দিনাজপুরের আয়তন ৩,৪৩৭ বর্গকিলোমিটার। প্রধান নদী : ঢেপা, পুনর্ভবা, কাঞ্চন, যমুনা ও আত্রাই।
দিনাজপুরের লিচু আকার আর স্বাদে অনন্য। আর ক’দিন বাদেই সেখানকার গাছে গাছে পাকতে শুরু করবে ফলটি। দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় লিচু বাগান থাকলেও আমাদের ভ্রমণ কাহারোলের লিচু বাগানে। কারণ লিচু ছাড়াও জায়গাটিতে আছে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনা__গোরা শহীদের মাজার, সিংহদুয়ার প্রাসাদ, সীতার কুঠরি, হাবড়া জমিদারবাড়ি, বারদুয়ারি (চিরিরবন্দর), নয়াবাদ মসজিদ।
কান্তজিউ মন্দির
দিনাজপুর শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে কাহারোল থানার কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত কান্তজিউ মন্দির। অনেকের মতে কান্তনগরে স্থাপিত বলে এর নাম কান্তজিউ মন্দির। জনশ্রুতি আছে, শ্রী কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। দিনাজপুরের তত্কালীন জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির অলঙ্করণসমৃদ্ধ এ মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে তার জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। পরে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তারই পালক পুত্র রামনাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এর পরে তিনি এ মন্দিরটি শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে উত্সর্গ করেন।
প্রায় ৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট বাহুবিশিষ্ট প্রস্তর নির্মিত বর্গাকৃতি সমান্তরাল জায়গার উপর মন্দিরটি দণ্ডায়মান। সৌধ পরিকল্পনায় মন্দিরটি তিন ধাপে নির্মিত। দেখতে অনেকটা বড় আকারের রথের মতো। তিনতলাবিশিষ্ট এবং বর্গাকারে নির্মিত এ মন্দিরটির প্রত্যেক দিকের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় উপরের গম্বুজ ঘরের আকৃতি ধারণ করেছে। ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়ার আগে গম্বুজ ঘরের উপরে ৯টি সুদৃশ্য চূড়া ছিল। বারান্দার সামনে রয়েছে ইটের তৈরি দুটি করে স্তম্ভ। এই স্তম্ভের সাহায্যে দেয়ালের সঙ্গে প্রত্যেক পাশে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি করে খোলা দরজা। দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের দরজা দুটি বেশি চোখে পড়ে। এই দরজার পরে, ভেতরে মূল কক্ষটি, সেখানে আছে মোট ১৮টি কক্ষ। বড় কক্ষগুলোর চারদিকে আছে ছোট ছোট কক্ষ। মন্দিরের বেদির নিচে এবং দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি খচিত প্রায় লক্ষাধিক ছবি রয়েছে। পৌরাণিক চিত্র সংবলিত টেরাকোটা ছাড়াও মন্দিরের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মূর্তির টেরাকোটাও রয়েছে। এসব টেরাকোটার মধ্যে নারী-পুরুষ, দেবতা ও কিন্নর, গায়ক ও বাদক, যোদ্ধা ও শিকারি, গৃহিণী, নৌকার মাঝি, নৃত্যরতা রমণী, পালকি বাহক, গাছপালা, ফল ও ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির ছবি মূর্তমান। কান্তজিউ মন্দিরের পাশেই রয়েছে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এক চূড়া বিশিষ্ট একটি মন্দির। এটিও নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনাথ। রাজা প্রাননাথ এই মন্দির নির্মাণ করে এখানে কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মূর্তি তিনি এনেছিলেন বৃন্দাবন থেকে। এ মন্দিরটি ছিল ১৬ পার্শ্ব সংবলিত সৌধ এবং ৪০ ফুট উচ্চতায়।
নয়াবাদ মসজিদ
কান্তজিউ মন্দির থেকে মাইলখানেক পশ্চিমে রয়েছে ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটিও কান্তজি’র সমসাময়িক মসজিদ। এ মসজিদটিতে তিনটি প্রবেশপথ এবং একটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের বাইরে চারপাশ সামান্য উঁচু দেয়ালে ঘেরা এবং দেয়ালের ভেতরের খোলা জায়গা পাকা করা।
|
An oath-ta on the middle doorway |
|
Nayabad Masjid in Dinajpur |
কান্তনগরের লিচু বাগান
কান্তজিউ মন্দির থেকে নয়াবাদ মসজিদ যাবার পথে পড়বে বেশ কয়েকটি লিচু বাগান। এখানকার গাছগুলো খুব একটা উঁচু নয়। তবে বেশ বিস্তৃত। গাছগুলো এ সময়ে লিচুতে পরিপূর্ণ। ফল পাকা শুরু হলে গাছগুলো লাল টকটকে হয়ে যায়। থোকায় থোকায় লিচু মাটি ছুঁই ছুঁই করে। ইচ্ছে হলে কোনো বাগান মালিককে বলে লিচু কিনে স্বাদ নিতে পারেন বাগানেই। সঙ্গেও নিয়ে আসতে পারেন। দামেও ঢাকার চেয়ে অনেক কম, তা ছাড়া সরাসরি বাগান থেকে কিনে আনার মজাটাও কম নয়।
রাজবাড়ি
শহরের উত্তর-পূর্ব পাশে এ বাড়ি। এখন ধ্বংসপ্রায়। প্রবেশপথ পেরিয়ে ডান দিকে একটি পুরনো কৃষ্ণমন্দির। বাড়িটি ১৭ একর জায়গার ওপর। তিনটি প্রধান অংশ_আয়নামহল, রানিমহল ও ঠাকুরবাড়ি মহল। এ ছাড়া আছে অতিথিশালা, চিকিৎসালয়, কর্মচারীদের আবাসস্থল ও দিঘি। মহারাজ প্রাণনাথ রায় ও তাঁর পোষ্যপুত্র রামনাথ অষ্টাদশ শতাব্দীতে এগুলো নির্মাণ করেন। শহরের ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজবাড়ি যেতে রিকশাভাড়া লাগে ৩৫ টাকা।
রামসাগর দিঘি
শহর থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে আউলিয়াপুর ইউনিয়নে দিঘিটি। রামসাগর নামটি শুনলে মনে হয় এটি বুঝি কোনো সাগরের নাম। প্রকৃতপক্ষে রামসাগর কোনো সাগর নয়, এটি একটি দিঘি। দারুণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দিঘিটি মানুষের খনন করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দিঘি। দিনাজপুর শহর থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে এই দিঘিটির অবস্থান। বর্তমানে এখানে গড়ে উঠেছে একটি মনোরম পার্ক। পলাশী যুদ্ধের কিছুকাল আগে দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ দিঘিটি খনন করান। রাজা রামনাথের নামেই এই দিঘির নামকরণ করা হয় রামসাগর। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর পানির চাহিদা পূরণের জন্য দিঘিটি খনন করা হয়। বলা হয়ে থাকে, সে সময় (১৭৫০-১৭৫৫ খ্রি.) দিনাজপুর অঞ্চলে প্রচণ্ড খরা ও দুর্ভিক্ষ চলছিল। রাজা রামনাথ অভাবী মানুষদের সাহায্য করার জন্য 'কাজের বিনিময়ে খাদ্য' এমন বন্দোবস্তের মাধ্যমে দিঘিটি খনন করান। এতে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক অংশ নেন এবং সে সময়ের মুদ্রায় ব্যয় হয় ৩০ হাজার টাকা। দিঘিটির চারপাশে সবুজ গাছপালায় ভরা। দিঘিটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এর জলভাগের দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার। দিঘির পশ্চিম পাড়ের বিপরীতে একটি ছোট কৃত্রিম চিড়িয়াখানা আছে। বর্তমানে রামসাগর দিঘিটি পর্যটন বিভাগ তত্ত্বাবধান করে থাকে। পর্যটন করপোরেশন দিঘিটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এখানে একটি মনোরম ও আধুনিক বিশ্রামাগার স্থাপন করেছে। শহরের ঈদগার টেম্পোস্ট্যান্ড থেকে অটো বাইকে দিঘি পর্যন্ত যেতে ভাড়া লাগে ২০ টাকা।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলো সাধারণত ছাড়ে গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে। ভাড়া ৫০০-৫৫০ টাকা। এ পথে ভালো বাস সার্ভিস হলো—হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস আর ট্রাভেলস, কেয়া পরিবহন, এসএ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ইত্যাদি। এ ছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর দ্রুতযান এক্সপ্রেস ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে। আর আন্তঃনগর একতা এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে। ভাড়া শোভন সিট ১৮৫, শোভন চেয়ার ২৫০, প্রথম শ্রেণী চেয়ার ৩৫০, প্রথম শ্রেণী বার্থ ৫৩৫, এসি চেয়ার ৬১৮, এসি বার্থ ৮৯৭ টাকা। দিনাজপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে আর একতা এক্সপ্রেস ছাড়ে সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে।
দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন থেকে পীরগঞ্জগামী বাসে কান্তনগর নামতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ২০-২৫ টাকা। সেখানে নেমে ঢেপা নদী পার হয়ে একটু সামনেই মন্দিরটি। শীতের সময় নদী পায়ে হেঁটে পার হতে পারলেও বর্ষায় নৌকায় পার হতে হবে।
কোথায় থাকবেন
দিনাজপুর শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হচ্ছে পর্যটন মোটেল (০৫৩১-৬৪৭১৮)। এ ছাড়া ঢাকায় পর্যটনের প্রধান কার্যালয় থেকেও এ মোটেলের বুকিং দিতে পারেন। ফোন :৯৮৯৯২৮৮-৯১। দিনাজপুরের পর্যটন মোটেলে এসি টুইনবেড ১৫০০ টাকা এবং এসি টুইনবেড ডিলাক্স কক্ষ ১৮০০ টাকা। এ ছাড়া দিনাজপুরের অন্যান্য সাধারণ মানের হোটেলে ১০০-১২০০ টাকায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা আছে। কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল হলো—মালদহ পট্টিতে হোটেল ডায়মন্ড (০৫৩১-৬৪৬২৯), নিমতলায় হোটেল আল রশিদ (০৫৩১-৬৪২৫১), হোটেল নবীন (০৫৩১-৬৪১৭৮), হোটেল রেহানা (০৫৩১-৬৪৪১৪), নিউ হোটেল (০৫৩১-৬৮১২২)।
উৎসঃ
ইত্তেফাক
ছবিঃ
পয়গম্বর ও
কাঊসার রুশো'র ব্লগ
আরো জানতে চাইলে এখানে দেখুন