বাংলার মাটি, জল, বাতাসের মতোই বটগাছ আমাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গাছ শুধু ছায়া দেয় না, দেয় ইতিহাসের সাক্ষ্য, দেয় লোককথার আনন্দ, দেয় আত্মার আশ্রয়। আজ আমরা জানব বাংলার এমন ৫টি প্রাচীন বটগাছের গল্প — যাদের ঘিরে আছে অতীতের কাহিনি, মানুষের বিশ্বাস ও সময়ের ছাপ।
🌿 ১. সুলতানি আমলের বটগাছ, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)
পানাম নগরের পাশে এক বিশাল বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে। সোনারগাঁ ছিল একসময় বাংলার রাজধানী, সুলতানদের বসতি। প্রচলিত আছে, এই বটগাছের নিচে বসত বিচারসভা। দণ্ডপ্রাপ্তদের নাম উচ্চারণ করলেই নাকি বাতাস থেমে যেত, শিকড় কাঁপত— যেন প্রকৃতি নিজেই রায় ঘোষণা করত।
পূর্বসূরিরা বলেন, পূর্ণিমা রাতে গাছের নিচে সাদা আলোর মতো কিছু দেখা যায়। কেউ বলেন, “পীর সাহেব আসেন রাতের ঘোড়ায় চড়ে”।
📍 অবস্থান: পানাম নগর, সোনারগাঁ
📜 কাহিনি: বলা হয়, এই বটগাছের নিচেই সুলতানি যুগে বিচারসভা বসত।
🧓 লোককথা: গ্রামের প্রবীণরা বলেন, পূর্ণিমার রাতে কেউ কেউ “আলো ঝলমলে পীর সাহেব” দেখতে পান।
🌿 ২. গোমতী বট, মহাস্থানগড় (বগুড়া)
মহাস্থানগড়ের প্রাচীন কেল্লার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই বটগাছকে স্থানীয়রা বলেন “গোমতী বট”। কথিত আছে, পাল রাজারা এই গাছের নিচে যুদ্ধের আগে বসতেন প্রার্থনায়। গাছটি নাকি যুদ্ধের সময় আশ্রয় দিত নারী ও শিশুদের।
আজও অনেক পর্যটক এই গাছের নিচে দাঁড়ালে শুনেন “মৃদু শঙ্খধ্বনি” — যাকে কেউ বলেন প্রাকৃতিক শব্দ, আবার কেউ বলেন অতীতের প্রতিধ্বনি।
📍 অবস্থান: মহাস্থানগড় কেল্লার পাশে
📜 কাহিনি: জনশ্রুতি মতে, প্রাচীন পাল রাজারা এই বটগাছের নিচে যুদ্ধের পূর্বে দোয়া করতেন।
🧓 লোকবিশ্বাস: এই গাছ নাকি কারো নাম শুনে পাতার নড়াচড়ায় “হ্যাঁ/না” বলে!
🌿 ৩. ভূতুড়ে বট, বড়জোড়া, পিরোজপুর
পিরোজপুরের বড়জোড়ার বাজারের পাশে এক প্রাচীন বটগাছ আছে, যার পরিচিতি— “ভূতুড়ে বট”। প্রায় একশ বছর আগে এক কৃষক এখানেই আত্মহত্যা করেছিলেন। এরপর থেকেই সন্ধ্যার পরে গাছের শিকড় থেকে যেন আসে কান্নার আওয়াজ।
স্থানীয়রা দিনভর গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু সূর্য অস্তালগামী হলেই কেউ আর কাছে ভিড়ে না। কিছু সাহসী তরুণ গেছেন, ভিডিও করেছেন — যদিও কিছুই ধরা পড়ে না, কেবল এক অদ্ভুত অনুভূতি।
📍 অবস্থান: বড়জোড়া বাজারের পাশে
📜 কাহিনি: শত বছর আগে এক চাষি এখানে আত্মহত্যা করেছিলেন, তারপর থেকেই গাছের পাতার মাঝে কেঁদে ওঠার শব্দ শোনা যায়।
🎭 ব্যবহার: স্থানীয়রা দিনে এখানে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু সন্ধ্যার পর কেউ যায় না!
🌿 ৪. লালনের বটগাছ, কুষ্টিয়া
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে লালন শাহের আখড়াবাড়ির পাশে যে বটগাছটি আছে, তা কেবল গাছ নয়— যেন আত্মার ঘর। লোকগীতি অনুসারে, লালন সাঁই এই গাছের নিচে বসেই আত্মজিজ্ঞাসা করতেন, গান লিখতেন।
আজও এখানে বসে বাউলরা গেয়ে ওঠেন —
“ধন ধারণা কিছু নয় লাগে,
যদি না জানিস আপন ভাগে…”
বটগাছটি যেন আধ্যাত্মিকতার প্রতীক, একান্ত সাধনার স্থান।
📍 অবস্থান: লালন শাহের আখড়াবাড়ি
📜 কাহিনি: লোকগীতি বলে, এই গাছের নিচেই লালন সাঁই ভাবনায় ডুবে যেতেন।
🎶 আজো এখানে বসে বাউলরা গান করে: “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”।
🌿 ৫. চন্দ্রনাথ বট, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে যে প্রাচীন বটগাছটি আছে, তা বহু পূণ্যার্থীর কাছে পবিত্র। হিন্দু ধর্মীয় কাহিনি বলে, সীতার বিশ্রামের স্থান ছিল এই বটগাছ। পূর্ণিমার রাতে এখানে হয় বিশেষ পূজা ও আরতি।
এই গাছের শিকড় যেন মাটির চেয়ে আকাশের দিকে বেশি টান, যেন সীতা ও রামের আলিঙ্গনের মতো এক নিরব অথচ শক্তিশালী স্পর্শ।
📍 অবস্থান: চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে
📜 কাহিনি: হিন্দু পূণ্যার্থীদের মতে, এটি ছিল সীতার বিশ্রামস্থল। পূর্ণিমায় এখানে আরতিও হয়।
🧘 আধ্যাত্মিক মহিমায় গাছটি আজও পূজিত হয়।
🧠 কেন বটগাছের সঙ্গে গল্প জড়িয়ে যায়?
বটগাছ গড়ে তোলে সমাজ, বসে “বটতলা সভা”, হয় বিচার, গড়ে ওঠে পীরের আসন। এর বিশালতা ও দীর্ঘায়ু মানুষকে দেয় এক প্রাকৃতিক শ্রদ্ধা — যেখান থেকে জন্ম নেয় কল্পনা, বিশ্বাস, ও গল্প।
0 comments:
Post a Comment