Sunday, October 21, 2012

জাপানি সবুজ চায়ের কথা

0 comments
‘ওচা ওয়া য়োওজোও নো ছেনইয়াকু, এনরেই নো মিয়োজুৎসু’ বলে একটি প্রবাদ ছিল কামাকুরা যুগে (১১৮৫-১৩৩৩)। এর অর্থ হল : ‘ওচা স্বাস্থ্য রক্ষার্থে মহাষৌধ এবং দীর্ঘায়ু হওয়ার জাদুকরী কৌশল।’ তখনকার আমলে জাপানে ওচা ওষুধ হিসেবে পান করা হতো। জেন বৌদ্ধধর্ম অনুসারে আধ্যাত্মিক মনোযোগ স্থাপনে এ ওচা বিশেষ ভূমিকা রাখত বলে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতো। অবশ্য তখন এটা একমাত্র সমাজের অভিজাত শ্রেণীর জন্য পানীয় বস্তু হিসেবে নির্ধারিত ছিল।
যুগের পালাবদলে এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) এসে ওচাকে কেন্দ্র করে জš§ নিল প্রিয়জন সমাবেশ। তখন কৃষিকাজের ক্লান্তি দূর করার এবং খিদের অনুভূতিকে ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে রাখার পন্থা হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ওচা পানের সুযোগ সৃষ্টি হল। এর শতাধিক বর্ষ পরে গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল যে, ওচার মধ্যে বেশি পরিমাণে আছে অ্যামিনো ও গ্লুমাটিক এসিড উপাদান, যা কিনা মানুষের মানসিক স্বস্তিবিধায়ক এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধে সহায়ক। শুধু তাই নয়, জাপানি ওচা>রোকুচা>গ্রিন টি>সবুজ চা পাতার মধ্যে রয়েছে আরও নানা ধরনের উপাদান, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপাদেয়। তাই জাপানে ওচা সংস্কৃতি আজ অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ, যা এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। এই ওচা সংস্কৃতিকে জাপানি ভাষায় বলে ‘ওচা আসোবি’ বা ‘চা নো ওইউ’ অর্থাৎ ‘চা-সঙ্গ’ আরও সহজ করে বললে ‘চায়ের আড্ডা।’ জাপানি এই ওচা আদৌ রং চা নয়, যা বিলেতে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ‘টি’ হিসেবে প্রচলিত। জাপানে ‘টি’কে ‘কোওচা’ বলে, যার অর্থ ‘লাল চা।’
জাপানি ওচাকে একটি শৈল্পিক রীতিতে রূপদান করা হয়েছে কামাকুরা যুগেই যাকে বলা হয় ‘চাদোও’ বা ‘শাদোও’; ইংরেজিতে ওয়ে অফ টি। সুঐতিহ্যবাহী এই চা-রীতিকে বিশ্বে প্রথম পরিচিত করান জাপানের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কলাশিল্পের পণ্ডিত ও দার্শনিক ওকাকুরা (কাকুজো) তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) ইংরেজিতে দি বুক অফ টি নামে একটি নাতিদীর্ঘ গ্রন্থ লিখে।
দি বুক অফ টি পড়লে বোঝা যায় চা-অনুষ্ঠানটিকে কীভাবে জাপানিরা চীন থেকে আমদানি করে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ চা-রীতিটিই একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন, যা কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতার চেয়েও বহুলাংশে অগ্রসর; শুধু তাই নয়, মানবতাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও সর্বজনীন শান্তিবাদেরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল একটি পন্থা। এই চা-অনুষ্ঠান দীর্ঘ সময় নিয়ে নানা আচার-আচরণ দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন ‘তাতামি’ তথা বিশেষ খড় দিয়ে তৈরি মেঝেতে হাঁটু মুড়ে নিঃশব্দে বসার ভঙ্গি, কয়েকবার ঘুরিয়ে চা পাত্র হাতে নেয়া ও চা পানের পদ্ধতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম সাধারণ ওচা পান করার থেকে। চাদোও অনুষ্ঠিত হয় কাঠ, বাঁশ ও বুনোছন দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি একটি কক্ষে যাকে বলে ‘চা-শিৎসু’ বা ‘চা-কক্ষ’। অবশ্য হেমন্তকালীন উৎসব ‘কোওয়োও মাৎসুরি’, বসন্তকালীন উৎসব ‘হানামি’এবং অন্যান্য জাতীয় দিবস, উৎসব-মেলা উপলক্ষে উদ্যানেও চাদোও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে ব্যবহƒত কাঠের তৈরি চা পাতার কৌটো, চীনা মাটি বা লোহার চা-পট যাকে বলে ‘কিউসু’, বাঁশের চামচ, বাঁশের ব্রাশ, পোড়া মাটির খাড়া চা-পাত্র ইত্যাদি ‘চা-দোওগু’ বা ‘চা-সরঞ্জাম’ নামে পরিচিত। এসবের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক নির্যাস ও সুগন্ধসার। এ জন্য চা-দোও জাপানের অন্যতম ‘লিভিং আর্ট।’ এই চা-অনুষ্ঠানে ব্যবহƒত হয় ‘মাচ্চা’ নামে ‘রোকু চা’রই একটি প্রজাতির গুঁড়ো চা, যার রং সফেদ ঘন সবুজ। স্বাদ কষজাতীয় কিন্তু সুরভিযুক্ত। কিয়োতো মহানগরে প্রচুর সুসজ্জিত ওচার দোকান আছে। টোকিওতেও আধুনিক ওচার দোকান উš§ুক্ত হয়ে চলেছে। জাপানের সর্বত্র পর্যটন কেন্দ্রে প্যাকেট ও কৌটোভরা পাতা ও গুঁড়ো ওচা বিক্রি হয়। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সরকারি পতিতাপল্লী ‘য়োশিওয়ারা’, ‘শিনমাচি’, ‘শিমাবারা’ প্রভৃতিতে ‘ওচাইয়া’ তথা ‘ওচার দোকান’ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ‘ওইরান’ বা ‘পতিতা’ ও খদ্দেরের মধ্যে দরকষাকষির ক্ষেত্রে। ওচার ব্যবসা পরিচালনা করতেন ‘গেইশা’রা। এখনও জাপানের প্রায় ৬০টি ‘গেইশা মাচি’ বা ‘গেইশা পাড়া’য় ওচার দোকান বিদ্যমান। জাপানব্যাপী চাদোওর প্রতিষ্ঠানও বিদ্যমান।
কামাকুরা যুগের মাঝামাঝি এসে একজন চা মাস্টার জেন্ পুরোহিত মুরাতা জুকোও (১৪২২-১৫০২) চা সমাবেশে জুয়া খেলা এবং মদ পান করা নিষিদ্ধ করেন। চা মাস্টার এবং অতিথিদের মধ্যে বাহ্যিক আনন্দ-বিনোদনের চেয়ে যদি আধ্যাÍিক ভাববিনিময় করা যায় সেটা যেমন হবে নান্দনিক তেমনি হবে শান্তিদায়কÑ এ রকম ব্যাখ্যা করে তাদের বোঝাতে সক্ষম হন। আর তখন থেকেই জাপানি নন্দনতত্ত্বের পরিভাষা ‘ওয়াবি-সাবি’ তথা ‘প্রকৃতির নিঃশব্দতা, একাকিত্ব এবং ক্ষণস্থায়িত্ব’ সম্পর্কে মানুষের যে অদৃশ্য গভীর অনুভূতি তার জš§ হয় চা মাস্টার মুরাতার এই চা সমাবেশ থেকেই। তিনিই প্রথম চা সমাবেশকে চা-অনুষ্ঠানের রীতি তথা চাদোও বা শাদোও-তে রূপান্তরিত করেন। তিনিই চাদোওর জনক।
জাপানের চাদোও এতই মর্যাদাসম্পন্ন যে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রসমূহের প্রধান, জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা কিয়োতো মহানগরে আসেন উরা ছেনকে ঘরানার চাদোওর সবুজ চায়ের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও টোকিওতে বিখ্যাত আসাহিশিম্বুন পত্রিকার মালিক রিউহেই মুরায়ামার বাসভবনে একবার চাদোওর অতিথি হয়েছিলেন। বর্তমানে ছেন্ বংশের চা মাস্টার হচ্ছেন ছেন্ গেনশিৎসু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন তিনি চাদোও সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছেন, আয়োজন করছেন চা-অনুষ্ঠানের।
চাদোওর এই সবুজ চা নানা কারণেই স্বাস্থ্যকর বিশেষ করে ক্যান্সার, হƒদরোগ, রক্তচাপ, বায়ুচড়া, দৈহিক দুর্বলতা, বহুমূত্র রোগ প্রভৃতি প্রতিরোধক। এখন অবশ্য নানা ধরনের চা পাতা উৎপাদিত হচ্ছে যেমন গিয়োকুরো চা, কাবুছে চা, ছেন চা, ফুকামুশি চা, বান চা, কামাইরি চা, তামারোকু চা, কুকি চা, মে চা, মাচ্চা চা, হোওজি চা, আরা চা, শিন চা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব চায়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পিঠা, কেক, আচার, সেনবেই (চাল থেকে প্রস্তুত এক ধরনের বিস্কুট বিশেষ যা খুবই জনপ্রিয়) প্রভৃতির সঙ্গে ওচা পান করাই সাধারণ রীতি। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ওচা জাপানিদের একবার না একবার পান করা চাই-ই। বাসাবাড়িতে তো বটেই, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, অফিস, আদালত, মন্দির সর্বত্রই প্রথমে ওচা দিয়ে অতিথিবরণ করা হয়। আবার খাওয়া-দাওয়ার পর ওচা পরিবেশন করাও জাপানি রীতি। এখন প্লাস্টিক বোতল এবং টিনের ক্যান্জাতীয় ওচা সর্বত্র ভেন্ডিং মেশিনে কিনতে পাওয়া যায়। একাধিক পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করে থাকে নানা ধরনের ওচা। বয়স্কদের হাতব্যাগে ওচার বোতল থাকবেই। ‘ওচাৎসুকে’ নামক এক ধরনের খাবার অত্যন্ত জনপ্রিয়। চীনামাটির বাটিতে গরম ভাত ও সালমন মাছের শুকনো গুঁড়োর সঙ্গে মেশানো সামুদ্রিক শ্যাওলা ‘নোরি’র শুকনো পাতার কুচি প্যাকেট থেকে খুলে ছড়িয়ে দেয়ার পর গরম ওচা তাতে ছেড়ে দিতে হয় বাটি পূর্ণ করে। মিনিট তিনেক রাখার পর কাঠি দিয়ে নাড়া দিয়ে স্যুপের মতো খাওয়ার এই খাদ্যটি আবালবৃদ্ধবণিতা সবারই প্রিয়। সাম্প্রতিককালে আইসক্রিম এবং কেক জাতীয় খাবারেও ওচার স্বাদ সংযুক্ত হয়েছে। কাজেই ওচা বা রোকুচা অর্থাৎ সবুজ চা আর জাপান সমার্থক। ঐতিহ্যবাহী চাদোও হচ্ছে জাপানি সংস্কৃতির অহঙ্কার।

লেখক : প্রবীর বিকাশ সরকার, গবেষক ও মাসিক কিশোরচিত্র সম্পাদক

0 comments:

Post a Comment