'মাওরি' (Māori) হলো নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তারা নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয়দের আগমনের আগে থেকেই সেখানে বসবাস করে আসছিল। তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষা রয়েছে, যা দেশটির জাতীয় পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মাওরি জনগোষ্ঠীর পরিচিতি:
উৎপত্তি: মাওরিরা পলিনেশীয় জাতিগোষ্ঠীর অংশ। ধারণা করা হয়, তারা প্রায় ১০০০ বছর আগে পূর্ব পলিনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপ থেকে সাগরপথে নিউজিল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তারা তাদের নতুন ভূমিকে 'আওতেরোয়া' (Aotearoa) বা 'দীর্ঘ সাদা মেঘের দেশ' নাম দিয়েছিল।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য: মাওরি সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক দিক হলো:
কার্ভিং (Whakairo): কাঠ, পাথর এবং হাড়ের উপর জটিল নকশা খোদাই করা তাদের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প।
নৃত্য ও গান (Haka and Waiata): 'হাকা' হলো একটি শক্তিশালী দলীয় নৃত্য, যা যুদ্ধ বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়। 'ওয়াইয়াতা' হলো ঐতিহ্যবাহী গান।
ট্যাটু (Tā Moko): মুখে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ঐতিহ্যবাহী ট্যাটু বা 'টা মোকো' করা হয়, যা ব্যক্তির বংশ, ইতিহাস এবং সামাজিক অবস্থান প্রকাশ করে।
মাওরি ট্যাটু, যা Tā Moko (টা মোকো) নামে পরিচিত, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল একটি ট্যাটু নয়, বরং এটি একজন ব্যক্তির পরিচয়, মর্যাদা, বংশ এবং ব্যক্তিগত ইতিহাসকে উপস্থাপন করে।
টা মোকোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে দেওয়া হলো:
১. Tā Moko এর অর্থ ও গুরুত্ব
টা মোকো একজন ব্যক্তির বংশ পরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদা বহন করে। প্রতিটি রেখা এবং নকশার পেছনে একটি গল্প লুকিয়ে থাকে। এই ট্যাটুগুলো দেখে একজন মাওরি ব্যক্তি সহজেই জানতে পারেন, অপরজন কোন গোত্রের, তার পূর্বপুরুষ কারা এবং সমাজে তার অবস্থান কী। এটি এক ধরনের লিখিত নথি, যা শরীরের উপর খোদাই করা হয়।
২. চিরায়ত পদ্ধতি
ঐতিহ্যগতভাবে, টা মোকো করার জন্য আধুনিক সুই ব্যবহার করা হতো না। এর পরিবর্তে, উকিতাকি (Uhi) নামক বিশেষ ধরনের ছেনি ব্যবহার করা হতো, যা পাখির হাড় বা ধারালো পাথর দিয়ে তৈরি হতো। এই ছেনি দিয়ে চামড়া কেটে নকশা তৈরি করা হতো। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল এবং এর জন্য ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রয়োজন হতো। এটি একজন ব্যক্তির মানসিক শক্তিরও একটি পরীক্ষা ছিল।
৩. নকশার ভিন্নতা
টা মোকোর নকশাগুলো স্থানভেদে ভিন্ন হয়। একজন পুরুষের ক্ষেত্রে, মুখের ট্যাটু সবচেয়ে সাধারণ। এটি তার মুখাবয়বের বাম ও ডান দিকে দুটি ভিন্ন গল্প বলে:
বাম দিক: মায়ের বংশের ইতিহাস।
ডান দিক: বাবার বংশের ইতিহাস।
মুখের ট্যাটু ছাড়াও, টা মোকো হাত, বাহু, উরু এবং শরীরের অন্যান্য অংশেও করা হয়।
৪. আধুনিক টা মোকো
বর্তমানে, আধুনিক সরঞ্জামের (যেমন ট্যাটু গান) সাহায্যেও টা মোকো করা হয়, যা প্রক্রিয়াটিকে কম বেদনাদায়ক করে তোলে। তবে, ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি ও নকশার গুরুত্ব এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অনেক মাওরি শিল্পী এখন আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেও টা মোকোর মূল অর্থ ও নকশার পবিত্রতা বজায় রাখেন। আধুনিক সময়ে, এটি কেবল পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অনেক নারীও Moko Kauae (ঠোঁট ও চিবুকের ট্যাটু) এবং অন্যান্য নকশার মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যকে ধারণ করছেন।
টা মোকো হলো মাওরিদের Te Reo Māori (মাওরি ভাষা), whakapapa (বংশতালিকা) এবং mana (আধ্যাত্মিক ক্ষমতা)-র একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি তাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে।
মিটিং হাউস (Marae): প্রতিটি সম্প্রদায়ের একটি মিটিং হাউস বা 'মারায়ে' থাকে, যা তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।
ভাষা: মাওরিদের নিজস্ব ভাষা আছে, যা 'তে রেও মাওরি' (Te Reo Māori) নামে পরিচিত। এটি নিউজিল্যান্ডের একটি সরকারি ভাষা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাষাটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
ইউরোপীয়দের আগমন: ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয়রা নিউজিল্যান্ডে আসতে শুরু করে। এর ফলে মাওরিদের ভূমি ও জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ে।
ওয়াইটাঙ্গি চুক্তি (Treaty of Waitangi): ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ ক্রাউন এবং মাওরি সর্দারদের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে মাওরিদের ভূমি ও সম্পদ রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এর শর্তগুলো প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়, যার ফলে মাওরি এবং ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমানে, মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার প্রায় ১৭%। নিউজিল্যান্ড সরকার এবং সমাজ মাওরি সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়েছে। মাওরি ঐতিহ্যকে শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, কিছু মাওরি সম্প্রদায় এখনও স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।












0 comments:
Post a Comment