২৪
জানুয়ারি—ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। ঊনসত্তরের এই অগ্নিঝরা দিনে
এদেশের ছাত্র-জনতা অকাতরে বুকের রক্ত দিয়ে গণমানুষের স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামে এক
নতুন দিগন্তের সূচনা করে। গ্রামবাংলা আর নগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেদিন লক্ষ্য-কোটি
মেহনতি মানুষের গগনবিদারী আওয়াজ ধ্বনিত হয় ‘১১-দফা আনতে হবে’। মৃত্যুঞ্জয়ী
মানুষের চোখেমুখে ছিল বিদ্যুতের ঝিলিক। পথে পথে ছিল মিছিলের পর মিছিল। স্বৈরাচারী
সরকারের বুলেটের আঘাতে নিহত আসাদ, রুস্তম, মনির, মতিউর, ড. জোহা ও সার্জেন্ট
জহুরুল হক আর আনোয়ারা
বেগমসহ শত শহীদের রক্ত-শপথ প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের মনে এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। শহীদদের সেই আত্মদানের প্রেক্ষিতে বাংলার আকাশে হাতছানি দেয় মুক্তির রক্তিম সূর্য। গণঅভ্যুত্থানের মহান জাগরণ এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রক্তে আঁকা যে নতুন ইতিহাস আমরা রচনা করেছি সেই ইতিহাসের সোপান অতিক্রম করে এক অসমাপ্ত সংগ্রামকে সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার ইস্পাতদৃঢ় আহ্বান নিয়ে প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং এর প্রধান নির্মাতা ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। সে সময় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য জাতীয় ও তরুণ নেতারা ছিলেন কারাগারে। ফলে এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। অধিকন্তু এই আন্দোলনের কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা জেল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব মজলুম মওলানা ভাসানীর এই অবদান এখন আর স্মরণ করেন না। রাজনীতির চানক্য চালের মাধ্যমে ওই সময় আওয়ামী লীগের তত্কালীন রাজনীতিকরা যেভাবে এ আন্দোলনের সাফল্যকে কুক্ষিগত করেছিলেন তা আজও অব্যাহত আছে। তবে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ ওই দিনই ছুটে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানীর কাছে। তিনি প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় কাটিয়েছিলেন মজলুম জননেতার সঙ্গে। আর এ সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী ছিলেন ১৯৬৬ সালের মে থেকে। তখন আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল শোচনীয়। শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতোটাই দুর্বল ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। আগরতলা মামলা শুনানির একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ জানান। শেখ মুজিবকে বাঁচানোর প্রধান উদ্দেশ্যেই ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী দেশব্যাপী জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের সূচনা করেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গর্ভনর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয় ছাত্র সমাজের ১১ দফা। এর ফলে আন্দোলন আরও গতিলাভ এবং ১৭ জানুয়ারি থেকে রুদ্ররূপ ধারণ করে এবং ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এই আন্দোলনে যুগপত্ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) নেতা ইব্রাহিম খলিল এবং ফখরুল ইসলাম মুন্সি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ (ছাত্রলীগ) এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরীর (এনএসএফ) সমন্বয়ে এই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) বিদ্রোহী নেতা মাহবুবুল হক দুলনসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
বেগমসহ শত শহীদের রক্ত-শপথ প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের মনে এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। শহীদদের সেই আত্মদানের প্রেক্ষিতে বাংলার আকাশে হাতছানি দেয় মুক্তির রক্তিম সূর্য। গণঅভ্যুত্থানের মহান জাগরণ এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রক্তে আঁকা যে নতুন ইতিহাস আমরা রচনা করেছি সেই ইতিহাসের সোপান অতিক্রম করে এক অসমাপ্ত সংগ্রামকে সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার ইস্পাতদৃঢ় আহ্বান নিয়ে প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের মাঝে ফিরে আসে।
‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং এর প্রধান নির্মাতা ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। সে সময় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য জাতীয় ও তরুণ নেতারা ছিলেন কারাগারে। ফলে এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। অধিকন্তু এই আন্দোলনের কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা জেল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব মজলুম মওলানা ভাসানীর এই অবদান এখন আর স্মরণ করেন না। রাজনীতির চানক্য চালের মাধ্যমে ওই সময় আওয়ামী লীগের তত্কালীন রাজনীতিকরা যেভাবে এ আন্দোলনের সাফল্যকে কুক্ষিগত করেছিলেন তা আজও অব্যাহত আছে। তবে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ ওই দিনই ছুটে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানীর কাছে। তিনি প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় কাটিয়েছিলেন মজলুম জননেতার সঙ্গে। আর এ সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে।
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী ছিলেন ১৯৬৬ সালের মে থেকে। তখন আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল শোচনীয়। শেখ মুজিব তার ছয় দফা পেশ করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছয় দফার প্রশ্নেই ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। শেখ মুজিব ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের সভাপতি, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী’ আওয়ামী লীগ। ‘ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতোটাই দুর্বল ছিল যে, শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি বানানোর পরও দলটির পক্ষ থেকে আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা, প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। আগরতলা মামলা শুনানির একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের মাধ্যমে মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ জানান। শেখ মুজিবকে বাঁচানোর প্রধান উদ্দেশ্যেই ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী দেশব্যাপী জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের সূচনা করেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গর্ভনর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করে। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয় ছাত্র সমাজের ১১ দফা। এর ফলে আন্দোলন আরও গতিলাভ এবং ১৭ জানুয়ারি থেকে রুদ্ররূপ ধারণ করে এবং ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এই আন্দোলনে যুগপত্ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলার ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯-এর ৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) নেতা ইব্রাহিম খলিল এবং ফখরুল ইসলাম মুন্সি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ (ছাত্রলীগ) এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরীর (এনএসএফ) সমন্বয়ে এই সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের (এনএসএফ) বিদ্রোহী নেতা মাহবুবুল হক দুলনসহ বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
‘৬৯-এর
গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে প্রখ্যাত রাজনীতিক প্রয়াত অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ৪৫
থেকে ৭৫’ শিরোনাম গ্রন্থে (পৃষ্ঠা নং ৩৪১) উল্লেখ করেন, ‘এই রক্ত বৃথা যায়
নাই। এক ব্যক্তির শাসন প্রবর্তক, জনতার সার্বভৌমত্ব ছিনতাইকারী, দেশের সংবিধান ও
প্রচলিত আইন মোতাবেক দেয়া ওয়াদা ভঙ্গকারী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই ২১শে
ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) ভবিষ্যত্ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হইবার সিদ্ধান্ত
ঘোষণা করেন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়। আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তবৃন্দ মুক্তি পান। ঢাকায় সংগ্রামী লক্ষ লক্ষ জনতা
তাঁহাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায় অপরাহেপ্ত অনুষ্ঠিত পল্টন জনসভায়। লক্ষণীয়
যে, শেখ মুজিবুর রহমান এই জনসভায় উপস্থিন হন নাই, অধিকন্তু সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম
পরিষদের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ
একক ও বিচ্ছিন্নভাবে ২৩শে ফেব্রুয়ারি অপরাহপ্ত ২ ঘটিকায় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সদ্য
মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসংবর্ধনা দানের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সদ্যমুক্ত অন্যদের সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নাই। এইভাবেই
ষড়যন্ত্র মামলার সকল কৃতিত্ব ও ত্যাগ তিতিক্ষার নৈবেদ্য ও জনপ্রিয়তা সুচতুর শেখ
মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মূলধনে পরিণত হয়। মামলার প্রকৃত ত্যাগী অভিযুক্ত লে.
কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সকল ভূমিকা একপাশে পড়িয়া রহিল—আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার
শিরোপা এককভাবে কুক্ষিগত করিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কয়েকজন যুবনেতার বদৌলতে তিনি
ভূষিত হইলেন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। কাহার প্রাপ্য কে আত্মসাত্ করে? রাজনীতির
চানক্যচাল কি ইহাকেই বলে? আসলে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন পূর্ব
পাকিস্তানকে স্বাধীন করিবার গোপন আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন
উক্ত আন্দোলন লক্ষ্যের বন্ধু ও সমার্থক মাত্র।’ ১৯৭০ সাল থেকে প্রতিবছর ২৪
জানুয়ারি বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের নানা আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে
গণঅভ্যুত্থান দিবস। দিবসটির তাত্পর্য তুলে ধরতে ওই বছর থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক
বিশেষ প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় ইত্যাদি প্রকাশ করে আসছে।
গণঅভ্যুত্থানের প্রথমবার্ষিকী উপলক্ষে দৈনিক সংবাদ ‘চব্বিশে জানুয়ারীর ডাক’
শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সম্পাদকীয়টি তুলে ধরা হলো—
চব্বিশে জানুয়ারীর ডাক
আজ ২৪শে জানুয়ারী—পূর্ব বাংলা তথা সারা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। গত বছর ১৭ই হইতে ২৪শে জানুয়ারী—এই এক সপ্তাহকাল ছিল আইয়ুবী শাসকচক্রের সহিত নির্যাতিত জনগণের চরম বোঝাপড়ার সময়। একদিকে চরম গণবিরোধী শক্তিসমূহ তথা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির প্রতিভূ আইয়ুব সরকার; অন্যদিকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত-বৃত্তিজীবী ছোট ও মাঝারি ব্যবযায়ী ও শিল্পপতি, এক কথায় সমগ্র জনতা। ১৭ই হইতে ২৪শে জানুয়ারীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আইয়ুবশাহীর ভাগ্য চূড়ান্তরূপে নির্ধারিত হইয়া যায়—দশ বত্সর অধিককাল স্থায়ী আইয়ুবের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনের অনিবার্য পতন নিছক সময়ের প্রশ্নে পরিণত হয়। গণতন্ত্র ও ১১ দফার দাবিতে ছাত্র-জনতার মরণপণ সংগ্রামের স্মরণে এ বত্সর ১৭ই হইতে ২৩শে জানুয়ারী সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কর্তৃক ‘১১ দফা সপ্তাহ’ হিসাবে উদযাপিত হইয়াছে এবং ২৪ জানুয়ারীকে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া হরতাল, জনসভা, গণ-সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে যথাযোগ্যভাবে পালনের আয়োজনস করা হইয়াছে। ১১-দফা সপ্তাহ ও গণ-অভ্যুত্থান দিবসের কর্মসূচীর প্রতি যে বিপুল ও স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন দেখা যাইতেছে তাহাতে সঙ্গতভাবেই বলা চলে: “১১ দফার রক্ত মুছে ফেলা শক্ত”।
১১-দফার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কেবলমাত্র আইয়ুব শাহীর পতনকেই অবধারিত করিয়া তোলে নাই—দেশবাসীর দীর্ঘদিনের কতকগুলি গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার স্বীকৃতিকেও অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। এই আন্দোলনের ফলেই আইয়ুব খান পহেলা ফেব্রুয়ারির মাস পহেলা বেতার ভাষণে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তিদান ও কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের মতানৈক্য এবং নসরুল্লাহ খাঁ-মওদুদী গংয়ের ভোল পাল্টানো সত্ত্বেও আইয়ুব খান যে জনগণের দুইটি দাবী—পার্লামেন্টারী সরকার ও ফেডারেল পদ্ধতি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা মানিয়া লইতে বাধ্য হন, তাহাও জনতার ঐক্যবদ্ধ ও দুর্বার আন্দোলনের ফলেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসন পরিচালক জেনারেল ইয়াহিয়া যে গত ২৮শে নভেম্বরের ভাষণে জনগণের কতকগুলি মৌলিক রাজনৈতিক দাবি দাওয়া মানিয়া লন এবং দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। উহারও পটভূমি হিসাবে আমরা গত বছরের শত শহীদানের আত্মদানে মহিমান্বিত ১৭-২৪শে জানুয়ারীর সংগ্রামকে চিহ্নিত করিতে পারি। গত বত্সর এই সপ্তাহব্যাপী সংগ্রামের মধ্য দিয়া ভীতি ও নির্যাতনের পাষাণ প্রাচীর ভাঙ্গিয়া যে বিপুল বিশাল জনতা রাজপথে বাহির হইয়া আসে তাহাকে ঘর লওয়ানো সম্ভব হয় নাই আজও। যাঁহাদের অকাতর আত্মদানের বিনিময়ে এই ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিল সমগ্র দেশবাসী আজ তাই তাঁহাদের উদ্দেশে জানায় লাখো সালাম।
১১-দফা আন্দোলনের বার্ষিকী উদযাপন করিতে গিয়া আজ আমরা ঐক্যের তাগিদ তীক্ষষ্টরূপে উপলব্ধি করিতেছি। গত বত্সর আন্দোলনের সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল ঐক্য। আজ দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থের ধারক ও বাহকেরা যখন প্রকাশ্যে ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগার দফার বিরোধিতা করিতেছে, তখন এগার দফার শিবিরে ঐক্যের অভাব প্রকট। কেহ কেহ প্রকাশ্যে ঐক্যের বিরোধিতা করিতেছেন, আবার কেহ কেহ বিপ্লবের হটকারী স্লোগানে জনমতকে বিভ্রান্ত করিতেছেন। ১১-দফা কর্মসূচীর মধ্যে জনতার ব্যাপকতম অংশের যে সকল জরুরী ও মৌলিক দাবী-দাওয়া অন্তর্ভুক্ত, সেগুলিকে আদায় করিতে হইলে প্রয়োজন সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য। গণবিরোধী শক্তিগুলি গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে পাল্টা মার দেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হইতেছে, অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়া উহারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কাজেই গণবিরোধী শক্তিবর্গের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করিয়া নির্দিষ্ট তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা বিধান, নির্বাচনের পর চার মাসের নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন ও জনগণের সরকার কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠনের সংকল্পই হউক চব্বিশে জানুয়ারীর শপথ। শহীদের আত্মদানকে সফল করার একমাত্র পথ ইহাই।
চব্বিশে জানুয়ারীর ডাক
আজ ২৪শে জানুয়ারী—পূর্ব বাংলা তথা সারা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় দিন। গত বছর ১৭ই হইতে ২৪শে জানুয়ারী—এই এক সপ্তাহকাল ছিল আইয়ুবী শাসকচক্রের সহিত নির্যাতিত জনগণের চরম বোঝাপড়ার সময়। একদিকে চরম গণবিরোধী শক্তিসমূহ তথা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির প্রতিভূ আইয়ুব সরকার; অন্যদিকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত-বৃত্তিজীবী ছোট ও মাঝারি ব্যবযায়ী ও শিল্পপতি, এক কথায় সমগ্র জনতা। ১৭ই হইতে ২৪শে জানুয়ারীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আইয়ুবশাহীর ভাগ্য চূড়ান্তরূপে নির্ধারিত হইয়া যায়—দশ বত্সর অধিককাল স্থায়ী আইয়ুবের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনের অনিবার্য পতন নিছক সময়ের প্রশ্নে পরিণত হয়। গণতন্ত্র ও ১১ দফার দাবিতে ছাত্র-জনতার মরণপণ সংগ্রামের স্মরণে এ বত্সর ১৭ই হইতে ২৩শে জানুয়ারী সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কর্তৃক ‘১১ দফা সপ্তাহ’ হিসাবে উদযাপিত হইয়াছে এবং ২৪ জানুয়ারীকে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া হরতাল, জনসভা, গণ-সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে যথাযোগ্যভাবে পালনের আয়োজনস করা হইয়াছে। ১১-দফা সপ্তাহ ও গণ-অভ্যুত্থান দিবসের কর্মসূচীর প্রতি যে বিপুল ও স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন দেখা যাইতেছে তাহাতে সঙ্গতভাবেই বলা চলে: “১১ দফার রক্ত মুছে ফেলা শক্ত”।
১১-দফার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম কেবলমাত্র আইয়ুব শাহীর পতনকেই অবধারিত করিয়া তোলে নাই—দেশবাসীর দীর্ঘদিনের কতকগুলি গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়ার স্বীকৃতিকেও অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। এই আন্দোলনের ফলেই আইয়ুব খান পহেলা ফেব্রুয়ারির মাস পহেলা বেতার ভাষণে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তিদান ও কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হন। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের মতানৈক্য এবং নসরুল্লাহ খাঁ-মওদুদী গংয়ের ভোল পাল্টানো সত্ত্বেও আইয়ুব খান যে জনগণের দুইটি দাবী—পার্লামেন্টারী সরকার ও ফেডারেল পদ্ধতি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে সরাসরি নির্বাচন ব্যবস্থা মানিয়া লইতে বাধ্য হন, তাহাও জনতার ঐক্যবদ্ধ ও দুর্বার আন্দোলনের ফলেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসন পরিচালক জেনারেল ইয়াহিয়া যে গত ২৮শে নভেম্বরের ভাষণে জনগণের কতকগুলি মৌলিক রাজনৈতিক দাবি দাওয়া মানিয়া লন এবং দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। উহারও পটভূমি হিসাবে আমরা গত বছরের শত শহীদানের আত্মদানে মহিমান্বিত ১৭-২৪শে জানুয়ারীর সংগ্রামকে চিহ্নিত করিতে পারি। গত বত্সর এই সপ্তাহব্যাপী সংগ্রামের মধ্য দিয়া ভীতি ও নির্যাতনের পাষাণ প্রাচীর ভাঙ্গিয়া যে বিপুল বিশাল জনতা রাজপথে বাহির হইয়া আসে তাহাকে ঘর লওয়ানো সম্ভব হয় নাই আজও। যাঁহাদের অকাতর আত্মদানের বিনিময়ে এই ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিল সমগ্র দেশবাসী আজ তাই তাঁহাদের উদ্দেশে জানায় লাখো সালাম।
১১-দফা আন্দোলনের বার্ষিকী উদযাপন করিতে গিয়া আজ আমরা ঐক্যের তাগিদ তীক্ষষ্টরূপে উপলব্ধি করিতেছি। গত বত্সর আন্দোলনের সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল ঐক্য। আজ দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থের ধারক ও বাহকেরা যখন প্রকাশ্যে ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগার দফার বিরোধিতা করিতেছে, তখন এগার দফার শিবিরে ঐক্যের অভাব প্রকট। কেহ কেহ প্রকাশ্যে ঐক্যের বিরোধিতা করিতেছেন, আবার কেহ কেহ বিপ্লবের হটকারী স্লোগানে জনমতকে বিভ্রান্ত করিতেছেন। ১১-দফা কর্মসূচীর মধ্যে জনতার ব্যাপকতম অংশের যে সকল জরুরী ও মৌলিক দাবী-দাওয়া অন্তর্ভুক্ত, সেগুলিকে আদায় করিতে হইলে প্রয়োজন সকল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য। গণবিরোধী শক্তিগুলি গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে পাল্টা মার দেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হইতেছে, অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়া উহারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কাজেই গণবিরোধী শক্তিবর্গের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করিয়া নির্দিষ্ট তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা বিধান, নির্বাচনের পর চার মাসের নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন ও জনগণের সরকার কায়েমের উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠনের সংকল্পই হউক চব্বিশে জানুয়ারীর শপথ। শহীদের আত্মদানকে সফল করার একমাত্র পথ ইহাই।
(দৈনিক সংবাদ : ২৪ জানুয়ারি ১৯৭০)