পদ্মার তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ শহরের উত্থান। আগে এ জেলার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। ১৮২৫ সালে সেটি নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। রেশম উত্পাদন কেন্দ্র এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী শহর হওয়ায় ইংরেজ বণিকদের সহজেই নজর কাড়ে রাজশাহী। পর্যায়ক্রমে ওলন্দাজ, ফরাসি, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এ শহরে। ওলন্দাজ রেশম কারখানার ভবনটি ছিল বড়কুঠি নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদর দফতর বসেছিল বড়কুঠিতে। উনিশ শতকের শেষ দিকে বড়কুঠি ব্রিটিশদের নিকট থেকে মেদিনীপুর জমিদার কিনে নেয়। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর একে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের গুদামঘর করা হয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড় কুঠি হয় ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ও কার্যালয়। শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলো হলো সাহেববাজার, রানীবাজার, রেশম পট্টি, ঘোড়ামারা, হাতেমখানা, দরগাপাড়া, কুমারপাড়া, বোয়ালিয়া ইত্যাদি। ১৮৭৬ সালে রাজশাহী পৌরসভা ও ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় রাজশাহী শহর।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
রাজশাহী ভ্রমণের শুরুতেই দেখে নিন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। তাতে এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা মিলবে। রাজশাহী সদর হাসপাতালের সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরত্ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামাপ্রসাদ চন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৬ সালে মূল জাদুঘর ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তত্কালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। ১৯৬৪ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের দায়িত্ব বর্তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আটটি গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, প্রায় এক হাজার পোড়ামাটির ফলক ছাড়াও হাজারো নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে। এপ্রিল থেকে অক্টোবরে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, নভেম্বর থেকে মার্চে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থকে এটি। শুক্রবার খোলা থাকে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে।
শাহ মখদুমের (র.) সমাধি
রাজশাহী সরকারি কলেজের কাছে দরগা পাড়ায় রয়েছে এ অঞ্চলের দরবেশ পুরুষ শাহ মখদুমের (র.) সমাধি। ১২৮৭ সালে তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে এ অঞ্চলে আসেন। ১৩১৩ সালে চিরকুমার এ দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। আলীকুলী বেগ ১৬৩৫ সালে তার সমাধির উপরে এক গম্বুজবিশিষ্ট সৌধ নির্মাণ করেন। প্রতিবছর আরবি মাসের ২৭ রজব এখানে উরস অনুষ্ঠিত হয়। আর ১০ মহররম এখান থেকে বের হয় তাজিয়া মিছিল।
টি বাঁধ
রাজশাহী শহরের পাশে পদ্মার তীরে ইংরেজি টি আকৃতির বাঁধ এখন শহরের অন্যতম বেড়ানোর জায়গা। পদ্মার শীতল বাতাসের পরশ নিতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ এখানে জড়ো হন। এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে পদ্মার চরেও ঘুরে আসা যায়।
বিসিক শিল্প এলাকা
শহরের বিসিক শিল্প এলাকায় আছে সিল্ক ফ্যাক্টরি। বিভিন্ন সিল্ক কারখানার শোরুমও আছে এখানে। তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে সিল্কের কাপড় কেনা যায়।
স্মৃতি অম্লান
মহান মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিসৌধটি রাজশাহীর কেন্দ্রস্থলে শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায়। ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। স্মৃতি অম্লান-এর নির্মাণ ও স্থাপিত্যিক ডিজাইনে নির্দেশনা দেন স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদ। এই স্মৃতিসৌধটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক। সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে ২৪টি করে ধাপ, ধাপগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তন ও স্বাধীনতার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে স্তম্ভের গায়ের ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে। প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে ১০টি করে ছিদ্র। বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে। সৌধের চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
রাজশাহী শহরের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছায়াঘেরা ক্যাম্পাসে বেড়াতে ভালো লাগবে সবার।
শাবাশ বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্যটিও রাজশাহীতে অবস্থিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরে মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে এটি অবস্থিত। রাকসু এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুন্ড এই ভাস্কর্যটি বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এটি উদ্বোধন করেন। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লাসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে।
বানেশ্বর বাজার
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বসে বানেশ্বরে। ঢাকা থেকে সড়কপথে যাবার সময় রাজশাহীর আগেই পড়ে বিশাল এ বাজার। এ বাজারে আমের দামও তুলনামূলক কম। দীর্ঘ এলাকাজুড়ে মহাসড়কের দুইপাশে নানান জাতের আমের পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। নিজস্ব বাহনে ভ্রমণে গেলে ফেরার পথে এ বাজার থেকে কিনে নিতে পারেন পছন্দসই আম।
বাঘা মসজিদ
রাজশাহী থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে বাঘায় অবস্থিত ইট নির্মিত প্রাচীন মসজিদ। প্রায় ২৩.১৬ মি দৈর্ঘ্য এবং ১২.৮০ মিটার প্রস্থের এ মসজিদটির ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ছাদ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পরবর্তীতে গম্বুজসহ ছাদটি পুনর্নিমাণ করে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে প্রচুর পোড়ামাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত একটি বিশেষ নামাজ কক্ষ আছে। ধারণা করা হয়, কক্ষটি শুধু সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে করাচিতে সংরক্ষিত মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের ওপরের শিলালিপি অনুযায়ী সুলতান নসরত শাহ মসজিদটি ১৫২৩ সালে নির্মাণ করেন। মসজিদের পূর্ব পাশে আছে বিশাল আকৃতির একটি দিঘি। বাঘা মসজিদের আশপাশের এলাকাজুড়ে রয়েছে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন আমের বাগান। ঘুরে দেখতে পারেন এগুলোও। রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন থেকে ত্রিশ মিনিট পর পর বাঘার উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪০-৪৫ টাকা।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে রাজশাহী যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে গ্রীন লাইনের (০১৭৩০০৬০০০৪) তাপনিয়ন্ত্রিত বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৫০০ টাকা। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পরিবহন (০২-৯১৪১০৪৭), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০২-৯১৩৫০১৮), ন্যাশনাল পরিবহন ইত্যাদি পরিবহনের সাধারণ বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ২৮০-৩০০ টাকা। ঢাকার কমলাপুর থেকে রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস। ভাড়া এসি বার্থ ৬৮০ টাকা, এসি সিট ৪৬৬ টাকা, প্রথম শ্রেণী বার্থ ৪০৫ টাকা, প্রথম শ্রেণী সিট ২৮৫ টাকা, স্নিগ্ধা ৩৪৪ টাকা, শোভন চেয়ার ১৬৫ টাকা, শোভন ১৪০ টাকা।
কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল আছে। এ শহরে ১০০-৪০০০ টাকায় বিভিন্ন মানের হোটেল পাওয়া যাবে। রাজশাহী চিড়িয়াখানার সামনে পর্যটন মোটেল (০৭২১-৭৭৫২৩৭, ০৭২১-৭৭০২৪৭), সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭১১০০, ০১৭১১৩০২৩২২), বিন্দুরমোড় রেল গেইটে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭৩৮৩৯, ০১৭১১৮০২৩৮৭), গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৬১৮৮, ৭৭১৮০৮), মালোপাড়ায় হোটেল সুকর্ণা ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭১৮১৭, ০১৭১৩৭২৪২৮৪), সাহেব বাজারে হামিদিয়া গ্রান্ড হোটেল (০৭২১-৭৭২৯৩০, ০১৭১৩৭০১০৫০), শিরোইলে হকস্ ইন (০৭২১-৮১০৭২১, ০১৭১৫৬০৫১৫৭), লক্ষ্মীপুর মোড়ে হোটেল গ্যালাক্সি (৮১২৭৪০, ০১৭৩৫৬৯২০২৯), সাহেব বাজারে হোটেল নিউ টাউন ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭৪৯৬১, ০১৭১৩৭০৪৩১৪)।