Monday, April 1, 2013

সভ্যতার বিবর্তন - রণক ইকরাম

0 comments
মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্ট বলেছেন, 'সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।' আর তাই মানব ইতিহাস বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মানা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষের জীবনধারা পাল্টেছে। হিংস্রতা থেকে মানুষের জীবন পেয়েছে সুসভ্য রূপ। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে। এলাকাভেদে ও সংঘবদ্ধ দলভেদে এই পরিবর্তন একেক জায়গায় একক রকম। আর এই পরিবর্তনের শুরুর দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সভ্যতা গড়ে ওঠে। এই সভ্যতাগুলোর ক্রমাগত বিবর্তনের ফলেই আমরা আজকের আধুনিক পৃথিবী পেয়েছি। চলুন জেনে নেওয়া যাক আলোচিত কিছু সভ্যতার গল্প।


সব মানুষের পূর্বপুরুষ আফ্রিকান


পৃথিবীতে প্রথম মানবসমাজের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে, প্রায় ২ লাখ বছর আগে। আফ্রিকাকে বলা চলে আদি মানুষের নিবাস। এরও প্রায় ৭০ হাজার বছর পরে, তার মানে আজ থেকে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বছর আগে তারা ছড়িয়ে পড়তে লাগল আফ্রিকার বাইরে, পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়। প্রায় ৯০ হাজার বছর আগে তারা ইউরোপে আর মধ্যপ্রাচ্যে পেঁৗছায়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত আমেরিকা মহাদেশেই মানুষ পৌঁছায় সবার শেষে। সেখানে মানুষ পেঁৗছায় আজ থেকে মাত্র ১৫ হাজার বছর আগে!

আজকের সভ্য পৃথিবীর শুরুটা হয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশ থেকে। এশিয়ার আরব, পারস্য, ভারত, চীন ছিল সমৃদ্ধশালী এলাকা। আর ইউরোপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ছিল উন্নত দেশ। আফ্রিকার মিসরও কিন্তু এক সময় অনেক উন্নত ছিল। জলপথ আবিষ্কারের মাধ্যমেই কিন্তু শুরু হয়েছিল ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য। এই জলপথ ব্যবহার করেই ইউরোপীয় বণিকরা আসা শুরু করে ভারতে। শুরু করে তাদের বসতি স্থাপন। একে একে আসে স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বণিকরা। এই জলপথ আবিষ্কারের সঙ্গে সূচনা হয় এই অঞ্চলের নতুন ইতিহাসের।

ইনকা সভ্যতা


যুগের পর যুগ ধরে প্রত্নতাত্তি্বকরা নানা প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ করছেন। এর মধ্যে কোনোটি সমৃদ্ধ কোনোটিবা একেবারে অগোছাল। কোনোটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আবার কোনোটি এখনো রয়ে গেছে অদ্ভুত রহস্যময়তার বেড়াজালে বন্দী। নেটিভ আমেরিকানদের ইনকা সভ্যতা এমনই এক রহস্যময় সাম্রাজ্য। তাদের সম্বন্ধে লিখিত কোনো তথ্য আজও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে নানা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন থেকে এ সভ্যতা সম্পর্কে অনুমান করা হয়। তাদের স্থাপত্যশৈলী ছিল অসাধারণ। মিসরের পিরামিডের নির্মাণশৈলী যেমন আধুনিক মানুষকে বিস্মিত করে, ঠিক তেমনি নান্দনিক ছিল ইনকাদের স্থাপত্যশৈলী। ইনকা সাম্রাজ্য 'কেচুয়া' নামক নেটিভ আমেরিকানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে। কেচুয়া জাতির শাসকদের মর্যাদা দেবতাতুল্য বলে তাদের ইনকা বলা হতো। সূর্যদেবকে তারা ইনতি বলে ডাকত এবং সেই নামের প্রতিনিধিত্ব করত ইনকা শাসকরা। একটি উপজাতি হিসেবে বর্তমান পেরুর কুস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। ইনকা সাম্রাজ্য একসময় বিস্তৃত ছিল বর্তমান পেরুর কুস্কো ভ্যালি থেকে উত্তরে ইকোয়েডর এবং সুদূর দক্ষিণে বলিভিয়া, চিলি এবং আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। পেরুর কুস্কো ভ্যালিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হচ্ছে বর্তমান প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে। ইনকাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেট অব দ্য আর্ট নিদর্শন যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত_ তা হলো মাচুপিচু। সমতল থেকে প্রায় এক হাজার ৮০০ ফুট উপরে এক দুর্গ শহর।

পেরুর কুস্কো অঞ্চলেই উপকথার প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কুস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরিদের অধীনে আন্দিজ পর্বতমালার অন্যসব জাতিগোষ্ঠীকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করে। পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে- পৃথিবী কাঁপানো মানুষ। তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল।

ইনকাদের নির্মাণশৈলী খুবই নিখুঁত এবং সাদামাঠা। মিসরীয় ফারাওদের মতো তাদের সম্রাটরাও ডেমিগড মর্যাদার অধিকারী ছিল। স্পেনীয় দখলদারদের আক্রমণে ১৫৩২ সালে ক্ষমতাধর ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক পরে তাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিহাসের পাতায় তুলে আনেন একজন উত্তর আমেরিকান এঙ্প্লোরার হায়ার্যাম বিংগাম। ১৯১১ সালে হায়ার্যাম বিংগাম তার ব্যক্তিগত ভ্রমণ অনুসন্ধিৎসা থেকে চলতে চলতে মাচুপিচু দুর্গনগরী, ইনকাদের শেষ আশ্চর্য নিদর্শন আবিষ্কার করেন। যখন তিনি প্রথম সে জায়গাটি খুঁজে পান তখন তিনি অনুমান করতে পারেননি, তিনি একটি মূল্যবান প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার সহজাত অনুসন্ধিৎসা তাকে আবার সেখানে ফিরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে পেশাদার প্রত্নতাত্তি্বকদের সহায়তায় তিনি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এই সভ্যতাকে আবিষ্কার করেন।

বিধ্বংসী স্পেনিশ অভিযাত্রীরা বারবার আঘাত হেনেছিল ইনকাদের প্রাচুর্যে। তারা লুটপাট, হত্যাসহ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে ইনকা সভ্যতার সমৃদ্ধ শহরগুলো। মূলত সেই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ইনকা সম্পর্কে খুব অল্পই তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।

ইনকাদের স্মৃতি ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনগুলো রহস্য হয়ে থাকার কারণ তাদের অধিক পরিমাণে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ব্যবহার। স্পেনীয় দখলদাররা নেটিভ আমেরিকানদের আক্রমণ ও তাদের দেশ দখল করার কারণ ছিল, স্বর্ণ ও রৌপ্যের লোভ। সেজন্য মনে করা হয় ইনকাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যের ঐতিহ্যই তাদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। একই কারণে তাদের বিভিন্ন নিদর্শন স্পেনীয়দের দ্বারা লুট হয়ে যাওয়া ও সেগুলোর স্বর্ণ ও রৌপ্য গলিয়ে ফেলার কারণে ইনকাদের সম্বন্ধে অনুমান করা আরও দূরূহ হয়ে পড়ে।

স্বর্ণের প্রতি ছিল ইনকাদের অন্যরকম আগ্রহ। এর পেছনে কারণ ছিল তারা স্বর্ণকে সূর্য দেবের প্রতীক ভাবত। তাদের মন্দিরগুলোতে তাই স্বর্ণের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।


মুসলিম সভ্যতা


বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে মুসলিম সভ্যতা। এই সভ্যতার উৎপত্তি মূলত ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মাধ্যমে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়_ এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো হল, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বাইরে থাকা। আধুনিক জীবনধারার নতুন ধারণার বিবর্তনে এই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতি কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ বর্বর ছিল। তাদের মধ্যে কোনো জ্ঞানের আলো ছিল না। ইসলাম তাদের জীবনে আলোকবার্তকা হয়ে ধরা দেয়। জ্ঞান ও প্রজ্ঞাভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম বর্বর আরবদের জীবনের গতিধারাই পাল্টে দেয়। প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জল হয়ে ওঠে মুসলিম সভ্যতা।

উইল ডোরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতার মতো এত বিস্ময়কর সভ্যতা আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাত তাহলে মুসলিম সভ্যতা আরব ভূখণ্ডের গণ্ডি পেরোতে সক্ষম হতো না। এসব গুণাবলীর কারণেই ইসলাম এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিল ।

সিন্ধু সভ্যতা


উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সভ্যাটির নাম হলো সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। ইতিহাসে ব্রোঞ্জ যুগ ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০- ১৩০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদের অববাহিকা। এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত। তবে আলোচিত এই সভ্যতার আবিষ্কার খুব বেশিদিন আগের নয়।

১৯২২-২৩ সালের কথা। ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শালের ভারতীয় সহকারী রাখালদাস অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদাড়ো এলাকায় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তার ক'দিন আগেই মহেঞ্জোদাড়োর কয়েকশ' মাইল উত্তরে পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় একটি প্রাচীন শহরের চার-পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। আর এতেই নড়েচড়ে বসেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। আশেপাশের এলাকাজুড়ে শুরু হয় ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান। ভারত ও পাকিস্তানের নানা জায়গায় এরকম আরো শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কার সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্তি্বক আবিষ্কারের সমস্ত অতীত রেকর্ড ভেঙে ফেলে। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্তি্বকরা মনে করেন, এই সব শহর একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। এই সভ্যতাই সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ান সাহিত্যে সম্ভবত যার নাম মেলুহা। ভৌগোলিক বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা। এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতি বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা থেকে এই সভ্যতাকে একদমই আলাদা করে তুলেছে।

এই সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ [ক্যালকোলিথিক] যুগের সভ্যতা। কারণ, লোহার ব্যবহার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অজ্ঞাতই ছিল। এই সভ্যতার সামগ্রিক সময়কাল ধরা হয় ৫৫০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সিন্ধুবাসীদের প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম, যব, মটর, খেজুর, তিল ও সরষে। সভ্যতার অনেক আগেই কৃষির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল।

প্রস্তর যুগ


ভারতে প্রথম কবে মানুষ বসবাস শুরু করে, সঠিকভাবে তা বলা যায় না । মধ্যপ্রদেশের হোসংগাবাদ শহরের নিকটবর্তী হাথনোরা গ্রামের কাছে ভারতের প্রাচীনতম মানুষের নিদর্শনটি পাওয়া গেছে । এর সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। অনুমান করা হয়েছে এর বয়স বড়োজোর ৫ লক্ষ বছর হবে । প্রাক্‌ঐতিহাসিক যুগের কোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না । কারণ তখন মানুষ লিখতে পড়তে জানত না । একমাত্র তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র থেকে তাদের কথা জানতে পারা যায় । তখন মানুষ পাথরের সাহায্যে যন্ত্রপাতি তৈরি করত বলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই যুগকে ‘প্রস্তর যুগ’ [Stone Age] বলে অভিহিত করেছেন । প্রস্তর যুগকে আবার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ,যথা- (১) পুরাপ্রস্তর যুগ [Palaeolithic Age বা Old Stone Age], (২) মধ্যপ্রস্তর যুগ [Mesolithic Age বা Middle Stone Age], ও (৩) নব্য প্রস্তর যুগ [Neolithic Age বা New Stone Age] ।

(১) পুরাপ্রস্তর যুগ [Palaeolithic Age বা Old Stone Age] : পুরাপ্রস্তর যুগের বিবর্তন দীর্ঘকাল জুড়ে চলেছিল । আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে, অর্থাৎ, ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুরাপ্রস্তর যুগ শেষ হয় । এ সময় মানুষ চাষাবাদ করতে জানত না । তারা ছিল যাযাবর; ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত । গাছের ফল ও পশুর মাংস ছিল তাদের প্রধান খাদ্য । এ সময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী । চাষবাস করে ফসল ফলাতে বা উৎপাদন করতে জানত না । পশু শিকারের জন্য তারা নানা ধরনের পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত । গঙ্গা, যমুনা ও সিন্ধু উপত্যকার সমভূমি বাদ দিলে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে এগুলির নিদর্শন পাওয়া গেছে । এগুলির মধ্যে হাত কুঠার ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ । পশ্চিম পাঞ্জাবের সোয়ান নদীর অববাহিকায় হাত কুঠারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

(২) মধ্যপ্রস্তর যুগ [Mesolithic Age বা Middle Stone Age]: ভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগ আনুমানিক ৮০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল । তবে ভারতের বাইরে অন্য অনেক জায়গায় এই যুগ অনুপস্থিত । সেইসব জায়গায় পুরাপ্রস্তরের পর সরাসরি নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । এই সময়ও মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী, খাদ্য উৎপাদক নয় । কারণ তখনও পর্যন্ত মানুষ চাষ-আবাদ করতে শেখেনি । তবে পাথরের অস্ত্রগুলি এই সময় আয়তনে ছোটো হয়ে যায় । এই সময়ের অস্ত্রগুলিকে মাইক্রোলিথ (Microlith) বলা হয়; অর্থাৎ, ছোটো, শক্ত ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ত্রিকোণাকার । মৃৎশিল্পে ও চিত্রশিল্পেও মানুষ বেশ পটু হয়ে উঠে । মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকার গুহাচিত্র এ সময়ের উল্লেখ্য চিত্রশিল্পের নিদর্শন।

(৩) নব্যপ্রস্তর যুগ [Neolithic Age বা New Stone Age] :
আঞ্চলিক বৈষম্যগুলি ধরে মোটামুটিভাবে বলা যায়, খ্রি.পূ.৪০০০ অব্দ থেকে ভারতে নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । মানুষ এ সময় কৃষিকাজ ও পশুপালন আয়ত্তে আনে এবং খাদ্য উৎপাদক হয়ে ওঠে । কাজেই মানুষ ক্রমশ: যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে । মাটি ও বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করা শিখে নেয় । বস্ত্রবয়ন শিল্প বিকশিত হয় । মৃতশিল্পের উন্নতি হয় । অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিও আগের তুলনায় অনেক উন্নত, মসৃণ ও মজবুত হয় । আগুনের ব্যবহারেও মানুষ সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে । মেহেরগড় এ যুগের সভ্যতা ।

মেহেরগড় সভ্যতা


মেহেরগড় সভ্যতা [Mehrgarh Civilisation]: হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।



(১) অবস্থান [Location of Mehrgarh Civilisation]: বালুচিস্তানের কাচ্চি সমতলভূমিতে বোলান নদীর পাড়ে কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মেহেরগড়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে । জ্যাঁ ফ্রাসোয়া জারিজ -এর নেতৃত্বে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন । এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলি হল কিলে গুল মহম্মদ, কোট ডিজি, গুমলা, মুন্ডিগাক, রানা ঘুনডাই, আনজিরা এবং মেহেরগড়।



(২) সময়কাল: প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূবাব্দে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতা বহু বছর স্থায়ী হয়েছিল বলে মনে করা হয় ।



(৩) সভ্যতার বৈশিষ্ঠ:[Characteristics of Mehrgarh Civilisation] : মেহেরগড়ের খনন কার্যের ফলে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চাষবাসের কিছু প্রমাণ মিলেছে এবং বহু দূর দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্কের প্রমাণও পাওয়া যায় । এখানকার মানুষ যে ঘরবাড়ি তৈরি করে গ্রাম স্থাপন করেছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে তার প্রমাণ মেলে ।



(ক) প্রাচীনতর পর্যায়ে একাধিক ঘর নিয়ে বাড়ি তৈরি করা হত । এইসব বাড়ি তৈরি হত রোদে শুকানো ইটের সাহায্যে । এই সময় তারা চাষবাস, পশুপালন ও শিকার করত । মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত এবং কোঁকড়ানো অবস্থায় সমাধিস্থ মৃতদেহ পাওয়া গেছে ।



(খ) পরের দিকে কৃষিকার্য ও পশুপালনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় । এই সময় তারা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । বাড়িগুলিও আকারে বড়ো হয়েছিল । এইসব বাড়ি থেকে ছোটো শিলনোড়ার পাথর, উনুন, হাড় দিয়ে তৈরি হাতিয়ার ইত্যাদি জিনিস পাওয়া গেছে । সমাধির মধ্যে যে সব জিনিস পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ঝিনুকের তৈরি লকেট, পুঁতি ও ঝিনুক জাতীয় জিনিসের মালা, পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি, পালিশ করা পাথরের কুডুল ইত্যাদি প্রধান । তখনকার মানুষ যব, গম, কুল, খেজুর ইত্যাদি চাষ করত । জন্তুজানোয়ারের মধ্যে হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া ও ছাগল, শুয়োর, গোরু ইত্যাদির হাড় পাওয়া গেছে । গরু, ভেড়া, ছাগল এবং সম্ভবত কুকুরও পোষ মানানো হত । শুধু চাষবাস বা পশুপালন এখানকার মানুষের উপজীবিকা ছিল না । ব্যবসা বাণিজ্যও করত । এখানে পাওয়া সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে মনে হয় সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানের সঙ্গে এদের ব্যাবসাবাণিজ্য চলত । মেহেরগড়ে যে সব পাথর পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয়, তাদের বাণিজ্য অন্তত তুর্কমেনিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । পাথর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বা জিনিসপত্র তৈরি হত । ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত হলেও, সমাধি থেকে তামার তৈরি একটি পুঁতি পাওয়া গেছে । এখানে পাথরের তৈরি কুড়ুল পাওয়া গেছে ।


(৪) মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব [Importance of Mehrgarh Civilisation]: মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমত, এখানে গম ও যব চাষের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, এই দুটি শস্যের সূত্রপাত পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে আমদানি করা হয়নি । দ্বিতীয়ত, এই সভ্যতা নব্যপ্রস্তর যুগের হলেও তামা, সিসা প্রভৃতি ধাতুও পুরোপুরি অজ্ঞাত ছিল না । তৃতীয়ত, এখানকার মানুষ দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করত । চতুর্থত, এখানে কাঁচা মাটি দিয়ে পুরুষমূর্তি ও পোড়া মাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে । তবে এই সব মূর্তির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কতটুকু ছিল, তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । পরিশেষে, এই সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগে বালুচিস্তান অঞ্চলে একটি মোটের উপর উন্নত গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল। এই জন্য অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।

তাম্রযুগ


নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ তামার ব্যবহার শিখেছিল । তবে পাথরের ব্যবহার ও গুরুত্ব তখনও অব্যাহত ছিল । তাই এই যুগকে তাম্র-প্রস্তর যুগ বা (Chalcolithic Age) বলে । সিন্ধু সভ্যতা এই যুগের সভ্যতা । তামার পর ধীরে ধীরে লোহার প্রচলন শুরু হয় । অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের পরেই লৌহ যুগ শুরু হয় । ভারতে কোথাও ব্রোঞ্জযুগের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না ।

সান সিং তুন সভ্যতা


সান সিং তুন বিশ্বের আরেকটি প্রাচীন সভ্যতা যেটির উৎপত্তি ও বিকাশ এশিয়ায়। আর স্পষ্ট করে বললে চীনে। এই সভ্যতার আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এখানকার সভ্যতা ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণাটা তেমন একটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু সান সিং তুন সভ্যতার আবিষ্কার সবকিছু আমূল বদলে দেয়। মজার ব্যাপার হলো এ সভ্যতার আবিষ্কারের গল্পটিও খুব অবাক করার মতো। এই সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে মূলত একটি গ্রামের নামে। সান সিং নামের একটি গ্রাম থেকে এই নামের উৎপত্তি। একজন সাধারণ কৃষকের কল্যাণে গোচা একটি সভ্যতা আবিষ্কৃত হবে, এমনটি কখনো কেউ ভাবেনি।

অথচ সান সিং তুন সভ্যতার আবিষ্কারের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন ইয়ে নামের একজন গরিব কৃষক। গরিব ইয়ে জমি চাষ করার সময় এমন বিস্ময়কর আবিষ্কার করবেন ভাবেননি তিনি নিজেও। জমি চাষ করতে গিয়ে আবিষ্কার হওয়া এখানকার প্রত্নতত্ত্ব ও আশপাশের এলাকা নিয়ে এরপর গবেষণা চলেছে একটানা কয়েক দশক। আর এ গবেষণা থেকেই উঠে এসেছে দারুণ এক ইতিহাস। পাঁচ থেকে তিন হাজার বছর আগে এখানে প্রাচীন শু রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। সুউজ্জ্বল এই সভ্যতা এখানে ২০০০ বছর স্থায়ী ছিল। সান সিং তুন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে শু রাষ্ট্রের ইতিহাস আর ২০০০ বছর এগিয়েছে। এ আবিষ্কার চীনের সভ্যতার ইতিহাসকে আর সুসম্পন্ন করেছে। সান সিং তুন সভ্যতা আর ছুয়াং চিয়াং নদীর সভ্যতা ও হোয়াংহো নদীর সভ্যতার মতো সবই চীনের সভ্যতার মূল ভিত্তি। সান সিং গ্রাম চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত। রাজধানী চেন তুং থেকে গাড়িতে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। আবিষ্কারের পর থেকেই আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে এই গ্রামটি। বছর দশেক আগে এখানে সান সিং তুন নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রায় ৫০০০ বছর আগের পুরনো এই প্রাচীন নগরের অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। ধারণা করা হয় ৩০০০ বছর আগে শহরটিকে আকস্মিকভাবে বাতিল করা হয়।

ফলে খুব উন্নত মানের সান সিং তুন সভ্যতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ বছর আগে চেন তুং শহরের উপকণ্ঠে আবিষ্কৃত কিনশা ধ্বংসাবশেষ এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারও কারও মতে সান সিং তুন বর্তমান কিনশা ধ্বংসাবশেষের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ বছর স্থায়ী এমন একটি প্রাচীন নগরকে বাতিল করার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ ছিল? অবশ্যই ছিল। কারও মতে বন্যার জন্য আবার কারও মতে যুদ্ধের জন্য।

আবার একদল বলেন, মহামারী রোগের জন্য শহরটি বিলীন হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই, সেই জন্য আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এক গোলক ধাঁধা রয়েছে। 

ওলমেক সভ্যতা


খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ঘটনাটা ১৮৬২ সালের। মেক্সিকো তখনো জঙ্গল আর জলাভূমিতে ভরা এক নির্জন দেশ। এরকমই একটা অরণ্যঘেরা জলাভূমিতে চাষের জন্য মাটি খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। হঠাৎ করেই পাথর বা ধাতুর একটি বিরাট বস্তু বেরিয়ে এলো। মাটির নিচে পুঁতে রাখা জিনিসটা দেখে চাষিদের মনে হলো এটা একটি লোহার কেতলি। গুপ্তধনের লোভে ওদের চোখ চকচক করে উঠল। দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গাটা খুঁড়ে পাথরের একটি ভাস্কর্যের ভাঙা মাথার সন্ধান মিলল। গুপ্তধনের দেখা না পেয়ে চাষিরা ভীষণ হতাশ হলো। কিন্তু আগ্রহী হয়ে ওঠলেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। কারণ এই ভাঙা মাথাটিই যে প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার প্রথম নিদর্শন।

সেই শুরু। তবে ওমলেক সভ্যতা বলে আদৌ কিছু ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্কের কমতি ছিল না। ১৯৪২ সালে মেক্সিকো তে এক আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্তি্বক সম্মেলনে অজস্র নমুনা ও প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওলমেক সভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সবাইকে নিশ্চিত করা হয়। নতুন সন্ধান পাওয়া এই সভ্যতার প্রাচুর্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন প্রত্নতাত্তি্বকরা।

'ওলমেক' শব্দটি এসেছে অ্যাজটেক সভ্যতার 'নাহুতল' ভাষা থেকে। শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'রাবার পিপল'। ১৫-১৬ শতকে উপসাগরীয় এলাকার নাব্যদেশে যারা বসবাস করত তাদের এই নামে ডাকা হতো। ওলমেকদের আদিনিবাস ধরা হয় আফ্রিকাকে। সেখান থেকে বহুদূরের পথ পেরিয়ে ওলমেকরা এসেছিল আমেরিকায়। ওলমেকদের অনেকে বলে থাকেন 'নওবান'। এটাই নাকি ওদের আসল নাম। আজ থেকে তিন হাজারেরও বেশি সময় আগে গড়ে উঠেছিল প্রাচুর্যে ভরা এই ওমলেক সভ্যতা। এটি ছিল প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মেসো আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। মেসো আমেরিকা অর্থ মধ্য আমেরিকা। আর ওলমেকরাই মেসো আমেরিকার প্রাচীন বাসিন্দা। ওলমেক সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মেঙ্েিকার ইউকান উপদ্বীপ। মেঙ্েিকা উপসাগরের উপকূলে টুঙ্টিলা পাহাড়ের পাদদেশের জলাভূমিময় জঙ্গলে, সে জঙ্গলের পাশে গ্রামে এবং নগরে বাস করত ওলমেকরা। বর্তমান মেঙ্েিকার ভেরাকুজ ও তাবাসকো প্রদেশই প্রথম নগর ও গ্রাম গড়ে তুলেছিল ওলমেকরা। প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে মায়ান ও অ্যাজটেক সভ্যতার কথা খুব শোনা গেলেও ওলমেক সভ্যতা এই দুই সভ্যতা থেকেও বুড়ো এবং সমৃদ্ধিশালী। ওলমেক সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করছেন, অ্যাজটেক ও মায়ান বিখ্যাত সভ্যতার অনেক কিছুই মায়ানদের দান করা। আর তাছাড়া ওমলেকদের সূক্ষ্ম খোদাইয়ের কাজ, বিরাট ভাস্কর্য, ভাষার ব্যবহার, গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য এবং বর্ষপঞ্জি প্রত্নতাত্তি্বকদের চমক লাগিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী বিখ্যাত সভ্যতাগুলোর মতোই তারা পুরো ৩৬৫ দিনের এক দিনপঞ্জিকা মেনে চলত। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওলমেকরাও পিরামিড বানাতে জানত। আর পশ্চিমা দুনিয়ায় ওলমেকরাই সম্ভবত প্রথম জাতি, যারা নিজেদের একটি লিখন-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। আর মায়ান সভ্যতার বর্ণমালা ওলমেক সভ্যতার প্রভাবেই গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। ওলমেকদের জীবনে ধর্ম ছিল কেন্দ্রজুড়ে, ছিল তাদের শাসকরা। আর সেই শাসকরা ছিলেন শামান। তাই যারা শাসক তারাই ছিলেন ওমলেকদের ধর্মীয় নেতা। সেই শামানরা নাকি রূপান্তরিত হতে পারত! বেশির ভাগ ওলমেকই গ্রামে বসবাস করত। আর এরা অরণ্য ও ঝোপঝাড় পুড়িয়ে ভুট্টা ও সূর্যমুখীর চাষ করত। বন্যার সময় ছাড়া তারা নদীর ধারেও চাষ করত। ভুট্টা ছাড়াও বুনত শিম, লাউ ও মিষ্টি আলু। সবজি ছাড়া তারা খেত মাছ, কাছিম, সাপ, ভোঁদড়, কাঁকড়া, হরিণ, খরগোশ ও পাখি। আর তারা খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে রাখার কৌশল জানত। পরবর্তী সময়ে যা খুঁজে পাওয়া গেছে অ্যাজটেকদের মধ্যে। ওলমেকদের চারটি শহরকে চিহ্নিত করা গেছে। লাগুনা দো লোজ সেরম, সান লোরেনজো, তে জাপাও আর লা তোনও।

এগুলো প্রতিটিই উন্নত স্থাপনায় ও শৈলীতে সমৃদ্ধ। ওলমেক সভ্যতার প্রাচুর্য আর অগ্রগতি প্রত্নতাত্তি্বকদের অবাক করেছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর আজো মেলেনি। ওলমেকরা কিভাবে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় এলো? তারা কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে ফেলল? তাদের এই বিচিত্র ভাস্কর্যবিদ্যার উৎস কি? আবার রাতারাতি এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল কিভাবে! আর এ সভ্যতার প্রাণরস কিভাবে পৌছে গেল মায়ান আর অ্যাজটেক সভ্যতার মধ্যে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজো মেলেনি।

বৈদিক সভ্যতা


উদ্ভব ও বিবর্তন: আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও আর্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, কোনটি আগে, কোনটি পরে বা আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কিনা, আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে, না তারা বহিরাগত— এইসব প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই। এসব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো উত্তর হয় না । বেদ ছিল আর্য মনীষার প্রধান ফসল এবং বেদ থেকেই আমরা আর্যসভ্যতার পরিচয় পাই। তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয় । ঋক্‌বেদের সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। ঋক্‌বেদ কবে রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ম্যাক্সমুলারের মতে, এর রচনা কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। বালগঙ্গাধর তিলকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ । দ্বিতীয় মতটি কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋক্‌বেদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই যুগকে তাই ঋক্‌বৈদিক যুগ বলা হয়। ঋক্‌বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগকে পরবর্তী-বৈদিক যুগ বলা হয়।

বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য [Features of vedic civilisation]:


সাধারণভাবে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলে থাকি। এই যুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে । প্রথমত,এই সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয় । অর্থাৎ এই সময় থেকেই আমরা সাহিত্যিক উপাদানের উপর নির্ভর করতে পারি । বেদ থেকে আমরা সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য জানতে পারি । দ্বিতীয়ত, এই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের কাছে অস্পষ্ট ও অনেকাংশে অজ্ঞাত । তৃতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যের উৎকর্ষতা ও উন্নত মান যেকোনো দেশের গর্বের বস্তু । এই সময়ে এত উন্নত মানের সাহিত্য পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি। চতুর্থত, বৈদিক সভ্যতাই উত্তর ভারতের গঙ্গা-যমুনা বিধৌত বিস্তীর্ণ সমভুমির প্রথম সভ্যতা । সিন্ধু সভ্যতার পূর্বতম সীমানা ছিল মিরাট জেলার আলমগিরপুর । পঞ্চমত, বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। প্রথমে তারা যাযাবর জীবন যাপন করত । পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা । পরে তারা কৃষিকাজ শুরু করে ও গ্রাম গড়ে তোলে। পরিশেষে, মনে রাখা দরকার যে,আর্যরা যে উন্নত মানের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল,তা যুগে যুগে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং আজ আমরা সেই ঐতিহ্য ও পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি।

প্রকাশিত হয়েছে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

0 comments:

Post a Comment