Thursday, October 16, 2025

পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি: যেভাবে মোঘল খাবার হয়ে উঠলো আমাদের ঐতিহ্য

0 comments

 প্লেটজুড়ে ধোঁয়া ওঠা বাসমতী চালের সাদা-হলুদ পাহাড়, তার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে খাসির তুলতুলে নরম মাংস আর সোনালি এক আলু। চামচ দিয়ে আলতো চাপ দিতেই মাংসটা এমনভাবে গলে গেলো, যেন হাড়ের সাথে তার কোনোকালে সম্পর্কই ছিল না। নাকে এসে লাগছে জাফরান, জয়ত্রী আর কেওড়া জলের মন মাতানো এক রাজকীয় সুবাস...

এই দৃশ্য বা অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঢাকার আসল পরিচয় কী? রিকশার টুং টাং শব্দ? সরু গলির হাজারো গল্প? নাকি এক প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানির এই মাতাল করা ঘ্রাণ? কাচ্চি বিরিয়ানি আমাদের কাছে শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি উৎসব, একটি স্মৃতি এবং পুরান ঢাকার শত শত বছরের ঐতিহ্য আর আবেগের নাম। কিন্তু কীভাবে এই পারস্যের খাবার মুঘলদের হাত ধরে আমাদের রান্নাঘরে এলো এবং শেষ পর্যন্ত ‘ঢাকাইয়া কাচ্চি’ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেলো? চলুন, আজ সেই ইতিহাসের গন্ধমাখা গলিতেই এক চক্কর ঘুরে আসা যাক।

ইতিহাসের পাতা থেকে: মুঘল রান্নাঘরের সেই ‘কাঁচা’ মাংসের কারসাজি

গল্পের শুরুটা করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে কয়েকশ বছর পেছনে, মুঘলদের শাহী রান্নাঘরে। "কাচ্চি" শব্দটি একটি উর্দু শব্দ, যার সহজ অর্থ হলো "কাঁচা"। এই বিরিয়ানির সবচেয়ে বড় বিশেষত্বই হলো এর নামে। অন্যান্য বিরিয়ানিতে যেখানে মাংস আগে রান্না করে তারপর চালের সাথে মেশানো হয়, সেখানে কাচ্চির ক্ষেত্রে কাঁচা মাংস দই এবং নানা মশলায় মেরিনেট করে হাঁড়ির (ডেগ) নিচে রাখা হয়। তার ওপরে দেওয়া হয় আধা-সিদ্ধ চালের আস্তরণ এবং সবশেষে সেই বিখ্যাত সোনালি আলু।

এরপর হাঁড়ির মুখ আটা দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় যেন একবিন্দু বাতাসও ভেতরে-বাইরে চলাচল করতে না পারে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘দম পোখত’ বা দমে রান্না। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা হালকা আঁচে কয়লার আগুনে রান্না হতে থাকে। ফলাফল? মশলার সব সুবাস চাল আর মাংসের ভেতরে প্রবেশ করে এক ঐশ্বরিক স্বাদ তৈরি করে, আর মাংস এতটাই নরম হয় যে মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। এই দমে রান্নার জাদুই কাচ্চিকে দিয়েছে তার রাজকীয় পরিচয়।

ঢাকায় আগমন ও নবাবী ছোঁয়া: যেভাবে কাচ্চি পেলো তার আসল ঠিকানা

মুঘলদের হাত ধরে কাচ্চি বাংলায় এলেও, একে ‘ঢাকাইয়া’ বানানোর পেছনের কারিগর ছিলেন ঢাকার নবাবরা। বিশেষ করে নবাবী আমলে ঢাকা যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তখন পারস্য ও উত্তর ভারত থেকে আসা বাবুর্চিরা এই খাবারটিকে ঢাকার আবহাওয়ায় নতুন করে গড়ে তোলেন। তারা ঢাকার স্থানীয় মশলা, ঘি এবং ঐতিহ্যের সাথে মুঘল রেসিপির এক অসাধারণ মিশ্রণ ঘটান।

তবে কাচ্চির সাথে আলুর এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের গল্পটি আরও মজার। অনেকে মনে করেন, আওয়াধের নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় আসেন, তখন তার বাবুর্চিরা মাংসের পরিমাণ কমাতে土豆 ব্যবহার শুরু করেন। সেই থেকে বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন হয়। পুরান ঢাকার বাবুর্চিরা সেই আলুকে শুধু ব্যবহারই করেননি, তাকে ঘি-তে ভেজে, জাফরানের রঙে রাঙিয়ে কাচ্চির এক অপরিহার্য অংশে পরিণত করেছেন। আজ ঢাকাইয়া কাচ্চি আলু ছাড়া কল্পনাও করা যায় না!

সাধারণের অসাধারণ ভালোবাসা: যেভাবে কাচ্চি আমাদের হলো

নবাবদের রান্নাঘর থেকে এই রেসিপি ধীরে ধীরে পুরান ঢাকার সাধারণ বাবুর্চিদের হাতে চলে আসে। আর এখানেই ঘটে আসল বিপ্লব। পুরান ঢাকার অলিগলিতে গড়ে ওঠা বিরিয়ানীর দোকানগুলো এই রাজকীয় খাবারকে সাধারণ মানুষের প্লেটে পৌঁছে দেয়। বিয়ে, আকিকা, ঈদ বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে কাচ্চি ছাড়া আয়োজন যেন অপূর্ণ থেকে যায়।

হাজী বিরিয়ানি থেকে শুরু করে হানিফের বিরিয়ানি কিংবা নতুন প্রজন্মের শত শত ব্র্যান্ড—প্রত্যেকেই নিজেদের বিশেষত্ব দিয়ে কাচ্চিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। পুরান ঢাকার বাবুর্চিদের হাতে কাচ্চির মশলার ব্যবহারে যে গোপন অনুপাত আর রান্নার ধরনে যে মমতা মিশে থাকে, সেটাই ঢাকাইয়া কাচ্চিকে অন্য যেকোনো বিরিয়ানি থেকে আলাদা করে রেখেছে।

শেষ কথা: শুধু খাবার নয়, এক ঐতিহ্যের ধারক

আজ কাচ্চি বিরিয়ানি ঢাকার সীমানা পেরিয়ে সারা বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকার সরু গলিতে, কয়লার আঁচে, বিশাল ডেগে রান্না হওয়া সেই কাচ্চির স্বাদ ও ঘ্রাণের সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।

তাই পরেরবার যখন আপনি এক প্লেট কাচ্চি সামনে নিয়ে বসবেন, তখন শুধু এর স্বাদই নেবেন না, চোখ বন্ধ করে একবার ভাবার চেষ্টা করবেন এর পেছনের শত শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর ভালোবাসার গল্প। কারণ কাচ্চি শুধু একটি খাবার নয়; এটি মুঘল আভিজাত্য, নবাবী যত্ন আর ঢাকাইয়া মমতার এক জীবন্ত ইতিহাস।

0 comments:

Post a Comment