হাঁটু শরীরের সবচেয়ে বড় এবং জটিল জয়েন্টগুলোর একটি। হাঁটুর চারপাশের
মাংসপেশীতে কিছু টেনডন থাকে যারা এই হাড়গুলোকে সংযুক্ত করে রাখে, যা হাটুকে
নাড়াচাড়া (ভাঁজ/ সোজা) করতে সাহায্য করে। এছাড়াও কিছু লিগামেন্ট আছে যারা
হাড়গুলোকে সংযুক্ত করে রাখার পাশাপাশি হাটুর জয়েন্টকে স্থায়িত্ব প্রদান
করে। এখানে ‘C’ আকৃতির দুটো কারটিলেজ থাকে যাদের মিনিছকি বলে।
হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলে জয়েন্টে যে ধরনের পরিবর্তন আসে:
কার্টিলেজ অথবা মিনিছকি ক্ষয় হয়ে হাড় বাহিরে বের হয়ে আসে। জয়েন্টে হাড়ের
অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে থাকে যার জন্য ভেতরে জায়গা কমে যায়। এতে হাঁটু ভাঁজ
এবং সোজা করার সময় হাড়ের ঘর্ষণের ফলে ব্যথা হয়।
হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিস:
অস্টিওআর্থ্রাইটিস এক ধরনের জয়েন্টের রোগ যা জয়েন্টের কার্টিলেজ এবং
হাড়ের ক্ষয়ের কারণে হয়ে থাকে। এটা মূলত শরীরের সবচেয়ে বড় এবং ওজন বহনকারী
জয়েন্টগুলোতে হয়ে থাকে, যেমন- মেরুদণ্ড, নিতম্ব বা হাঁটুর জয়েন্ট। এছাড়া
গোড়ালী ও হাতের জয়েন্টে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে, তবে সবচেয়ে বেশি হয়
হাঁটুর জয়েন্টে।
হাঁটুর জয়েন্টে যখন কার্টিলেজ ও হাড়ের ক্ষয় বাড়তে থাকে, তখন একে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বলে।
যেসব কারণে হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে:
১। হাঁটুর অস্টিওআর্থ্রাইটিসের অনেকগুলো কারণের মধ্যে বয়স একটি অন্যতম
কারণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জয়েন্টের ভেতরের কার্টিলেজের কার্যক্ষমতা কমতে
থাকে। ফলে সহজেই ক্ষত সৃষ্টি হয়।
২। শরীরের ওজন বাড়ার ফলেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে, অতিরিক্ত ওজনের
ফলে হাঁটুতে বেশি পরিমাণে চাপ পরে যা ধীরে ধীরে জয়েন্টে ক্ষত সৃষ্টি করতে
পারে।
৩। বংশগত কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
৪। নারীদের অস্টিওআর্থ্রাইটিস বেশি হয়ে থাকে পুরুষদের চেয়ে।
৫। যারা বাড়িতে বা অফিসে এমন ধরনের কাজ করেন যেখানে হাঁটু ভাঁজ করে অনেক
সময় বসে থাকতে হয়, সামনের দিকে ঝুঁকে কোন ভারী জিনিস উঠাতে হয় এদের
অস্টিওআর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৬। অনেক সময় অন্য কোন রোগের কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়ে থাকে।
যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
১। হাঁটু ফুলে যাবে এবং ব্যথা বেড়ে যাবে, ব্যথাটা উপরে বা নিচে ছড়িয়ে যেতে পারে।
২। মাংশপেশী শক্ত হয়ে যাবে এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে।
৩। হাঁটু ভাজ এবং সোজা করার ক্ষমতা কমে যাবে।
৪। অস্টিওআর্থ্রাইটিস দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়ন্ত্রণ না করলে অঙ্গ বিকৃতিও হতে পারে।
নিয়ন্ত্রণে বাড়িতে থেরাপি
হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলে চারপাশের মাংসপেশীকে প্রসারিত করা এবং
মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এতে হাঁটুর জয়েন্টের চারপাশের
অতিরিক্ত চাপ কমে যায় এবং নাড়াচাড়া স্বাভাবিক হয়।
নিচের থেরাপিগুলো ব্যথা কমাতে এবং আপনাকে আরও শক্তিশালী ও সতেজ করতে
সাহায্য করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যদি থেরাপি দেয়ার সময় আপনি খুব বেশি
ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে থেরাপি বন্ধ রাখতে হবে।
উরুর সামনের ভাগের মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধির থেরাপি
আপনি চিৎ হয়ে শুয়ে যে পায়ের থেরাপি করবেন সেটি সোজা রেখে অপর পা ভাঁজ
করে রাখবেন। একটি ছোট টাওয়াল (গামছা) মুড়িয়ে বা কোন ছোট বালিশ হাঁটুর নিচে
রাখুন। এবার উরুর সামনের মাংসপেশীকে ধীরে ধীরে শক্ত করুন এবং হাঁটু দিয়ে
টাওয়াল বা বালিশের উপর চাপ দিন। ৫ সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে বালিশের উপর থেকে
চাপ ছেড়ে দিন।
উপকারিতা: এই থেরাপি হাঁটুর সামনের ভাগের মাংসপেশীকে শক্তিশালী করবে এবং হাঁটুর ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
উরুর সামনের ভাগের মাংসপেশীর শক্তি বৃদ্ধির থেরাপি
একটি চেয়ারে বসুন, খেয়াল রাখতে হবে যেন দুই পা মেঝেতে রাখা থাকে। এবার
যে পায়ের থেরাপি করবেন সেটি মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উপরের দিকে নিয়ে আসুন এবং
এই অবস্থায় পাকে ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। এরপর পা আবার মেঝেতে নামিয়ে নিয়ে
আসুন, এভাবে পর পর ১০ বার করবেন দিনে দুই বেলা।
উপকারিতা: হাঁটুর চারপাশের মাংসপেশীর শক্তি বাড়বে এবং ব্যথা কমাবে।
উরুর সামনের ভাগের মাংসপেশীকে প্রসারিত করার থেরাপি
কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে একটি দেয়ালের সামনে মুখ দিয়ে দাড়াঁন। একটি হাত
দেয়ালে রাখুন ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। এবার হাতটি দেয়ালে রেখে অপর পাশের
পায়ের হাঁটুকে ভাঁজ করে উপরের দিকে নিয়ে আসুন এবং একই পাশের হাত দিয়ে পা
ধরে চাপ দিন। এতে আপনার উরুর সামনের ভাগের মাংসপেশীতে চাপ অনুভূত হবে,
এভাবে ৩০ সেকেন্ড চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। এবার পা ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়াঁন, এভাবে
পরপর তিন বার করবেন দিনে দুই বেলা।
উপকারিতা: জয়েন্টের চাপ কমাবে।
উরুর পেছনের ভাগের মাংসপেশীকে প্রসারিত করার থেরাপি
চিৎ হয়ে শুয়ে যে পায়ের থেরাপি করবেন, তার পাতার সামনের অংশে একটি কাপড়
পেঁচিয়ে নিন। কাপড়টিকে দুই হাত দিয়ে ভাল করে ধরে টেনে পা ধীরে ধীরে উপরে
নিয়ে আসুন। কাপড়ের সাহায্যে পা উপরে ঝুলিয়ে রাখুন যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি
উরুর পেছনের মাংসপেশীতে সামান্য চাপ অনুভব করবেন। ৩০ সেকেন্ড উপরে ঝুলিয়ে
রাখুন, পরে পা ধীরে ধীরে নামিয়ে ফেলুন, এভাবে পর পর তিন বার করবেন দিনে দুই
বেলা।
উপকারিতা: এই থেরাপি হাঁটুর নির্দিষ্ট পরিমাণ নাড়াচাড়াকে স্বাভাবিক করবে।
হাঁটুর নিচের পেছনের ভাগের মাংসপেশীকে প্রসারিত করার থেরাপি:
একটি দেয়ালের সামনে সোজা হয়ে দাড়াবেন, এরপর একটি পা সামনের দিকে এগিয়ে
মেঝেতে রাখুন। এ সময় অপর পা পেছনে মেঝেতে রাখা থাকবে। এখন ভারসাম্য রক্ষার
জন্য হাত দুটি দেয়ালে রাখুন। এবার সামনে রাখা পায়ের হাঁটু ভাঁজ করুন এবং
ধীরে ধীরে দেয়ালে ভর দিয়ে সামনের দিকে শুধুমাত্র শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে যান।
এই সময় হাঁটুর নিচের পেছনের ভাগের মাংসপেশীতে চাপ অনুভব করবেন। এই অবস্থায়
৩০ সেকেন্ড থাকুন। এখন ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাড়াঁন, এভাবে পর পর তিন বার
করবেন দিনে দুই বেলা।
উপকারিতা: এই থেরাপি হাঁটার সময় ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
বাড়িতেতে যেসব উপদেশ মেনে চলতে হবে:
১। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
৩। হাঁটু ফোলা থাকলে ব্যথা কমাতে বাড়িতে দুই ঘন্টা পর পর এক মিনিট করে
কয়েক বারে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য ঠান্ডা সেক দিতে হবে। কয়েকটি বরফের
টুকরা একটি পাতলা টাওয়ালে পেঁচিয়ে হাঁটুতে ধরে রাখতে হবে।
৪।হাঁটুর ব্যথা এবং শক্তভাব কমাতে বাড়িতে দুই ঘন্টা পর পর দুই থেকে তিন
মিনিট কয়েক বারে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের জন্য গরম সেক দিতে হবে। গরম পানি একটি
বোতলে ভরে পাতলা টাওয়াল দিয়ে পেঁচিয়ে সেটি দিয়ে হাঁটুতে গরম সেক দিতে
পারেন।
৫। মেঝেতে অনেক সময় ধরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে থাকা এড়িয়ে চলতে হবে। মেঝেতে
হাঁটু ভাজ করে বসে নামায পড়া বা মেঝেতে বসা বাদ দিতে হবে। ছোট একটি টুল বা
চেয়ারে বসে এই কাজগুলো করতে পারেন।
৬। গৃহস্থালী কাজ করার সময় মনে রাখতে হবে হাঁটু যেন অনেক সময় ধরে ভাঁজ হয়ে না থাকে।
৭। সবসময় সতর্ক থাকবেন যেন পড়ে গিয়ে বা আঘাত পেয়ে পুনরায় হাঁটুতে কোন ব্যথা না পান।
লেখক: ফাহমিদা বানু; সিনিয়র ক্লিনিকাল ফিজিওথেরাপিস্ট, সিআরপি, সাভার
0 comments:
Post a Comment