২০২৩ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর, পৃথিবীতে এক বিশেষ অতিথি নেমে এল মহাকাশ থেকে—একটি ছোট বাক্সে ভরা, প্রায় ১২২ গ্রাম মাটির মতো ধুলো ও খনিজ। কিন্তু এই ধুলোগুলো ছিল কোনো সাধারণ ধুলো নয়, এগুলো এসেছে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩২০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে থাকা একটি প্রাচীন অ্যাস্টেরয়েড—Bennu থেকে। এই মিশনের নাম OSIRIS-REx, আর এর লক্ষ্য ছিল আমাদের সৌরজগতের শুরুর দিনগুলোর রহস্য উন্মোচন করা। NASA-এর OSIRIS-REx মিশনের এই সাফল্য এখন বিজ্ঞানীদের মধ্যে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
OSIRIS-REx মিশনটি কী?
OSIRIS-REx (Origins, Spectral Interpretation, Resource Identification, Security, Regolith Explorer) একটি NASA মহাকাশযান, যেটি ২০১৬ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল অ্যাস্টেরয়েড Bennu-তে গিয়ে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা।
এই মিশন প্রথম নয়—জাপানের হায়াবুসা মিশনও নমুনা এনেছিল—তবে OSIRIS-REx সবচেয়ে বেশি পরিমাণ (১২২ গ্রাম) অ্যাস্টেরয়েডের নমুনা এনেছে। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক সাফল্য।
Bennu-র নমুনায় কী কী পাওয়া গেছে?
Bennu হলো একটি কার্বনযুক্ত অ্যাস্টেরয়েড, অর্থাৎ এটি কার্বনসহ জৈব যৌগে সমৃদ্ধ। গবেষণায় যা পাওয়া গেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর:
🧬 ১. নিউক্লিওবেস (Nucleobases):
নিউক্লিওবেস হলো ডিএনএ ও আরএনএ তৈরির মূল উপাদান। Bennu-র নমুনায় পাওয়া গেছে:
-
অ্যাডেনিন (A)
-
থাইমিন (T)
-
সাইটোসিন (C)
-
গোয়ানিন (G)
-
ইউরাসিল (U)
এগুলো সবই আমাদের জীবদেহের জেনেটিক কোডের অংশ!
🧪 ২. অ্যামিনো অ্যাসিড:
Bennu-র নমুনায় পাওয়া গেছে অন্তত ২০টির মধ্যে ১৪টি অ্যামিনো অ্যাসিড, যা প্রোটিন তৈরির জন্য দরকার। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো পাওয়া গেছে প্রাকৃতিকভাবে গঠিত অবস্থায়, কোনো জীবজন্তু বা উদ্ভিদ ছাড়াই!
💧 ৩. প্রাচীন লবণাক্ততা ও পানির অস্তিত্ব:
নমুনায় পাওয়া গেছে লবণাক্ত খনিজ পদার্থ ও জলের উপাদান—যা ইঙ্গিত দেয় যে Bennu-র অভ্যন্তরে একসময় তরল পানি ছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, Bennu এর মূল ‘প্যারেন্ট বডি’ হয়তো ছিল এমন এক গ্রহাণু, যার অভ্যন্তরে ছোট ছোট জলাধার ছিল।
⚖️ ৪. ডান ও বাঁ-হাতি অ্যামিনো অ্যাসিড:
জীবদেহে সাধারণত বাঁ-হাতি (left-handed) অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। কিন্তু Bennu-তে পাওয়া গেছে দুদিকেরই (left & right) অ্যামিনো অ্যাসিড—যা বলছে, জীবনের পূর্ব-পর্যায়গুলো ছিল আরও নিরপেক্ষ এবং মহাকাশের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো অনেক বিস্তৃত পরিসরে ঘটেছিল।
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কতখানি?
এই নমুনাগুলো প্রমাণ করছে, জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ পৃথিবীর বাইরেও বিদ্যমান। সম্ভবত, পৃথিবীর শুরুর দিকে এই রকম অ্যাস্টেরয়েড পৃথিবীতে এসে পড়েছিল এবং জীবনের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি, এই নমুনা দিয়ে আমরা হয়তো শিখে নিতে পারি, জীবন কিভাবে শুরু হয়েছিল, কিভাবে ডিএনএ ও প্রোটিন গঠনের রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলো ঘটেছিল—এসব প্রশ্নের উত্তর।
এই আবিষ্কারগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হয়তো মহাকাশ থেকেই এসেছে! Bennu-এর মতো অ্যাস্টেরয়েড হয়তো কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসে এই রাসায়নিক উপাদানগুলো পৌঁছে দিয়েছিল।
আরো অবাক করা বিষয় হলো, এই নমুনায় ডান ও বাঁ-হাতি অ্যামিনো অ্যাসিড সমান পরিমাণে পাওয়া গেছে। অথচ, পৃথিবীর জীবজগতে সাধারণত বাঁ-হাতি অ্যামিনো অ্যাসিডই পাওয়া যায়। তাহলে জীবন কেন বাঁ-হাতিকে বেছে নিলো? সেই প্রশ্ন এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।
🔭 ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা NASA-এর?
NASA জানিয়েছে, এই নমুনার ৭০% সংরক্ষণ করে রাখা হবে, যাতে ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায়। আর OSIRIS-REx এখন নতুন অভিযানে বেরিয়েছে, এবার লক্ষ্য Apophis নামের আরেকটি অ্যাস্টেরয়েড, যেখানে এটি ২০২৯ সালে পৌঁছাবে।
NASA বলেছে, তারা এই নমুনার ৭০% সংরক্ষণ করে রাখবে ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য। এখনকার প্রযুক্তিতে যা জানা যাচ্ছে, ২০ বছর পর আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে।
এদিকে OSIRIS-REx এখন নতুন মিশনে—তার গন্তব্য হলো আরেকটি অ্যাস্টেরয়েড, Apophis, যেখানে এটি পৌঁছাবে ২০২৯ সালে।
উপসংহার
এই মিশন শুধু বিজ্ঞান নয়, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের জন্মের ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার একটি বড় ধাপ। ছোট একটি গ্রহাণুর বুক থেকে উঠে আসা কিছু ধুলো, হয়তো আমাদের বলে দেবে, "তুমি কে, কোথা থেকে এসেছো?"
0 comments:
Post a Comment