আইসল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশের একটি প্রজাতান্ত্রিক দ্বীপরাষ্ট্র। রাজধানীর নাম রেইকিয়াভিক। দেশটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ফারো দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সদাসক্রিয় ভূ-সাংগঠনিক প্লেপগুলোর সীমারেখার ঠিক উপরে অবস্থিত একটি আগ্নেয় দ্বীপ। আইসল্যান্ডের উত্তর প্রান্ত সুমেরুবৃত্তকে স্পর্শ করেছে। ডিম্বাকার এই দ্বীপটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৪৮৫ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ। পার্শ্ববর্তী গ্রিনল্যান্ডকে উত্তর আমেরিকার অংশ ধরা হলেও আইসল্যান্ডকে ইউরোপ অন্তর্গত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা যায়। দেশটির জলবায়ু, ভূগোল ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ। ভূ-গঠনগত দিক থেকে আইসল্যান্ড অপেক্ষাকৃত নবীন। বিগত ৬০ মিলিয়ন বছর ধরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের অবশেষ থেকে দ্বীপটি উৎপত্তি লাভ করে। এখনো দ্বীপটিতে বেশ কটি আগ্নেয়গিরি সক্রিয় আছে। ভূমিকম্প সাধারণ ব্যাপার। ভূ-গর্ভস্থ উষ্ণ পানির প্রসবণগুলো দেশটির ভবনগুলোকে সারা বছর ধরে উষ্ণ রাখে এবং কৃষিকাজে সহায়তা করে। দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রসবণগুলো থেকে নির্গত জলীয়বাষ্পের কারণে সেখানে অবস্থিত আইসল্যান্ডের রাজধানীর নাম দেওয়া হয়েছে রেইকিয়াভিক অর্থাৎ ধোঁয়াটে উপসাগর। ভৌগোলিকভাবে উত্তরে সুমেরুর কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ উপসাগরীয় সমুদ্রস্রোতের কারণে এখানকার জলবায়ু তুলনামূলকভাবে মৃদু। ফলে আইসল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত মনব বসতিগুলোর একটি। এটিকে তাই সুমেরু অঞ্চলীয় রাষ্ট্র হিসেবেও গণ্য করা হয়। আইসল্যান্ডের রুক্ষ পর্বতশ্রেণীগুলো হিমবাহে আবৃত। এদের মধ্যে ভাতা হিমবাহটি ইউরোপের বৃহত্তম। আইসল্যান্ডের সমুদ্র উপকূল প্রায় সারা বছরই জাহাজ নোঙর করার জন্য উন্মুক্ত থাকে। কেবল শীতকালে মেরুদেশীয় অঞ্চল থেকে আগত ভাসমান বরফের কারণে দেশের উত্তর ও পূর্বের বন্দরগুলো বন্ধ রাখতে হয়। প্রায় ১০০০ বছর আগে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে ভাইকিং অভিযানকারীরা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। আইসল্যান্ডবাসী তাদের ভাইকিং ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। অনেকেই একেবারে শুরুর দিকের বসতি স্থাপকদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক খুঁজে বের করতে পারে। এখানে বসবাসকারী জনগণ জাতিতে নর্স ও কেল্টীয়। শুরুর দিকে মূলত নরওয়েজীয় নাবিক ও অভিযানকারীরা এখানে বসবাস করত এবং এখান থেকে পরবর্তীতে গ্রিনল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকায় অভিযান চালাত। আইসল্যান্ডের সঙ্গে নিকটতম ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশ স্কটল্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমগ্র ইতিহাসে আইসল্যান্ড বৃহত্তর ইউরোপীয় সভ্যতার অংশ হিসেবেই বিদ্যমান। আইসল্যান্ডের গাথাগুলোকে মধ্যযুগের উৎকৃষ্ট সাহিত্য নির্দেশক অংশ হিসেবে মনে করা হয়। এই গাথাগুলোতে ইউরোপের চিন্তাধারা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তেমনি ইউরোপ মহাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত লোকদের ইতিহাস ও রীতিনীতিও ফুটে উঠেছে। ভাইকিংদের মুখের প্রাচীন নর্স ভাষার সঙ্গে আইসল্যান্ডীয় ভাষার পার্থক্য খুবই কম। ফলে তারা সহজেই এই গাথাগুলো পড়তে পারে। আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিকেই দেশের প্রথম কৃষি খামার গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে এটি একটি বর্ধনশীল শহর এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিক এখানে বসবাস করে। এখানে কৃষি ও খনিজ সম্পদ খুব কম। দ্বীপের তিন-চতুর্থাংশই উদ্ভিদ জন্মানোর অযোগ্য। উদ্ভিদের মধ্যে তৃণভূমি প্রধান। যেখানে ভেড়া, গবাদিপশু ও শক্তসামর্থ্য আইসল্যান্ডীয় ঘোড়া পালন করা হয়। দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রে বিভিন্ন জাতের মাছ পাওয়া যায় এবং মৎস্যশিকার এখানকার লোকদের আদি পেশা। এখনো বহু গ্রামীণ আইসল্যান্ডীয় অধিবাসী প্রাচীন নরওয়েজীয় পুরাণের নানা দৈত্য-দানব যেমন ট্রোলার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে শহরের আইসল্যান্ডীয়দের অধিকাংশ নিজেদের দেশকে একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে মনে করতেই পছন্দ করেন।
আফতাব চৌধুরী
0 comments:
Post a Comment