Friday, September 26, 2025

বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসা ও ইসরায়েলি দখলনীতি

0 comments

ইসরায়েলি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি সম্প্রসারণকে আন্তর্জাতিক আইন অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবুও পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান মালভূমিতে বসতি গড়ে তোলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায় ১৫৮টি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কোম্পানির নাম এসেছে, যারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এসব অবৈধ বসতি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত। এ তালিকায় রয়েছে বিশ্বের পরিচিত ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম, নির্মাণ কোম্পানি, ভোক্তা পণ্যের ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে বহুজাতিক খাদ্যচেইন পর্যন্ত।

ভ্রমণ ও পর্যটন প্ল্যাটফর্ম

Airbnb, Booking.com, Expedia ও TripAdvisor-এর মতো জনপ্রিয় অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের বসতিগুলিতে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্রের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা অবৈধ বসতিগুলোতে যাওয়া ও থাকা সহজ হয়েছে, ফলে বসতিগুলোর অর্থনীতি ও বৈধতার ভাবমূর্তি শক্তিশালী হয়েছে।

অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠান

ইউরোপীয় ও ইসরায়েলি বেশ কয়েকটি কোম্পানি সরাসরি বসতি নির্মাণে যুক্ত থাকার অভিযোগে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে Heidelberg Materials AG (জার্মানি), Steconfer (পর্তুগাল), Ineco (স্পেন), Alstom (ফ্রান্স), Egis (ফ্রান্স) এবং Electra Group Ltd. (ইসরায়েল)। এরা সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করেছে, যা দখলকৃত ভূখণ্ডে বসতি টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।

স্থানীয় বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়িক গ্রুপ

Export Investment Company Ltd., Hadar Group, Hamat Group Ltd., Kardan N.V., এবং Mayer’s Cars and Trucks Co. Ltd. সরাসরি বসতি অঞ্চলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করেছে বলে জাতিসংঘের তালিকায় উল্লেখ আছে। তাদের কার্যক্রম বসতির অর্থনৈতিক টেকসই কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।

বহুজাতিক ভোক্তা পণ্যের ব্র্যান্ড

ইসরায়েলের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছে কোকা-কোলা ও পেপসিকো। সমালোচকদের মতে, এসব কোম্পানির স্থানীয় উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলি অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে, যা দখলনীতিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। বিশেষত পেপসিকোর মালিকানাধীন সোডাস্ট্রিম আগে পশ্চিম তীরের একটি বসতিতে কারখানা পরিচালনা করত, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পরে নেগেভে সরিয়ে নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক খাদ্যচেইন

জাতিসংঘের তালিকায় উল্লেখিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুড ব্র্যান্ড KFC। অভিযোগ উঠেছে, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো বসতি অঞ্চলে ব্যবসা চালিয়েছে, যা অর্থনৈতিকভাবে বসতিগুলোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও নিরাপত্তা সেবা

এছাড়াও পূর্ববর্তী সময়ে সমালোচিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাটারপিলার (বুলডোজার দিয়ে বসতি নির্মাণ ও ঘরবাড়ি ভাঙচুরে ব্যবহারের অভিযোগ), হিউলেট-প্যাকার্ড (HP) (চেকপয়েন্ট ও নজরদারি সিস্টেমে প্রযুক্তি সরবরাহের অভিযোগ) এবং ব্রিটিশ নিরাপত্তা কোম্পানি জি৪এস (কারাগার ও নিরাপত্তা সেবা সরবরাহের অভিযোগ)।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের প্রকাশিত এই তালিকা প্রকাশের পর মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, এই কোম্পানিগুলো বসতি কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতার ছাপ দিচ্ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখছে। এ কারণে BDS (Boycott, Divestment and Sanctions) আন্দোলন এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক বয়কটের ডাক দিয়েছে। ইতোমধ্যেই কিছু আন্তর্জাতিক তহবিল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে।

কোম্পানিগুলোর অবস্থান

অভিযোগের মুখে অধিকাংশ কোম্পানি বলে আসছে, তারা কেবল ব্যবসায়িক ও স্থানীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করছে। রাজনৈতিক ইস্যুতে কোনো অবস্থান নেয় না। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী কর্মকাণ্ডে অংশীদার হয়ে উঠছে।

   

বহুজাতিক কোম্পানি ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক: অভিযোগ, প্রমাণ ও কোম্পানির প্রতিক্রিয়া

এই প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে কেন কিছু বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে — বিশেষভাবে যে অভিযোগগুলো বাণিজ্যিক কার্যক্রম, সরবরাহ বা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বসতি-চলাচলে বা নির্ধারিত সামরিক/প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। আরেকটি লক্ষ্য হলো কোম্পানিগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া করেছে—সংক্ষিপ্ত উদাহরণ ও উৎসসহ।

সংক্ষিপ্ত সারমর্ম

জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা এবং সিভিল সোসাইটি অনেক বছর ধরে বিভিন্ন কোম্পানির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অভিযোগগুলোর ধরন মূলত তিনটি: (১) অর্থনৈতিকভাবে বসতি ও নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা, (২) প্রযুক্তি/সেবার মাধ্যমে প্রশাসনিক বা নিরাপত্তা প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা, এবং (৩) প্ল্যাটফর্ম বা পরিষেবা দিয়ে বসতিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাভাবিক/বাণিজ্যিকভাবে উপস্থিত করা। নিচে প্রধান কোম্পানিগুলো নিয়ে টেবিল ও বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হলো।

কোম্পানি বনাম অভিযোগ — সংক্ষিপ্ত টেবিল

কোম্পানি প্রধান অভিযোগ / কীভাবে "সহায়তা" করছে বলে বলা হয় উদাহরণ / ঘটনার ইঙ্গিত কোম্পানির প্রতিক্রিয়া / পরিণতি
Coca-Cola (কোকা-কোলা) ইসরায়েলি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও বটলিং/লোকাল অপারেশন দিয়ে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক শক্তি প্রদান—যা বাল্কভাবে বসতি/একের পক্ষের নীতিকে সহায়তা করে বলে সমালোচনা। ইসরায়েলে স্থানীয় বটলার/পার্টনারের মাধ্যমে দীর্ঘকালীন উপস্থিতি; BDS আন্দোলন কোম্পানিটিকে বয়কট তালিকাভুক্ত করেছে। কোম্পানি সাধারণত বলে যে তারা মানবাধিকার নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; সার্বিকভাবে ব্যবসা বজায় রেখেছে, কিন্তু গ্রাহক-চাপে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
PepsiCo / SodaStream SodaStream-এর কারখানা পূর্বে পশ্চিম তীরে (অবৈধ বসতিসংলগ্ন এলাকা) অবস্থিত ছিল—সরাসরি বসতি-অর্থনীতিকে সাহায্য করতো। SodaStream-এর কারখানা বসতিতে থাকার কারণে আন্তর্জাতিক চাপ এবং বয়কট শুরু হয়; পরে কোম্পানি কারখানা স্থানান্তর করে। সোডাস্ট্রিম কারখানা সরিয়েছে; PepsiCo-র অধিগ্রহণের পরও রাজনৈতিক ও এথিক্যাল প্রশ্ন রয়ে গেছে।
Caterpillar সামরিক/নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বড় বুলডোজার (D9 ইত্যাদি) বসতি সম্প্রসারণ ও বাড়ি ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ—ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি অবদান। Human Rights Watch ও অন্যান্য রিপোর্টে এমন ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে; কিছু বিনিয়োগকারী কেটারপিলার থেকে বেরিয়ে গেছে। Caterpillar সাধারণত বলে যে তারা সরকারি চাহিদা ও রপ্তানি নিয়ম মেনে চলে; কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি দিক থেকে চাপ গিয়েছে।
Hewlett-Packard (HP) আইটি/নজরদারি/ডেটা সিস্টেম সরবরাহ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচয় যাচাই-প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার অভিযোগ। কয়েকটি তদন্ত রিপোর্ট HP-এর সরবরাহ ও সিস্টেমের ব্যবহার আলোচ্য করেছে; কিছু শিক্ষা/ধর্মীয় বিনিয়োগকারী ডিভেস্টমেন্ট করেছে। HP বলেছে তারা আইনি ও কনট্রাকচুয়াল দায়িত্ব মেনে চলে; তবু কিছু প্রতিষ্ঠান নীতি-চাপে ডিভেস্টমেন্ট করেছে।
G4S (প্রাইভেট সিকিউরিটি) প্রাইভেট সিকিউরিটি সেবা দিয়ে সীমান্ত/নিরাপত্তা কার্যক্রমে অংশ—মানবাধিকার গ্রুপ গুলোর অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। চাপের পর G4S কিছু ব্যবসায়িক অংশ বিক্রি/স্থগিত করেছে; এটি অনেকেই অ্যাকটিভিস্টদের সফলতা বলে দেখেন। কিছু অপারেশন বিক্রি বা বদল করেছে; পুরো প্রত্যাহার আংশিক ও বিতর্কিত।

নোট: উল্লিখিত টেবিলটি সারসংক্ষেপ—প্রতিটি লাইনের পেছনে সময়ভিত্তিক রিপোর্ট, তদন্ত ও সংবাদ কভারেজ রয়েছে। বিস্তারিত টাইমলাইন ও উৎস-ডকুমেন্ট যোগ করলে প্রতিটি কোম্পানির প্রতিক্রিয়া ও আইনি/কর্পোরেট কাগজপত্র আরও স্পষ্ট হবে।

১) অভিযোগের প্রকৃতি

বহুজাতিক কোম্পানিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, তা মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
  1. অর্থনৈতিক সহায়তা: সরাসরি বিনিয়োগ, স্থানীয় পার্টনারশিপ বা কারখানা–এবং সেই এলাকায় কর্মসংস্থান বসতির আর্থিক সংকট দূর করে।
  2. প্রযুক্তি ও সেবা সরবরাহ: নিরাপত্তা, পরিচয় যাচাই, নজরদারি বা प्रशासनিক সফটওয়্যার সরবরাহ করলে দখলকৃত অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে।
  3. প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বাভাবিকীকরণ: বুকিং/ট্যুর/রিয়েল এস্টেট প্ল্যাটফর্ম বসতিগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যটন-গন্তব্য হিসেবে দেখালে তা একটি দৃষ্টান্তিক বৈধতা দেয়।

২) কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া ও করণীয়

বেশিরভাগ কোম্পানি দাবি করে যে তারা স্থানীয় আইন, আন্তর্জাতিক রপ্তানি/অপারেশন নিয়ম ও কর্পোরেট নীতিমালা মেনে কাজ করে। অনেক সময় তারা বলে থাকে যে মানবাধিকার রক্ষা তাদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং তারা নিরপেক্ষ ব্যবসায়িক ভূমিকায় রয়েছে। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ বা স্থানান্তর করে—যেমন SodaStream-এর কারখানা সরানো—তাতে BDS-ধর্মী আন্দোলনগুলোকে একধরনের বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছে।

৩) প্রভাব এবং রাজনৈতিক/সামাজিক প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিকভাবে কিছু সরকার, পেনশন ফান্ড ও ইথিকাল বিনিয়োগকারী কোম্পানি বা সেক্টর থেকে ডিভেস্টমেন্ট করেছে। মানবাধিকার গ্রুপ ও রিসার্চ আইটেমগুলো (যেমন WhoProfits, Human Rights Watch) কোম্পানিগুলোকে নজরে রেখেছে এবং জাতিসংঘ নিজেও কিছু পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক তালিকা বা ডাটাবেস আপডেট করেছে — যা কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে।

উপসংহার

কিসে ‘সহায়তা’ হয়ে থাকে—সে প্রশ্নে জবাব সরল নয়। সরাসরি অস্ত্র বা ট্যাকটিক্যাল সাপোর্ট না দিয়েও অর্থনীতি, সেবা ও প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে একধরনের সহায়তা এবং বৈধতা প্রদান করা যায়। এই কারণেই সিভিল সোসাইটি, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো কর্পোরেট আচরণ, সরবরাহ শৃঙ্খল ও স্থানীয় কার্যক্রম বিশ্লেষণ করছে এবং কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে।
সূত্র (বাছাইকৃত অনলাইন রেফারেন্স — পড়ার সুবিধার্থে):
  • UN Human Rights — business & Israeli settlements database / related press releases (ohchr.org)
  • Reuters — সরাসরি সংবাদের কভারেজ ও UN ডাটাবেস রিপোর্ট (reuters.com)
  • Associated Press (AP) — Sodastream / corporate controversies (apnews.com)
  • Human Rights Watch — বিভিন্ন কোম্পানি ও কেস স্টাডি (hrw.org)
  • WhoProfits, BDS ও Ethical Consumer — কর্পোরেট সম্পর্কিত তদন্ত ও রিপোর্ট
  • গ্লোবাল সংবাদ মাধ্যম: The Guardian, Washington Post ইত্যাদি কভারেজ

ফিলিস্তিন প্রশ্নে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্পৃক্ততা এখন আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পর্যটন, অবকাঠামো, খাদ্য, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা খাতে তাদের উপস্থিতি কেবল ব্যবসায়িক নয়, বরং রাজনৈতিক ও মানবাধিকার প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কোম্পানিগুলোর ওপরও আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।


Thursday, September 25, 2025

সূর্যগ্রহণ কি সত্যিই বিপদ ডেকে আনে? জেনে নিন যা কেউ আপনাকে বলবে না!

0 comments
 আজ থেকে মাত্র ৪০০০ বছর আগে, চীনের এক সম্রাট তার দুই জ্যোতিষীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন! কারণ? তারা সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেননি। 
আর মাত্র কয়েক দিন আগেই আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল... একই ঘটনার জন্য।
কী এমন আছে সূর্যগ্রহণে যা হাজার বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে? কেন এই কয়েক মিনিটের ঘটনা পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দেয়?

আজ আমরা জানব সূর্যগ্রহণের সেই অবিশ্বাস্য সত্য যা আপনার চোখ খুলে দেবে!


বন্ধুরা! যেমনটা শুনলেন, সূর্য গ্রহণ এমন এক মহাজাগতিক ঘটনা যা প্রাচীনকালে যেমন মানুষের মনে ভয় আর বিস্ময় তৈরি করত, আজও ঠিক তেমনই করে। এই ঘটনাটি শুধু আজকের নয়, এর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরোনো। রাজারা সিংহাসন হারিয়েছেন, যুদ্ধ থেমে গেছে, আবার জন্ম নিয়েছে কতশত গল্প আর কুসংস্কার।

আজকে আমরা জানবো:

১. কেন এবং কীভাবে এই গ্রহণ হয়? (এর পেছনের সহজ বিজ্ঞান)

২. ইতিহাস জুড়ে মানুষ একে কীভাবে দেখেছে? (কিছু গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প)

৩. এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রহণ চলাকালীন কী করা উচিত এবং কোনগুলো নিছকই কুসংস্কার?

 

চলুন, এই মহাজাগতিক যাত্রায় একসঙ্গে সামিল হই!"

 

"প্রথমেই আসি, এই গ্রহণ কেন হয়? বিষয়টা আসলে একটা মহাজাগতিক লুকোচুরি খেলার মতো। আমাদের পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তেমনই চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীর চারদিকে।

 

যখন এই তিনটি বস্তুসূর্য, চাঁদ এবং পৃথিবীঘুরতে ঘুরতে একই সরলরেখায় চলে আসে এবং চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থান করে, তখন চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপর পড়ে। পৃথিবীর যে অংশ জুড়ে ওই ছায়া পড়ে, সেখান থেকে সূর্যকে আর দেখা যায় না বা আংশিকভাবে ঢাকা পড়ে যায়। আর একেই আমরা বলি সূর্য গ্রহণ।

 

মজার ব্যাপার হলো, সূর্য চাঁদের চেয়ে ৪০০ গুণ বড়, আবার চাঁদ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সূর্যের দূরত্বের ৪০০ ভাগের এক ভাগ। এই অদ্ভুত গাণিতিক কারণেই পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্যকে প্রায় একই আকারে দেখায়। তাই চাঁদ সহজেই সূর্যকে ঢেকে ফেলতে পারে।

 

এই গ্রহণ তিন ধরনের হতে পারেপূর্ণগ্রাস (Total), যেখানে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে; খণ্ডগ্রাস (Partial), যেখানে সূর্যের একাংশ ঢাকা থাকে; এবং বলয়গ্রাস (Annular), যেখানে চাঁদ সূর্যকে ঢাকলেও চারপাশে একটি আগুনের বলয় বা রিং অফ ফায়ার দেখা যায়।"

 

বিজ্ঞান তো সহজ, কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ যখন দেখত তাদের আলোর উৎস, তাদের দেবতা সূর্যকে কিছু একটা গিলে ফেলছে, তখন তাদের মনের অবস্থা কী হতো, ভেবে দেখুন তো?

 

হিন্দু পুরাণ: আমাদের এই উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনীটি হলো রাহু ও কেতুর। সমুদ্র মন্থনের সময় অসুর রাহু ছলনা করে অমৃত পান করলে, মোহিনীরূপী বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে তার ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা করে দেন। কিন্তু অমৃত পানের কারণে তার মুণ্ড ও ধড় অমর হয়ে যায়। সেই ছিন্ন মস্তকটিই হলো 'রাহু' এবং ধড়টি হলো 'কেতু'। রাহুর সেই কাটা মাথা সূর্য ও চন্দ্রের ওপর প্রতিশোধ নিতেই সময়ে সময়ে তাদের গ্রাস করে ফেলে। আর তখনই হয় গ্রহণ।

 

চীন: প্রাচীন চীনে মনে করা হতো, এক স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই গ্রহণ শুরু হলেই চীনারা ড্রাম, বাসন-কোসন বাজিয়ে বিকট শব্দ করত, যাতে সেই ড্রাগন ভয় পেয়ে সূর্যকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। আজ থেকে চার হাজার বছর আগে চীনের শিয়া রাজবংশের সম্রাট চং খাং তখন ক্ষমতায়। সেই সময়ে সম্রাটকে মনে করা হতো 'স্বর্গের পুত্র'। অর্থাৎ, আকাশ বা স্বর্গের সাথে পৃথিবীর মানুষের সংযোগ স্থাপনকারী। তাই আকাশে যা কিছু ঘটত, তার সরাসরি প্রভাব সম্রাটের সম্মান এবং শাসনের ওপর পড়ত।

 

তার রাজসভায় দুজন রাজকীয় জ্যোতির্বিদ ছিলেনতাদের নাম ছিল হি এবং হো (Hsi and Ho)। তাদের কাজ শুধু তারা দেখা বা দিনপঞ্জি বানানো ছিল না। তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মহাজাগতিক ঘটনা, বিশেষ করে সূর্যগ্রহণের নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করা। কারণ, আগেই বলেছি, চীনারা মনে করত এক স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গিলে ফেলে। তাই গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই যদি জানা যায়, তবে ড্রাম বাজিয়ে, তীর ছুড়ে সূর্যকে বাঁচানোর প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।

 

কিন্তু সেই বিশেষ দিনে যা ঘটল, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।

 

হঠাৎ, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, দিনের বেলা আকাশ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করলো। সূর্যকে যেন এক অদৃশ্য দৈত্য গ্রাস করছে। রাজদরবারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। প্রজাদের মধ্যে শুরু হলো হাহাকার। সূর্যকে বাঁচানোর জন্য যে ড্রাম বাজানো হবে, তীর ছোড়া হবেসেই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই পাওয়া গেল না।

 

আর এর জন্য দায়ী কে? রাজদরবারের প্রধান দুই জ্যোতির্বিদ, হি এবং হো!

 

অভিযোগ ওঠে, তারা নিজেদের কর্তব্যে এতটাই অবহেলা করেছিলেন যে তারা মদ্যপানে মত্ত ছিলেন এবং এই বিশাল মহাজাগতিক ঘটনা তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।

 

সম্রাট চং খাং-এর জন্য এটা ছিল চরম অবমাননা এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এই অপ্রত্যাশিত গ্রহণকে স্বর্গের তরফ থেকে তার শাসনের প্রতি একটি অনাস্থা হিসেবে দেখা হতে পারত, যা রাজ্যে বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারত। হি এবং হো-র এই ব্যর্থতা শুধু একটি বৈজ্ঞানিক ভুল ছিল না, এটি ছিল সম্রাটের ক্ষমতার প্রতি এক বিরাট হুমকি।

 

ফলাফল? মৃত্যুদণ্ড।

 

সম্রাট তার দুই সর্বোচ্চ জ্যোতির্বিদকে শিরশ্ছেদের আদেশ দিলেন। কারণ তারা শুধু একটি গ্রহণ দেখতেই ব্যর্থ হননি, তারা সম্রাটের সম্মান এবং স্বর্গীয় অধিকারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন।

 

ভাইকিং: উত্তরের ভাইকিং যোদ্ধারা বিশ্বাস করত, স্কল (Sköll) এবং হাটি (Hati) নামের দুটি বিশাল নেকড়ে সারাক্ষণ আকাশে সূর্য ও চন্দ্রকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যখন তারা ধরতে পারে, তখনই গ্রহণ হয়।

 

শুধু গল্পই নয়, ইতিহাসে এর বাস্তব প্রভাবও ছিল। গ্রহণের ভয়ে যুদ্ধ থেমে গেছে, রাজারা নিজেদের ভাগ্য গণনা করতে জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হয়েছেন। এই মহাজাগতিক ঘটনাটি ছিল একাধারে ভয় এবং শ্রদ্ধার।

 

"এবার আসি সবচেয়ে জরুরি অংশে। গ্রহণ নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন। কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা শুধুই ধারণা?

 

প্রথমেই বিজ্ঞান কী বলে:

Is Solar Eclipse a Danger

গ্রহণ দেখার সময় সবচেয়ে বড় সতর্কতা হলোকখনোই, কখনোই খালি চোখে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাবেন না। এটা কোনো কুসংস্কার নয়, এটা খাঁটি বিজ্ঞান।

 

কেন? গ্রহণের সময় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির (UV rays) তীব্রতা অনেক বেশি থাকে, যা আপনার চোখের রেটিনাকে চিরতরে পুড়িয়ে দিতে পারে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা, আপনি এটা টেরও পাবেন না, কারণ রেটিনায় কোনো ব্যথা অনুভব করার কোষ নেই।

 

কীভাবে দেখবেন? গ্রহণ দেখার জন্য বিশেষ সোলার ফিল্টারযুক্ত চশমা বা ওয়েল্ডার গ্লাস (শেড ১৪ বা তার বেশি) ব্যবহার করুন। অথবা ঘরেই বানিয়ে নিতে পারেন পিনহোল প্রজেক্টর। এর মাধ্যমে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখে নিরাপদে গ্রহণ উপভোগ করতে পারবেন।

 

এবার আসি প্রচলিত কিছু ধারণায়:

আমাদের সমাজে কিছু বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যেমন:

১. গর্ভবতী নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ: বলা হয়, এতে গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটি সম্পূর্ণ একটি কুসংস্কার।

২. গ্রহণ চলাকালীন খাওয়া বা রান্না করা নিষেধ: অনেকেই ভাবেন, এই সময়ে খাবার বিষাক্ত হয়ে যায়। এটাও একটি ভুল ধারণা। খাবার বা জলের ওপর গ্রহণের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।

৩. গ্রহণের পর স্নান করা: অনেকে শুদ্ধ হওয়ার জন্য এটা করে থাকেন। এটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অংশ হতে পারে, তবে এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক বাধ্যবাধকতা নেই।

 

মূল কথা হলো, সূর্য গ্রহণ একটি প্রাকৃতিক এবং সুন্দর ঘটনা। ভয় না পেয়ে, সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করে এটি উপভোগ করুন।"

 

"তাহলে আমরা দেখলাম, সূর্য গ্রহণ কোনো অভিশাপ বা অশুভ সংকেত নয়, বরং চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবীর সরলরেখায় অবস্থানের এক অসাধারণ মহাজাগতিক মুহূর্ত। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই বিশাল মহাবিশ্বে আমরা কতটা ক্ষুদ্র, অথচ কত সুন্দর এক মঞ্চের অংশ।

 

আজকের এই বিশেষ দিনটি আপনি কীভাবে কাটাচ্ছেন? আপনার এলাকায় গ্রহণ নিয়ে কী ধরনের লোককথা বা বিশ্বাস প্রচলিত আছে? আমাদের কমেন্ট করে অবশ্যই জানান।

 

লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে এবং নতুন কিছু জানতে পারেন, তাহলে অবশ্যই একটি লাইক দিন। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরও এই মহাজাগতিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করুন। চাঁদগ্রহণের রহস্য নিয়ে জানতে আমাদের আগের এই লেখটি পড়ুন। 

Saturday, September 13, 2025

মাওরি জনগোষ্ঠী

0 comments

 'মাওরি' (Māori) হলো নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তারা নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয়দের আগমনের আগে থেকেই সেখানে বসবাস করে আসছিল। তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষা রয়েছে, যা দেশটির জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।



মাওরি জনগোষ্ঠীর পরিচিতি:

  • উৎপত্তি: মাওরিরা পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠীর অংশ। ধারণা করা হয়, তারা প্রায় ১০০০ বছর আগে পূর্ব পলিনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ থেকে সাগরপথে নিউজিল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা তাদের নতুন ভূমিকে 'আওতেরোয়া' (Aotearoa) বা 'দীর্ঘ সাদা মেঘের দেশ' নাম দিয়েছিল।

  • সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য: মাওরি সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক দিক হলো:

    • কার্ভিং (Whakairo): কাঠ, পাথর এবং হাড়ের উপর জটিল নকশা খোদাই করা তাদের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প।

    • নৃত্য ও গান (Haka and Waiata): 'হাকা' হলো একটি শক্তিশালী দলীয় নৃত্য, যা যুদ্ধ বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়। 'ওয়াইয়াতা' হলো ঐতিহ্যবাহী গান।

    • ট্যাটু (Tā Moko): মুখে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ঐতিহ্যবাহী ট্যাটু বা 'টা মোকো' করা হয়, যা ব্যক্তির বংশ, ইতিহাস এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করে।

মাওরি ট্যাটু, যা Tā Moko (টা মোকো) নামে পরিচিত, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল একটি ট্যাটু নয়, বরং এটি একজন ব্যক্তির পরিচয়, মর্যাদা, বংশ এবং ব্যক্তিগত ইতিহাসকে উপস্থাপন করে।

টা মোকোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে দেওয়া হলো:

১. Tā Moko এর অর্থ ও গুরুত্ব

টা মোকো একজন ব্যক্তির বংশ পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদা বহন করে। প্রতিটি রেখা এবং নকশার পেছনে একটি গল্প লুকিয়ে থাকে। এই ট্যাটুগুলো দেখে একজন মাওরি ব্যক্তি সহজেই জানতে পারেন, অপরজন কোন গোত্রের, তার পূর্বপুরুষ কারা এবং সমাজে তার অবস্থান কী। এটি এক ধরনের লিখিত নথি, যা শরীরের উপর খোদাই করা হয়।

২. চিরায়ত পদ্ধতি

ঐতিহ্যগতভাবে, টা মোকো করার জন্য আধুনিক সুই ব্যবহার করা হতো না। এর পরিবর্তে, উকিতাকি (Uhi) নামক বিশেষ ধরনের ছেনি ব্যবহার করা হতো, যা পাখির হাড় বা ধারালো পাথর দিয়ে তৈরি হতো। এই ছেনি দিয়ে চামড়া কেটে নকশা তৈরি করা হতো। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল এবং এর জন্য ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রয়োজন হতো। এটি একজন ব্যক্তির মানসিক শক্তিরও একটি পরীক্ষা ছিল।

৩. নকশার ভিন্নতা

টা মোকোর নকশাগুলো স্থানভেদে ভিন্ন হয়। একজন পুরুষের ক্ষেত্রে, মুখের ট্যাটু সবচেয়ে সাধারণ। এটি তার মুখাবয়বের বাম ও ডান দিকে দুটি ভিন্ন গল্প বলে:

  • বাম দিক: মায়ের বংশের ইতিহাস।

  • ডান দিক: বাবার বংশের ইতিহাস।

মুখের ট্যাটু ছাড়াও, টা মোকো হাত, বাহু, উরু এবং শরীরের অন্যান্য অংশেও করা হয়।

৪. আধুনিক টা মোকো

বর্তমানে, আধুনিক সরঞ্জামের (যেমন ট্যাটু গান) সাহায্যেও টা মোকো করা হয়, যা প্রক্রিয়াটিকে কম বেদনাদায়ক করে তোলে। তবে, ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ও নকশার গুরুত্ব এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অনেক মাওরি শিল্পী এখন আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেও টা মোকোর মূল অর্থ ও নকশার পবিত্রতা বজায় রাখেন। আধুনিক সময়ে, এটি কেবল পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক নারীও Moko Kauae (ঠোঁট ও চিবুকের ট্যাটু) এবং অন্যান্য নকশার মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধারণ করছেন।


টা মোকো হলো মাওরিদের Te Reo Māori (মাওরি ভাষা), whakapapa (বংশতালিকা) এবং mana (আধ্যাত্মিক ক্ষমতা)-র একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি তাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে।

    • মিটিং হাউস (Marae): প্রতিটি সম্প্রদায়ের একটি মিটিং হাউস বা 'মারায়ে' থাকে, যা তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।

  • ভাষা: মাওরিদের নিজস্ব ভাষা আছে, যা 'তে রেও মাওরি' (Te Reo Māori) নামে পরিচিত। এটি নিউজিল্যান্ডের একটি সরকারি ভাষা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাষাটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

  • ঐতিহাসিক পটভূমি:

    • ইউরোপীয়দের আগমন: ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয়রা নিউজিল্যান্ডে আসতে শুরু করে। এর ফলে মাওরিদের ভূমি ও জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ে।

    • ওয়াইটাঙ্গি চুক্তি (Treaty of Waitangi): ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ ক্রাউন এবং মাওরি সর্দারদের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে মাওরিদের ভূমি ও সম্পদ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এর শর্তগুলো প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়, যার ফলে মাওরি এবং ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমানে, মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় ১৭%। নিউজিল্যান্ড সরকার এবং সমাজ মাওরি সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। মাওরি ঐতিহ্যকে শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, কিছু মাওরি সম্প্রদায় এখনও স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

Saturday, September 6, 2025

চন্দ্রগ্রহণে কি মানবো কি মানবো না | চন্দ্রগ্রহণ: কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বিজ্ঞানের আলোয় এক মহাজাগতিক রহস্য

0 comments


 আজ, চাঁদ তার মহাজাগতিক যাত্রায় এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হতে চলেছে - পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। যখন পৃথিবী তার বিশাল ছায়া দিয়ে চাঁদকে পুরোপুরি ঢেকে দেবে, তখন এটি কেবল একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা নয়, বরং শতাব্দী ধরে চলে আসা বিভিন্ন বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক প্রতিচ্ছবি। একদিকে যেমন বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলা এক অসাধারণ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন, অন্যদিকে অনেক সমাজে এটি গভীর আধ্যাত্মিক এবং কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িত।

চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে অনেক ধরনের বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যা কুসংস্কার ও বাস্তবতার মধ্যে বিভক্ত। বিজ্ঞান কখনোই এই ধরনের বিশ্বাস বা কুসংস্কারকে সমর্থন করে না। চন্দ্রগ্রহণ একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ঘটনা। যখন পৃথিবী সূর্য এবং চাঁদের মাঝে চলে আসে এবং চাঁদ পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে, তখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

এখানে চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত কিছু প্রচলিত বিশ্বাস ও সেগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

 

যে বিষয়গুলো মানা হয় (প্রচলিত বিশ্বাস):

 

  • খাবার খাওয়া নিষেধ: অনেক জায়গায় বিশ্বাস করা হয় যে গ্রহণের সময় খাবার খেলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়।

  • রান্না করা নিষেধ: এই সময়ে রান্না করা বা খাবার প্রস্তুত করা অশুভ বলে মনে করা হয়।

  • গর্ভাবস্থায় বাইরে যাওয়া নিষেধ: গর্ভবতী নারীদের গ্রহণের সময় বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়। মনে করা হয় এতে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হতে পারে।

  • ধর্মীয় কাজ বা প্রার্থনা: কিছু বিশ্বাস অনুযায়ী, গ্রহণের সময় ধ্যান বা প্রার্থনা করলে তা বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়।

  • ধারালো বস্তু ব্যবহার নিষেধ: গ্রহণ চলাকালীন ছুরি বা অন্য ধারালো জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়।

 

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা:

 

  • খাবার ও পানীয়: বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রহণ চলাকালীন খাবার বা পানীয়ের গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন আসে না। খাদ্য বিষাক্ত হওয়ার ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

  • রান্না করা: এই সময়ে রান্না করা বা খাবার প্রস্তুত করায় কোনো সমস্যা নেই। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

  • গর্ভাবস্থা: গ্রহণের সময় বাইরে বের হওয়া বা ঘরে থাকা গর্ভবতী নারী বা তার শিশুর ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এর ফলে কোনো শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

  • ধারালো জিনিস: গ্রহণ চলাকালীন ধারালো জিনিস ব্যবহার করায় কোনো সমস্যা নেই। এর সঙ্গে কোনো দুর্ঘটনার সম্পর্ক নেই।

সংক্ষেপে, চন্দ্রগ্রহণ একটি মহাজাগতিক ঘটনা। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ মানার প্রয়োজন নেই। আপনি চাইলে এই বিষয়গুলো মানতেও পারেন, আবার না-ও মানতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস:

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সভ্যতা চন্দ্রগ্রহণকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এসেছে। অনেক সংস্কৃতিতে এটিকে একটি খারাপ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিছু সমাজে মনে করা হতো যে একটি রাক্ষস বা ড্রাগন চাঁদকে গিলে খাচ্ছে। এই বিশ্বাস থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা এবং জোরে শব্দ করে রাক্ষসটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করত।

  • প্রাচীন গ্রিকরা: তারা বিশ্বাস করত চন্দ্রগ্রহণ দেবতাদের অসন্তুষ্টির লক্ষণ।

  • মেসোপটেমিয়ানরা: তারা চন্দ্রগ্রহণকে রাজার জন্য বিপদ সংকেত হিসেবে দেখত। তাই তারা এই সময়ে রাজাকে অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকতে বলত।

  • ভারতীয় সংস্কৃতিতে: চন্দ্রগ্রহণকে সাধারণত অশুভ হিসেবে দেখা হয়। এই সময়ে খাবার গ্রহণ, রান্না করা, বা ধারালো বস্তু ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। গর্ভবতী নারীদের ঘরের বাইরে না যাওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে, এই বিশ্বাস থেকে যে এটি গর্ভের শিশুর ক্ষতি করতে পারে।

 

বিজ্ঞানের চোখে চন্দ্রগ্রহণ:

বিজ্ঞানীরা চন্দ্রগ্রহণকে একটি সাধারণ মহাজাগতিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এটি ঘটে যখন সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ একটি সরল রেখায় চলে আসে এবং পৃথিবী সূর্যের আলো চাঁদের উপর পড়তে বাধা দেয়। এর ফলে চাঁদ সাময়িকভাবে অন্ধকার হয়ে যায়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ পুরোপুরি পৃথিবীর ছায়ায় ঢেকে গেলেও এটি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায় না, বরং একটি লালচে বা তামাটে রঙ ধারণ করে। এর কারণ হলো, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে সূর্যের কিছু নীল আলো ছড়িয়ে যায় এবং লাল আলো চাঁদের উপর পৌঁছায়, যা চাঁদকে 'রক্ত চন্দ্র' (Blood Moon) হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এই ঘটনাটি কোনো অস্বাভাবিক বা অশুভ লক্ষণ নয়, বরং এটি আলোর প্রতিসরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ।

আধুনিক যুগে চন্দ্রগ্রহণ:

আধুনিক যুগে চন্দ্রগ্রহণ একটি পর্যটন আকর্ষণ এবং শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই সময়ে চাঁদকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান এবং সাধারণ মানুষও খালি চোখে এই অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। বর্তমানে, মোবাইল অ্যাপস এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে মানুষ সহজেই গ্রহণের সময় এবং স্থান সম্পর্কে তথ্য পেতে পারে।

উপসংহার:

চন্দ্রগ্রহণ একদিকে যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি মনোমুগ্ধকর উদাহরণ, অন্যদিকে এটি মানব সভ্যতার বহু প্রাচীন বিশ্বাস এবং কুসংস্কারের প্রতিফলন। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে এটি একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা, যার সঙ্গে মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ বা ভাগ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও, এই মহাজাগতিক দৃশ্যটি আমাদের প্রাচীন ইতিহাস এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মধ্যে এক দারুণ সেতুবন্ধন তৈরি করে।