বিদেশে ভালো চাকরির আশায় যখন দেশ ছাড়েন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মুস্তাফিজুর শাহীন, তখন কল্পনাও করেননি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এক দ্বীপে তাকে এভাবে বন্দি থাকতে হবে, বেতন ছাড়াই কাজ করতে হবে, অভিযোগ করলে শিকার হতে হবে মারধরের এবং কেবল পালিয়ে যেতে পারলেই মিলবে নিস্তার।
প্রতিশ্রুতি ছিল জীবন বদলে দেওয়ার, মিলিয়নিয়র পোশাক ব্যবসায়ীর হয়ে কাজ করার। অথচ একসময় তা রূপ নেয় আধুনিক দাসত্বে, যেখানে প্রতিনিয়তই মারধর ও হত্যার হুমকি পেতেন শাহীন।
ভানুয়াতু দ্বীপের দিনগুলো স্মরণ করতে গিয়ে শাহীন মন্তব্য করেন, সেখানে নিজেকে তার 'জীবন্ত লাশ' বলে মনে হতো। তিনি বলেন, আমার সব স্বপ্ন, সব প্রত্যাশা ধুলোয় মিশে গেছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালের মধ্যে ভানুয়াতুতে আসা ১০৭ বাংলাদেশির মধ্যে শাহীন একজন। নিজেকে পোশাকের আন্তর্জাতিক একটি চেইনশপের মালিক পরিচয় দেওয়া মানব পাচারকারী শিকদার সুমন তাদের এখানে নিয়ে আসে।
এই ১০৭ বাংলাদেশির পরিণতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে আধুনিক দাসত্বের সবেচয়ে বড় ঘটনা। শাহীন এবং তার সহকর্মীদের প্রতারণা ও মারধরের শিকারের ঘটনা সামনে আসার পাঁচ বছর পার হলেও কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, উন্নত জীবনের আশায় এখনো অনেকের প্রত্যাশিত গন্তব্য ভানুয়াতুর মতো দ্বীপ।
শাহীনের জীবনে এই দুর্যোগের শুরু ২০১৮ সালের জুনে। ওই সময় টাঙ্গাইলের একটি বাস স্টেশনে শিকদার সুমনের এক সহযোগীর সঙ্গে তার দেখা হয়। শাহীনকে বলা হয়, সুমন 'মাল্টিমিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী', বিশ্বব্যাপী তার পোশাক ব্যবসা রয়েছে।
শাহীন খোঁজখবর নেন। সুমনের দাবি সে দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড মি. প্রাইসের হয়ে কাজ করে। শাহীন ভানুয়াতুর স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন আগেই প্রতিবেদন দেখতে পান, যার শিরোনাম 'ভানুয়াতুতে আসছে মি. প্রাইস'। সেখানে সুমন এবং ভানুয়াতুর একজন মন্ত্রীর উদ্ধুতি দেওয়া হয়েছে। বিষয়গুলো শাহীনের মনে ইতিবাচক ধারণা আনে।
দেশে শাহীনের ছোট তবে সফল পোশাক ব্যবসা ছিল। এই ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে সেগুলো সুমন এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেন শাহীন। স্ত্রী-সন্তানকে বিদায় জানিয়ে মি. প্রাইসের হয়ে কাজ করতে ভানুয়াতুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়েন শাহীন।
সে ঘটনার পাঁচ বছর হতে চলেছে, শাহীন এখনো দেশে ফেরেননি।
ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলায় আসার পর শাহীনের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। সমুদ্রতীরবর্তী একটি বাংলোতে তাকে আটকে রাখা হয়। ভাত আর বাঁধাকপি খেয়ে বেশিরভাগ দিন কাটিয়েছেন তিনি। সেখানে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদের দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করানো হতো।
২০২২ সালে এসে ভানুয়াতুর পাবলিস প্রসিকিউটর সুমন, তার স্ত্রী এবং দুই সহযোগীকে মানবপাচার, দাসত্ব, অর্থ পাচার, হত্যার হুমকি ও দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে।
ভানুয়াতুর প্রধান বিচারপতি ভিনসেন্ট লুনাবেক রায় ঘোষণার সময় বলেন, শিকদার সমুন সব সময় ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কি কি করা হবে তা বলে হুমকি দিত। বলা হতো, তাদের গাড়ির নিচে চাপা দেওয়া হবে, তাদের কুপিয়ে মারা হবে বা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে, জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তাদের ফ্রিজারে ঢুকিয়ে রাখা হবে। তাদের লাশের ছবি তুলে সেগুলোরে পরিবারের কাছে পাঠানো হবে বলেও হুমকি দেওয়া হতো।
শাহীন আল জাজিরাকে জানান, এসব হুমকিকে তারা কখনো হালকাভাবে নেননি। তিনি জানান, ভানুয়াতুতে আসার পরপরই সুমনের হয়ে কাজ করা এক বাংলাদেশি তাকে ঘুষি মারে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বলপ্রয়োগ করে তার থেকে ১৪ হাজার ডলার নিয়ে যায়।
আর টাকা দিতে না পারায় বলা হয়, তার উল্টো ঝুলন্ত, রক্তাক্ত ছবি বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কাছে পাঠানো হবে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ভীত অবস্থায় একদিন দিনের কাজের বিরতির মধ্যে যখন সুমনের লোকজন ঘুমাচ্ছিল তখন সুযোগ পেয়ে শাহীন ও আরও দুইজন বাংলো থেকে পালিয়ে যান। তারা সৈকতের দিকে ছোটেন এবং উপকূল ধরে এগুতে থাকেন। পাশে রাস্তায় তারা একটি গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়েন এবং তাদেরকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে বলেন।
ব্র্যান্ডের নাম ভাঙিয়ে মানবপাচার, অতপর দাসত্ব
কর্তৃপক্ষের মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে শাহীনসহ বাকি বাংলাদেশিদের ভানুয়াতুতে নিয়ে যায় সুমন। অনেককে বলা হয়, সুমনের মি. প্রাইসে কাজ করতে তারা বৈধ পথে অস্ট্রেলিয়া, কিউবা কিংবা নিউ ক্যালেডোনিয়াতে যাচ্ছেন।
জাল ব্যবসায়ী নথি, লাইসেন্স এবং পাশাপাশি ঘুষের মাধ্যমে পাচারকারীরা ভানুয়াতুর ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ব্যবস্থা করে।
এরপর ভুক্তভোগীরা হয়ে যান সুমনের দাস। মারধরের হুমকির মুখে খুব সামান্য অর্থ অথবা বিনা পারিশ্রমিকে তাদেরকে দিয়ে কাজ করানো হতো। স্থানীয় সংবাদপত্রের মতে, ভানুয়াতুতে আসার পর তাদের দিয়ে জোর করে নির্মাণকাজ, কাঠের আসবাব তৈরি ও বিক্রি করানো হতো তাদের দিয়ে। কাজ করতে অস্বীকার করলেই তাদের মারধর করা হতো। তাদের প্রতিশ্রুত চাকরি কিংবা বেতন কখনোই দেওয়া হয়নি।
তদন্তে উঠে আসে, ভানুয়াতুতে প্রকৃত ব্যবসা পরিচালনার কোনো উদ্দেশ্যই ছিল না সুমনের। মূলত শাহীনের মতো লোকদের থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে সুবিধাবঞ্চিত অবস্থায় রেখে যাওয়াই ছিল সুমনের লক্ষ্য।
শহরের কেন্দ্রে মি. প্রাইস-এর একটি দায়সারা গোছের শোরুম তৈরি করেছিল সুমন। তদন্তকারীরা পরে জানতে পারেন, সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিটির ব্র্যান্ড আর লোগো বিনা অনুমতিতেই ব্যবহার করছিল।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর সুমন নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে দাবি করে, সে জিম্বাবুয়ের নাগরিক। যদিও তদন্তকারীরা পরে আবিষ্কার করেন, তার পাসপোর্ট আদতে জাল।
বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ। এসব অভিবাসীদের অনেকেই দালালদের ওপর নির্ভর করেন। এ দালালেরা বিদেশে সম্ভাব্য কর্মী এবং নিয়োগকারীদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশিকে বিদেশে ভালো চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে এসব দালাল। এ দালালদের অনেকে অতীতে নিজেরাই পাচারের শিকার হয়েছিল।
বাংলাদেশের পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর ২০২২ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, 'বিশ্বব্যাপী পাচারের সবচেয়ে বেশি শিকার বাংলাদেশিরা।'
0 comments:
Post a Comment