় একটা অংশ নিয়ে ভারতে চলে যান এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুরনগরে নিজেদের ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডা. সি এস মিড গুরুচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, সারা ভারতবর্ষের প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের মধ্যে তার মতো একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং তেজস্বী মানুষ দেখেননি তিনি। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু। 

Sunday, March 7, 2021

গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত

0 comments

চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত।সীতাকুণ্ড বাজার থেকে গুলিয়াখালি সি বীচের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। অনিন্দ্য সুন্দর গুলিয়াখালি সী বিচ কে সাজাতে প্রকৃতি কোন কার্পন্য করেনি। 

একদিকে দিগন্তজোড়া সাগর জলরাশি আর অন্য দিকে কেওড়া বন এই সাগর সৈকতকে করেছে অনন্য। কেওড়া বনের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের চারিদিকে কেওড়া গাছের শ্বাসমূল লক্ষ করা যায়, এই বন সমুদ্রের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে। 

এখানে পাওয়া যাবে সোয়াম্প ফরেস্ট ও ম্যানগ্রোভ বনের মত পরিবেশ। গুলিয়াখালি সৈকতকে ভিন্নতা দিয়েছে সবুজ গালিচার বিস্তৃত ঘাস। সাগরের পাশে সবুজ ঘাসের উন্মুক্ত প্রান্তর নিশ্চিতভাবেই আপনার চোখ জুড়াবে। 

এইসব নালায় জোয়ারের সময় পানি ভরে উঠে। সাগরের এত ঢেউ বা গর্জন না থাকলেও এই নিরবিলি পরিবেশের গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকত আপনার কাছে ধরা দিবে ভিন্ন ভাবেই। চাইলে জেলেদের বোটে সমুদ্রে ঘুরে আসতে পারেন।

ভ্রমণ স্থানকে ময়লা ফেলে নোংরা করবেন না। নিজে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বেপারে সচেতন হোন এবং অন্যকে সচেতন করার চেষ্টা করুন। জোয়ার ভাটার সময় জেনে নিন। জোয়ারের সময় হলে বীচের কাছে না থাকাই ভালো। পানির ঢেউ যখন বাড়বে বীচ থেকে চলে আসবেন। আর জোয়ারের সময় পানি উঠে নালা গুলো পূর্ণ হয়ে যায়। তখন পারাপার হতে সমস্যা হতে পারে। আর যেহেতু এটা পর্যটক বান্ধব বীচ নয়, তাই সমুদ্রে নামার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।


লেখা: আনিকা তাহসিন

Saturday, March 6, 2021

লোহায় পা কেটে গেলে কী টিটেনাস ইনজেকশন দিতে হয়?

0 comments

 মরচে পড়া লোহায় মরিচার সাথে আরও থাকতে পারে ময়লা আবর্জনা এবং বিভিন্ন ধরণের জীবাণু। এই জীবাণু গুলোই আমাদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।

একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া Clostridium tetani যা সাধারণত মাটি, আবর্জনা ও নোংরা স্থানে পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়ার স্পোর যখন তীক্ষ্ণ পেরেক বা ওইজাতীয় জীবানু বাহিত বস্তু দ্বারা চামড়া ভেদ করে শরীরের মাংসপেশিতে প্রবেশ করে তখন সেগুলো বংশবিস্তারের মাধ্যমে এক প্রকার টক্সিন (tetanospasmin) তৈরি হয়। এ টক্সিন মানবদেহের মোটর নিউরনে আক্রমন করে যা মাংসপেশির সন্ঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে।



সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে পেশী খিঁচুনি ক্রমশ চোয়ালেও পরিলক্ষিত হয়, ফলে এই রোগের একটি সাধারণ নাম হল দাঁতকপাটি । এই রোগের অন্যান্য লক্ষণগুলি হল পেশীর অনমনীয়তা, গিলে খেতে অসুবিধা এবং দেহের অন্যান্য অংশে খিঁচুনি। শরীরের পেছনের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয় বলে পুরো শরীর ধনুকের মতো বেঁকে যায়। এই কারণে এই রোগকে (ধনুঃ + টঙ্কার) ধনুষ্টংকার বলে।

Friday, March 5, 2021

খেজুর রস ও গাছি

0 comments

খেজুরগাছ, শীতের সঙ্গে রয়েছে যার নিবিড় সম্পর্ক। শীতকালে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছ থেকে পাওয়া যায় সুমিষ্ট রস, গুড়। ফল হিসেবেও খেজুরের জুড়ি নেই। শীতের মিষ্টি রোদে খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি খেতে কে না ভালোবাসে?

কিন্তু বর্তমানে খেজুর গাছের কদর নেই। এ গাছকে ঝোপঝাড়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কোথাও-বা ইটভাটার উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শীতকালে গাছিরা আর যান না তার কাছে। দা-কাঁচি, একগাছি রশি, একদণ্ড বাঁশ ও কোমরে ঝোলানো লম্বা-গোল আকৃতির বিশেষ পাত্র (ঠুঙ্গি) নিয়ে গাছে উঠতে দেখা যায় না গাছিদের। শীতের প্রত্যুষে কাঁধে ভার চেপে ঝুলন্ত কলস নিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেলে তাঁদের ছুটতে দেখা যায় না, হাল আমলে। 

কিছুদিন আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার প্রাথমিক কাজগুলো করার হিড়িক পড়ত। গায়ের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দুধারে বা খেতের আল ঘেঁষে শত শত গাছের শীর্ষভাগ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা। ১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করতেন। আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের দণ্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি পেঁচিয়ে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ চাঁছা বা কাটার দারুণ দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না।

দুর্লভ এ ছবি কেবল বইয়ের পাতায়ই শোভা পাচ্ছে। খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে দেখা যায় না মা-চাচিদের রসের বা ভাপা-পুলিপিঠা বানাতে। বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা খেজুরগাছের জন্য সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরেও উল্লেখযোগ্য খেজুরগাছ জন্মে। দেশের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক খেজুরগাছ। হারানো এ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। গাছিদের গাছ কাটার সরঞ্জাম, পোশাক, প্রণোদনা ইত্যাদি প্রদান করার মাধ্যমে তাঁদের এ কাজে উৎসাহিত করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে কৃষকদেরও। তাঁদের উচিত হবে গাছিদের মজুরি বাড়িয়ে দেওয়া। খেজুরগাছ থেকে উৎপাদিত রস ও গুড়ের উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। বন বিভাগ স্বল্প ব্যয়ে রাস্তার পাশে বা ডিভাইডারে বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজার হাজার খেজুরগাছ রোপণ করতে পারে। রক্ষণাবেক্ষণ এবং রস আহরণের জন্য স্থায়ীভাবে গাছি নিয়োগ দিতে পারে তারা। এতে রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে এবং সুযোগ সৃষ্টি হবে অনেক দরিদ্র গাছির কর্মসংস্থানেরও।


 

মাহতাব উদ্দিন প্রাইম স্টার একাডেমির প্রধান শিক্ষক, শ্রীপুর, গাজীপুর

 

Thursday, March 4, 2021

মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডা

0 comments

 মণ্ডা বললেই মনে আসে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডা।

১৯৬ বছর ধরে একটি পরিবারের হাতেই তৈরি হয়ে আসছে মুক্তাগাছার এই মণ্ডা। ওই পরিবারের বাইরের আর কেউ ওই মণ্ডা প্রস্তুতের প্রণালি জানেন না বলে দাবি মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানটির মালিকপক্ষের।

বর্তমান ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌর শহরে গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানটি ১৮২৪ সালে স্থাপিত হয়। তখন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। গোপাল পালের মণ্ডা তাঁকে মুগ্ধ করে। এরপর জমিদারবাড়ির খাবারের তালিকায় জায়গা করে নেয় মণ্ডা। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে উপহার হিসেবে পাঠাতে মণ্ডাকেই বেছে নিয়েছেন জমিদারেরা। জমিদার পরিবারটির মাধ্যমেই মণ্ডার দেশব্যাপী সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা যায়।

গোপাল পাল মারা যান ১৯০৭ সালে। এরপর পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে এ মণ্ডা তৈরি করেন গোপাল পালের বংশধরেরা। এখন পর্যন্ত গোপাল পালের উত্তরসূরিরাই কেবল এই মণ্ডা তৈরি করে থাকেন। মণ্ডার ইতিহাস নিয়ে গোপাল পালের বংশধরদের বের করা পুস্তিকায় বলা হয়েছে, মণ্ডা এক প্রকারের সন্দেশ। শুধু ছানা ও চিনি দিয়ে এটি বানানো হয়। তবে স্বাদের রহস্যটা পাকের (রান্নার) মধ্যে লুকিয়ে আছে, যা বছরের পর বছর ধরে গোপন রাখা হয়েছে।

ওই মণ্ডা তৈরির কৌশল নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যেও রয়েছে অপার কৌতূহল। মণ্ডার দোকানের মালিকেরা নিজেদের দোকানের কর্মচারীদেরও মণ্ডা তৈরির স্থানে যেতে দেন না।

মণ্ডার দোকানটির মালিকদের একজন বলেন, বিভিন্ন সময় দোকানে বসেই এই মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গেলে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁদের তৈরি মণ্ডার স্বাদ নিতে চান। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গেলে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁদের তৈরি মণ্ডার স্বাদ নিতে চান। গত বছর একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য মণ্ডা বানানো হয়। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার সামনেই তাঁদের মণ্ডা বানাতে হয়েছিল। নিরাপত্তার কারণে এ রকম আরও কয়েকবার মণ্ডার গোপনীয়তার ব্যত্যয় হয়েছে।

 

মণ্ডার কৌশল গোপন রাখার ফলে ঐতিহ্যবাহী এ সুস্বাদু খাবার হারিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা মুক্তাগাছার অনেক মানুষের। সে প্রসঙ্গে শিশির পাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মধ্যেও কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। যে কারণে সারা দেশেই মুক্তাগাছার মণ্ডার দোকানের শাখা করার কথা ভাবছেন তাঁরা।

 

এখন অনেকেই মণ্ডার জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন) স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তুলেছেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০১৭ সালেই সে দেশের ব্যবসায়ী মহল থেকে মণ্ডার জিআই স্বীকৃতি নেওয়ার দাবি উঠেছে।

লেখা: কামরান পারভেজ, প্রথম আলো

Wednesday, March 3, 2021

বিলুপ্তির পথে বাংলার গ্রে-হাউন্ড কুকুর

0 comments

 শিকারি গোছের গ্রে-হাউন্ড কুকুর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এর দেহ তিন থেকে চার ফুট লম্বা। কান ও মুখ বেশ লম্বাটে। পেট ছোট হলেও বুকটা চওড়া। লেজটা চিকন ও লম্বা। লেজটি অধিকাংশ সময় দেহের নিচের দিকে সোজা ঝুলে থাকে। খুব একটা বাঁকা করে না। হালকা–পাতলা গড়নের এই কুকুরের পা ও পায়ের নখ লম্বা। বাদামি রঙের চোখ দুটি বড় বড়।

শুধু আকৃতি বা দৈহিক গঠনের দিক থেকে গ্রে-হাউন্ড অন্যান্য কুকুরের চেয়ে আলাদা তা নয়। আচরণের দিক থেকেও আলাদা। হাঁটাচলা বা দৌড় দেওয়ার ভঙ্গিট ভিন্ন। ঘুমের অভ্যাসের মধ্যেও আছে ভিন্নতা। শুধু ঘ্রাণশক্তি নয়, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির মাধ্যমে শিকার ধরা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্রুতগামী কুকুরটি অন্যান্য কুকুরের মতো আহ্লাদী হলেও অপরিচিতদের আদর তার পছন্দ নয়। দিনেরবেলা ঘেউ ঘেউ করা তার স্বভাব না হলেও রাতের ঘেউ ঘেউ শব্দে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি প্রভুর বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারে না। প্রভুভক্ত শান্ত কুকুরটি শত্রুর জন্য খুবই হিংস্র ও ভয়ংকর। দিনে-রাতে মালিকের বাড়ি নিরাপত্তায় জুড়ি মেলা ভার। চোর, ডাকাত এ কুকুরের নাম শুনলে আঁতকে ওঠে।

আরামপ্রিয় কুকুরগুলো প্রতিদিন অল্প পরিমাণ খেলেও তাদের খুব ভালো মানের খাবার দিতে হয়। প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন কুকুরটির খাদ্যতালিকায় আছে দুধ-ভাত ও মাংস। এদের জীবনকাল এক যুগ হয়ে থাকে।

একসময় শীতকালে এখানে গ্রে-হাউন্ড কুকুর দিয়ে বনজঙ্গল ঘেরাও করে ছোট বাঘ, গাছি খাটাশ, শিয়াল, বাগডাশ, বন খাটাশ, বনবিড়াল ইত্যাদি বন্য প্রাণী শিকার করা হতো। 

 

একসময় জাতীয় চিড়িয়াখানায়ও দেখা যেত গ্রে-হাউন্ড কুকুর। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই অতীত। তবে কয়েক বছর আগে র‌্যাব সদস্যরা বেশ কয়েকটি হাউন্ড কুকুর এখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পরে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

 


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর বেশ নামকরা। এই জাতের কুকুর পোষা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে, যা লালন-পালন যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সরাইলের ঐতিহ্য হিসেবেও পরিচিত গ্রে-হাউন্ড। তবে এ ধরনের কুকুর পালন অনেক কমে গেছে।

কথিত আছে, একবার সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেব থেকে ওই কুকুরটি (মাদি-স্ত্রী জাতের) নিয়ে আসেন।দেওয়ান একদিন হাতির পিঠে চড়ে বনে শিকারে বের হয়েছিলেন। একপর্যায়ে মাদি কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর গর্ভবতী হয়ে কুকুরটি ফিরে আসে। কদিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি বাচ্চা দেয়। দেখা গেল, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বাঘের বেশ মিল আছে। ধারণা করা হয়, নেকড়ের সঙ্গে দেওয়ানের কুকুরের মিলন থেকে ওই বাচ্চাগুলোর জন্ম হয়েছে।

উন্নত বিশ্বে দিন দিন বিরল প্রজাতির কুকুরের কদর বাড়লেও সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। সরাইলের হাউন্ড কুকুর এখন এক দুর্লভ হয়ে গেছে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই জাতের কুকুর লালন-পালন করে আসছে। কারণ, এ ধরনের কুকুর পোষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

১৯৮৩ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উপজেলা সদরে একটি গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে উপযুক্ত চিকিৎসা, সুষ্ঠু পরিচালনা ও আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক বছর পরই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা সদরের বড়দেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ঠাকুর ২০০১ সালে সরাইলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্যোগটিও টেকেনি।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী সরাইলের বিরল প্রজাতির মূল্যবান গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের কাছে সরাইলের কুকুরের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি আরও বলেন, এখনো সরাইলে ৮-১০টি গ্রে-হাউন্ড কুকুর আছে। তা–ও আবার ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ সংকর জাতের হয়ে গেছে। এগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর।

 লেখা: বদর উদ্দিন, প্রথম আলো

Tuesday, March 2, 2021

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপিঠা

0 comments

 

খড়ের আগুনে বাঁশের ভেতর আতপ চালের গুঁড়ি সেদ্ধ হয়ে তৈরি হয় লম্বাটে সাদা পিঠা। চুঙ্গার ভেতরে তৈরি বলে এর নাম চুঙ্গাপিঠা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শীত মৌসুমে ভাপা, পুলি আর মালপোয়া পিঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিঠা উৎসব মাতালেও এর দেখা পাওয়া এখন দুষ্কর।


একসময় বাড়িতে জামাই এলে এই চুঙ্গাপিঠার সঙ্গে হালকা মসলায় ভাজা মাছ, নারকেল, কুমড়ার মিঠা বা রিসা পরিবেশন করা ছিল রেওয়াজ। রাতভর চলত চুঙ্গাপুড়ার কাজ। গিট্টু (ভাঁজ) মেপে ছোট ছোট করে কাটা বাঁশের ওপর জ্বলত খড়ের আগুন। কালের পরিক্রমায় সেই পিঠা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

পৌষ ও মাঘের শীতের রাতে বৃহত্তর সিলেটের গ্রামে গ্রামে চুঙ্গাপিঠা তৈরির ধুম পড়ে। আগে চুঙ্গাপিঠা তৈরির সময় সঙ্গে থাকত গান, পুথিপাঠ, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুকসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। এখন এসব পরিবেশনা না থাকলেও রয়েছে শীতের রাতে খড়ের আগুনে চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রচলন।  

ঐতিহ্যবাহী এই পিঠা বানাতে ঢলু নামে যে বিশেষ প্রজাতির বাঁশ দরকার হয়, তা বিলুপ্ত হতে বসেছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন আর পাহাড় উজাড়ের কারণে ঢলু বাঁশ এখন সহজে পাওয়াই মুশকিল। শীতকালে কালেভদ্রে দেখা মেলে ঢলু বাঁশের। এ বাঁশে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে বলে সহজে আগুনে পোড়ে না। ক্রমাগত তৈলাক্ত তরল নিঃসরণ করে টিকে থাকে সরু বাঁশের সবুজ শরীর। এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগুনে পোড়ার পরও সবুজই থাকে ঢলু বাঁশ। কিন্তু আগুনের ভাপে চোঙ্গার ভেতরে ঠিকই তৈরি হয়ে যায় চুঙ্গাপিঠা।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ডালরুটি

0 comments

 বাংলাদেশের খাদ্যসংস্কৃতিতে পুরান ঢাকার খাবারের আলাদা একটি স্থান আছে। মোগলাই খাবারের সঙ্গে দেশি খাবারের সংমিশ্রণ কিংবা মোগলাই খাবারের দেশি সংস্করণের জন্য পুরান ঢাকা বিখ্যাত। ডালরুটি পুরান ঢাকার সে রকম ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম। তবে এখন বিভিন্ন কারণে ঢাকার আদি খাবারগুলোর মধ্যে এটি টিকে আছে কোনোভাবে।

 


পুরান ঢাকার মানুষ মনে করেন, বিকেলের নাশতায় নানা রকম তেলে ভাজা খাবারের চেয়ে এটি ভালো এবং মুখরোচক। তাই এটি ছিল ঢাকাবাসীর জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। লোকমুখে জানা যায়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পুরান ঢাকায় এই ডালরুটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এটি তেল ছাড়া তৈরি বিশেষ একধরনের রুটি। একসময় এ রুটির এতটাই কদর ছিল যে পুরান ঢাকার মানুষ বিকেলের নাশতা হিসেবে এটি খেতে পছন্দ করতেন। তবে এখন কালের বিবর্তনে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকা থেকে স্বাস্থ্যকর এই খাবার হারাতে বসেছে।

 

এ খাবারের আদি উৎস কোথায়, সেটা জানা যায় না। অনেকেই মনে করেন, এটি ভারতীয় খাবার। আবার কেউ মনে করেন এটির জন্ম বাংলাদেশেই, বিশেষ করে ঢাকায়। অবশ্য সাতক্ষীরা-বাগেরহাট অঞ্চলে এ রকম খাবার এখনো খাওয়ার চল আছে বলে জানা যায়। খুবই অল্প খরচে সহজলভ্য উপাদানে তৈরি এই খাবার তৈরি করা যায়। খাবারটি শরীরে প্রয়োজনীয় শর্করা ও আমিষের অভাব পূরণ করে এবং দ্রুত শক্তি জোগাতে পারে বলে জানা যায়। এ কারণে শ্রমজীবী মানুষের কাছে ডালের রুটির কদর ছিল এবং আছে। মুখরোচক এ খাবার পুরান ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মধ্যে গরুর, মুরগি কিংবা হাঁসের মাংসের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন ছিল বলে জানা যায় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে।

পুরান ঢাকায় দোকানিরা মূলত ঘরে বসেই ডালরুটি তৈরি করেন। এরপর বাড়ির সামনে বা রাস্তার পাশে ডালরুটির পসরা সাজিয়ে বসেন। ক্রেতাদের সামনে দোকানিরা তাওয়ায় সেঁকে বিক্রি করেন এ রুটি। আকারে কিছুটা ছোট, বড় হলেও প্রতিটি রুটি এখন বিক্রি হয় ১০ টাকা করে। শীতকালে এ রুটির চাহিদা বেড়ে যায়। যাঁদের জন্য তৈলাক্ত খাবার খাওয়া একেবারে নিষেধ, তাঁদের জন্য ডালরুটি খুব ভালো খাবার হিসেবে পরিচিত দীর্ঘদিন ধরে।

কয়েক বছর আগেও পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় এ রুটির দেখা মিলত। তবে এখন মাত্র অল্প কিছু জায়গায় ডালরুটির দোকান বসে। নগরীর রায়সাহেবের বাজার, জিন্দাবাহার, নয়াবাজার, কসাইটুলি, বংশাল, আগামসি লেন, নারিন্দা, সূত্রাপুরসহ কয়েকটি এলাকায় পাওয়া যায় ডালরুটি। এসব এলাকায় পিঠা ব্যবসায়ীরা কয়েক পুরুষ ধরে এটি তৈরি করে আসছেন। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পিঠা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলো ডালরুটি বানানো ছেড়ে দিচ্ছেন। এসব পরিবার থেকে আর নতুন করে ছেলেমেয়েরা চাইছে না রাস্তায় বসে এই ডালরুটি বিক্রির ব্যবসায় আসতে।

 লেখা: হাসান রাজা, প্রথম আলো

Monday, March 1, 2021

বড়ি'র কথা

0 comments

 ডাল বা কুমড়োর বড়ি মূলত সংরক্ষণযোগ্য খাদ্য উপাদান। বড়ি বানিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে কাচের বয়ামে পুরে বছরভর খাওয়া যায়।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে গ্রামে গ্রামে বড়ি দেওয়ার দৃশ্য ছিল নিয়মিত। শীত এলেই মাষকলাইয়ের বড়ি বানিয়ে সে বড়িকে খোলা জায়গায় নরম রোদে শুকাতে দেওয়ার দৃশ্য খুব একটা ধূসর হয়নি এখনো। কিন্তু বড়ি দেওয়ার সে চলই এখন সীমিত হয়ে গেছে।  


 

নাম যেহেতু ডালের বড়ি, তাই এর মূল উপাদান যে ডাল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মাষকলাই, মসুর এবং মটর ডাল ব্যবহার করা হয় এটি তৈরি করতে। সারা রাত ডাল ভিজিয়ে রেখে পরদিন পানি ঝরিয়ে সকালবেলা পাথরের জাঁতায় পিষে লেই তৈরি করে তারপর দেওয়া হয় বড়ি। তবে ব্যাপারটি সহজ নয়। পাটায় বা জাঁতায় মিহি করে বেটে নিয়ে খুব ভালোভাবে ফেটিয়ে নিতে হয় ডালের লেই। দীর্ঘ সময় ধরে ভালোভাবে ফেটানোর ওপরই নির্ভর করে বড়ির গুণগত মান। বলা হয়ে থাকে যে ডালের লেই ফেটানোর পর তাতে বাতাস থাকা যাবে না কোনোভাবেই। বাতাসহীন লেই হলেই কেবল সুস্বাদু বড়ি পাওয়া যাবে। কোনোভাবে লেইয়ে বাতাস থেকে গেলে বড়ি কিছুটা তিতা হবে। মটর ডালের চাষ আমাদের দেশে এখন একেবারেই কম। তাই বড়ি বানাতে এখন ব্যবহার করা হয় মাষকলাই ও মসুর ডাল। তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাষকলাইয়ের ডাল দিয়েই বহুলভাবে তৈরি করা হয় বড়ি।

আমাদের দেশের সব অঞ্চলে ডালের বড়ি বানানো হয় না। ঢাকার বিক্রমপুর-মানিকগঞ্জ অঞ্চল, যশোর-খুলনা অঞ্চল, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে ডালের বড়ি বানানোর প্রচলন আছে, যদিও তার পরিমাণ এখন কমে এসেছে। এগুলো ছাড়াও কিছু অঞ্চলে ডালের বড়ি বানানো হয় বটে। কিন্তু সেটা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে প্রায় পুরো দেশেই এখন কমবেশি খাওয়া হয় ডালের বড়ি।

শুধু ডাল দিয়ে বানানো বড়ি ডালের বড়ি এবং ডালের লেইয়ের সঙ্গে চালকুমড়ার মিহি কুচি মিশিয়ে বানানো বড়ি কুমড়ো বড়ি নামে পরিচিত। উত্তরবঙ্গে এই বড়ি বানানোর চল বেশি। এই খাবারগুলো আবহমানকাল ধরে আমাদের রসনাবিলাসী মনকে তৃপ্ত করে আসছে।

ছোট ও বড়—এ দুই আকৃতির হয়ে থাকে ডালের বড়ি। আকারভেদে এর রান্নাও ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের ডালের বড়ি সাধারণত ভর্তা বা ভাজা খাওয়ার জন্যই ব্যবহার করা হয়। এটা যে অন্য তরকারিতে দিয়ে খাওয়া হয় না, তা নয়। তবে বড় আকৃতির বড়ি দিয়েই তরকারি খাওয়াটা সাধারণভাবে প্রচলিত।

মূলত নিরামিষ তরকারির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে বড়ি। এটি কোনো একক উপাদান হিসেবে তরকারিতে ব্যবহার করা হয় না। সুক্তো, সবজির ঘন্ট, ভাজা, ঝোল এবং অম্বল বা টক—এ ধরনের খাবারে অন্যান্য সবজির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয় বড়ি, তা সেটা কুমড়ো বড়ি হোক অথবা ডালের বড়ি।

 

 লেখা: রজত কান্তি রায়, প্রথম আলো

সমুচা যেভাবে এলো বাংলায়

0 comments

 দশম শতকের ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বেহাগি তাঁর তারিখ-ই-বেহাগি নামের বইয়ে প্রথম ‘সাম্বুসাক’ খাবারটির উল্লেখ করেন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫) তেরো শতকের ভারতবর্ষীয় সুলতানদের খাবার টেবিলে দেখেছিলেন মাংসের পুর ভরা সামুসাক। সামুসাক বা সাম্বুসাক বা সামোসায়, সোজা বাংলায় আমরা যাকে সমুচা নামে চিনি। চলিত বাংলায় এ খাবারকে ছামুচা (সামুচা) বলেও ডাকা হয়।


পর্তুগিজরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে আলুর চাষ শুরু করে ১৭ শতকে। ধারণা করা হয়, সে সময় ভারতের পশ্চিম উপকূলের নিরামিষাশী মানুষ মাংসের পুরের বদলে আলু দিয়ে সমুচা বানানো শুরু করে। এতে সমুচার আসল আকার কিছুটা বদলে যায়। সেই থেকে আলুর পুর ভরা সমুচা হয়ে যায় শিঙাড়া। পরে এটি বিভিন্ন কারণে বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

লেখা:রজত কান্তি রায়, প্রথম আলো

শিঙাড়া’র ইতিকথা

0 comments

খাদ্য বিশারদদের মধ্যে একশ্রেণির ধারণা, শিঙাড়ার জন্ম মধ্যপ্রাচ্যে। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, এটি ইরানের খোরাসান অঞ্চলের খাবার। আবার কারও মতে, এটি তুর্কি খাবার। পরে যা ইরানে চলে যায়।

এই খাবারটি এসেছে অন্য দেশ থেকে। এখনো শিঙারার জনপ্রিয়তা অটুট। সকালে কিংবা বিকালে চায়ের সঙ্গে খা্ওয়া হয় নানা স্বাদের শিঙারা।

হিন্দিতে পানিফলের নাম শিঙাড়া। পানিফলের সঙ্গে শিঙাড়ার আকৃতিগত মিলের জন্য একে শিঙাড়া নামে ডাকা হয়।

শিঙাড়ার শিং থাকে তিনটি। তবে শিং ভেঙে দিলে হাতে থাকে আলু। কিন্তু কী আশ্চর্য, আলুর সঙ্গে থাকে আরও কত কী? থাকছে ফুলকপি, চিনাবাদাম, গরু বা খাসির কলিজা কিংবা মাংসের পুর! অবাক হই না। কারণ, খেতে ভালোই লাগে। বাঙালির হেঁশেলে ঢুকে কোন খাবারটি তার স্বরূপ ধরে রাখতে পেরেছে? এমন যে পরাক্রমশালী মোগল, কূটনীতিতে পোক্ত ইংরেজ, যুদ্ধবাজ ডাচ, নাক উঁচু ফরাসি তাদের সবাইকে পরাজিত করেছে আমাদের হেঁশেলের মানুষেরা—মসলা, তেল আর লবণে মেখে কষিয়ে কষিয়ে। সেখানে শিঙাড়ায় আলুর সঙ্গে ফুলকপি, চিনাবাদাম, কলিজা কিংবা মাংসের পুর জায়গা করে নেবে, সেটা ছিল বিধিলিপি।

আলুর পুর দিয়ে শিঙ্গাড়া বানানোই আদি নিয়ম।  কিন্তু শীতে আলুর সঙ্গে ফুলকপির ফুল আর তাজা ধনেপাতা কষিয়ে পুর বানিয়ে শিঙাড়া বানানো হয়।

 

লেখা:রজত কান্তি রায়, প্রথম আলো