Thursday, November 20, 2025

বিশ্বের ১০টি দেশে ভিসা স্ক্যাম — ২০২৫ সালের নতুন পদ্ধতি ও প্রতারণা চেনার উপায়

0 comments

বিশ্বজুড়ে অভিবাসন ও ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাল ভিসা, ভুয়া এজেন্সি, ফেক ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইট এবং ফোন-ইমেইল স্ক্যামের পরিসর বহুগুণে বেড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এমন মানুষদের টার্গেট করে নতুন ধরনের প্রতারণার কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।


২০২৫ সালে যেসব দেশে এসব স্ক্যাম বেশি রিপোর্ট হয়েছে, সেগুলোর বাস্তব কাহিনি, নতুন পদ্ধতি এবং সতর্কতার উপায় এখানে তুলে ধরা হলো।


🇦🇪 দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যের উমরাহ–হজ ভিসা প্রতারণা

২০২৫ সালে দুবাই পুলিশ যে চক্রটিকে গ্রেপ্তার করেছে, তারা কয়েক মাস ধরে “সস্তায় উমরাহ ভিসা” ও “এক্সপ্রেস হজ প্যাকেজ” নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল। ভুক্তভোগীরা টাকা পাঠানোর পর এজেন্টের নম্বর বন্ধ, পেজ অদৃশ্য।
এই স্ক্যামের মূল লক্ষ্য ছিল—সাধারণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানো। অনেকে হজ-উমরাহর আগ্রহে যাচাই না করেই টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন।

সতর্কতা: হজ-উমরাহ ভিসা শুধু সরকারি অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমেই করতে হবে। ফেসবুক পোস্টে ‘সুপার অফার’ মানেই সন্দেহ।


🇹🇭 থাইল্যান্ডে “ডিজিটাল অ্যারাইভাল কার্ড” নামে নতুন স্ক্যাম

থাইল্যান্ডে ভিসা স্ক্যাম বছরের পর বছর ধরে চলছে, কিন্তু ২০২৫ সালে নতুন ফাঁদ হলো—ফেক TDAC (Digital Arrival Card) ওয়েবসাইট
অচেনা সাইটগুলোতে প্রবেশ করলে তারা “অতিরিক্ত চার্জ” ও “প্রায়োরিটি প্রসেসিং ফি” দাবি করছে। কেউ কেউ পেমেন্ট করেও বৈধ কার্ড পাচ্ছেন না। আবার ১৫ বছর ধরে চলা এক বড় ভিসা-চক্র ভুয়া কোম্পানির নামে নকল ডকুমেন্ট বানিয়ে দিচ্ছিল—এ বছর তা ধরা পড়ে।

সতর্কতা: থাইল্যান্ড ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের আসল ওয়েবসাইট ছাড়া আর কোথাও TDAC ফর্ম পূরণ করবেন না।


🇰🇭 কম্বোডিয়ায় ভুয়া e-Visa সাইট

কম্বোডিয়ায় ভ্রমণ ভিসা সাধারণত সহজ—তাই অনেকেই ব্রোকার ছাড়া অনলাইনে আবেদন করেন। এই সুবিধাকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে প্রতারকরা।
একাধিক ফেক ওয়েবসাইট সরকারি ডিজাইন কপি করে তৈরি করা, আর আবেদনকারীকে ২–৩ গুণ বেশি ফি ধার্য করা—এটাই প্রধান স্ক্যাম। অনেকেই টাকা পাঠানোর পর কোনো ভিসা পাননি।

সতর্কতা: URL-এ “gov.kh” না থাকলে ক্লিক করবেন না।


🇻🇳 ভিয়েতনামে ভিসা অফিসারের নাম ভাঙিয়ে ফোন

২০২৫ সালে ভিয়েতনামে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ফোন-কল ইম্পার্সনেশন স্ক্যাম
প্রতারকরা দূতাবাস বা ইমিগ্রেশন অফিসার পরিচয় দিয়ে বলেন—
“আপনার ভিসা প্রায় রেডি, শুধু অতিরিক্ত প্রসেসিং ফি পাঠাতে হবে।”
এভাবে একাধিক বিদেশি ও দক্ষিণ এশীয় নাগরিক লাখ লাখ ডং হারিয়েছেন।

সতর্কতা: অফিসিয়াল নম্বর থেকে কল এসেছে কি না তা যাচাই করুন। সন্দেহ হলে সরাসরি দূতাবাসে ফোন দিন।


🇮🇹 ইতালিতে নকল শেনজেন ভিসা চক্র

ইতালিতে পুলিশ ২০২৫ সালে একটি বড় সিন্ডিকেট ধরেছে, যাদের কাছ থেকে হাজার হাজার ইউরো মূল্যের জাল শেনজেন ভিসা উদ্ধার হয়েছে।
চক্রটি মূলত আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের টার্গেট করত।
“গ্যারান্টি ভিসা”, “এক্সপ্রেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট”, “ইউরোপ ট্রাভেল পাস”—এসব নাম ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস করানো হতো।

সতর্কতা: শেনজেন ভিসার জন্য কোনো দেশে “গ্যারান্টি” নেই। কেউ দিলে বুঝবেন ১০০% প্রতারণা।


🇺🇸 যুক্তরাষ্ট্রে U-Visa প্রতারণা

২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক প্রতারক ধরা পড়েছে যারা U-ভিসা (যারা কোনো অপরাধের শিকার হলে এবং পুলিশকে সহায়তা করলে দেওয়া হয়) পাওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিত।
এজন্য তারা নকল পুলিশ রিপোর্ট তৈরি করত, আবার কখনো “বৈধ সংস্থার লোক” সাজত।
হাস্যকর বিষয়—কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে $১০,০০০ দিলেই U-ভিসা মিলে যাবে।

সতর্কতা: U-ভিসা শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পাওয়া যায়; কোনো শর্টকাট নেই।


🇯🇵 জাপানে দক্ষ কর্মী (SSW) ভিসায় ভুয়া রিক্রুটিং ফার্ম

বাংলাদেশি এবং নেপালি কর্মীদের টার্গেট করে কিছু ভুয়া রিক্রুটিং কোম্পানি “জাপান SSW ভিসা”র নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
২০২৫ সালে অভিযোগ বেড়েছে—
“ভাষা পরীক্ষা ছাড়াই ভিসা করে দেব”,
“জাপান থেকে চাকরির অফার রেডি”—এসব প্রতারণার কৌশল।

সতর্কতা: জাপানের অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা সবসময় জাস্টিস মিনিস্ট্রি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত থাকে। সেই লিস্ট ছাড়া কারো সঙ্গে লেনদেন করবেন না।


🇵🇹 পর্তুগালে ওয়ার্ক-পারমিট স্ক্যাম

অনেক দক্ষিণ এশীয়রা পর্তুগালে EWL (Employment Visa) পেতে চান।
এ সুযোগে প্রতারকরা নকল কোম্পানির অফার লেটার, ফেক কনট্রাক্ট, গ্যারান্টিড ওয়ার্ক পারমিট দেখিয়ে টাকা নেয়।
২০২৫ সালে সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট এসেছে—
“দুই মাসে রেসিডেন্স পেপার”—এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি থেকে।

সতর্কতা: পর্তুগালের কোম্পানি নিবন্ধন নম্বর (NIF) অনলাইনে যাচাই করা যায়—না থাকলে এড়িয়ে চলুন।


🇷🇼 রুয়ান্ডায় ভুয়া ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইট

একজন ইউগান্ডার ভ্রমণকারী $৮০০ হারানোর পর বিষয়টি ভাইরাল হয়—তিনি ভেবেছিলেন তিনি রুয়ান্ডার সরকারি সাইটে ভিসা করছেন, পরে বুঝলেন এটি একটি প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট।
অফিশিয়ালি যেসব দেশে e-Visa সহজ, সেগুলোকেই এখন টার্গেট করা হচ্ছে বেশি।

সতর্কতা: সরকারি সাইটে সবসময় “gov” বা দেশের অফিসিয়াল ডোমেইন থাকে।


🇲🇾 মালয়েশিয়ায় “স্টুডেন্ট ভিসা শর্টকাট”

মালয়েশিয়ার নাম ভাঙিয়ে অনেক ভুয়া এজেন্ট ২০২৫ সালে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঠকাচ্ছে।
“কনফার্ম লেটার”, “এপ্রিল সেশন গ্যারান্টিড”—এসব দেখিয়ে টাকা নিয়ে নিখোঁজ।
অনেকে জাল কলেজে ভর্তি হয়ে পরে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।

সতর্কতা: মালয়েশিয়ান কনসালটেটের EMGS সাইটে কলেজ/ইউনিভার্সিটির কোড চেক করুন।


🔎 প্রতারণা চেনার ৭টি নিশ্চিত উপায়

যে দেশেই যান—

✔ ১) এজেন্ট যদি বলে “ভিসা গ্যারান্টি”, বুঝবেন ১০০% স্ক্যাম

কোনো দেশেই গ্যারান্টি নেই—শুধু ডাকুমেন্ট দেখে সিদ্ধান্ত হয়।

✔ ২) সোশ্যাল মিডিয়ায় “স্পেশাল অফার”

বিশেষ করে WhatsApp / Messenger / TikTok—সবচেয়ে বেশি স্ক্যাম এখানেই।

✔ ৩) সরকারি সাইট ছাড়া অন্য URL

বেশিরভাগ নকল ভিসা সাইটে .org / .com ব্যবহার করা হয়।

✔ ৪) এজেন্ট যদি বলছে “আজকেই টাকা পাঠাও”

তাড়াহুড়ো মানেই সন্দেহ।

✔ ৫) কোম্পানির অফার লেটার যাচাই করুন

ইউরোপ/এশিয়ার কোম্পানিগুলোর রেজিস্ট্রেশন অনলাইনেই দেখা যায়।

✔ ৬) ফোনে কেউ ফি চাইলে

দূতাবাস কখনই ফোনে টাকা নেয় না।

✔ ৭) কাগজপত্রে ভুল বানান / ভুল লোগো

ফেক পেপারের সবচেয়ে সাধারণ চিহ্ন।


উপসংহার

২০২৫ সাল দেখিয়ে দিয়েছে—স্ক্যামারদের হাত বদলেছে, কৌশল বদলেছে, কিন্তু উদ্দেশ্য একই: মানুষের স্বপ্নকে ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।
সে কারণে যে দেশেই ভ্রমণ বা অভিবাসনের পরিকল্পনা করেন না কেন—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক তথ্য, অফিশিয়াল সোর্স, এবং নিজের সতর্কতা

0 comments:

Post a Comment