ভাতে-মাছে বাঙালির মিষ্টান্নপ্রিয়তার কথা কে না জানে। রসনাবিলাসে তাই শেষপাতে মিষ্টি না হলে কি চলে? তা সে ঘরে বানানোই হোক বা ময়রার তৈরি। বাঙালির মিষ্টির আবার আছে নানা ধরন। স্থানভেদে এর স্বাদ আর তৈরির পদ্ধতিও ভিন্ন। এসব মিষ্টি কেবল জিবে জল আনে না, বরং এর সৃষ্টিকর্ম অনন্য শিল্পকর্ম বটে।
বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির কারণে গবাদিপশুর খাদ্যের আকাল কখনোই হয়নি। গোয়াল ভরা গরু সব সময়ই ছিল বলে বাড়ন্ত হয়নি গরুর দুধ। ময়রারাও তাই মনের সুখে তৈরি করেছেন নানা ধরনের মিষ্টি। করেছেন নানা ধরনের নিরীক্ষা। নতুন পদের স্বাদ ভুবন মাতিয়েছে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে এ জন্য দেখা মেলে বাহারি সব মিষ্টি—নামে, স্বাদে, আকারে এরা অনন্য।
এমনই একটি মিষ্টি হলো নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি। এটা কেবল একটা মিষ্টি নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস আর ঐতিহ্য। এর উদ্ভাবক শ্রী গয়ানাথ ঘোষ। তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এই হালুইকর নেত্রকোনা জেলা শহরের বারহাট্টা রোডে একটি মিষ্টান্ন ভান্ডার চালাতেন। তাঁর দোকানের নামই ছিল গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার। তিনি গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে কিছু করতে মনস্থির করেন। যার ফলশ্রুতি হলো নতুন এক মিষ্টির উদ্ভাবন। আকারে সাধারণ মিষ্টির চেয়ে আলাদা। স্বাদেও।
দুটো বিষয়ই মিষ্টিপ্রিয় মানুষকে আকৃষ্ট করতে সময় লাগেনি। বরং রাতারাতি তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটা দেখতে অনেকটা কোলবালিশের মতো বলেই এর নাম হয়ে যায় বালিশ মিষ্টি। অনেকে আবার বলে থাকেন গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি। কেবল নেত্রকোনা বা বৃহত্তর ময়মনসিংহ নয়, বরং বালিশ মিষ্টির সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। তবে কোন সালে এই মিষ্টি তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটা আজ আর জানা সম্ভব হয়নি।
দুঃখজনক হলেও ১৯৬৯ সালে অশীতির গয়ানাথ ঘোষ সপরিবার দেশান্তরী হন। চলে যান ভারতে। এরপর আর ফেরেননি। পরভূমে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটালেও সেখানে তিনি আর বালিশ মিষ্টি তৈরি করতেন কি না, তা জানা যায় না।
তবে নিজের উদ্ভাবনকে তিনি বলতে গেলে স্বদেশেই রেখে যান। কারণ, এই মিষ্টি তৈরির গোপন কৌশল তিনি তাঁর প্রধান কারিগর নিখিলচন্দ্র মোদককে শিখিয়ে দিয়ে যান। তবে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি তখন কিনে নেন কুমুদ চন্দ্র নাগ। যদিও মাত্র ছয় বছর বাদে কুমুদ চন্দ্র নাগ বালিশ মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর নিখিলচন্দ্র মোদকের কাছে এই মিষ্টির দোকান বিক্রি করে দেন। এরপর আর হাতবদল হয়নি।
বরং সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই এই প্রতিষ্ঠান নিখিলচন্দ্রের পরিবারের কাছেই রয়েছে। তবে প্রজন্মান্তর হয়েছে। নিখিলচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর তিন ছেলে বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেই শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে সুনামের সঙ্গে পরিচালনা করে যাচ্ছেন। একইভাবে অক্ষুণ্ন রেখেছেন বালিশ মিষ্টির ঐতিহ্য। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গয়ানাথের ছেলেরাও এখন আর ভারতে বেঁচে নেই। তথ্য সংগ্রহের আর কোনো উপায় নেই।
বর্তমানে এই মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর রতন পাল। তাঁর সহকারী হিসেবে আছেন আরও চার-পাঁচজন কারিগর। রতন পালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরুর খাঁটি ঘন দুধে তৈরি উৎকৃষ্ট মানের ছানার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ ময়দার সংমিশ্রণে বিশেষ ভালো করে মেখে গোলা পাকিয়ে ছোট ছোট মণ্ড তৈরি করা হয়। মণ্ডগুলোকে বিভিন্ন মাপ ও আকারের কোলবালিশের আদলে মিষ্টি বানিয়ে অতি যত্ন ও সচেতনতার সঙ্গে ভেজে ফুটন্ত গরম চিনির রসে রাতভর ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর রাত পোহালে রসে টইটম্বুর ও তুলতুলে এই মিষ্টির ওপর ক্ষীর বা ঘন মালাইয়ের প্রলেপ দিয়ে বিক্রি করা হয়।
এই মিষ্টি বর্তমানে মোট পাঁচ আকৃতির হয়ে থাকে। ১ কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ৫০০ টাকা, ১ কেজি ওজনের একেকটির দাম ৩০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ২০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের একেকটির দাম ১০০ টাকা এবং ২৫০ গ্রামের একেকটির দাম ৫০ টাকা। ৩০০ টাকা মূল্যের মিষ্টি দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চির মতো এবং তৈরি করতে ৪৫০ গ্রাম ছানা লাগে।
জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্য বর্তমানে একই শহরে আদি প্রতিষ্ঠানটির আরও দুটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্টেশন রোড ও ছোট বাজারে। আদি প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলাতেই মিষ্টি তৈরি করে শাখা দুটোয় সরবরাহ করা হয়। এই মিষ্টির অনুকরণে ওই অঞ্চলের অন্য মিষ্টির দোকানগুলোও পরস্পর পাল্লা দিয়ে বালিশ মিষ্টি তৈরি করলেও সেই আসল স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। কেননা ব্যবসায়িক স্বার্থে পুরো রেসিপির কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হলেও কারিগরদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, দক্ষতা এবং উপাদানের পরিমাণের ভারসাম্যের সুকৌশল ও রন্ধনশৈলীও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
ওই অঞ্চলসহ আশপাশেরে এলাকা ছাড়াও অনেক জায়গাতেই গায়েহলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, মিলাদ, বিবাহবার্ষিকী কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নেওয়ার ক্ষেত্রে এই মিষ্টি একপ্রকার রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি দূরদূরান্ত থেকে অনেক সময় পর্যটকেরা ছুটে আসেন এই মিষ্টির টানে।
নেত্রকোনা জেলা শহরটি ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ দেশের মানুষ ভারতেও আত্মীয়স্বজনের কাছে নিয়ে যান এই মিষ্টি। তাই এই মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা, জনপ্রিয়তা ও দীর্ঘ ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অন্যান্য শহরেও শাখা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমনকি দেশের বাইরেও সরবরাহের ইচ্ছাও পোষণ করছেন।
সূত্র: প্রথম আলো