Thursday, April 26, 2012

তাজহাট জমিদার বাড়ি, রংপুর

47 comments
হাতিশালে হাতি নেই, আস্তাবলে ঘোড়া নেই, নায়েব মশাইর ব্যস্ততা নেই, দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রজাদের আরজি নেই, খাজনা পরিশোধের তাগিদ নেই_ সবই আজ ইতিহাস। জমিদার বাড়ি ঘুরে এসে লিখেছেন ফখরুল ইসলাম
Tajhat Zomidar Bari, Rangpur, Bangladesh

৯৬ একর জায়গাজুড়ে বিশাল রাজবাড়ি। শান বাঁধানো দুটি বড় পুকুর। বিস্তীর্ণ বিশাল বাগান। সব কিছু সাজানো-গোছানো। সদর ফটক থেকে সোজা পথটি রাজবাড়ির সামনে এসে মিশেছে। পথই চিনিয়ে নিয়ে যাবে আগন্তুককে। শান-শওকত, জৌলুস_ কিছুর কমতি নেই। রাজবাড়ির বৈঠকখানা গমগম করছে। রাজা মশাই আসার এলান হতেই পিনপতন নীরবতা। উপস্থিত মজলিসের কুর্নিশ আর শ্রদ্ধায় সিক্ত রাজা আসন গ্রহণ করলেন। অন্দর মহল রানীর রূপের আলোয় উদ্ভাসিত। বাঁদিদের ব্যস্ততা। এভাবেই চলছিল প্রতাপশালী মহারাজা গোবিন্দ লালের রাজ্যপাট। সময়ের অনেক বাঁক পেরিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আজ দাঁড়িয়ে আছে তাজহাট জমিদার বাড়ি। শহরের কোলাহল, অসহনীয় ধুলাবালি, যানজটে ঘর্মাক্ত সময়ের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত বোধ করছেন কিংবা ফ্ল্যাটবাড়ির কুঠুরির যাপিত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা কোনো নাগরিক যদি অন্তত কিছুটা সময় বিশাল খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখার ছল করে মন ভরে দম নিতে চান, তারা ঘুরে আসুন তাজহাট জমিদার বাড়ি। ব্যবসায়িক, দাফতরিক অথবা অন্য কোনো কাজে রংপুর এলে হাতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়ে দেখে যেতে পারেন হালে জাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়া এ জমিদার বাড়ি।
প্রাসাদটি যেভাবে দেখলাম : পূর্বমুখী দোতলা এ বিশাল প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ৭৬ দশমিক ২০ মিটার। এটির ভূমি নকশা ইংরেজি ইউয়ের মতো এবং পশ্চিম দিক উন্মুক্ত। প্রাসাদটির নিচ তলায় প্রবেশপথের পশ্চাতে ১৮ দশমিক ২৯ বাই ১৩ দশমিক ৭২ মিটার মাপের হলঘর আছে। প্রাসাদ অভ্যন্তরের পুরোভাগেই আছে ৩ মিটার প্রশস্ত বারান্দা। ১৫ দমমিক ২৪ মিটার প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গেছে। তা ইতালি থেকে আনা মার্বেল পাথরে তৈরি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, এ সিঁড়ির উভয় পাশে দোতলা পর্যন্ত ইতালীয় মার্বেলের ধ্রুপদী রোমান দেব-দেবীর মূর্তি দ্বারা সজ্জিত ছিল। অযত্ন-অবহেলা এবং যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে এগুলো অনেক আগে হারিয়ে গেছে। প্রাসাদের সামনের দিকে দুই প্রান্তে সেমিআটকোনার উদ্গত ও মধ্যভাগে একটি ৯ দশমিক ১৪ মিটার উদ্গত বারান্দা রয়েছে। ওই বারান্দার ছাদের ওপর চারটি সুসজ্জিত করিন্থীয় স্তম্ভ ও দুই পাশের উদ্গত অংশের প্রতিটিতে দুটি করে একই ধরনের স্তম্ভ রয়েছে। এর ওপর ত্রিকোণ আকৃতির চালের দুটি কক্ষ আছে। উপরতলায় ওঠার জন্য দুটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। প্রাসাদের পেছনের দিক দিয়ে উপরে ওঠার জন্য দু'প্রান্তে দুটি গোল আকৃতির লোহার সিঁড়ি রয়েছে। এ প্রাসাদে ২২টি কক্ষ আছে। প্রাসাদ থেকে সদর ফটকে যাওয়ার পথের দু'পাশে প্রাসাদের সামনে দুটি বড় আকৃতির পুকুর আছে। পুকুর দুটির চারদিকে প্রায় ২ দশমিক ৫ ফুট উঁচু কারুকার্যময় দেয়াল রয়েছে। আছে সুদৃশ্য সিঁড়ি। এ পুকুর দুটির চারদিকে রয়েছে নারিকেল বীথিকার সারি। অবশিষ্ট সবটুকু জায়গাজুড়ে ফুলের বাগান। নরম সবুজ ঘাস আবৃত করে রেখেছে বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান। কান পেতে শুনতে পারেন এ প্রাসাদের বাসিন্দাদের হারিয়ে যাওয়া পায়ের আওয়াজ, নূপুরের নিকস্ফণ, সেতারের মূর্ছনা, রাগ আর ঠুমরির সুর লহরি।
পেছন ফিরে দেখা : এ রাজবাড়ির ৫৬ একর জায়গায় সরকার গড়ে তুলেছে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। অবশিষ্ট ৪০ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে এটি এখন কালের মহিমা ঘোষণা করে যাচ্ছে। ২০০২ সালে সরকার এখানে রংপুর জাদুঘর স্থানান্তর করে। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর রাজবাড়িটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এরও আগে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি বাংলাদেশ সুুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এ প্রাসাদের ইতিহাস সংক্ষেপে এ রকম যে, মান্না লাল রায় তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। শিখ ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি পাঞ্জাব থেকে এসে রংপুরের মাহীগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহীগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা শহর। কথিত আছে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্না লাল রায়ের আকর্ষণীয় 'তাজ' আর 'রত্ন' খচিত মুকুটের কারণে এ এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট। জীবদ্দশায় তিনি বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হন। রংপুরের অনেক এলাকা তার আয়ত্তে আসে। বংশপরম্পরায় মান্না লাল রায়ের নাতি ধনপতি লাল জমিদার হন। ধনপতি রায়ের নাতি উপেন্দ্র লাল রায় জমিদারি গ্রহণের পর অল্প বয়সে মারা যান। তখন জমিদারির দায়িত্ব তার কাকা 'মুনসেফ' গিরিধারী লাল রায়ের হাতে আসে। তিনি নিঃসন্তান হওয়ার কারণে কলকাতার গোবিন্দ লালকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গোবিন্দ লাল ১৮৭৯ সালে এই জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা আর জনপ্রিয়। তিনি ১৮৮৫ সালে 'রাজা', ১৮৯২ সালে 'রাজাবাহাদুর' এবং ১৮৯৬ সালে 'মহারাজা' উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে তিনি মারা যান। ১৯০৮ সালে তার ছেলে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় রাজবাড়ির মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনে ভারতে যাওয়ার সময় কুষ্টিয়ায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছেলেমেয়েরা তার লাশ ও মালপত্র নিয়ে ভারতে চলে যান। এখন রাজবাড়িতে জমিদার আমলের কাঠের একটি টেবিল-চেয়ার ও ঝাড়বাতির অংশ আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
যা যা দেখতে পাবেন : দোতলায় প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংগ্রহশালাটি অনেক সমৃদ্ধ না হলেও দেখার মতো অনেক কিছু আছে। ২ হাজার বছরের পুরনো ছাদ আছে। তা মহাস্থানগড়ে রাজা পরশুরামের বাড়ি খনন করে ৬০ ফুট মাটির নিচ থেকে পাওয়া গেছে। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুলাই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পাওয়া উল্কাপিণ্ড এখানে যত্নে রক্ষিত আছে দর্শনার্থীদের জন্য। এখানে আছে এক বিশেষ পাথর, নাম 'কচিকা পাথর'। এ পাথর ছয় মাস পানির নিচে রাখলে তা থেকে নতুন পাথর হয়। ১৯৩২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লেখা বেগম রোকেয়ার চিঠি, তুলট কাগজে লেখা সংস্কৃত হস্তলিপি, ১৭ খ্রিস্টাব্দে লেখা বিসমিল্লাহসহ ৫ কালিমার শাহাদৎ উৎকীর্ণ আরবি শিলালিপি, ৬৯ হিজরির পোড়ামাটির ইস্টকলিপি। তা লালমনিরহাট জেলার অন্তর্গত হারানো মসজিদ থেকে উদ্ধার করা হয়। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের শিলালিপি, ১৬৯১ সালের কালো পাথরের সংস্কৃতি শিলালিপি, এক দশমিক ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, এক ইঞ্চি প্রস্থ ও আধা ইঞ্চি পুরো কোরআন শরিফ, পোড়ামাটির সিলমোহর, মাটির পাত্র, বৃহৎ হাতির দাঁত ও হাতির দাঁতের পাশা, বিভিন্ন আকার ও সময়ের অনেক বিষ্ণুমূর্তিসহ প্রত্নসম্পদ এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রক্ষিত আছে।
টুকিটাকি তথ্য :মূল ফটকে জনপ্রতি ১০ টাকা টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হবে। মূল জাদুঘরে ছবি তোলার অনুমতি নেই। প্রাসাদের বাইরে ছবি তোলা যাবে। রংপুর শহর থেকে রিকশা ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা।

47 comments:

Post a Comment