Saturday, September 26, 2009

সোনা-রুপা দিলে মুদ্রা তৈরি করে দিত ঢাকার টাঁকশাল

0 comments
লিখেছেন আশীষ-উর-রহমান



টাঁকশাল স্থাপন মুঘল আমলে শহরের মর্যাদা বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। টাঁকশাল হলো টাকা তৈরির কারখানা। ঢাকাকে রাজধানী করার পর এখানে একটি টাঁকশাল স্থাপন করেছিলেন মুঘল শাসকেরা। বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার কোনো এক জায়গায় ছিল এর অবস্থান।
সে সময় স্থানীয় মুদ্রা বিদেশি বণিকদের কাছে পর্যাপ্ত থাকত না। ইউরোপীয় বড় বণিক, কোম্পানি বা অন্যান্য বিদেশি ব্যবসায়ী আসতেন সোনা বা রুপা নিয়ে। তাঁরা সেসব সোনা-রুপা দিয়ে এই টাঁকশাল থেকে বিভিন্ন মানের স্থানীয় মুদ্রা তৈরি করিয়ে নিতেন কেনাকাটার জন্য। এ জন্য অবশ্য টাঁকশালকে শতকরা সাড়ে তিন ভাগ শুল্ক দিতে হতো তাঁদের।
ঢাকার টাঁকশাল প্রতিষ্ঠার সঠিক সন-তারিখ অজানা। সুবেদার ইসলাম খান ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের পর শহরের নামকরণ করেছিলেন তাঁর প্রিয় সম্রাটের নামানুসারে জাহাঙ্গীরনগর। ইসলাম খানের সময়ই, না এর পরে টাঁকশালটি স্থাপন করা হয়েছিল, তেমন কোনো প্রমাণ ঐতিহাসিকেরা পাননি। অধ্যাপক আবদুল করিম তাঁর ঢাকা: দ্য মুঘল ক্যাপিটাল বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ঢাকার টাঁকশালের সবচেয়ে পুরোনো যে মুদ্রাটি পাওয়া গেছে, তা হিজরি ১০২৬ সনের; ইংরেজি ১৬১৭ সালের। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষাবধি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পরও ঢাকার টাঁকশাল চালু ছিল। তিনি জানিয়েছেন, আঠারো শতকের দিকে টাঁকশালে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাও ছিল।


কোথায় ছিল টাঁকশাল: ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেন, ঢাকার বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় ছিল টাঁকশালের অবস্থান। তবে ঠিক কোন জায়গায় এটি ছিল, তা চিহ্নিত করা যায়নি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ঢাকা: স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে ঢাকার কালেক্টর র্যাংকিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, চকবাজারের পুরোনো দুর্গের মধ্যে তখন ছিল পাগলাগারদ। এর আশপাশেই তিনি মুঘল আমলের টাঁকশালটির জরাজীর্ণ ভিত্তিটি হয়তো দেখে থাকবেন। পাগলাগারদের পাশেই ছিল একটি পুকুর। পাগলাগারদের কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন। র্যাংকিন ঢাকায় এসেছিলেন ১৯২০ সালে। এ সময় পুকুরটির পাশে আগা মেহেন্দী টাঁকশালীর বাড়ি ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মুনতাসীর মামুনের অনুমান, আগা মেহেন্দী হয়তো কখনো টাঁকশালের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বলেই তাঁর টাঁকশালী উপাধি।
টাকার হাট: টাঁকশাল ছাড়া ঢাকায় টাকার হাটও ছিল মুঘল আমলে। নবাবপুর এলাকায় ছিল এই হাট ও মহাজনপুর নামের দুটি বসতি। টাকার হাটে সোনা-রুপার বদলে টাকা দেওয়া, বন্ধকি ও ঋণ দেওয়ার ব্যবসা চলত। যাঁরা এসব ব্যবসা করতেন তাঁরাই থাকতেন পাশের মহাজনপুরে। নাজির হোসেন তাঁর কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে টাকার হাট ও মহাজনপুরের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, মুঘল আমলের শেষদিকে নবাবপুরে এই এলাকা গড়ে উঠেছিল এবং কোম্পানির আমলেও টাকার হাটের ব্যবসা চলত।
আরও টাঁকশাল: মুঘলদের আগেও বাংলায় টাঁকশাল ছিল। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে এখানে টাঁকশাল স্থাপিত হতে থাকে। বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজধানীসহ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক শহরগুলোতে মুদ্রা তৈরি শুরু হয়।’ সে সময়ের টাঁকশালগুলোর দীর্ঘ তালিকা আছে বাংলাপিডিয়ায়। বাংলার আদি টাঁকশালটি অবশ্য ছিল গঙ্গার পশ্চিম তীরে রাজধানী লক্ষ্নৌতে। এখানে পাওয়া প্রথম রৌপ্যমুদ্রাটি ১২৩৬ সালের। সুলতান জালালুদ্দিন বাজিয়ারের সময় টাঁকশালটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহর সময় ১৩২২ সালে টাঁকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোনারগাঁয়ে। ব্রহ্মপুত্র নদের বিপরীতে সোনারগাঁর ১২ মাইল উত্তরে তখনকার মুয়াজ্জামাবাদে সিকান্দার শাহর সময় টাঁকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৩৯৫ সালে। ফরিদপুরের নাম ছিল তখন ফতেহাবাদ, এখানে ১৪৩৬ সালে টাঁকশাল স্থাপন করেন রুকনুদ্দিন বরবক। জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ চাটগাঁওয়ের টাঁকশালটি করেছিলেন ১৪১৫ সালে (মুঘল আমলে সুবেদার শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামের নাম বদলে রেখেছিলেন ইসলামাবাদ)। যশোরের উত্তর-পূর্ব এলাকায় ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে একটি টাঁকশাল স্থাপিত হয়েছিল ১৪৫৪ সালে নাসিরউদ্দিন শাহর আমলে। এলাকাটির নাম ছিল মাহমুদাবাদ। পশ্চিম দিনাজপুর অঞ্চলকে তখন বলা হতো বারবকাবাদ। এখানে ১৪৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল টাঁকশাল। বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকা নিয়ে ১৪৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নুসরতাবাদ টাঁকশাল। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ।
প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক প্রথম আলো" পত্রিকায়।

0 comments:

Post a Comment