Saturday, December 25, 2010

ওডারল্যান্ড

0 comments
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে করেছেন গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা ও সুমহান অবদান এ দেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একজন বিদেশি নাগরিক বীরপ্রতীক উপাধি পেয়েছেন। অনেকেই হয়তো তার নাম জানি না। তিনি হলেন ওডারল্যান্ড। তিনি ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। কাজ করতেন বাটা সু কোম্পানিতে। সেইসূত্রে ১৯৭০ সালে ঢাকায় পোস্টিং পেলেন। নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ওডারল্যান্ড ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন বীর সেনানী। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কখনো গোয়েন্দাগিরি, কখনো আলোকচিত্রী আর কখনো বাঙালিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন ওডারল্যান্ড খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকার আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেন। পঁচিশে মার্চের কালো রাত্রে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর যে বর্বর হামলা চালায়, তা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে।

জীবদ্দশায় ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধের উপর কোনো স্মৃতিচারণ লিখে যাননি। তবে, ক্ষুদ্রাকারের কিছু চিঠিপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক কিছু অবতারণা করেছিলেন। তিনি এক চিরকুটে লিখেছেন, 'আমার জন্ম ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে, আমস্টারডামে। ইউরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বছর। ১৯৩৬ সালে আমি ন্যাশনাল সার্ভিসে যেতে বাধ্য হই। এর কিছুদিন পর বাটা সু কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ডাচ বাহিনীর পক্ষে লড়াই করে নাভেসি বাহিনীর বর্বতার সম্মুখীন হই। তিনি আরো লেখেন, 'নাৎসি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর আমি আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতায় যুক্ত হই। জার্মান এবং বিভিন্ন ডাচ উপভাষায় আমি অনর্গল কথা বলতে পারতাম। এই সময় জার্মান হাই কমান্ডের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফলে, ডাচ আন্ডার গ্রাউন্ড তৎপরতাকে যেমন আমি সাহায্য করতে পেরেছিলাম, তেমনি মিত্রবাহিনীকে জরুরি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ঢাকায় ট্যাংক নামার পরও একই ব্যাপার হয়েছিল।' ওডারল্যান্ডের চোখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেদনা, রক্তাক্ত স্মৃতি আর বাংলার মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে পড়েছিল। আর তাই তিনি বাংলার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা দেখে আমার ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে কারো না কারো জানানো উচিত। আমি অবাধেই চলাফেরা করতে পারছিলাম। নিরীহ মানুষজনের উপর পাকিস্তানিরা যেসব ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, সেসবের ছবিও তুলতে পেরেছিলাম। এরপর সেই ছবিগুলো বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়াতে পাঠিয়ে দিতাম।' তিনি আরো লেখেন, 'হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পরিধি বাড়িয়ে নানা তথ্য গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে লাগাতে থাকলাম। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের আরো গভীরে। বাটার শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে টংগীসহ সেক্টর ১ এবং ২ নম্বরে গড়ে তুলি গেরিলা বাহিনী। আর নিজেই দায়িত্ব নিলাম প্রশিক্ষকের।' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এ অকুতোভয় বীর আরো লিখেছেন, 'সেসময় বাঙালিদের জন্য যে ভালোবাসা আর টান আমি অনুভব করেছি, এ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ।' যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চাকরি শেষে ১৯৭৮ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। এরপর ২০০১ সালের ১৮ মে বাংলাদেশের এই বন্ধু বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড পরলোকগমন করেন।

0 comments:

Post a Comment