Monday, July 7, 2014

ব্রাজিল বিশ্বকাপের বল ব্রাজুকা’র আদ্যোপান্ত

0 comments
বারের ব্রাজিল বিশ্বকাপের বল ‘ব্রাজুকা’, আর অ্যাডিডাসের তৈরি এই বলটির আকর্ষনীয় নকঁশা ও নিখুঁত কার্যকর ভূমিকা খেলোয়াড়সহ দর্শকদেরও মন মাতাবে।
অদ্ভুত সুন্দর এই ‘ব্রাজুকা’ নামটি গৃহীত হয় ভোটাভুটির মাধ্যমে, ২০১৩ সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাজিলের প্রায় এক মিলিয়ন ফুটবল সমর্থক এই ভোটে অংশগ্রহণ করে। যে দেশে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় সাধারণত সে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আবহমান জীবন ধারা, প্রকৃতি-পরিবেশ ইত্যাদি তুলে ধরা হয় বিশ্বকাপের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নামকরণের মাধ্যমে। সেই ঐতিহ্য থেকেইএসেছে ‘ব্রাজুকা’(Brazuca) নামটি। ‘ব্রাজুকা’(Brazuca) একটি অপ্রচলিত লৌকিক পরিশব্দ যার অর্থ ‘ব্রাজিলিয়ান’ এবং আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে ‘ব্রাজুকা’ বলতে বুঝানো হচ্ছে যেভাবে ব্রাজিলিয়ানরা জীবনধারণ করে এবং তাদের নিত্যদিনের জীবনের সমষ্টি। সাম্বার দেশ ব্রাজিল, নানা রঙের নানা বর্ণের এক উৎসবমুখর দেশ। তাই স্বভাবতই ফুটবল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে রঙ্গিন বলটি হল এবারের ‘ব্রাজুকা’। বলের উপরিভাগের এই রঙ্গিন কারুকার্যও বেশ সুন্দর ভাবে তুলে ধরছে ব্রাজিলিয়ানদের একটি বিশেষ ঐতিহ্য; তা হল ব্রাজিলিয়ানরা ঐতিহ্যগত ভাবে বহু বর্ণের হাত বন্ধনী (wristbands) পরে থাকে সেটিকে। এখন পর্যন্ত ‘ব্রাজুকা’ বলটি নিয়ে কম বেশি প্রায় সকলেই সন্তুষ্ট, কেননা ইতিহাসের সবচেয় পরীক্ষিত বল এটি। ক্রীড়া সামগ্রী নির্মান প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাসের দীর্ঘ নিরলস পরিশ্রম ও গবেষণার ফসল এটি। বলটি বানানোর সময় অবশ্যই তাদের মাথায় ছিল ২০১০ বিশ্বকাপের বল জাবুলানি নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারটি। অনেকেই বেশ বিরক্ত ছিলেন জাবুলানি নিয়ে, আর ঐ বিশ্বকাপে আমেরিকার সাথে ড্র করার পর ইংল্যান্ড গোলরক্ষক তো বলেই ফেললেন এটি ‘জঘন্য’। আর তাই এবারে বিশ্বকাপের জন্য বল তৈরির ব্যাপারটি আরও বেশি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা পূর্বক খুবই সতর্ক ছিল অ্যাডিডাস।

বলটি তৈরির জন্য ব্যাবহার করা হয়েছে উন্নতমানের প্রযুক্তি এবং কলাকৌশল। চ্যাম্পিয়নস লীগে যে বল ব্যাবহৃত হয় এবং ইউরো ২০১২ এর জনপ্রিয় ও সফল বল ট্যাঙ্গো-১২ (Tango-12) যে প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছে সে প্রযুক্তি তো অবশ্যই ছিল, সেই সাথে বলের উপরিভাগ তৈরিতে আরও উন্নত মানের প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হয়েছে। এবারের বলটির প্যানেলের (panel) বুনন এবং আকৃতি একেবারেই ভিন্ন ও নতুন। এটি প্রথম কোন বল যেটিতে ব্যাবহার করা হয়েছে ছয়টি অভিন্ন প্যানেল এবং এগুলো একেবারে নিখুঁত ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন বাতাসে গোলরক্ষকদের জন্য জাবুলানির মত কোন সমস্যা না করে। বলটির নকঁশার ব্যাপারে অ্যাডিডাসের পরিচালক জানিয়েছেন এটি বাতাসে গতিবিদ্যার সূত্র প্রায় নিখুঁতভাবে মেনে চলে এবং উড়ন্ত অবস্থায় যথেষ্ট সুস্থির। জাবুলানি প্রায় গোলরক্ষকদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল কেননা বলটির উপরিভাগ ধরার জন্য গোলরক্ষকদের তেমন সুবিধা দেয় নি তবে এবারে ব্রাজুকা এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে গোলরক্ষক এবং অন্যরা সমান ভাবে নিজেদের খুশি মত এটিকে ব্যাবহার করতে পারে। ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার দানি আলভেজ বলটি দিয়ে খেলতে পারাটা দারুন আনন্দের হবে জানিয়ে বলেছেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল মাটিতে এবং বাতাসে বলটি সত্যি ভাল।”

ব্রাজুকার তৈরি সহ এর মান উন্নয়নে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর এবং বিভিন্নভাবে বলটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ের ব্যাপ্তিও অবাক করার মত- প্রায় আড়াই বছর! আগেই বলেছি এটি ইতিহাসের সবচেয়ে পরীক্ষিত বল। বলটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাথে জ়ড়িত ছিল প্রায় ১০ টি দেশের প্রায় ৩০ টি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাব যাদের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, ফ্লুমিনেসে, বায়ার্ন মিউনিখের মত ক্লাব সহ আরও অন্যান্য নামি-দামি ক্লাব ছিল; সেই সাথে এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত খেলোয়াড়ের সংখ্যা প্রায় ৬০০ জন এবং এদের মধ্যে প্রায় ৩০% খেলোয়াড় ছিলেন যাদের সাথে এডিডাসের কোন প্রকার চুক্তি নেই। এ থেকে সহজেই বোধগম্য যে বলটির ব্যাপারে কতখানি একনিষ্ঠ ছিল প্রতিষ্ঠানটি! মজার ব্যাপার হল বলটি আনষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করার আগেই এটি দিয়ে কিন্তু খেলা হয়েছে! অবাক হলেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ বলটি বিশ্বকাপের জন্য কতখানি উপযোগি তা যত্নশীল ভাবে পরীক্ষার জন্য গত অনুর্দ্ধ্ব-২০ ফুটবল বিশ্বকাপে, কিছু আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ ব্রাজুকা দিয়েই খেলা হয়েছে, এসবের মধ্যে ছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারির আর্জেন্টিনা বনাম সুইডেনের খেলাটিও; তবে অবশ্যই বল গুলো ছিল ছদ্মবেশের আড়ালে ভিন্ন খোলসে। এখন পর্যন্ত বলটি নিয়ে তেমন কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি। আর্জেন্টাইন তারকা মেসি বলটি সম্পর্কে বলেছেন, “বলটি সম্পর্কে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল এটি সত্যিই ভাল।”

এডিডাসের সাথে চুক্তি বিহীন যেসব খেলোয়াড় বলটির উন্নতিকরণ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে একজন ইংল্যান্ড অধিনায়ক জেরার্ড। কেউ বলটি নিয়ে নেতিবাচক কোন মন্তব্য করবে বলে মনে করেন না লিভারপুলের এই মিডফিল্ডার। “গোলরক্ষকদের জন্য যতদূর সম্ভব কঠিন বল আমি চাই কিন্তু আমি মনে করি ব্রাজুকা উভয় পক্ষের জন্যই পক্ষপাতহীন।” সেই সাথে জেরার্ড আরও বলেছেন, “একটি বিষয় নিশ্চিত বলটির ব্যাপারে কোন ওজর (excuse) থাকবে না।”

ব্রাজিলের বহুমাত্রিক আবহাওয়ার সাথে যেন সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে বলটি সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে বলটি; কি বৃষ্টি, কি তপ্ত রোদ, যে কোন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মত করেই উন্নত করা হয়েছে ব্রাজুকা। মাত্র ৪৩৭ গ্রাম ওজনের বলটির পানি শোষণ ক্ষমতা প্রায় ০.২%, এবং মাত্র ৭% চাপ হারাবে উন্নত মানের এই বলটি। বলটি তৈরিতে ব্যাবহৃত হয়েছে বিশেষ ধরণের রাবার (Butyl) এবং অন্যান্য কাচামালের মধ্যে ছিল বিশেষ ধরণের ফোম (PU Based)। বলটি নিয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা অ্যাডিডাস কতৃপক্ষের। প্রায় কম বেশি সব ধরনের আবহাওয়া, পরিস্থিতি ও পরিবেশে পরীক্ষা করা হয়েছে বলটি। গত বিশ্বকাপে জাবুলানি নিয়ে যে অসন্তুষ্টি ছিল খেলোয়াড়দের মাঝে, এবারে ব্রাজুকা নিয়ে তেমনটা হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।


0 comments:

Post a Comment