Monday, April 22, 2013

টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা

0 comments
"...আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশী অনুষ্ঠানও প্রচারিত হচ্ছে। সংবাদ ও নানা অনুষ্ঠানে হিন্দি ও ইংরেজী নতুন সিনেমার প্রমোশন দেখানো হচ্ছে যা দেশীয় সিনেমার চেয়ে কম নয়, কখনো কখনো বরং বেশী। কেউ কেউ বলছেন এটি বিশ্বায়নের অংশ। তবে কৌতুক করে বলা যায়, বিশ্বায়ন শুধু কী গরীব দেশের জন্য প্রযোজ্য? আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেখানে পাশ্ববর্তী দেশে সম্প্রচারের সুযোগ নেই, সেদেশে আমাদের নাটক, সিনেমা, গান জনপ্রিয় হবার সুযোগই বা কোথায়? সেক্ষেত্রে আমাদের টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমে তাদের সিনেমার ঢাউস প্রমোশন ও শিল্পীদের অংশগ্রহন, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে পাবলিসিটি কতটা যৌক্তিক?..."(চ্যানেল আইয়ের ১৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সেমিনার ২০১২ - এর মূল প্রবন্ধ "টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা"-এর অংশবিশেষ/প্রবন্ধ উপস্থাপন :সৈকত সালাহউদ্দিন)


প্রথমেই একটি সুসংবাদ দিতে চাই। নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা বলছে, দেশে পনের বছর উর্ধ্ব প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন দেখেন। এদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষের কাছে টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ, পর্যালোচনা বিশ্বাসযোগ্য। সংযোগ সুবিধার কারণে এখনো তৃর্ণমূল বেশীরভাগ মানুষ বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখেন। তবে দিনে দিনে স্যাটেলাইট চ্যানেলের দর্শক বাড়ছেই।

বাংলাদেশ টেলিভিশন যাত্রা শুরু করে ১৯৬৫ সালে। ১৯৯৭ সালে স্যাটেলাইট চ্যানেলের পদযাত্রা শুরু হয় এটিএন বাংলা দিয়ে। সে হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বয়স ৪৭ বছর। আর স্যাটেলাইট টেলিভিশন-এর যাত্রা ১৫ বছর।

বিটিভি ছাড়াও এদেশে বর্তমানে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মধ্যে বেশীর ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলই হচ্ছে জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল (জি ই সি)। এসব চ্যানেল সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, নাটক, চলচ্চিত্র, রিয়েলিটি শো, তথ্য ও বিনোদনমূলকসহ নানামুখী অনুষ্ঠান প্রচার করে। এগুলো হলো- এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, একুশে টেলিভিশন, এনটিভি, আরটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, বাংলাভিশন, দিগন্ত টেলিভিশন, দেশটিভি, বৈশাখী টেলিভিশন, মাই টিভি, মাছরাঙা টেলিভিশন, মোহনা টেলিভিশন,চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর, ইসলামিক টেলিভিশন ও গাজী টিভি। আর বিশেষায়িত টেলিভিশন যারা শুধু অনুষ্ঠান প্রচার করছে তাদের মধ্যে আছে চ্যানেল নাইন, চ্যানেল সিক্সটিন, সংসদ টেলিভিশন ও বিজয় টিভি। শুধুমাত্র সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান ও টক শো প্রচার করে এটিএন নিউজ, সময় টিভি, ইনডিপেডেন্ট ও ৭১ টিভি। সম্প্রচারের অপেক্ষায় আরো আছে এশিয়ান টিভি, এস এ টেলিভিশন, গান বাংলা ও দীপ্ত বাংলা।



অন্যদিকে দেশে ১০০ এর অধিক ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং ২৮০ টি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন মিলিয়ে রেজিষ্টার্ড সংবাদপত্র প্রকাশনা বর্তমানে পাঁচ শো ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে বগুড়া থেকে প্রকাশিত প্রয়াত ফজলুল হক সম্পাদিত মাসিক সিনেমাকে সূচনা ধরলে বিনোদন সাংবাদিকতার বয়স এখন ৬২। তবে সূচনালগ্নে বিনোদন সাংবাদিকতা ছিলো চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত নির্ভর। এর পরে বেতার ও মঞ্চ। সত্তর দশকের শেষভাগে বিনোদন সাংবাদিকতায় যোগ হয় টেলিভিশন। মিলেনিয়াম যুগে পদ্ার্পণের প্রত্যুষ থেকেই টেলিভিশনে বিনোদন সাংবাদিকতার এক বৈপ্লবিক সূচনা হয়। টেলিভিশনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ মাধ্যমের প্রসারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত।



টেলিভিশনের সবচেয়ে বড় শক্তি কোথায়? টেলিভিশন যে কোন ঘটনা, বিষয়, ব্যক্তি, ইন্ডাষ্ট্রির ইমেজ নির্মাণ করে। সে ক্ষেত্রে আলোচনায় এসে যায় টেলিভিশন বিশেষ করে আমাদের বিনোদন ইন্ডাষ্ট্রির কী ধরণের ইমেজ নির্মাণ করছে?

টেলিভিশন বিনোদনের মধ্যে আছে নাটক, ম্যাগাজিন, টক শো, রিয়েলিটি শো, সিনেমা, সঙ্গীত প্রভৃতি। এ সময়ে খেলাধুলাও বিনোদন। সারা বছর বিটিভিসহ দেশের সবকয়টি টিভি চ্যানেলে পুর্ণাঙ্গ নাটক, খন্ডনাটক, ধারাবাহিক নাটক মিলিয়ে গড়ে প্রায় তিন হাজার নাটক প্রচার হয়। সেক্ষেত্রে শুধু নাটকের বিনিয়োগ ও বিজ্ঞাপন বিবেচনা করলে টেলিভিশন নাটককে ঘিরেও ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠেছে। এই অবস্থায় অন্যান্য অনুষ্ঠান যোগ করলে টেলিভিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প ঘোষণা করে সুযোগ সুবিধা দেওয়া এখন সময়ের দাবি মাত্র।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নানা রকম রিয়েলিটি শো করছে। বিতর্ক থাকলেও এর মাধ্যমে যারা বেরিয়ে আসছেন তারাই বর্তমান সময়ে অভিনয়, সঙ্গীত, উপস্থাপনা ও বিজ্ঞাপনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। সংবাদ মাধ্যমও তাদের হাইলাইটস করছে।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কী ধরণের নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে? সে সব অনুষ্ঠানের মান কেমন? বিটিভিতে একটি কার্যকরী প্রিভিউ কমিটি আছে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর প্রিভিউ দৃশ্যমান নয়। ঠিক এ জায়গাটিতে কার্যকর শক্তিশালী ভুমিকা পালন করতে পারে বিনোদন পত্রিকা ও সাংবাদিকরা। টেলিভিশন কী মানুষকে সত্যিকার বিনোদন দিতে পারছে- তা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের।

দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিনোদন সাংবাদিকতা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এক সঙ্গে এতো চ্যানেল দেখা ও যথাযথ পর্যালোচনা করা খুবই কঠিন ও সময় সাপেক্ষ কাজ। চ্যানেলগুলোর পি আর সেকশন থাকায় কাজটা একটু সহজ হয়ে যায় । সাধারণভাবে প্রতিদিন পত্রিকার বিনোদন সংবাদ ও ম্যাগাজিনে থাকে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সময়সুচি, হাইলাইটস, তারকার খবর, নাটক, নতুন বিজ্ঞাপন, টক শোর খবর।



এগুলো হলো টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতার ভালো দিক, অর্থাৎ মুদ্রার এক পিঠ।



মুদ্রার অপর পিঠে আছে নানারকম অভিযোগ অনুযোগ। যেমন এই মুহুুর্তে সংবাদ মাধ্যমে প্রোমোশন সাংবাদিকতা, প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতা বেশী দেখা যায়। এর ফলে অনুসন্ধানী ও বৈচিত্রময় বিনোদন সাংবাদিকতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাঠক সেই সঙ্গে টেলিভিশন। টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা নিয়ে বড়ো অভিযোগ হলো ‘তারকা’, ‘জনপ্রিয়’,‘আলোচিত’, ‘নন্দিত’, ‘কিংবদন্তি বিশেষণগুলোর যত্রতত্র ব্যবহার। এছাড়া পত্রিকার পাতায় নাটক কিংবা অনুষ্ঠানের নিয়মিত সমালোচনা অনুপস্থিত। একটি উদাহরণ দেই - বছরে যদি দেশে টেলিভিশনগুলো তিন হাজার নাটক প্রচার করে এর মধ্যে ৩০টি নাটকের মান ভালো হলে অনুপাতিক হারে নাটকের মান আসলেই ভালো কী মন্দ, এই নিয়ে গবেষণা নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সংবাদ মাধ্যম বলে চলেছেন নাটকের মান ভালো! অন্যদিকে গত তিন বছর গড়ে ষাটটি সিনেমার মাঝে ১০টি সিনেমার মান ভালো হলেও বলা হয়ে থাকে সিনেমার মান খারাপ।

টিভি ইন্ডাষ্ট্রি ও সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত সে কারণে বিজ্ঞাপনের মান নিয়ে দুই মাধ্যমই নীরব। সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায় একটি ছেলে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, এরপর ঝামেলা মনে করে কলার টিউন সেট করে রেখেছে। আরেকটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় , তরুণ ছেলেটি ভয়েস অপশনে গিয়ে বান্ধবী সেজে মেয়ের বাবাকে ধোঁকা দিচ্ছে। এমনকী মিডিয়ায় ভাষা বিকৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও এক শ্রেণীর বিজ্ঞাপনদাতাকে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। এর কোন সমালোচনা কী আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি? স্মরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশের একটি ফোন কোম্পানী প্রথম ‘খাইছি’ ‘ধরছি’ ভাষা সহযোগে বিলবোর্ড স্থাপন করে সমালোচিত হয়। কিছুদিন পরই নাটকের ভাষা বিকৃতি প্রকোপ হয়, এমন কী টক শো, অনুষ্ঠানেও স্মার্টনেসের নামে এই ধরণের ভাষা ব্যাধি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এসব নাটক ও অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দৃশ্যমান হয়নি। এমনকী কোন কোন সংবাদপত্রকে এই ধরণের ভাষার নাটক, নির্মাতা ও কলাকুশলীকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা গেছে। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মিডিয়ায় ভাষা ব্যবহারে স্বস্তি ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। অথচ বিনোদন সাংবাদিকরা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে বিষয়টি হয়ত আদালত পর্যন্ত গড়াতো না।

এ কারণে প্রশ্ন উঠে, বিজ্ঞাপনদাতা+টেলিভিশন+সংবাদ মাধ্যম এক হয়ে কখনো কখনো ভূল জিনিসের জনপ্রিয়তা তৈরি করেন কী-না? যাকে বলে ম্যানুফ্যাকচারড হাইপ।

আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হলো- টেলিভিশন আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির সত্যিকার ইমেজ তৈরি করতে পারছে কী-না? বাংলাদেশের মহিলা টিভি দর্শকের প্রায় অধিকাংশই কোলকাতার ষ্টার জলসা দেখেন। লক্ষ্যনীয়, তাদের নাটকের মান ও বিষয় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থাকলেও সে নাটকগুলোয় তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, পোষাক সুনির্দিষ্ট ও সুদুরপ্রসারী। বিনোদনের সঙ্গে এইসব নাটকগুলো তাদের পোষাক, অলংকার, সংস্কৃতি, মূল্যবোধও যেন পাচার করে দিচ্ছে এদেশে। অন্যদিকে আমাদের বেশীরভাগ নাটক দেখলে বোঝা মুশকিল এটা কোন দেশের,কোন সময়ের নাটক।



টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতায় আরেকটি বিষয় আলোচনা জরুরী। বর্তমান সময়ে বাইরের দেশের শিল্পীরা দেশীয় চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় অংশ নিয়ে চলছেন। ধীরে ধীরে এই হার বাড়ছে। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশী অনুষ্ঠানও প্রচারিত হচ্ছে। সংবাদ ও নানা অনুষ্ঠানে হিন্দি ও ইংরেজী নতুন সিনেমার প্রমোশন দেখানো হচ্ছে যা দেশীয় সিনেমার চেয়ে কম নয়, কখনো কখনো বরং বেশী। কেউ কেউ বলছেন এটি বিশ্বায়নের অংশ। তবে কৌতুক করে বলা যায়, বিশ্বায়ন শুধু কী গরীব দেশের জন্য প্রযোজ্য? আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেখানে পাশ্ববর্তী দেশে সম্প্রচারের সুযোগ নেই, সেদেশে আমাদের নাটক, সিনেমা, গান জনপ্রিয় হবার সুযোগই বা কোথায়? সেক্ষেত্রে আমাদের টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমে তাদের সিনেমার ঢাউস প্রমোশন ও শিল্পীদের অংশগ্রহন, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে পাবলিসিটি কতটা যৌক্তিক?



পরিশেষে বলতে চাই, টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমের ক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন জাতীয়ভাবে ছায়া পার্লামেন্টের মতোই। কাজেই অদৃশ্য বা দৃশ্যমান চাপকে মোকাবিলা করে টেলিভিশনকে আমাদের জনগোষ্ঠিকে সুস্থ বিনোদন দিতে হবে। বিনোদন সাংবাদিকদের কখনো সহযোগী, কখনো কঠিন সমালোচক হিসেবে টেলিভিশনের মান নির্ণায়কের দায়িত্ব পালন করতে হবে।





লেখক পরিচিতি : সৈকত সালাহউদ্দিন, সাংবাদিক ও মিডিয়া কনসালটেন্ট।

ক) সাংবাদিকতা : নির্বাহী সম্পাদক আনন্দভুবন / আনন্দ আলো খ) এন্টারটেইনমেন্ট নিউজ এডিটর, এশিয়ান টিভি। গ) ওয়ার্কশপ : ওয়ার্ল্ডভিউ টেলিভিশন ট্রেনিং কোর্স ২০০২; মুভিজ টুডে ২০০৭

0 comments:

Post a Comment