স্বচ্ছ ক্লাস সেভেনে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরে মায়ের স্মার্টফোনটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। খেতে খেতেও খেলতে থাকে গেম। বিরতিহীন। বাইরের কোনো খেলার দিকে তার মন নেই। পড়ালেখা নামমাত্র। স্কুলে যায় ঠিকই, কিন্তু ইদানীং তার ফল খারাপ হচ্ছে। বাসায় যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ মা বা বাবার মুঠোফোন আঁকড়ে থাকে। নানা ধরনের গেম খেলে। বেড়াতে যেতে চায় না। বাসায় কোনো অতিথি বেড়াতে এলে সে তাদের সময় দেয় না। জোর করে মুঠোফোন সরিয়ে রাখলে বা গেম খেলতে বাধা দিলে কান্নাকাটি করে; চিৎকার করে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে।
মুঠোফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে থাকছে শিশু-কিশোর, তরুণদের একাংশ। প্রযুক্তি বা ইন্টারনেটের প্রতি সন্তানের আসক্তি বাবা-মায়ের চিন্তার কারণ। কেউ মুঠোফোন বা ল্যাপটপে গেম খেলে, কেউ নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে গিয়ে উত্তেজক ছবি বা ভিডিও দেখে। আবার কেউ সফটওয়্যার ও অ্যাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কেউ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করে।
কীভাবে জন্মায় ইন্টারনেট-আসক্তি
l সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত বাবা-মায়েরা। এ থেকে সন্তানের মধ্যে প্রযুক্তি উপভোগ করার অভ্যাস জন্মায়।
l অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে সব সময় ঘরে বন্দী রাখতে চান। নিজের চোখের সামনে দেখতে চান। সে ক্ষেত্রে তাদের হাতে মুঠোফোন-ল্যাপটপ তুলে দিয়ে আপাত স্বস্তি অনুভব করেন, যা শিশু-কিশোরদের যন্ত্রের প্রতি আসক্ত করে ফেলে।
l বাবা-মা নিজেরাও সারা দিন ইন্টারনেটনির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন। সন্তানেরা এতে উৎসাহিত হয়।
l ‘আমার ছেলে এই বয়সেই মোবাইল ফোন-ল্যাপটপের সব কারিকুরি জানে, আমরা কিছুই পারি না’—এই বলে বাবা-মায়েরা অন্যদের কাছে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকেন। ভাবেন, ‘আহ্ আমার সন্তান কত স্মার্ট’। কিন্তু দিন শেষে এই প্রযুক্তি-আসক্ত সন্তানটি স্মার্ট হওয়ার বদলে ব্যর্থ হয়।
l কখনো কখনো কিছু বিজ্ঞাপনের ভাষা ও উপাদান শিশুদের প্রযুক্তি বা গেমের প্রতি আসক্ত করে তুলতে পারে।
ক্ষতি কী?
l সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় এবং কোনো বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ধীরে ধীরে সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
l জীবনের গুণগত মান কমে যায়। পড়ালেখাসহ সব কাজের গতি ও মান নিচে নামতে থাকে। হতাশা বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারে; ঘটাতে পারে আত্মহত্যা।
l অন্যদের সঙ্গে আচরণ সুষম হয় না, খিটখিটে মেজাজ আর অস্থিরতা দেখা দেয়, সম্পর্কের জটিলতা তৈরি হয়।
l সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া বা সাইবার জগতের অপরাধে জড়িয়ে আইনি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে।
l ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে; যা কারও পরবর্তী বিবাহিত জীবনকে অসফল করে তোলে। উত্তেজক ওয়েবসাইটের আসক্তির কারণে যৌন অপরাধ বা যৌন সমস্যা তৈরি হতে পারে।
প্রতিরোধ আর প্রতিকার
l সন্তানের সার্বিক দিক বিবেচনা করে দেখুন, সে প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত কি না। অপরের প্রতি তার সম্মানবোধ আছে কি না। সে নিজেকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
l গ্যাজেট আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানের সঙ্গে চুক্তিতে আসুন, যাতে নিয়মগুলো পালন করে। সময় মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।
l বাসার ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে (কমন এরিয়া) রাখুন। শিশু যাতে আপনার সামনে মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করে, সেদিকে গুরুত্ব দিন।
l ১৮ বছরের নিচের সন্তানের ইন্টারনেটের যাবতীয় পাসওয়ার্ড জানুন। তবে লুকিয়ে নয়, তাকে জানিয়েই তার নিরাপত্তার জন্য পাসওয়ার্ডটি আপনার জানা দরকার; এটি বুঝিয়ে বলুন।
l নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন, যাতে আপনার বাসার সংযোগ থেকে কোনো নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা না যায়। এ বিষয়ে আপনার ইন্টারনেট সংযোগদাতা বা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
l আপনার সন্তান প্রযুক্তিতে অতি দক্ষ—এই ভেবে আত্মতৃপ্তি পাবেন না। তার বয়স প্রযুক্তির উপযোগী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন।
l শিশুকে গুণগত সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যতি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। পরিবারের সবাই মিলে বাসায় ক্যারম, লুডু, দাবা, মনোপলি ইত্যাদি খেলার চর্চা করুন। নিয়ম করে সবাই মিলে বেড়াতে যান।
l প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট-আসক্তি কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করুন।
0 comments:
Post a Comment