Tuesday, October 16, 2012

খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, সিলেট

0 comments
সিলেট শহরের পাশেই বাংলাদেশের নবীনতম জাতীয় উদ্যান খাদিমনগর। শহর সিলেট ছেড়ে জাফলং তামাবিল সড়কের খাদিম নগরে হাতের বাঁ বড়জান আর খাদিমনগর চা বাগানের দিকে চলে যাওয়া সড়কটির ঠাঁই মেলেছে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে। চা বাগানের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে জঙ্গলের ঘনত্বই জানান দেবে তার আপন পরিচয়। সিলেট শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের যে কয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে তার মধ্যে খাদিমনগর নবীনতম। ২০০৬ সালে এটি জাতীয় উদ্যান বা ন্যাশনাল পার্কের মর্যাদা পায়। এর আয়তন প্রায় ৬৭৮ হেক্টর। তবে সর্বপ্রথম ১৯৫৭ সালে এই বনকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছিল। জানা যায়, সে সময়ে বাঁশবন পরিষ্কার করে এখানে বনায়ন করা হয়েছিল। প্রায়-পাতাঝরা উষ্ণ মণ্ডলীয় চিরসবুজ এই বন দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, পাখি আর বন্য প্রাণীদের অভয়াশ্রম। এ বনে বসবাসকারী বন্যপ্রাণীদের আছে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৯ প্রজাতির উভচর, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২৫ প্রজাতির পাখি।
খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের এসব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উল্লেখযোগ্য হলো মুখপোড়া হনুমান, বানর, বনবিড়াল, ভল্লুক, মায়া হরিণ, লজ্জাবতী বানর, বনরুই, খাটাশ, সজারু, সাদা বুক-কাঠবিড়ালি, খরগোশ, মালায়ান বৃহত্ কাঠবিড়ালি, বাদুর প্রভৃতি। সরীসৃপের মধ্যে আছে বিভিন্ন জাতের সাপ, অজগর, গুইসাপ, উড়ুক্কু লিজার্ড, বেজি ইত্যাদি। এ ছাড়া নানান পাখপাখালির কলকাকলিতে সবসময় মুখরিত থাকে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান। হলুদ পা হরিয়াল, পাকড়া ধনেশ, বড় র্যাকেট টেইল ফিঙ্গে, লালপিঠ ফুলঝুরি, বেগুনি মৌটুসি, মদনা টিয়া, কালা মথুরা, বাসন্তী লটকন টিয়া, মালয়ি নিশি বক ইত্যাদি। বনের গাছগাছালির মধ্যে রয়েছে চাঁপালিশ, কদম, জলকড়ই, কড়ই, গর্জন, সিভেট, বাঁশ, মুলিবাঁশ, বুনো সুপারি, ট্রি-ফার্ন ইত্যাদি।
খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ঘন জঙ্গলের ভেতরে চমত্কার দুটি ট্রেইলে গা ছম ছম করা পরিবেশের মধ্যে হেঁটে বেড়াতে পারেন। বনের ভেতরে জঙ্গলের ঘনত্ব কোথাও কোথাও এতো বেশি, সূর্যের আলো পর্যন্ত মাটি ছুঁতে পারে না। দুটি ট্রেইলের মধ্যে একটি ৪৫ মিনিটের, অন্যটি দুই ঘণ্টার। ৪৫ মিনিটের ট্রেইলটির শুরু সড়কের খাদিমনগর চা বাগান থেকে চলে আসা সড়কটির কালিবাড়িতে আবুলের টিলাকে বাঁয়ে রেখে শুরু হয়েছে। এ পথে শীতল জলের পাহাড়ি ছড়া আছে। এ পথে বিভিন্ন রকম বনফুল, ঘন বাঁশবন আছে। নিরবতা অবলম্বন করলে নানান দুর্লভ বন্যপ্রাণী আর পাখির দেখা মিলতে পারে এ পথে। ঘুরে ফিরে এসে এ পথটির শেষ হয়েছে বিট অফিসের আগে প্রদান সড়কের সঙ্গেই। 
দুই ঘণ্টার ট্রেইলটির শুরু বিট অফিসের পাশ থেকে। শুরুতেই ছড়ার উপর থেকে বাঁশের সেতু পেরিয়ে হাঁটা শুরু করতে হবে। বিট অফিসকে হাতের ডানে রেখে বাঁয়ের সরু পথ ধরে চলতে হবে। এ পথে জোয়ালনালা, জলকণা, জিয়ানা, সাধুনালা নামের চারটি পাহাড়ি ছড়া পড়বে। এ পথে আছে ঘন বাঁশবন। নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে চলতে এ পথের শেষ হয়েছে আবার প্রধান সড়কে এসে। এ পথেও দেখা মিলতে পারে নানান বন্যপ্রাণী আর পাখির।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে সিলেট শহরে। সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট আসতে পারেন। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে আসা যায়। ঢাকা থেকে গ্রিন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহনের এসি বাস যায় সিলেটে। ভাড়া ৮০০-১০০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ প্রভৃতি জায়গা থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া, মামুন পরিবহন, সিলকম পরিবহন ইত্যাদি সংস্থার নন-এসি বাসও সিলেটে যায়। ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা। ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ৯৫ টাকা-৬৯৮ টাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টায় যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টায় উদয়ন এক্সপ্রেস। সিলেট শহর থেকে কার, মাইক্রো বাস, কিংবা অটোরিকশায় খাদিমনগর জাতীয় ্উদ্যানে আসতে সময় লাগবে ত্রিশ মিনিটের মতো।
কোথায় থাকবেন
সিলেট শহরে রাতে অবস্থান করার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। তবে এ ভ্রমণে উদ্যানের একেবারে কাছাকাছি অবস্থান করার জন্য আছে শুকতারা প্রকৃতি নিবাস। পাহাড় চূড়ায় চমত্কার আর আধুনিক কটেজ আছে শুকতারায়। শুকতারার কক্ষ ভাড়া ৫০০০-৬৫০০ টাকা। তবে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনে এ মূল্যের উপরে মিলবে ১০ ভাগ ছাড়। যোগাযোগ :শুকতারা প্রকৃতি নিবাস, উদ্দীনের টিলা, শাহপরাণ উপশহর, খাদিমনগর সিলেট। ফোন :০৮২১-২৮৭০৯৯৪-৫, ০১৭৬৪-৫৪৩৫৩৫। www.shuktararesort.com
কী করবেন
জঙ্গলে ভ্রমণে সবসময় হালকা কাপড় ও জুতা এবং কেমোফ্লাজ রঙের কাপড় পরিধান করবেন। রোদ চশমা, রোদ টুপি, ছাতা, পানির বোতল, সঙ্গে নেবেন। বর্ষায় ভ্রমণে গেলে অবশ্যই রেইনকোট কিংবা পঞ্চ সঙ্গে নিন। পোকা মাকড় ও মশার হাত থেকে বাঁচতে পতঙ্গ নাশক ক্রিম সঙ্গে নিন। জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে মোজার মধ্যে প্যান্ট গুঁজে নিন। দূরের বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখতে দূরবীন নিতে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণকালীন সর্বোচ্চ নিরবতা অবলম্বন করুন। প্লাস্টিক জাতীয় প্যাকেট, বোতল, ক্যান সঙ্গে এনে বাইরে কোথাও ফেলুন।  
কী করবেন না
পিকনিক করতে জঙ্গলে যাবেন না। ভ্রমণে উচ্চ শব্দে মাইকে গান কিংবা কোনো কিছু বাজাবেন না। বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো শব্দ কিংবা আওয়াজ করবেন না। ময়লা, প্লাস্টিক জাতীয় কোনো কিছু জঙ্গলে ফেলবেন না। বনে ধূমপান করবেন না। 
প্রয়োজনীয় তথ্য
খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানে একাকী ভ্রমণ না করাই ভালো। দলবদ্ধভাবে ভ্রমণে গেলে অবশ্যই অভিজ্ঞ গাইড সঙ্গে নেওয়া ভালো। তাতে জঙ্গলে ভ্রমণ এবং বন্যপ্রাণী দর্শন সহজ হবে। খাদিমনগর উদ্যানে নিসর্গ প্রশিক্ষিত কয়েকজন গাইড আছেন। নির্ধারিত সম্মানীর বিনিময়ে এসব গাইডের সেবা নেওয়া যাবে। কয়েকজন গাইডের মুঠোফোন নম্বর :শ্রী গোপাল পাত্র ০১৭৩৯১৭১৫৮৭, এমরান আলী তালুকদার ০১৭২৫১০৮৯৫৯, নাদিম হোসেন ০১৭১৭৫৬৬৬৯৬, বিলাস ব্যানার্জী ০১৭২৮৯৬৮২৭৯, কামরুল ইসলাম ০১৭১২৩২৮৭৫৮, হোসেন আলী ০১৭২২২২৮৩১৯, রিন্টু চাষা ০১৯১২৮৭৫৭০৮, স্বরস্বতী পাত্র ০১৭৩৯১৭১৫৮৭।

আলোকচিত্র ও লেখা  মুস্তাফিজ মামুন  |  ইত্তেফাক

0 comments:

Post a Comment