ঢাকা অতি প্রাচীন এবং সৌন্দর্যের নগরী। কিন্তু ঢাকা শহরের এই সৌন্দর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও যে সৌন্দর্যগুলো ঢাকাকে আলোকিত করে রেখেছে এবং বাংলার জাতীয় ইতিহাসের সাথে বিশেভাবে জড়িত ঐতিহাসিক ভবন ও পুরাকৃতির অনুপম শৈল্পিক স্থাপত্য নির্দেশের মধ্যে আহসান মঞ্জিল অন্যতম।
নামকরণঃ জমিদার শেখ ইনায়েত উল্লাহ অস্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এখানে (বর্তমান আহসান মঞ্জিল) প্রমোদভবন নামে একটি রঙ্গমহল তৈরি করেন। ইনায়েত উল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ রঙ্গ মহলকে ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ফরাসিরা এই প্রমোদ ভবনটি বর্তমান আহসান মঞ্জিল) তাদের বাণিজ্য কুঠির হিসেবে ব্যবহার করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে ভবনটি ক্রয় করেন এবং বসবাস শুরু করেন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে নওয়াব আবদুল গণি পুরো ভবনটিকে পুনঃনির্মাণ করেন এবং তার পুত্র খাজা আহসান উল্লাহর নামানুসারে এই প্রমোদ ভবনটির নাম করেন আহসান মঞ্জিল।
যাদুঘরে রূপান্তর
পাক আমলের শেষ দিক থেকে আহসান মঞ্জিলকে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা চলছিলো এবং স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ঢাকা জাদুঘর এবং পর্যটন করপোরেশনকে যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এমএইচ, খান এর নেতৃত্ব প্রকল্পটির অগ্রগতি হয় এবং ১৯৭৭ সালে ঢাকা জাদুঘঘর কর্তৃক ২,২৫,৫০,০০০ টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে পরিকল্পনা করা হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আহসান মঞ্জিলকে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে উদ্বোধন করেন।
মঞ্জিলের বর্ণনা
শতাব্দীতে ঢাকায় নির্মিত অন্যান্য ইমারতের মধ্যে আহসান মঞ্জিল একটি উল্লেখযোগ্য ও অনবদ্য শৈল্পিক স্থাপত্য নিদর্শন। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দিকে প্রাকৃতিক দৃশ্যশোভিত প্রাসাদের মনোরম অঙ্গন বিস্তৃত। সমগ্র আহসান মঞ্জিল ২টি অংশে বিভক্ত। পূর্বপাশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন এবং পশ্চিমাংশের আবাসিক প্রকোষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দর মহল। প্রাসাদ ভবনটি আবার ২টি সুষম অংশে বিভক্ত। মাঝখানে অষ্টকোণ গম্বুজটি উত্তোলিত।
গ্যালারি পরিচিত
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে মোট গ্যালারির সংখ্যা ২৬টি। মূল ভবনের সংস্কার কাজ চলার কারণে দর্শনীয় বস্তুগুলোকে পাশের ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। স্থানসংকুলানের অভাবে এ ভবনে মোট ১১টি গ্যালারি করা হয়েছে।
গ্যালারি-১
প্রথম গ্যালারিতে আপনি দেখতে পাবেন আহসান মঞ্জিলের ইতিহাস লেখা বোর্ড, আহসান মঞ্জিলের মডেল, আহসান মঞ্জিলের তৈল চিত্র, ফানুস, ঝাড়বাতি।
গ্যালারি-২
এই গ্যালারীতে আপনি দেখতে পাবেন নওয়াব সলিমুলহ্মাহ, লর্ড মিন্টো, লর্ড কার্জন, আগা খানের প্রতিকৃতি। শাহবাগ বাগানবাড়ির ছবি। নওয়াবদের ব্যবহৃত ল্যাম্প, কেরোসিন বাতি, অষ্টকোণ টেবিল, হুক্কার খোল, কোলকের ঢাকনা, ফুলদানী, পিকদান, খামদানি পানদানি, আফতারাব, সুরাই কোর্টা, গোলাব পাশ, আতরদানি ফলপাত্র, সাবানদানী, চিনিপাত্র, চা পাত্র, দুধদান জগ, কেটলি এবং নিখিল ভারত মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দের ছবি।
গ্যালারি-৩
এই গ্যালাারতে দেখতে পাবেন চীনা মাটির ফুলদানি ও স্টান্ড ক্রিস্টাল চেয়ার, ক্রিস্টাল চেয়ার, অলংকৃত চেয়ার, হুক্কা, বিলিয়ার্ড বক্স, বিলিয়ার্ড বল, হাতির দাঁদের বিভিন্ন সামগ্রিক হাত পাখা, পিঠচুলকানি, কাঁচি, চাকু, চামচ ও অলংকৃত সামগ্রী।
গ্যালারি ৪
এই গ্যালারিতে আপনি দেখতে পাবেন নওয়াব আবদুল গণি, আহসান উল্লাহ, সমিলমুলহ্মাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা হাফিজুল্লাহ, নওয়াব হাবিবুল্লাহর প্রতিকৃতি। আরো দেখতে পাবেন- ডাইরী, জমি পত্তন দেয়ার দলিল, ডাইরী (উর্দ্দুতে লেখা) নওয়াবদের বংশের তালিকা।
গ্যালারি- ৫
এই গ্যালারীতে আছে নওয়াব সলিমুলহ্মার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চিঠি, জুয়েলারী এলবাম, ফটো এলবাম, আলোকচিত্র, তরবারি, গুপ্তি বেয়নেট, লেটার স্টান্ড, সীল রাখার পাত্র। ডেক্স কেলেন্ডার স্টান্ড, নওয়াব সলিমুল্লার ব্যবহৃত টুপি। তারবারি, সলিমুল্লার প্রতিকৃতি।
গ্যালারি-৬
এই গ্যালারি পুরোটাই একটা অতিথি ক । চেয়ার, টেবিল, শোপিস, ওয়াল পেপার, সোফা, ডাইনিং টেবিল, আলনা, প্রতিকৃতি, চেয়ার ইত্যাদিতে ভরপুর এই ক ।
গ্যালারি- ৭
এই গ্যালারিতে আছে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা, ব্যাজ, মেডেল, হোল্ডার, কোর্টপিন ও মেডেল, কোর্টপিন, রাবার স্প্যাম্প, কাঠ ও রাবার স্মারক ব্যাজ। এই গ্যালারিতে আরো আছে এ.কে. ফজলুল হক, হাকিব হাবিবুর রহমান, স্যার আশরাফ আলী, সৈয়দ শামসুল হুদা, স্যার আবদুর রহমান, স্যার যুবেন্দনাথ ব্যানার্জী, মাওলানা মোঃ আলী, সৈয়দ আমীর আলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নওয়াব মোহসীনুল মুলফ, মাওলানা আকরাম খাঁ, স্যার সৈয়দ আহম্মদ খানের প্রতিকৃতি।
আরো আছে- অলংকৃত চেয়ার কাঠ, হুক্কা, নল, নইচা, কলকে।
গ্যালারি- ৮
এই গ্যালারিতে নওয়াব আবদুল গণির প্রিয় হাতি ফিরোজ জং এর মাথার কঙ্কাল গজদন্তসহ সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
গ্যালরি- ৯
এই গ্যালারির মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন, ফিল্টার ট্যাংকসহ পানির কল ঘরের দৃশ্য। পানির ট্যাপ, জগ, পানির গ্লাস, কেরোসিন বাতি, গার্ডবাতি, হারিকেন সার্চ বাতি, হারিকেন-চুল্লি, বাইগুন বাতির প্রসাদ, কেরোসিন চালিত পাখা, ব্যাটারি বৈদ্যুতিক মিটার, বৈদ্যুতিক কেটলি, ইশরাত মঞ্জিলের ছবি। কেরোসিন চুল্লি, বৈদ্যুতিক হিটার, টেবিল ল্যাম্প, মোমবাতি, ফানুস, লোহার চুল্লি, পানির ট্যাপ, অলংকৃত বালতি, মগ।
আরো দেখতে পাবেন বিভিন্ন তৈলচিত্র- নওয়াব আবদুল গণির অনুদানে ১৮৭৪ খ্রীঃ ঢাকার প্রথম পানীয় জলের কল উদ্বোধনের তৈলচিত্র। আরো আছে পানির ড্রাম।
গ্যালরী- ১০
এই গ্যালারীতে দেখতে স্টেট বেডরশুম। যার মধ্যে আছে খাট, ডেসিং টেবিল, ঘরি, বড় আয়না, কাঁচের ল্যাম্প, জামা-কাপড় রাখার স্ট্যান্ড।
গ্যালরি- ১১
এই গ্যালারি ভবনের নীচ তলায় একটির পাঠাগার আছে আপনি ইচ্ছে করলে আহসান মঞ্জিল সম্পর্কে এই পাঠাগারে গিয়ে জানতে পারবেন।
অবস্থানঃ ঢাকা শহরের দক্ষিণাংশের বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই সুরম্য মঞ্জিল অবস্থিত।
যেভাবে যাবেনঃ আপনি দেশের যে প্রান্ত থেকেই আহসান মঞ্জিল দেখতে আসবেন আপনাকে প্রথম সদরঘাট (পুরান ঢাকাই যেতে হবে। সেখান থেকে হেঁটে অথবা রিকশায় করে আপনি চলে যেতে পারবেন আহসান মঞ্জিল। আহসান মঞ্জিল জাদুঘর খোলা থাকে শীতকালে শনি-বুধবার ৯.৩০ থেকে ৪.৪০ পর্যন্ত।
শুক্রবার- বিকেল ৩.৩০ থেকে ৭.৩০ পর্যন্ত এবং বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
আরো ছবি দেখতে চাইলে....এই লিংকে যান
আরো ছবি দেখতে চাইলে....এই লিংকে যান
আহসান মঞ্জিলের উপর বেশ তথ্যনির্ভর পোস্ট... :) ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্যে...