পৃথিবীতে মানবজাতি যেসব প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে তার মধ্যে কিডনী রোগ অন্যতম। কিডনি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি রোগ নীরবে শরীরের খুব ক্ষতি করে। এজন্য এটাকে ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অত্যন্ত জটিল অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশও পায় না। বাংলাদেশে দুই কোটিরও অধিক লোক কোনো না কোনো কারণে কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় অকাল মৃত্যুবরণ করছে পাঁচজন। অন্যদিকে কিডনি রোগের চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল যে, এদেশের শতকরা পাঁচ ভাগ লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার।
মানবদেহের কোমরের কিছুটা ওপরে দুই পাশে দুটি কিডনি থাকে। পরিণত বয়সে একটি কিডনি ১১-১৩ সেমি লম্বা, ৫-৬ সেমি চওড়া এবং ৩ সেমি পুরু হয়। একটি কিডনির ওজন প্রায় ১৫০ গ্রাম। তবে বাম কিডনিটি ডান কিডনি অপেক্ষা একটু বড় ও কিছুটা ওপরে থাকে। প্রতিটি কিডনি প্রায় ১২ লাখ নেফ্রন দিয়ে তৈরি। নেফ্রন হলো কিডনির কার্যকর ও গাঠনিক একক। কোনো কারণে এই নেফ্রনগুলো নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি দ্রুত অকেজো হয়ে যায়। কিডনি রোগে সাধারণত একসঙ্গে দুটি কিডনি আক্রান্ত হয়।
আমাদের দেহে প্রতিনিয়ত অসংখ্য জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে। এসব বিক্রিয়ায় উৎপন্ন দূষিত পদার্থ রক্তে মিশে যায়। আর কিডনি তার ছাঁকনির মাধ্যমে রক্তকে ছেঁকে পরিশোধিত করে এবং দূষিত পদার্থগুলো (ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটনিন ইত্যাদি) দেহ থেকে মূত্রের সঙ্গে বের করে দেয়। এভাবে কিডনি আমাদের দেহকে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও কিডনির অন্যান্য কাজ আছে।
কিডনি বিকল হওয়ার আগে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কোনোভাবেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ অবস্থায় দেখা যায় খাওয়ায় অরুচি, বমি বমি ভাব, মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠলে চোখ-মুখ ফোলা দেখানো অর্থাৎ চোখের নিচের অংশ বেশি ভারী ভারী হয়ে থাকে।
কিডনি রোগের প্রধান প্রধান লক্ষণ হচ্ছে হঠাৎ করে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, প্রস্রাবে পরিমাণ ও সংখ্যার পরিবর্তন বিশেষ করে রাতে বেশি প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবে অতিরিক্ত ফেনা হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত এবং প্রোটিন যাওয়া, চোখের চারপাশে ও পায়ের গোড়ালিতে পানি জমা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা ও অস্বাভাবিক গন্ধ হওয়া, রক্তশূন্যতা বেড়ে যাওয়া, মাথাব্যথা ও শরীর চুলকানো, বমি বমি ভাব, প্রস্রাবের সঙ্গে পাথর বের হওয়া, হাত, পা মুখসহ সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া, গ্লোমেরুলার ফিল্টারেশন রেট ৯০-এর কম হওয়া।
সঠিক নিয়ম মেনে না চললে ও খাদ্যাভ্যাস যথাযথ না হলে, এমনকি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবেও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু খাবার আপনার খাদ্যতালিকায় রেখে সহজেই ক্রিয়েটিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও কিডনিকে সুস্থ রাখতে পারেন।
প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস (২ লিটার) বিশুদ্ধ পানি পান করা। তবে ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষেত্রে অধিক পানি পান করা প্রয়োজন।
দানা বা বীজ জাতীয় খাদ্য খান যেমন ব্রেড, নুডলস, বাদাম ইত্যাদি। সপ্তাহে অন্তত একটি কচি ডাবের পানি পান করুন। প্রতিদিন অন্তত চারটি থানকুচি পাতা খেতে হবে। শসা, তরমুজ, লাউ, বাঙ্গি, কমলালেবু, লেবু, মাল্টা, ডালিম, বীট, গাজর, আখের রস, বার্লি, পেঁয়াজ, সাজনা ইত্যাদি পরিমাণ মতো খেতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং হাত পায়ে পানি জমে তারা নিয়মিত গোক্ষুর চূর্ণ তিন গ্রাম মাত্রায় সেবন করলে মূত্রের পরিমাণ ঠিক হয়ে যাবে এবং শরীরে জমে থাকা পানি বা ইউরিক এসিডের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
রক্ত চন্দন কিডনি রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ। রক্ত চন্দন ডাই ডাইরুটিক হিসাবে কাজ করে।
এছাড়া প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বন্ধ করে এবং প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। জুনিপার বেরি মূত্রবর্ধক হিসাবে কাজ করে, কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পাথরকুচি পাতার নির্যাস কিডনি পাথরী ধ্বংস করতে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কিডনি রোগীদের জন্য অন্য রোগীদের তুলনায় একটু বেশি ক্যালোরি নির্ধারণ করা হয়। প্রতি কেজি ওজনের জন্য কার্বোহাইড্রেট থেকে পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ ক্যালোরি হয়ে থাকে। ভাত/ রুটি (ময়দার বা চালের) চিড়া/ সাগু/ চালের সুজি ইত্যাদি কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রোটিন নিয়ন্ত্রণ কিডনি রোগীর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম প্রোটিন রোগীভেদে ডায়েটে দেয়া হয়ে থাকে। প্রাণীজ প্রোটিন থেকে রোগীর প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে।
ডিমের সাদা অংশ, মুরগির বুকের মাংস, দুধ বা দই থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। মাছে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ফ্যাট ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ রেখে সহজেই এড়াতে পারেন কিডনির সমস্যা।
বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যালমন ও টুনাতে রয়েছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। আমাদের মনে রাখতে হবে ৩০ গ্রাম প্রোটিন মানে ৩০ গ্রাম মাছ, মাংস বা ডিম নয়। যেমন একটি ডিমের সাদা অংশ থেকে আমরা মাত্র ৩.২ গ্রাম প্রোটিন পেয়ে থাকি। ফলের ক্ষেত্রে দিনে আপেল, নাসপাতি, পেয়ারা ও পেঁপে যেকোনো একটি এক কাপ পরিমাণ খেতে পারেন।
শাকসবজির পরিমাণও প্রতিবেলায় এক কাপ রাখতে পারেন, সঙ্গে পর্যাপ্ত সালাদ। প্রায় সবধরনের সবজি খেতে পারলেও পিউরিন ও উচ্চ পটাশিয়াম যুক্ত সবজি যেমন ফুলকপি, মটরশুটি, টমেটো, ঢেড়শ, কচুরলতি আরও বেশ কিছু সবজি কিডনি রোগীদের না খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় এক থেকে দেড় লিটার পানি রোগীকে বরাদ্দ করা হয়। যা পানি, চা, দুধ সব মিলিয়ে হিসেব করতে হবে। কিডনি রোগীর সোডিয়ামও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। সাধারণত প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচ গ্রাম লবণ গ্রহণ করতে পারেন। এক চামচ সমান পাঁচ গ্রাম।
রোগীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপলিমেন্ট বা ইঞ্জেকশন নিতে হতে পারে। তবে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর জন্য না জেনে কখনোই কোনো খাবার গ্রহণ করা উচিত না।
প্রত্যেক কিডনি রোগীর জন্য যদিও স্বতন্ত্র ডায়েট - তারপরও কিছু খাবার আছে যা সব কিডনি রোগীকেই পরিহার করতে বলা হয়। যেমন: ডাল, কোল্ড ড্রিংকস, আঁচার, গরু, খাসির মাংস, ভাজাপোড়া খাবার, কফি, চানাচুর, পাপড়, বাইরের কেনা খাবার ও বাসি খাবার। এছাড়া পরিহার করতে হবে চকোলেট, চকোলেট দুধ, পনির, মুরগির মাংস, সস, পিচস, ব্রকোলি, বাদাম, মাশরুম, মিষ্টি কুমড়া, পালংশাক, টমেটো, কলা, খেজুর ও আচার ইত্যাদি।
কিডনি রোগের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা খুবই দরকার। এই রোগের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য আমি কোথাও পাইনি।
আপনার লেখাটি আমি পড়েছি, কিছু নোট করে রেখেছি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন উপকারী একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
This comment has been removed by the author.
This comment has been removed by the author.
বাংলাদেশে ঘণ্টায় পাঁচজনের বেশি মানুষ মারা যান কিডনি বিকল হয়ে আর দুই কোটিরও বেশি মানুষ কোন না কোনভাবে আক্রান্ত হয়ে আছেন কিডনি রোগে- এমন তথ্যই জানাচ্ছে পরিসংখ্যান। আমাদের অনেকেরই জানা নেই, কিডনি রোগকিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। তবে সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হওয়ার আগে কিডনি বিকল হওয়ার উপসর্গ বোঝা যায় না বলে প্রতিরোধ করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।