শিকারি গোছের গ্রে-হাউন্ড কুকুর বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। এর দেহ তিন থেকে চার ফুট লম্বা। কান ও মুখ বেশ লম্বাটে। পেট ছোট হলেও বুকটা চওড়া। লেজটা চিকন ও লম্বা। লেজটি অধিকাংশ সময় দেহের নিচের দিকে সোজা ঝুলে থাকে। খুব একটা বাঁকা করে না। হালকা–পাতলা গড়নের এই কুকুরের পা ও পায়ের নখ লম্বা। বাদামি রঙের চোখ দুটি বড় বড়।
শুধু আকৃতি বা দৈহিক গঠনের দিক থেকে গ্রে-হাউন্ড অন্যান্য কুকুরের চেয়ে আলাদা তা নয়। আচরণের দিক থেকেও আলাদা। হাঁটাচলা বা দৌড় দেওয়ার ভঙ্গিট ভিন্ন। ঘুমের অভ্যাসের মধ্যেও আছে ভিন্নতা। শুধু ঘ্রাণশক্তি নয়, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির মাধ্যমে শিকার ধরা এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্রুতগামী কুকুরটি অন্যান্য কুকুরের মতো আহ্লাদী হলেও অপরিচিতদের আদর তার পছন্দ নয়। দিনেরবেলা ঘেউ ঘেউ করা তার স্বভাব না হলেও রাতের ঘেউ ঘেউ শব্দে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি প্রভুর বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারে না। প্রভুভক্ত শান্ত কুকুরটি শত্রুর জন্য খুবই হিংস্র ও ভয়ংকর। দিনে-রাতে মালিকের বাড়ি নিরাপত্তায় জুড়ি মেলা ভার। চোর, ডাকাত এ কুকুরের নাম শুনলে আঁতকে ওঠে।
আরামপ্রিয় কুকুরগুলো প্রতিদিন অল্প পরিমাণ খেলেও তাদের খুব ভালো মানের খাবার দিতে হয়। প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন কুকুরটির খাদ্যতালিকায় আছে দুধ-ভাত ও মাংস। এদের জীবনকাল এক যুগ হয়ে থাকে।
একসময় শীতকালে এখানে গ্রে-হাউন্ড কুকুর দিয়ে বনজঙ্গল ঘেরাও করে ছোট বাঘ, গাছি খাটাশ, শিয়াল, বাগডাশ, বন খাটাশ, বনবিড়াল ইত্যাদি বন্য প্রাণী শিকার করা হতো।
একসময় জাতীয় চিড়িয়াখানায়ও দেখা যেত গ্রে-হাউন্ড কুকুর। কিন্তু কালের আবর্তে আজ সবই অতীত। তবে কয়েক বছর আগে র্যাব সদস্যরা বেশ কয়েকটি হাউন্ড কুকুর এখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পরে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর বেশ নামকরা। এই জাতের কুকুর পোষা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে, যা লালন-পালন যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সরাইলের ঐতিহ্য হিসেবেও পরিচিত গ্রে-হাউন্ড। তবে এ ধরনের কুকুর পালন অনেক কমে গেছে।
কথিত আছে, একবার সরাইলের জমিদার দেওয়ান হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে
এক ইংরেজ সাহেবের কাছে একটি সুন্দর কুকুর দেখতে পান। তিনি কুকুরটি কেনার
চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি একটি হাতির বিনিময়ে ইংরেজ সাহেব থেকে ওই
কুকুরটি (মাদি-স্ত্রী জাতের) নিয়ে আসেন।দেওয়ান একদিন হাতির পিঠে চড়ে বনে
শিকারে বের হয়েছিলেন। একপর্যায়ে মাদি কুকুরটি বনে হারিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন
পর গর্ভবতী হয়ে কুকুরটি ফিরে আসে। কদিন পরই দেওয়ানের বাড়িতে কুকুরটি কয়েকটি
বাচ্চা দেয়। দেখা গেল, এসব বাচ্চা সাধারণ কুকুরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বাঘের বেশ মিল আছে। ধারণা করা হয়, নেকড়ের সঙ্গে দেওয়ানের
কুকুরের মিলন থেকে ওই বাচ্চাগুলোর জন্ম হয়েছে।
উন্নত বিশ্বে দিন দিন বিরল প্রজাতির কুকুরের কদর বাড়লেও সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। সরাইলের হাউন্ড কুকুর এখন এক দুর্লভ হয়ে গেছে। এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই জাতের কুকুর লালন-পালন করে আসছে। কারণ, এ ধরনের কুকুর পোষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
১৯৮৩ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় উপজেলা সদরে একটি গ্রে-হাউন্ড কুকুর সংরক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে উপযুক্ত চিকিৎসা, সুষ্ঠু পরিচালনা ও আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক বছর পরই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা সদরের বড়দেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ঠাকুর ২০০১ সালে সরাইলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কুকুর প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্যোগটিও টেকেনি।
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী সরাইলের বিরল প্রজাতির মূল্যবান গ্রে-হাউন্ড কুকুর বিলুপ্ত হতে চলেছে।
সরাইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের কাছে সরাইলের কুকুরের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা সেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তিনি আরও বলেন, এখনো সরাইলে ৮-১০টি গ্রে-হাউন্ড কুকুর আছে। তা–ও আবার ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ সংকর জাতের হয়ে গেছে। এগুলোকে রক্ষার উদ্যোগ নিলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে সরাইলের ঐতিহ্য গ্রে-হাউন্ড কুকুর।
লেখা: বদর উদ্দিন, প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment