Wednesday, May 19, 2021

যুগে যুগে ইসরায়েলকে যেভাবে রক্ষা করেছে যুক্তরাষ্ট্র

0 comments
গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলায় বেড়েই চলেছে মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাইডেনের ভূমিকা নিয়ে দেশে-বিদেশে ক্ষোভ বাড়ছে। কিন্তু জো বাইডেনই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট নন যিনি সমালোচনা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের হামলা ও নির্যাতন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

যুগে যুগে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে শর্তহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন ও সামগ্রিকভাবে দেশটিকে ‘রক্ষা’ করেছেন।

২০২১ সালের চলতি মাসে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা চলাকালে জো বাইডেন দুই বার বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, গাজা থেকে রকেট ছোড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার আছে।

বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া, হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি বিবৃতিও প্রচার করতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যেটি সংঘাত বন্ধে কার্যকর হতে পারত।

২০১৮ সালের মে মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল ও এর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভক্ত ছিলেন। সেই মাসে ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যার পরও ইসরায়েলকে নিন্দার চেষ্টা বাতিল করে দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নিলে বিক্ষুব্ধ হন ফিলিস্তিনিরা। তারা ‘মহা সমাবেশের’ ডাক দিয়ে মিছিলে অংশ নিলে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালায়।

ইসরায়েলের সেই হামলার দায় হামাসের ওপর চাপিয়ে হোয়াইট হাউজের তৎকালীন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি রাজ শাহ বলেছিলেন, ‘এই নির্মম হত্যার দায় হামাসকে নিতে হবে।’ তিনি ‘উসকানি’ দেয়ার জন্য ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামী সংগঠন হামাসকে দায়ী করেন। তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ উদ্ধৃতিটিও স্মরণ করিয়ে দেন।

২০১৪ সালের জুলাইয়ে গাজা উপত্যকায় স্থল হামলার আগে টানা ১০ দিন বোমাবর্ষণ করেছিল ইসরায়েল। সে মাসের ১৮ তারিখে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কোনো দেশেরই সীমান্ত থেকে রকেট হামলা বা তার সীমান্তে সন্ত্রাসীদের সুড়ঙ্গ তৈরি মেনে নেয়া উচিত নয়। এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র, আমাদের বন্ধু ও মিত্রশক্তি আরও বেশি সংঘাত এবং সাধারণ নাগরিকদের প্রাণহানির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

জাতিসংঘের হিসাবে, ওই সময় ইসরায়েলি হামলায় গাজায় দেড় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৫০০-র বেশি শিশু ছিল।

২০১২ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামী সংগঠন হামাসের মিলিটারি কমান্ডার আহমেদ জাবারিকে গুপ্ত হত্যার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় অভিযান চালিয়ে ১০০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোককে হত্যা করে। বারাক ওবামা তখনো ইসরায়েলকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশই সীমান্তের বাইরে থেকে তার ভূখণ্ডে মিসাইল নিক্ষেপ সহ্য করবে না। সুতরাং, মানুষের বাড়িতে মিসাইল নিক্ষেপের হাত থেকে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।’

২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে গাজায় ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ নামে আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২২ দিন ধরে চলা ওই আক্রমণে ১,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন, তাদের অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক। এ ছাড়া, দেশটির বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।


 

২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হোয়াইট হাউসে তার মেয়াদের শেষ সপ্তাহে ওই হামলার জন্য শুধু হামাসকেই দায়ী করেছিলেন। তখন এনবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতের জন্য হামাসের উসকানি দায়ী বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বুশ।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলের নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনে গেলে তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ জানায় ফিলিস্তিনিরা। এতে ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে সাত ফিলিস্তিনি নিহত হন। এরপর ‘আল-আকসা ইন্তিফাদা’ নামে দ্বিতীয় গণজাগরণের ডাক দেয়া হয়। সে সময় আত্মঘাতী হামলা চালানো ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনগুলো ও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করায় তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ৩,০০০ ফিলিস্তিনি ও ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর হামলায় অন্তত ১,০০০ ইসরায়েলি নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্রে সেসময় নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইসরায়েলি আগ্রাসনকে সমর্থন না দিলেও টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর অ্যারিয়েল শ্যারনের সঙ্গে জোট করে ‘ওয়ার অন টেরর’ অভিযান শুরু করেন। এ ছাড়া, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে শ্যারনের প্রত্যাখ্যানকেও সমর্থন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ।

১৯৯৬ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ লেবাননের কানায় জাতিসংঘের অফিস চত্বরে আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলাকে সমর্থন করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ওই হামলায় ১০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন কয়েকশ। ইসরায়েল দাবি ছিল, ভুলবশত ওই হামলা করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে কয়েকটি আরব দেশ এক যোগে অভিযান চালিয়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করে। পাল্টা আক্রমণে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বিমান হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে। দ্রুততম সময়ে সেসব অস্ত্র সরবরাহ করায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডে মেয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশংসা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের কারণে যুদ্ধের ফলাফল ঘুরে গিয়েছিল। দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ করায় নিক্সন তার দেশের কংগ্রেসের প্রশংসা করেছিলেন।

১৯৬৭ সালের জুনে মিশরে বিমান হামলা করে ইসরায়েল। যার ফলে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে জর্ডান ও সিরিয়াও জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে গাজা, পশ্চিম তীর ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট লিন্ডোন বি জনসন ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারি, যখন শত্রুপক্ষ তাদের সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে, গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং যখন রাজনৈতিক নেতারা একটি জাতিকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বাতাস ভারি করে তোলে, তখন লোকেরা অবশ্যই তাদের নিজেদের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেয়।’

১৯৪৮ সালের ১৪ মে জুইশ অ্যাজেন্সির প্রধান স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেন যখন সেই ভূমিতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান তখনই এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ট্রুম্যানের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই সরকার জানতে পেরেছে যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে, এবং অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নব গঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্থায়ী সরকারকে ডি-ফ্যাক্টো কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

ঢাকা-টাইমস

 

0 comments:

Post a Comment