Friday, June 6, 2025

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব: ইসলামিক বিধান ও হাদীসের আলোকে

0 comments

ইসলাম ধর্মে কুরবানীকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ঈদুল আজহার বড় আকর্ষণ এই ইবাদতটি, যা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর আত্মত্যাগ ও আনুগত্যের প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা কুরবানীর মাধ্যমে আমাদের আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ প্রতিজ্ঞা করেছেন, “আমি নিশ্চয় তোমাকে কাওসার দান করেছি; অতএব তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ো এবং কোরবানী দাও।”। আর কুরবানীকে ইসলামের অন্যতম শিয়া’র (লক্ষণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যেমন কথায় এসেছে, “জাকাত প্রদান, ঈদ এবং কুরবানী করা – এ জাতীয় মৌলিক নিদর্শনগুলোর মধ্য দিয়ে ইসলামের রূপ ও অবয়ব প্রকাশ পায়”। নবী করীম (সা.) মদীনায় হিজরতের পর থেকে ঈদুল আজহার প্রতিটি বছরে কুরবানী আদায় করে গেছেন এবং কখনও বাদ দেননি।

Qurbani

কুরআন ও হাদীসের আলোকে কুরবানীর বিধান

কুরআনে কুরবানীর হুকুম সরাসরি নির্দেশিত হয়েছে। সূরা কাওসারে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “অতএব তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি দাও”। এখান থেকে স্পষ্ট হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ ও কোরবানী করা সর্ম্পকে বলা হয়েছে। এছাড়া সূরা হজ্বের ৩৪ নম্বর আয়াতে আছে, “প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমরা নছিক (কুরবানির নিয়ম) নির্ধারণ করেছি; যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে ওই পশুদের মাংস ভক্ষণ করে”।

হাদীস শরীফেও কুরবানীর গুরুত্ব ও বিধান বিস্তারিত এসেছে। ইবনে মাজাহ শরীফে আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, “যে যার কাছে সামর্থ্য আছে অথচ কুরবানী দেয় না, সে যেন আমাদের নামাযের স্থানে আসেও না।” এই সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে সামর্থ্য থাকলে কুরবানী না করা কঠোরভাবে নিষেধ। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের উম্মাহর জন্য এবং নিজ ও পরিবার-উম্মাহর জন্য দুটি বড়, মোটা, সাদা-কালো প্রজাতির খাসি কুরবানী করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য, সাহিহ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদীসে নবী (সা.) আয়েশা (রা.)-এর কাছে জানান, “তোমরা অবশ্যই এক বছরের বয়সের ছাগল কুরবানী করবে; যদি তা তোমাদের জন্য কঠিন হয়, তাহলে ছয় মাসের (যৌবন ছাগল) কুরবানী করতে পার”। কুরবানীর জন্য অনুমোদিত পশুর মধ্যে শুধুমাত্র ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট – এই ছয় ধরণের পশু আছে। এগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীকে কুরবানী হিসেবে জবাই করা হারাম। যেমন হাদীসে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এসব ছয় ধরনের পশু ব্যতীত অন্য কোনো পশু কুরবানী হিসেবে জবাই করেননি।

Qurban

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব – পাঁচটি শর্ত ব্যাখ্যা

হানাফী ফিকহ অনুযায়ী কুরবানী ওয়াজিব হলে পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এই শর্তগুলো হলো:

  • মুসলিম হতে হবে – কুরবানী শুধুমাত্র মুসলমানের ওপর ওয়াজিব, অমুসলিমের ওপর নয়।

  • বালিগ হতে হবে – অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক (জাঁককাঠামো ও যৌন চেতনাসম্পন্ন) হতে হবে। বাল্যকালে এই আমল ফরজ বা ওয়াজিব হিসেবে বিবেচিত নয়।

  • সুস্থ মস্তিষ্ক থাকতে হবে – পাগল বা মানসিকভাবে অস্থির ব্যক্তির ওপর কোনো শারীরিক ইবাদত ফরজ নয়।

  • নিযার (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে – কুরবানীর দিন (১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ) নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে নিসাব সমপরিমাণ (হানাফীদের মতে একই নিসাব, যা প্রায় ৫৯৫ গ্রাম রুপী বা প্রায় ১১ ভরি সোনা) সম্পদ থাকা উচিত। নিসাবের নিচে মালিকের ওপর কুরবানী ওযিব হয় না।

  • মুকীম বা নিজ এলাকায় অবস্থানকারী হতে হবে – পবিত্র ঈদের দিন নিজের নিবাসস্থলে অবস্থান করতে হবে। Musafir (ভ্রমণরত) অবস্থায় কুরবানী ওয়াজিব নয়। যদি কেউ পবিত্র স্থানে এলে তবেই সে ওয়াজিব হয়ে ওঠে।

এই শর্তগুলো পূরণ করলে যে মুসলমান তার অদক্ষিণ, স্বাস্থ্যবান ও শাস্ত্রানুযায়ী পুঁজি রয়েছে, তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। উদাহরণস্বরূপ, শপথবাদী হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করে, সে অবশ্যই উম্মতের নামায থেকে নিজেকে দূরে রাখুক।

হাদীসের রেফারেন্সসহ দলিল

কুরবানীর বিধান ও ওয়াজিব হওয়ার বিভিন্ন শর্তের দালিল দিতে সহীহ হাদীস রয়েছেঃ

  • ইবনে মাজাহ (হাদিস নং ৩১২৩): আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, যে যার জন্য কুরবানী আদায় করতে সক্ষম সে যদি আদায় না করে, তবেই যেন আমাদের ঈদের নামাযের জায়গায় না আসে।

  • ইবনে মাজাহ (হাদিস নং ৩১২২): আয়েশা ও আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত, নবী (সা.) ইচ্ছা করলে দুইটি বড়, মোটা, দু’শিং বিশিষ্ট ভেড়া কুরবানী করতেন: একটি উম্মতের পক্ষ, আর একটি নিজ ও পরিবারের পক্ষ থেকে।

  • সহীহ মুসলিম (হাদিস নং ১৯৬৩): বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, “তোমরা (বালিগ) ব্যক্তি লক্ষ্য করো, একবছরের পূর্ণবয়স্ক ছাগল বর্জন করিও না; যদি তোমাদের কঠিন হয়, তাহলে ছয় মাসের অর্ধবয়স্ক ছাগলও কুরবানী করতে পার”।

  • বুখারি-মুসলিম: হাদিস অনুযায়ী কুরবানী শুধুমাত্র পূর্বের বর্ণিত ছয় প্রকার পশু দিয়েই করা যায়।

  • সামুহিক খত্মুল হাদিস: (সম্ভাব্য) হাদিসে এসেছে, কুরবানীর মাস জিলহজের চাঁদ ওঠার পর থেকে কোরবানির পশু জবেহ না হওয়া পর্যন্ত চুল-নখ কাটা নিষিদ্ধ।

এসব আদি-সূত্র দেখিয়ে মুসলিম উম্মাহ নিশ্চিত হয় যে কুরবানী আইন, সালাতের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল, এবং কুরবানীতে ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জিত হয়।

Eid-ul-Adha

শিশু, পাগল ও মুসাফিরদের বিধান

ইসলামী শরিয়তে বালক বা পাগল ব্যক্তির ওপর কোনো ফরজ বা ওয়াজিব ইবাদত আরোপ করা হয় না। তাই শিশু বা মানসিক অক্ষম ব্যক্তির ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে কুরবানী নেই। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি পূর্ণবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কের হলেও ঈদুল আজহার সময় ভ্রমণরত (মুসাফির) অবস্থায় থাকলে তার ওপরও কুরবানী ফরজ নয়। তবে যারা বাসিন্দা হয়ে ফিরে এলে তাৎক্ষণিক বা পরবর্তী সময়ে কুরবানী দিতে পারে।

অন্যদিকে, পূর্ণবয়স্ক বিশ্বাসী ব্যক্তি যদি পরিবারের একাধিক সদস্যের পক্ষ থেকে কুরবানী দিতে চান, তবে একটি পশু দিয়ে কয়েকজনের পক্ষ থেকেও আদায় করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, হাদিসে বর্ণিত হয়, হুদাইবিয়াতে জাবের (রা.) বলেন, “রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে আমরা ছিলাম; তখন উট ও গরু দুটি ক্রয় করে যেগুলো দিয়ে সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি।”। অর্থাৎ এক পশু দিয়ে ভাগাভাগি করে ৭ জন পর্যন্ত ব্যক্তির জন্য কুরবানী দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

uḍḥiyah

নারীদের ক্ষেত্রে কুরবানীর হুকুম

ইসলামী ফিকহানুযায়ী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যদি উপরোক্ত পাঁচটি শর্ত পূরণ করে থাকে, তার ওপরও কুরবানী ওয়াজিব। সাহাবিদের দাবি করা হত, যে ব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের (স্ত্রীরা ও সন্তানেরা) সঙ্গে সম্পদবান হলে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা পশু কুরবানী করতে হবে না; একটি পশু সাতজন পর্যন্ত হয়ে যায়। আবার অনেক মুতাহাদ্দিথ মনে করেন নারীরও স্বনিয়ন্ত্রিত সম্পদ থাকলে কুরবানী করা চাওয়া উচিত। তাই মাযহাব হানাফীর মতে, বিবাহিত স্ত্রী যখন তার ব্যক্তিগত সম্পদ (যেমন গহনা বা নিজস্ব আয়) থেকে নিসাব পরিমাণ বৈধ অর্থে সামর্থ্য সৃষ্টি করতে পারে, তখন তাঁর পক্ষেও কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব। তিনি নিজে জবাই না করতে পারলেও, অন্যের মাধ্যমে বা দরিদ্রদের অংশ ভাগ করে দিয়েই আদায় সম্পন্ন করতে পারেন।

কুরবানী না দিলে পরিণতি

আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে তার ফল ভালো হয় না। কুরবানী দিতে সক্ষম থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ত্যাগ করে, তাহলে গোনাহের আওতায় পড়বে। নবী (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই ব্যক্তিকে ঈদের নামাজের স্থানেও আসতে নিষেধ। এই উক্তি থেকে বোঝা যায় কুরবানী মুলক প্রযোজ্য আদর্শ মেনে না চলা মারাত্মক অপরাধ; তাই মুসলিম বুকে দায়বোধ থাকা উচিৎ।

সর্বোপরি, যদি কোনো বাসিন্দা অঞ্চলের মানুষ হঠাৎ সম্মিলিতভাবে কুরবানী পরিত্যাগ করে, তাহলে ইসলামের একতা ও সনাতনী দায়িত্ব বিকৃত হবে। শাস্ত্রীয় গ্রন্থে এমন পরিস্থিতিতে কঠোর ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে – যদি সম্ভাব্য লোকেরা একযোগে কুরবানী না করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হস্তক্ষেপ হতে পারে। এটি প্রাচীন যুগের উদাহরণ, তবে আমাদের জন্য মর্মবাণী যে, কুরবানীকে অতিরিক্ত বা তুচ্ছ হিসেবে দেখা যায় না। বরং যা ওয়াজিব, তা ত্যাগ করলে ইসলামী সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।

উপসংহার: আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার চর্চা

কুরবানী হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। পশু কোরবানী ঈমান আর তাকওয়া বৃদ্ধি করে, দাতব্য কাজ হিসেবে দরিদ্রদের জন্য খাদ্য ও সহায়তা জোগায়। এতে নবী ইব্রাহীম (আঃ)-এর আনুগত্যের আদর্শ অনুসরণ করি এবং নিজকে আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত রাখি। আল্লাহ তায়ালা সওয়াবের আশ্বাস দিয়েছেন – কুরবানী ছাড়াও কোনো গানাহ কটার নির্দেশনা নেই, বরং এটি মহান নেকি। তাই তরুণ-মুসলিম, সাধারণ ধর্মপ্রাণ বা শরীয়তজ্ঞ সবাই যেন কুরবানীকে ঈমানি অধিকার হিসেবেই গুরুত্ব দিয়ে পালন করে; তা কেবল একটি পশুর জবাই নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য, আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার সমাবেশ। আমাদের প্রত্যেকে আল্লাহর প্রাকৃষ্ট নির্দেশ মেনে কুরবানী দান করে নিজের হৃদয়ে তাকওয়া ও শোকরিয়া জন্ম দিই; কারণ কুরবানী আদায়ে না শুধু নিজের সুবৃত্তি, বরং সবার মাঝে ন্যায়-বিচার এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে গৌরব প্রতিষ্ঠা পাই।

Islamic ritual sacrifice

সূত্র: সৌজন্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও ইসলামিক গ্রন্থাবলী.

Title: Who Is Obligated to Offer Qurbani? Rules and Hadith-Based Guidelines in Islam
Tags: "Qurbani," "Obligated," "Rules," "Hadith"

0 comments:

Post a Comment