ফুটবল মানেই উম্মাদনা আর উম্মাদনা মানেই তো ফুটবল। এই এক ফুটবলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে কত নাটক, কত কাহিনী আর হাজার আনন্দাশ্রু এবং দুঃখের নোনা জলে অঙ্কিত রূপকথা। যে বল নিয়েই এত আলোচনা, কত শত ইতিহাসের জন্ম তো সেই বলের হালচাল নিয়ে কি একটু হলেও উম্মাদনা থাকা সমীচিন নয় কি?
ফুটবল এমনই এক খেলা যা কিনা সমাজের সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষের রক্তে মিশে আছে। পেলে, গাহিন্সা, সক্রেটিস থেকে শুরু করে আজকের মেসি, রোনালদো কিংবা তেভেজের কথাই একবার ভাবুন। অভাবের সংসার থেকে উঠে এসে পাড়ায় পাড়ায় ছেড়া-ফাটা বল নিয়ে খেলতে খেলতে আজ তাঁরা কোথায়! তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে পরিবর্তন সামাজিক অবস্থানের তবে গোলাকার সেই বস্তুটি কিন্তু গোলাকারই আছে বৈকি! তবে এটা ঠিক কালের পরিক্রমায় এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বদান্যতায় সেটার বাহ্যিক গঠনের মসৃণতা বেড়েই চলেছে। যতই যা পরিবর্তন হোক না কেন ফুটবলের প্রতি সে ভালবাসা আর উত্তেজনাটা আগের মতোই অকৃত্রিম রয়ে গেছে।
শুরুটা হয়েছিল ‘জুলে রিমে ট্রফি’ দিয়ে। এরপর নাম নিল ‘ওয়ার্ল্ড কাপ’ অর্থাৎ ‘বিশ্বকাপ’। পায়ের আঘাতে বল এক প্রান্ত থেকে ছুটে চলে অন্য প্রান্তে আর সেইসাথে রচিত হয় বীরত্বগাঁথা। ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরের নাম বিশ্বকাপ। ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিশ্বকাপের ফুটবল নিয়েই আমাদের এই ছোট্ট প্রচেষ্টা। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিশ্বকাপের বিভিন্ন আসরের কতিপয় বলগুলো-
১. টেলস্টার (১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপ)
অ্যাডিডাস ১৯৬৩ সাল থেকে ফুটবল প্রস্তুত করা শুরু করলেও ১৯৭০ সালেই প্রথম তারা বিশ্বকাপের জন্য ফুটবল প্রস্তুত করে। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দামী বল ছিল এটি। বিশ্বকাপের বল বলে কথা! বলটির ডিজাইন ছিল ‘বাকমিনস্টার’ ঘরনার। সেই আমলে রঙিন টেলিভিশন ছিল দুর্লভ। তাই সকল শ্রেণির দর্শকদের বিবেচনায় বলটিকে এমন ভাবে রূপ দেয়া হয়েছিল যেন তা সাদা কালো টেলিভিশনে স্পষ্ট দেখা যায়। বলটিকে ৩২টি সাদা এবং কালো প্যানেল রয়েছে। যা বলটিকে দিয়েছিল অনন্য এক রূপ।
২.টেলস্টার ডুরলাস্ট ( ১৯৭৪ পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপ)
এই বলটিও অ্যাডিডাসের তৈরি। বস্তুত এটি ছিল ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের বলটির উন্নত একটি রূপ। পূর্বের বলটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল যে বলটি বেশ ভারী। শট নিতে বেশ বেগ পেতে হত। তাই অ্যাডিডাস এই বলটির কারিগরি ত্রুটি সমাধান করার একটি চেষ্টা চালায়। সোনালি ব্র্যান্ডিংয়ের বদলে কালো ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করা হয় এই বলটিতে। এটাই প্রথম বল যেটাতে নাম এবং লোগো একইসাথে ব্যবহার করা হয়।
৩.ট্যাঙ্গো ডুরলাস্ট (১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ)
গতি, সৌন্দর্য এবং সময়োপযোগী চাহিদার দাবি মেটাতে বলটির আবির্ভাব। বলটিতে ছিল ২০টি প্যানেল এবং ১২টি বৃত্তাকার চিহ্ন যা বলটিকে দিয়েছিল অন্য এক চেহারা যা দিয়ে সহজেই বলটিকে আলাদা করে বোঝা যেত। বলটি এতোই খ্যাতি পায় যে পরবর্তী ৫টি বিশ্বকাপ এই বলটির ডিজাইন দিয়েই চালিয়ে নেয়া হয়।
৪.ট্যাঙ্গো স্পানা (১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপ)
এই বলটি দেখতে পূর্ববর্তী বিশ্বকাপের বলটির মতই। বলটিতে রাবারের একটি স্তর রাখা হয় যা বলটিতে পানি প্রবেশের পথে বাঁধার সৃষ্টি করত। এটাই প্রথম পানি বিরোধী বল। বলটিতে সমস্যা ছিল কিছুক্ষণ ম্যাচে গড়ানোর পর রাবারের স্তরটি খসে পড়ত। তাই বিরতির সময় বল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে ধরা পড়ত। এটাই ছিল সর্বশেষ আসল চামড়ার বল যা দিয়ে বিশ্বকাপ খেলা হয়েছিল।
৫.অ্যাজটেকা (১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ)
এই বলটি ছিল প্রথম সিনথেটিকের বল। বলটি হাল আমলে বেশ জনপ্রিয় ছিল বলটির অসাধারণ গতির জন্য। বলটি ইতোপূর্বের বলগুলোর তুলনায় হালকা ছিল যা বলাই বাহুল্য। বলটি ভেজা কিংবা শক্ত মাটি উভয়ক্ষেত্রেই সমধর্মী আচরণ প্রদর্শন করত। স্বাগতিক দেশের অ্যাজটেক স্থাপত্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত রেখেই বলটির এমন নামকরণ করা হয়েছিল।
৬.এতরুস্কো (১৯৯০ ইতালী বিশ্বকাপ)
এই বলটিতে সর্বপ্রথম পলিইউরেথিনের ফোম অভ্যন্তরীন আস্তরণ ব্যবহার করা হয়েছিল। ইতালীর ইতিহাস এবং এতরুস্কো সম্প্রদায়ের কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে বলটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল।
৭.কুয়েস্ট্রা (১৯৯৪ যুক্তরাস্ট্র বিশ্বকাপ)
এই বলটিতে পলিস্টাইরিনের ফোমের আস্তরণ ব্যবহার করা হয়েছিল। বলটি একাধারে পানিরোধকই ছিল না সেই সাথে বলটির গতি ছিল বলার মত! পূর্বের বিশ্বকাপের বলগুলোর তুলনায় হালকা এবং নরম ছিল এই বলটি। বলের আকার আকৃতি পরিবর্তন করে বলের প্রতি নিয়ন্ত্রণ কৌশলেরও বেশ উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
৮.ট্রাইকোলোর (১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপ)
বিশ্বকাপ বলের ইতিহাসে প্রথম রঙিন বল। ফ্রান্সের জাতীয় পতাকার লাল, সাদা এবং নীল রঙকে ইঙ্গিত করে বলটিতেও তেমনই একটা ছোঁয়া রাখা হয়।
৯.ফেভারনোভা (২০০২ কোরিয়া জাপান বিশ্বকাপ )
২০০২ সালের কোরিয়া জাপান বিশ্বকাপকে লক্ষ্য রেখে অ্যাডিডাস মোটা অভ্যন্তরীণ আস্তরণ বিশিষ্ট এই বলটি তৈরি করে। অভ্যন্তরীণ আস্তরণটি অপেক্ষাকৃত মোটা হওয়ার কারণে বলটি বাতাসে বেশ বেগ পেত যার ফলে হেডিংয়ে পাওয়া যেত বাড়তি সুবিধা।
১০.টিমজিস্ট (২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ)
বলার অপেক্ষা রাখে না এই বলটি ফুটবল বিশ্বকে দেয়া অ্যাডিডাসের অন্যতম সেরা উপহার। বলটিতে প্যানেল কমিয়ে আনার কারণে বলটি আরো নিখুঁত এবং গোলাকৃতিরূপ ধারণ করে। “প্রপেলার ডিজাইন” নামক নতুন এবং ভিন্নধারার এই প্রযুক্তি বলটিতে প্রয়োগ করা হয় যার ফলে বলটিতে ‘বন্ধুর’ তল সংখ্যা হ্রাস পায়। এর ফলে ফুটবলাররা বলটিকে গতিশীল অবস্থায় খুব সহজেই কিক করতে সমর্থ হতেন।
১১.জাবুলানি (২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ)
বলটিতে ‘গ্রিপ এন গ্রুভ টেকনোলজি’ ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তিতে ব্যবহারের ফলে বলটি বৃষ্টিস্নাত কিংবা উষ্ণ আবহাওয়াতে সমান গতি বজায় রাখতে পারত। বলটিতে ত্রিমাত্রিক প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছিল যার ফলে বলটি পূর্বের বলগুলোর তুলনায় বেশ হালকা এবং আরো বেশী গোলাকাররূপ পেয়েছিল। বিশ্বকাপ ফাইনাল উপলক্ষে ‘জোবুলানি’ নামক সোনালি প্যানেল যুক্ত বিশেষ বল বানায় অ্যাডিডাস।
১২.ব্রাজুকা (২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ)
এই বলটি দিয়ে আসন্ন বিশ্বকাপ ফুটবল মাঠে গড়াবে। ধারণা করা হচ্ছে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত ও নিখুঁত বল হতে যাচ্ছে এটি। বলটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে উন্নত মানের প্রযুক্তি, সেই সাথে এটিই প্রথম বল যেটিতে রয়েছে অভিন্ন ছয়টি প্যানেল। ব্রাজুকার ওজন মাত্র ৪৩৭ গ্রাম, পানি শোষণ ক্ষমতা প্রায় ০.২%, এবং মাত্র ৭% চাপ হারাবে বলটি। ব্রাজিল বিশ্বকাপের ব্রাজুকায় অবশ্য লাগানো হবে উন্নত প্রযুক্তির ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা, বলের ‘চোখে’ খেলা দেখার অভিনব কায়দা।
0 comments:
Post a Comment