পৃথিবীর সেরা আশ্চর্য্যগুলোর মধ্যে অন্যতম তাজমহল। ভারতের আগ্রায় যমুনা
নদীর তীরে অবস্থিত তাজমহল একটি রাজকীয় সমাধি। মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার
স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের স্মৃতি রায় এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন।
তাজমহল বা শুধু তাজ হিসেবে পরিচিত এই মর্মর সৌধের নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। আর কাজ শেষ হয় ১৬৪৮ এ।
তাজমহলকে মোঘল স্থাপত্যশৈলীর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়। এর
নির্মাণশৈলীতে অসাধারণ পারঙ্গমতায় পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী
স্থাপত্যশৈলীর সম্মিলন ঘটানো হয়েছে।
যদিও তাজ কমপ্লেঙ্ এর কেন্দ্রে থাকা সাদা মার্বেলের গম্বুজাকৃতির রাজকীয়
সমাধীটিই সাধারণ্যে অধিক সমাদৃত আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, তবে তাজমহল
সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্যকীর্তি। এটি ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো
বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরণের তালিকাভুক্ত করে। তখন একে বলা হয়েছিল, বিশ্ব
ঐতিহ্যের চিরকাল সমাদৃত শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন (universally admired
masterpiece of the world`s heritage).
১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী মুমতাজ মহল
তাদের চতুর্দশ সন্তান গৌহর বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ
মৃত্যুতে প্রচণ্ড শোকাহত হয়ে পড়েন শাহজাহান। তিনি প্রিয়তমা স্ত্রীর
স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য তাজমহল গড়ার উদ্যোগ নেন।
তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় মমতাজের মৃত্যুর ঠিক পরপরই। মূল সমাধিটি
সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে এবং এর চারদিকের ইমারত এবং বাগান আরও পাঁচ
বছর পরে তৈরি হয়।
স্বেত মর্মরে নির্মিত তাজমহল অন্যান্য মুঘল সমাধি সৌধের মতই মূলতঃ
পারস্যদেশীয় বৈশিষ্টমণ্ডিত, যেমন আইওয়ানসহ প্রতিসম ইমারত, এ ধনুক আকৃতির
দরজার ওপরে বড় গম্বুজ। বর্গাকার বেদির উপর স্থাপিত সমাধির ভিত্তি কাঠামোটি
বিশাল এবং কয়েক কবিশিষ্ট। প্রধান কটিতে মুমতাজ মহল ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক
বসানো, তাদের কবর রয়েছে এক স্তর নিচে।
সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। এর আকার
প্রায় ইমারতের ভিত্তির সমান, প্রায় ৩৫ মিটার। এ ধরণের উচ্চতা হওয়ার কারণ,
গম্বুজটি একটি ৭ মিটার উচ্চতার সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এর উপরে বসানো।
তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই শাহজাহান পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে
বন্দি ও মতাচ্যুত হন। তাকে আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কথিত আছে,
জীবনের বাকি সময়টুকুর অধিকাংশ শাহজাহান আগ্রার কেল্লার জানালা দিয়ে
তাজমহলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই কাটিয়েছিলেন।
শাহজাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাকে তাজমহলে স্ত্রী মমতাজের পাশে
সমাহিত করেন। ১৯ শতকের শেষ ভাগে তাজমহলের একটি অংশ মেরামতের অভাবে তিগ্রস্থ
হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজ সৈন্যরা তাজমহলের বিকৃতি সাধন
করে আর সরকারি কর্মচারীরা বাটালি দিয়ে তাজমহলের দেয়াল থেকে মূল্যবান ও দামী
নীলকান্তমণি খুলে নিয়ে যায়।
১৯ শতকের শেষ দিকে লর্ড কার্জন তাজমহল পুণঃনির্মাণের একটি বড় প্রকল্প
হাতে নেন। প্রকল্পের কাজ ১৯০৮ সালে শেষ হয়। তিনি তাজমহলের ভেতরের মঞ্চে
একটি বড় বাতি (যা কায়রো মসজিদে ঝুলানো একটি বাতির অনুকরণে তৈরি করার কথা
ছিল কিন্তু তৎকালীন কারিগরেরা ঠিক হুবুহু তৈরি করতে পারেনি) বসিয়েছিলেন।
একইভাবে বাগানের নকশা পরিবর্তন করে ইংরেজ উদ্যানরীতিতে গড়া হয়। তাজের
সামনের উদ্যানটি সেই নকশাতেই এখনও রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে তাজমহলের রণাবেণে ব্যাপক মেনোযোগ দেওয়া হয়। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে যখন জার্মান বিমান বাহিনী এবং পরে জাপানি
বিমান বাহিনী আকাশপথে হামলা চালায়, তৎকালীন বৃটিশ সরকার তখন তাজমহল রার
জন্য এর ওপর একটি ভারা তৈরি করেছিল। এরপর ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময়ও তাজমহলকে ভারা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল যাতে
শত্রুপরে বৈমানিকের দৃষ্টিভ্রম হয় তাজকে খুঁজে নিতে।
তাজমহল সম্প্রতি যে হুমকির মুখে পরেছে তা হল যমুনা নদীর তীরের পরিবেশ
দূষণ। এছাড়া মথুরাতে তেল পরিশোধনাগারের কারণে সৃষ্ট এসিড বৃষ্টি ( ওই
শোধনাগারের বিষয়ে অবশ্য ভারতীয় উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে)।
১৯৮৩ সালে তাজমহলকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।