Saturday, June 29, 2013

ডিজিটাল ক্যামেরা

0 comments
ডিজিটাল ক্যামেরা বলতে এমন ক্যামেরা বোঝায়, যেগুলোতে সনাতনী ফিল্ম ব্যবহৃত হয় না, বরং তার বদলে মেমরী চিপের মধ্যে ছবি ধারণ করে রাখার ব্যবস্থা থাকে।

ডিজিটাল ক্যামেরার মান হিসাব করা হয় মেগা পিক্সেল দিয়ে: যত বেশি মেগা পিক্সেল তত বেশি বড় ছবি ধারণ করার ক্ষমতা। প্রথমে দাম বেশি থাকলেও ফিল্ম ক্যামেরা থেকে অনেক দ্রুত দাম কমছে, এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ফিল্ম লাগেনা এবং সাথে সাথে স্ক্রিনে ছবি দেখা যায় বলে এর চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। নিকট ভবিষ্যতে এটি ফিল্ম ক্যামেরাকে জাদুঘরের পণ্যে পরিণত করতে পারে।



Resolution (MP)

কোন ডিজিটাল ক্যমেরার রেসুলেশন কত মেগাপিক্সেল তা দিয়ে ঐ ক্যামেরার সেনসরের ক্ষমতাকেই বুঝায়। যত বেশি মেগাপিক্সেল তত বড় প্রিন্ট আউট নেয়া যাবে ছবির মান অক্ষুন্ন রেখেই। ইদানীং অনেকে এই মেগাপিক্সেলকে ক্যামেরার স্ট্যাটাস সিম্বল মনে করে ! পোস্টকার্ড সাইজ ফটো হচ্ছে 6"x4"। ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়োজন ছাড়া এর থেকে বড় প্রিন্ট কেউ করে না। 7"x5" ফটো কোয়ালিটি প্রিন্টের জন্য ৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরাই যথেষ্ট!

Sensor Type

ইমেজ সেনসরের ওপর তোলা ছবির মান নির্ভর করে। এই সেনসর ২৫ এমএম২ থেকে ২০০০ এমএম২ মানের হয়ে থাকে। থাকে। ইমেজ সেনসরের আকার যত বড় হবে, ছবির মান তত ভালো হবে। ডিজিটাল ক্যামেরার সাধারণত দুই ধরনের ইমেজ সেনসর দেখা যায়। একটি সিসিডি (Charge Couple Device) ও অপরটি সিএমওএস (Complementary Metal Oxide Semiconductor)। সিএমওএস সেনসর সাধারণত কম ব্যাটারি খরচ করায়। এর গতিও সিসিডির চেয়ে অনেক বেশি।

Lens

লেনস ডিজিটাল ক্যামেরার গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস। Nikkon, Canon, Olympus কোম্পানীগুলো নিজেরাই লেন্স প্রস্তুত করে, আবার Sony, Casio, Panasonic কোম্পানীগুলো থার্ড পার্টির লেন্স ব্যবহার করে।

Display (Inch)

সাধারনত 2.5- to 3-inch হয়ে থাকে।



Optical Zoom (X)

অপটিক্যাল জুম করার ক্ষেত্রে ক্যামেরা ব্যবহার করে লেন্স। অর্থাৎ লেন্সের সাহায্যে বস্তুকে ছোটবড় করবে যেখানে ছবির কোয়ালিটি একই থাকবে।

Digital Zoom (X)

ডিজিটাল জুমের সাথে বস্তু বা লেন্সের কোন সম্পর্ক নেই। এখানে ডিজিটাল প্রসেসে ছবির কোন অংশকে বড় করে দেখানো হয় এবং ছবির কোয়ালিটি হ্রাস পায়।

***** ক্যমেরার ডিজিটাল জুম দেখে প্ররোচিত হবেন না, লক্ষ্য করবেন অপটিক্যাল জুম ক্ষমতা কত। যত বেশি জুম থাকবে তত বেশি দুরত্বের ছবি তোলা যাবে।

Shutter Speed (sec)

লেন্স ও সেনসরের মাঝখানে আলো ঠেকানোর আবরণকে বলে শাটার। এটি আলো আটকে রাখার কাজ করে। লেন্সের মধ্য দিয়ে আসা আলো সেনসরে প্রবেশের জন্য এটি খুলে দিতে হয়। ছবি তোলার সময় অর্থাৎ Shutter release button চাপার সাথে সাথে এই শাটার অল্পক্ষণের জন্য খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। শাটার স্পিড হচ্ছে লেন্স ও সেনসরের মাঝখানে আলো ঠেকানোর আবরণটি (শাটার) খুলে যাওয়া এবং বন্ধ হয়ে যাওয়ার টাইম গ্যাপ। অর্থাৎ আবরণটি কতক্ষণ খোলা থাকবে তা নিয়ন্ত্রণ করা। সাধারনত এই সময়টি এক সেকেন্ডেরও কম হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশিও হতে পারে। শাটার স্পিডকে 1/90, 1/125, 1/250, 1/500, 1/1000, 1/1500 সেকেন্ড হিসেবে প্রকাশ করা হয়। রাতের ও দিনের ছবির জন্য Aperture ও Shutter Speed ভিন্ন রকমের হয়।

Face Detection

ডিজিটাল ক্যামেরায় ফেস ডিটেকশান টেকনোলজির ক্ষেত্রে আপনি ম্যানুয়ালি ক্যামেরার তোলা ছবির প্রিভিউ অপশন থেকে ফেস ডিটেক্ট করে তাতে আপনার মন মত ইফেক্ট এবং ফিনিশিং টাচ দিতে পারবেন। ফেস ডিটেকশান টেকনোলজি ফেসকে ডিটেক্ট করা ছাড়াও ডিজিটাল ক্যামেরায় আরো যে সকল সুবিধা যোগ করে দিয়েছে তা হলো ফোকাস, এক্সপোজার, হেয়াইট ব্যালান্স, রেড আই ডিটেকসন, ফোকাস, ট্রিমিং এর মত সুক্ষ কাজ যা ক্যামেরার ব্যবহার কে আরও সহজ করে তুলেছে।

Red-Eye Reduction

মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবিতে অনেকসময় দেখা যায় চোখের রেটিনা লাল বর্ণের হয়ে গেছে। শটের সময় ফ্লাশের আলো সামান্য কোণ সৃষ্টি করে লেন্সে ফিরে আসে। চোখের রেটিনা হল আয়নার মত। কমপ্যাক্ট ক্যামেরায় ফ্লাশ লাইট ও লেন্সের অবস্থান খুবই কাছাকাছি। পোট্রেইট বা ক্লোজ-আপ শট নেওয়ার সময় ফ্লাশ লাইটের আলো যখন রেটিনা থেকে প্রতিফলিত হয়ে সোজাসুজি লেন্সে চলে আসে তখনই রেটিনার ছবি লাল হয়। এই সমস্যাকে এড়ানোর জন্য Red-Eye Reduction Flash Mode

Sweep Panorama

কেবল আলতো বোতামের চাপে বিস্ত্রিত পরিসরে এবং সুইপ প্যানোরামিক ছবি তৈরি করুন। পুরু ছবিটি দেখার জন্য এবং তা গভির ভাবে বুঝার জন্য দরকের হবে পেনরামার। অবিশ্বাস্য দৃশ্য নির্মানের জন্য সুইপ প্যানোরামার কোন বিকল্প নেই। আর মজার বিষয় হচ্ছে যে, এর জন্য কোন প্রকার পিসি বা বিশেষ সফটওয়্যার দরকের হবেনা। এখন একটি মজার এবং সহজ উপায় দেখুন সুইপ প্যানোরামার মাধ্যমে আপনি কতটা মনের মত ছবি তৈরি করতে পেরেছেন।

Internal Memory

ডিজিটাল ক্যামেরার সাথে যে মেমোরি (12 MB - 32 MB) দেয়া হয় তা খুবই অল্প। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলাদাভাবে মেমোরি কিনতে হয়। সুতরাং ক্যামেরা কেনার আগে দেখা উচিত কোন ধরনের মেমোরি কার্ড কিনতে হবে। তার দাম কেমন ও সহজলভ্য কিনা।

Memory Type

উল্লেখযোগ্য মেমোরি কার্ড CompactFlash, Secure Digital, SDHC, xD Picture, Memory Stick, MicroDrive, and SmartMedia. তবে SD ও SDHC কার্ড হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও সহজলভ্য কার্ড।সাধারণত 4GB মেমোরীতে 10MP ক্যামেরায় JFEG ফরমেটের প্রায় ১১৫০ টি ছবি ও 8 MP ক্যামেরায় ১৪৫০টি ছবি সেভ করা যায়।

USB

সব ক্যামেরার সাথে USB ক্যাবল থাকে। অনেক ক্যামেরার সাথে টিভি কানেকটিং কেবল থাকে যাতে ক্যামেরার ছবি সরাসরি টিভিতে দেখা যায়।

Battery

ডিজিটাল ক্যামেরার বহুমুখী ফাংশন ও এলসিডি ডিসপ্লের জন্য রিচার্জেবল ব্যাটারীর কোন বিকল্প নেই। সাধারণত ব্যাটারীর অপশন তিন রকমের হয়ে থাকে। ক) Lithium Ion ব্যাটারী, এটি ক্যামেরার সাথেই থাকে এবং ক্যামেরাসহ চার্জ করতে হয়। খ) চার্জারসহ Lithium Ionব্যাটারী, পার্থক্য হচ্ছে আলাদা একটি চার্জার থাকে, ব্যাটারী ক্যামেরা থেকে বের করে এই চার্জারে রেখে চার্জ করতে হয়। সুবিধা হল, একটা এক্সট্রা ব্যাটারী কিনলে একটা স্ট্যান্ড বাই চার্জে রেখে আরেকটা দিয়ে ক্যামেরার কাজ চালানো যায়।গ) Rechargeble AA NiMh (পেন্সিল ব্যাটারী)। এ অপশনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাটারী ও চার্জার আলাদাভাবে নিজেকে কিনতে হয়। ব্যাটারীর চার্জের ক্ষমতা mAh বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

Friday, June 28, 2013

এই গরমে সুস্থ থাকুন

0 comments
গরম পড়েছে। গরম কাল এলেই বাড়তে থাকে অস্বস্তি। তাই এই গরমে যে কোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়া যেমন স্বাভাবিক, তেমনি একটু নিয়ম মেনে চললেই সুস্থ থাকা সম্ভব। সুস্থ থাকার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।

১। গরমে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পানি ও লবণ বের হয়ে যায়, যা কিছুটা দৃশ্যমান এবং কিছুটা অদৃশ্য। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খান।

২। বাইরের রোদ থেকে এসেই ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করবেন না। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। তারপর পান করুন।

৩। ঠান্ডা কোমল পানীয় বেশি পান না করাই ভালো। লেবুর শরবত, ডাবের পানি ইত্যাদি পান করুন।

৪। ঘাম বেশি হলে প্রয়োজনে খাওয়ার স্যালাইন খেতে পারেন। তাতে শরীরে পানির পাশাপাশি লবণের ঘাটতিটাও পূরণ হবে।

৫। নিয়মিত গোসল করুন। প্রয়োজনে দিনে একাধিকবার গোসল করতে পারেন। এতে শরীর ও মন চাঙা হবে।

৬। বাইরে বেরোনোর আগে সুতির হালকা রঙের পোশাক পরাই ভালো। এতে কাপড়ের মধ্য দিয়ে বাতাস চলাচলের কারণে এবং হালকা রং কম তাপ শোষণ করায় কিছুটা আরাম পেতে পারেন।

৭। নিয়মিত অন্তর্বাস পরিষ্কার করবেন। এতে চর্মরোগ কম হবে।

৮। রোদে বেরোনোর সময় ছাতা ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে ভালো কোনো সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করতে পারেন। এতে চামড়া রোদে পোড়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।

৯। যাঁরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে কাজ করেন, তাঁরা কক্ষ থেকে বের হয়ে সরাসরি বাইরে বা রোদে যাবেন না; বরং কিছুক্ষণ সাধারণ তাপমাত্রার কক্ষে বসুন। তারপর বাইরে বের হোন। বাইরে থেকে আসার সময়ও একই প্রক্রিয়ায় চলুন।

১০। গরমে রাস্তার ধারের লোভনীয় শরবত কিংবা ফলের রস খাওয়ার আগে দেখে নিন, তাতে যে পানি ব্যবহার করা হয়েছে, তা বিশুদ্ধ কি না। না হলে ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এসব পানীয় পারতপক্ষে এড়িয়ে চলাই ভালো।

১১। অনেকক্ষণ ধরে বেশি গরমে বা রোদে থাকলে অনেকে অচেতন হয়ে পড়তে পারে, যাকে হিটস্ট্রোক বলা হয়। এ রকম হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে শুইয়ে দিতে হবে। সারা গা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। রোগী খেতে পারলে তাকে প্রচুর পানি বা খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

ব্রণ থেকে মুক্তির উপায়

0 comments
ব্রণ বা অ্যাকনি ত্বকের তেলগ্রন্থি বা সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডের একটি প্রদাহজনিত রোগ। ব্রণকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি রোগ হিসেবেই দেখা হয়। এর সুনির্দিষ্ট কারণ ও নিরাময়যোগ্য চিকিৎসাও আছে।

সাধারণত ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সে দেহে নানা হরমোনের ওঠানামার কারণে এ সময় ব্রণের প্রকোপ বেশি হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় এমনিতেই সেরে যায়। তবে প্রাপ্তবয়স্করাও যে ব্রণের ঝামেলায় ভোগেন না, তা নয়। ব্রণের আক্রমণের পেছনে বংশগত বা জেনেটিক কারণ যেমন দায়ী তেমনি হরমোনজনিত জটিলতা যেমন অ্যান্ড্রোজেনের প্রভাব, প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবহার, জীবাণুর আক্রমণ, মানসিক চাপ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদিরও হাত আছে।

ব্রণ হলে সাধারণত চুলকানি থাকে না। তবে ব্যথা হতে পারে। কিশোরী ও তরুণীদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ মেয়ে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম নামের একধরনের হরমোনজনিত জটিলতায় ভোগে। এদের ব্রণ বেশি হয়। এদের ওজন কমালে এবং চিকিৎসা করলে ব্রণ সেরে যায়। কারণভেদে চিকিৎসকেরা নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন থেরাপি, অ্যান্টি অ্যান্ড্রোজেন, স্পাইরোনোল্যাকটন ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করেন ব্রণের চিকিৎসায়।

তবে গর্ভবতী নারী বা সন্তানধারণে চেষ্টা করছেন এমন নারীদের ওষুধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা দরকার। প্রথম তিন মাস কোনো ধরনের ওষুধ না খাওয়াই ভালো।

ব্রণ হলে মুখের ত্বক খোঁটা উচিত নয়, এতে ত্বকে দাগ পড়ে যাবে। সব সময় ত্বক পরিষ্কার রাখতে হবে। অতিরিক্ত তেলজাতীয় খাবার বা ভাজা পোড়া এড়িয়ে চলতে হবে। যেকোনো প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারের আগে সাবধান হওয়া উচিত। ব্রণের কারণে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তা না করে সঠিক কারণ চিহ্নিত করুন। কোনো শারীরিক জটিলতা থাকলে তার চিকিৎসা নিন।

এম মনিরুজ্জামান খান, ত্বক বিশেষজ্ঞ

Saturday, June 22, 2013

সাব-এডিটর : সংবাদপত্রের নেপথ্য নায়ক

1 comments
সাব-এডিটর হচ্ছেন সংবাদপত্রের নেপথ্য নায়ক। তিনি তার সম্পাদনার দক্ষতার বৈচিত্র্য দিয়ে সংবাদপত্রের ভাবমর্যদা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সংবাদ কপির একটি অপরিচ্ছন্ন, দুর্বল ও দুর্বোধ্য লেখাও তার হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে পরিপাটি, পরিশুদ্ধ, যথার্থ ও সুপাঠ্য।

সাব-এডিটরকে তাই বলা হয় ‘King of the news desk'; কেননা সাব-এডিটররা তাদের অসাধারণ সম্পাদনা দক্ষতা দিয়ে নানা ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রতিবেদনকে পাঠকের কাছে ত্রুটিমুক্ত করে পরিবেশন করতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সে কারণে বলা হয়ে থাকে, ‘Reporters write the paper but sub-editors make it.’
এতসব কাজ করেন সাব-এডিটররা, অথচ তাদের কথা জানেন না কেউ। একজন রিপোর্টারের জীবনে অসংখ্যবার ছাপা হয় বাইলাইন স্টোরি। সফল রিপোর্টার তার করা স্টোরির জন্য অসংখ্যবার হয়তো পান অনেক মানুষের বাহবা। কিন্তু সাব-এডিটর, যিনি প্রতিটি প্রতিবেদনকে পাঠযোগ্য, যথার্থ ও নির্ভুল করাসহ এত অসংখ্য কাজ করেন, তিনি চিরকাল থেকে যান পর্দার অন্তরালে। পত্রিকায় তার নাম ছাপা হয় না। কোনো টেলিফোন বেজে ওঠে না তার প্রশংসায়। পাঠক তার নামে উচ্চারণ করেন না কোনো মঙ্গলধ্বনি।

আর এ কারণে সাব-এডিটরকে বলা হয় `Unsung hero of the newspaper'. সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো সংবাদ কপি তার হাতেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছোঁয়া পায় বলেই তাকে বলা হয় ‘সীমান্তের শেষ ফাঁড়ি’ ( Last cheek post)।

বার্তা বিভাগের সবাই এক একজন সাব-এডিটর। এমনকি বার্তা সম্পাদকও তাদের মধ্যে একজন। বার্তা সম্পাদক বার্তা বিভাগের প্রধান। তার অধীনে শিফট-ইন-চার্জ, চিফ সাব-এডিটর, সিনিয়র সাব-এডিটর এবং অন্যসব সাব-এডিটর কাজ করেন।

সাব-এডিটটের যোগ্যতা ও গুণাবলি :
সাব-এডিটরের কাজের ফিরিস্তি থেকে নিশ্চয় অনুমান করা যায়, এতসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হলে কী ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন। সাব-এডিটরকে ‘সব কাজের কাজি’ হতে হয়। এবং অবশ্যই বেশকিছু বিষয়ে তার থাকতে হয় পাণ্ডিত্য। সাব-এডিটরের থাকতে হয় সুশৃঙ্খল মন। তার মনের সুশৃঙ্খলাই তাকে সহায়তা করে কপি সম্পাদনা করতে।

১. সংবাদ চেতনা : নানা সোর্স থেকে অসংখ্য খবর আসে সংবাদকক্ষে। এসব থেকেই সাব-এডিটরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোনটি সংবাদ আর কোনটি নয়। আর যেটি সংবাদ সেটি সংবাদপত্রের কোথায়, কত কলাম জুড়ে যাবে, সেটি তাকেই নির্ধারণ করতে হয়। সাব-এডিটরের এসব সিদ্ধান্ত নিতে যে বোধ বা চেতনার প্রয়োজন হয়, তা-ই হলো সংবাদ চেতনা ( News Sence )। সাব-এডিটররা এই সংবাদ চেতনা দিয়ে সংবাদের মূল্য নির্ণয় করে থাকেন।

২. সন্দেহবাতিক মন : সাব-এডিটরের মন সুশৃঙ্খল হলেই চলে না, তার মনে সন্দেহের একটি স্থায়ী আবাসও থাকতে চাই। সবকিছুতে সন্দেহ করার একটি বাতিক থাকা চাই তার। কপির যেখানেই সন্দেহ হবে সেখানেই চলবে তার কলম/কম্পিউটারে আঙুল।

৩. বিশ্লেষণ ক্ষমতা : সাব-এডিটরের বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকা চাই। যেকোনো কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তার থাকতে হবে। তিনি হবেন খুঁটিনাটি বিষয়ের মাস্টার। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি নাম, সম্ভব হলে প্রতিটি শব্দ তিনি তার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চ্যালেঞ্জ করবেন।

সাব-এডিটরের ক্ষমতা থাকতে হয় সংবাদ থেকে মতামত পৃথক করে ফেলার। স্টোরির মধ্যে লুকিয়ে থাকে মতামত, লৈঙ্গিক ও সামাজিক পক্ষপাতিত্ব, এসব কিছু বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগ করে শনাক্ত করতে জানতে হয় তাকে। বিচার-বিশ্লেষণ করে যেকোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব শনাক্ত করার ক্ষমতা তার থাকা চাই।

৪. বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার : সাব-এডিটরের থাকতে হবে একটি বড় জ্ঞানভাণ্ডার। সব ধরনের, সব বিষয়ের স্টোরিই তো তার চেকপোস্টে ছাড়পত্র নিতে হাজির হয়। কাজেই সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ইস্যু আর প্রবণতাগুলো সম্পর্কে তাকে জানতে হয় বেশ ভালোভাবে। জানতে হয় তার নিজের সংবাদপত্র আর নীতি সম্পর্কেও। সাব-এডিটরের জ্ঞানভান্ডারে থাকতে হয় বই-পুস্তক, নাটক-উপন্যাস, ম্যাগাজিন-রিভিউ ইত্যাদি থেকে শুরু করে আইন ও সরকার সম্পর্কেও ভালো জানা-শোনা। তার জানা থাকতে হয় খ্যাতিমান সম্পর্কে, এমনকি জানতে হয় বিভিন্ন স্থান সম্পর্কেও। রাজনৈতিক আর সামাজিক সম্পর্কগুলোও রাখতে হয় মাথায়। ভূগোল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কেও তাকে জানতে হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ। সবচেয়ে বেশি জানতে হয় নিজের চারপাশ সম্পর্কে। নিজের ইন্টারনেট কানেকশন থাকা মহা জরুরি।

৫. সময় সচেনতা : সাব-এডিটরকে হতে হয় অত্যন্ত সময় সচেতন। সময় হচ্ছে সংবাদপত্র জগতে গুরত্বপূর্ণ বিবেচনা। সাব-এডিটরের কাছে যখন কপি পৌঁছে, তখনো বাকি থাকে অনেক কাজ, কিন্তু সময় থাকে খুবই কম। ডেড লাইন অতিক্রম করার আগেই কপি ছাপার উপযুক্ত করে ফেলার কাজটি সমাপ্ত করতে তাই সাব-এডিটরকে সময় সম্পর্কে হতে হয় অত্যন্ত সতর্ক।

৬. ভাষা ও ব্যাকরণ জ্ঞান : সাব-এডিটরকে ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা চাই। তিনি যেন অতি সহজেই বাক্য গঠনের দুর্বলতা চট করে ধরতে পারেন। কী ধরনের শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করলে সংবাদটি সহজপাঠ্য ও অর্থবহ হয় তা তাকে দ্রুতই বুঝতে হবে। তাকে আরো বুঝতে হবে, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ভাষা আলাদা। সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে পারসোনাল স্টাইল বলতে কিছু নেই। অথচ সাহিত্যে তা আছে। সঙ্গত কারণে সংবাদ লেখা ও সম্পাদনায় যথার্থ, নির্মোহ ও বস্ত্তনিষ্ঠ শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করার ব্যাপারে সাব-এডিটরকে বিশেষ পারদর্শী হতে হবে। অনেক শব্দভাণ্ডার তার থাকা চাই। চাই সব লেখাকে তার পত্রিকার স্টাইল অনুসরণ করে সংক্ষিপ্ত করার ক্ষমতা।

৭. বন্ধুভাবাপন্ন : জীবন ও জগত সম্পর্কে অনেক কিছু জানার পরও মানুষের কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু সদা মিশুক ও বন্ধুবৎসল হলে সাব-এডিটর তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা মাত্রায় সহযোগিতা পেতে পারেন। আর বন্ধুবৎসল না হলে ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি কর্মস্থলেও তাকে বহু সমস্যা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

৮. উদ্যমী ও সৃজনশীল : সাব-এডিটর হবেন একজন সৃজনশীল, উদ্যমী ও উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ। কপি পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জন করার সময় তাকে যেমন সৃজনশীল, বৈচিত্র অন্বেষী ও উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে, তেমনি তাকে সম্পাদনা কাজে পর্যাপ্ত উদ্যম ও আনন্দ খুঁজে পেতে হবে।

৯. রুচিবোধ : সংবাদপত্রের সুনাম ও পাঠকের রুচি ক্ষুণ্ন করে এমন যেকোনো স্পর্শকাতর তথ্য সম্পর্কে সাব-এডিটরকে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি, সংবাদ পরিবেশনে এবং সংবাদের সঙ্গে পরিবেশিত ছবি যাতে গ্রহণযোগ্য রুচির মানদণ্ডের মধ্যে থাকে, সেদিকে তাকে বিশেষ লক্ষ রেখে পত্রিকার যাবতীয় তথ্য উপকরণ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সুস্থ রুচিবোধের পরিচয় দিতে হবে।

১০. শারীরিক সামর্থ্য : শারীরিকভাবে সুস্থ হতে হবে। দুর্বল স্বাস্থ্যের ব্যক্তির পক্ষে সাব-এডিটরগিরি করা সম্ভব নয়। দিনে-রাতে যেকোনো শিফটে তাকে কাজ করতে হতে পারে।

১১. দ্বিমুখী মন : এই সবকিছুর সাথে সাব-এডিটরকে হতে হয় দ্বিমুখী মনের অধিকারী। সাব-এডিটরের এই গুণটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘বাইফোকাল মাইন্ড’। একদিকে খুঁটিনাটি বিবরণ যাচাই করবেন সাব-এডিটর, আবার একইসাথে নিমিষের মধ্যে তিনি চলে যাবেন সামগ্রিক ঘটনায় বা বিস্তারিততে। দ্বিমুখী মন হচ্ছে এমন মন `one that can be shifted instantly from meticulous examination of details to the overall story'। দ্বিতল লেন্স বা বাইফোকাল লেন্সের কথা আমরা জানি, এই লেন্সের চশমার অধিকারী যেমন কাছের জিনিস দেখতে দেখতে সহসাই চলে যেতে পারেন দূরের কিছু দেখায়, আবার চাওয়ামাত্রই প্রত্যাবর্তন করতে পারেন কাছের দৃশ্যে; তেমনই বাইফোকাল মাইন্ডের অধিকারী সাব-এডিটর স্টোরির খুঁটিনাটি যাচাই করতে করতেই তাকাতে পারেন স্টোরির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে। অবিরামভাবে চলে সাব-এডিটরের দ্বিমুখী মনের ব্যবহার।

নিচের স্টোরিটি লক্ষ করুন :
গতকাল এক সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন শিশু ও একজন মহিলা। নিহতদের নাম লারা (৮), বিপু (১৯), দিশা (৩) ও জিনা (৩৪)।

উপরের সংবাদ সূচনায় দেখা যাচ্ছে, কোথায় সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে তা বলা হয়নি, সাব-এডিটর এই ত্রুটি দূর করার পদক্ষেপ নেবেন। আরো দেখা যাচ্ছে, পাঁচজন নিহতের কথা বলা হলেও নাম আছে চার জনের, নিহতের তিনজন শিশু বলা হলেও একজনের বয়স দেয়া হয়েছে ১৯। স্টোরি পড়তে পড়তেই তথ্যের স্বল্পতা থেকে ভ্রান্তি এবং অসামঞ্জস্য সব কিছু সংশোধন করতে হবে সাব-এডিটরকে। এখন যদি তিনি দ্বিমুখী মনের অধিকারী হন তাহলে তিনি ওপরের ত্রুটিগুলো ধরতে পারবেন। একদিকে তিনি প্রাপ্ত তথ্যের দিকে নজর দেবেন, একজনের নাম জিনা না জিনাত তা যাচাই করবেন, অন্যদিকে চিন্তা করে দেখবেন, একজনের নাম কি বাদ পড়েছে না কি মারা গেছে চার জন, ভুলক্রমে নিহতের সংখ্যা লেখা হয়েছে পাঁচ। সাব-এডিটরের এই এক সাথে দুইদিকে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা হচ্ছে দ্বিমুখী মনের বহিঃপ্রকাশ।

সংগৃহিত

সাংবাদিকের ভাষাজ্ঞান ও স্টাইল শিট

0 comments
মিডিয়ার পাঁচটি কাজের মধ্যে একটি হলো মানুষকে শিক্ষিত করা। মানুষ সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রতিদিন হরেক রকম খবর জানার পাশাপাশি ভাষাও শেখে। একটি বিষয়কে ভালোভাবে, স্পষ্ট করে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে শুদ্ধ ভাষায় না লিখলে চলবে না। আমরা জানি, বাক্যের গঠনে ভুল হলে, শব্দের প্রয়োগ ভুল হলে কিংবা বানানে ভুল হলে অর্থ বদলে যায়। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই সংবাদপত্রে শুদ্ধভাবে লেখা উচিত।

সংবাদপত্রের প্রতিটি পর্যায়ের কাজ খুব ব্যস্ততার মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। অনলাইন পত্রিকায় তো বিষয়টি আরো দ্রুত। টেলিভিশনের টিকারের জন্যও শুদ্ধ বানান ও বাক্য প্রয়োজন। এ জন্য সবাইকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। মূল কপিতে ভুল থাকলে সেই ভুল শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই সংবাদ রচনার সময় একজন রিপোর্টারকে অন্যসব বিষয়ের পাশাপাশি শুদ্ধ ভাষায় লেখার দিকে সতর্ক ও মনোযোগী থাকতে হয়। অনেক রিপোর্টার ধরে নেন তথ্য ঠিক থাকলেই হলো। বাকি কাজ বার্তা সম্পাদক, শিফট-ইনচার্জ, সিনিয়র সহ-সম্পাদক অথবা সম্পাদনা সহকারী কেউ একজন ঠিক করে দেবেন। এই ধরনের ভাবনা একজন রিপোর্টারকে দু’দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এক. তার লেখা রিপোর্টটি ভুলভাবে ছাপা হতে পারে। দুই. এতে করে রিপোর্টারের যোগ্যতা নিয়ে অফিসে প্রশ্ন উঠতে পারে, যা তার ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।

ধরুন একজন রিপোর্টার লিখলেন : ‘ধানমন্ডি থানা পুলিশ গতকাল একজন দোকানদারের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়ার সময় নিউমার্কেট থেকে চুইল্ল্যা আনোয়ার (৩৮) নামের একজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে।’ এ বাক্যে মনে হয় পুলিশই বুঝি দোকানদারকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করছিল। বাক্যটি হতে পারত-‘গতকাল একজন দোকানদারের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়ার সময় নিউমার্কেট থেকে চুইল্ল্যা আনোয়ার (৩৮) নামের এক সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।’

আমরা কোনো কিছু লিখতে গেলেই শব্দের ব্যবহারের সাধুরূপ নিয়ে আসি। ‘কাছে’ না লিখে ‘নিকটে’ লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এটা ঠিক নয়। সংবাদপত্রের ভাষা মুখের ভাষার যতো কাছাকাছি হয় তত বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত। সংবাদপত্র যেমন উচ্চশিক্ষিত লোকেরা পড়েন, তেমনি স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষও পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক সিনিয়র শিক্ষকের বক্তব্য হলো- সংবাদের ভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে অষ্টম শ্রেণী পাস একজন ব্যক্তি পড়ে বুঝতে পারে।

বানানের দিকে রিপোর্টাররা মনোযোগ দিতে আগ্রহী কম। কিন্তু বানানের হেরফেরে অর্থ একদম পাল্টে যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আভাষ অর্থ ভূমিকা। কিন্তু কেউ যদি আভাস লেখেন? আভাস অর্থ ইঙ্গিত। কৃতি অর্থ কার্য; কৃতী মানে কৃতকর্মা। হ্রস্ব ই-কার ও দীর্ঘ-ইকারের কারণে অর্থ বদলে যাচ্ছে। বাধা অর্থ প্রতিবন্ধক, আর ব’র ওপর চন্দ্রবিন্দু দিলে অর্থ দাঁড়ায় বন্ধন করা। সত্ব অর্থ সত্ত্বা, অসিত্ব। আর দন্তস্য’র নিচে ব দিলে অর্থ হয়ে যায় অধিকার।

লেখার ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিককে এই বিষয়গুলো ছাড়াও হাউস স্টাইল অনুকরণ করতে হয়। পত্রিকাগুলোতে কিছু শব্দ ব্যবহারে এবং বানানে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।। পত্রিকাগুলো নিজস্ব বানান ও লেখারীতি অনুসরণ করে। এর জন্য বড় পত্রিকাগুলো নিজস্ব স্টাইল শিট তৈরি করে নেয়।

কিছু পত্রিকা বাড়ি, গুলি, পাখি লিখতে দীর্ঘ-ই-কার ব্যবহার করে। কোনো কোনো পত্রিকা ‘সাংসদ’ লিখলেও এমন পত্রিকাও আছে যারা ভুলেও এটি লিখবে না, লিখবে ‘সংসদ সদস্য’। এমন পত্রিকা আছে যারা, ‘উপাচার্য’ মরে গেলেও লিখবে না। লিখবে ‘ভাইস-চ্যান্সেলর’। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ক্রিকেট লেখে কৃকেট, ব্রিটেনকে বৃটেন ক্রিজ-এর বানান লেখে কৃজ। এই যে বানান ও শব্দের ভিন্নতা- এগুলোই হলো পত্রিকার নিজস্ব হাউস স্টাইল। একজন রিপোর্টারকে ভাষাবিদ হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যাতে শুদ্ধ ভাষা লেখা যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টা করতে দোষ কী? এক্ষেত্রে নিজ পত্রিকার স্টাইল শিট বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা রাখে। কাজেই পত্রিকাগুলোর নিজস্ব স্টাইল শিট থাকা উচিত। এটি যেমন পত্রিকাটির মর্যাদা, নির্ভরযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি স্বাতন্ত্র্য প্রকাশেরও প্রতীক হয়ে ওঠে।


-সংগৃহিত

প্রতিবেদকের প্রস্তুতি - শামীম আল আমিন

0 comments
সংবাদপত্রের কাঠামো অনুযায়ী দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা তাদের জন্য নির্ধারিত কাজ করে থাকেন। রেডিও, টেলিভিশন কিংবা অন্য যেকোনো গণমাধ্যমের জন্য একই কথা প্রযোজ্য।

অন্য সবার মতো একজন রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের কাজও নির্ধারিত। শিক্ষানবিশ থেকে শুরু হয় রিপোর্টারদের পদবি। এরপর স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার হয়ে স্পেশাল করেসপনডেন্ট বা বিশেষ প্রতিনিধিই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদ। তবে চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদক বলে একটা পদ থাকে, যেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পত্রিকাগুলোয় একজন করেই প্রধান প্রতিবেদক দেখা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এ দুজন প্রধান প্রতিবেদক। এ ছাড়া ‘প্রথম আলো’সহ আরো কয়েকটি পত্রিকায় ডেপুটি চিফ রিপোর্টারের একাধিক পদ রয়েছে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে চিফ রিপোর্টার না বলে আজকাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবেই ডাকা হয়।
রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের যেমন নির্দিষ্ট করে দেয়া কাজ আছে, তেমনি দায়িত্ব নির্ধারিত চিফ রিপোর্টারেরও। প্রতিবেদকের কাজে যাওয়ার আগে চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বের ধরন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া দরকার।

চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদক
প্রধান প্রতিবেদককে তার প্রতিষ্ঠানের সব রিপোর্টারকে নিয়ে কাজ করতে হয়। পরের দিনের সম্ভাব্য ঘটনাগুলো নিয়ে যেমন পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়, তেমনি দিনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তার যথাযথ খোঁজ নিতে হয়। কেবল খোঁজ নেয়াই শেষ কথা নয়; ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তার জন্য উপযুক্ত এক বা একাধিক রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান নিযুক্ত করে ঘটনাটি কাভার করতে হয়। একই সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ দিন সামনে রেখে সংবাদ পরিকল্পনার কাজটিও করেন তিনি। সব মিলিয়ে বলা যায়, সংবাদ ব্যবস্থনার গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় থাকেন প্রধান প্রতিবেদক। বিশেষ প্রতিবেদন, দিনের ঘটনা এবং হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মালার মতো গাঁথার কাজটিই করেন তিনি।

একজন প্রধান প্রতিবেদককে চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। তার ‘সোর্স’রা যেমন তাকে সব ধরনের খবরাখবর জানান, তেমনি নির্দিষ্ট বিটের রিপোর্টারও সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে তাকে অবহিত রাখেন। আর সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা নেন। আর সংবাদ কাভার করার ক্ষেত্রে চিফ রিপোর্টার প্রয়োজনে গণমাধ্যমটির ব্যবস্থাপনার উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি, যেমন সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। তাদের নির্দেশনা নিতে পারেন।

বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে চিফ রিপোর্টারের দুটি ভালো সংজ্ঞা পাওয়া গেছে। এখানে তা উল্লেখ করা হলো:
The official head of the reporting department is called Chief reporter. He is the one who allots work for the other reporters according to their skill, ability and kind of work suits to them along with the deadline of reporting.

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের কাজের ধারা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। প্রধান প্রতিবেদকই হচ্ছেন সব রিপোর্টারের অফিসিয়াল প্রধান। প্রত্যেক রিপোর্টারের যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি কাজ ও দায়িত্ব বন্টন করেন। নির্দিষ্ট সময় পর সেই কাজ আবার বুঝেও নেন। যেকোনো ধরনের সমস্যা কিংবা কোনো কিছু বলার থাকলে একজন রিপোর্টার তা প্রধান প্রতিবেদককে অবহিত করেন।
"Chief Reporter" means a person who is in-charge of all reporters at a centre of publication, supervises their work and also regularly reports and interprets all news of legislative, political or general importance.

এখানে চিফ রিপোর্টারের কাজকে আর একটু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি কেবল অন্য রিপোর্টারদের কাজ তদারকিই করবেন না, মাঝে মাঝে গুরুত্ব বুঝে নিজেও রিপোর্টিং করবেন। বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও আইনগত ব্যাখ্যাও তুলে ধরবেন।

প্রধান প্রতিবেদকের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রিপোর্টারদের মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট বা কাজ বণ্টন।

অ্যাসাইনমেন্ট
অ্যাসাইনমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়- একটি হচ্ছে জানা ঘটনা; অন্যটি অজানা ঘটনা।

জানা ঘটনা: এ ধরনের বিষয় চিফ রিপোর্টার আগেই জেনে থাকেন। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট বিটের রিপোর্টারই তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, চিঠি কিংবা আমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা অফিস জেনে যায়। যেমন: সভা, সেমিনার, গোলটেবিল, পূর্বনির্ধারিত জনসভা, পথসভা, মিছিল, সাংস্কৃতিক আয়োজন ইত্যাদি। মোটা দাগে এগুলোকে বলা হয় ‘আগেই ঠিক হওয়া দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড’।

অজানা ঘটনা: অজানা ঘটনাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন:


• অনুসরণ: নির্ধারিত কিছু বিট বা ক্ষেত্র থাকে যা রিপোর্টাররা দিনের পর দিন অনুসরণ করেন। নিয়মিত লেগে থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসেন। এসব ক্ষেত্রে রিপোর্টারকে বিশেষ ওই জায়গার প্রতি নিয়মিত নজর রাখতে হয়। খোঁজ-খবর রাখতে হয়। এমনকি নানা ধরনের লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে সংবাদ বের করে আনতে হয়। এসব জায়গায় নজরদারি বাড়িয়ে বা অনুসরণের মধ্যে রেখে নিয়মিত ভালো রিপোর্ট করা সম্ভব। যেমন, সংসদ, সচিবালয়, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইত্যাদি।

• হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা: হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার সংবাদমূল্য হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে হলেও সেই ঘটনা কাভার করতে হয়। বের করে আনতে হয় ঘটনার পেছনের কারণ, ঘটনার প্রেক্ষাপট। তা ছাড়া এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানবিক বিষয়গুলোও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হয়। এর জন্য রিপোর্টিং টিমকে সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের কথা। কেউ কি জানত এখানে আগুন লাগবে? আগুন লাগার পর যখন এই খবর নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন সংবাদকর্মীরাও ছুটে গেলেন সেখানে।

• একইভাবে লঞ্চডুবি, সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিধসসহ নানা ঘটনাই হঠাৎ করে ঘটে যেতে পারে। বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা শুরু হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি মারা যেতে পারেন। কিংবা অর্জিত হতে পারে বড় কোনো সম্মান, সাফল্য। এসব কিছুই খেয়াল রাখতে হয় সাংবাদিকদের। বিশেষ করে চিফ রিপোর্টারের নেতৃত্বে রিপোর্টিং টিমকে।

অ্যাসাইনমেন্টের গুরুত্ব
অ্যাসাইনমেন্টের গুরুত্ব নির্ভর করে সেই ঘটনায় মানুষের কতটা আগ্রহ আছে তার ওপর। আর সেই ঘটনা কতটা গুরুত্ব পাবে তা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপর। অর্থাৎ সেই ঘটনায় কতটা সংবাদ উপাদান আছে, তার ওপর।

কার্ল ওয়ারেন তার ‘মডার্ন নিউজ রিপোর্টিং’ বইয়ে সংবাদ হতে হলে আটটি উপাদান থাকতে হবে বলে আলোচনা করেছেন। উপাদানগুলো হচ্ছে:
• তাৎক্ষণিকতা (Immediacy)
• নৈকট্য (Proximity)
• খ্যাতি (Prominence)
• বিষমতা (Oddity)
• দ্বন্দ্ব (Conflict)
• বিস্ময় (Suspense)
• আবেগ (Emotions)
• পরিণাম (Consequence)
এর বাইরেও আরো কয়েকটি সংবাদ উপাদানকে বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন:
• আকার (Size)
• গুরুত্ব (Importance)
• তাৎপর্য (Significance)
• মানবিক আবেদন (Human Interest)

রিপোর্টার বা প্রতিবেদক
রিপোর্টার বা প্রতিবেদক হচ্ছেন একটি সংবাদমাধ্যমে সংবাদের নিজস্ব উৎস। সংবাদ পেতে অনেকাংশেই তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আগেই বলেছি, রিপোর্টার হতে পারেন শিক্ষানবিশ থেকে শুরু করে বিশেষ প্রতিনিধি পর্যন্ত। রিপোর্টারদের সরাসরি দায়বদ্ধ থাকতে হয় চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের কাছে।

উইকিপিডিয়ায় একজন রিপোর্টার সম্পর্কে বলা হয়েছে, A reporter is a type of journalist who researches, writes, and reports information to present in sources, conduct interviews, engage in research, and make reports. The information-gathering part of a journalist's job is sometimes called "reporting," in contrast to the production part of the job such as writing articles. Reporters may split their time between working in a newsroom and going out to witness events or interview people. Reporters may be assigned a specific beat or area of coverage.
উপরের সংজ্ঞায়ন থেকে একজন রিপোর্টারের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকটাই বোঝা যাচ্ছে। একজন রিপোর্টারকে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। কোনো একটি বিষয়ের তথ্য অনুসন্ধানে তাকে যেমন নামতে হয় গবেষণায়, তেমনি সেই তথ্য যুক্তিসঙ্গত উপায়ে লিখে উপস্থাপনও করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজনে সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটিও করতে হয় তাকে। রিপোর্টারকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অফিসের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক ক্ষেত্রেই নানা ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখিও হতে হয়। আর এসব কিছু মাথায় রেখেই তাকে প্রস্তুতি নিতে হয়।

রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের প্রস্তুতি
রিপোর্টারের প্রস্তুতি নির্ভর করবে কোন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট তাকে দেয়া হয়েছে তার ওপর। অ্যাসাইনমেন্টটি কি আগেই জানা ঘটনার ওপর, নাকি হঠাৎ ঘটেছে। সেটি কি তার নির্দিষ্ট বিট অনুসরণের, নাকি হঠাৎ ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের। এমনও হতে পারে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে কোনো সভা-সমাবেশ, কিংবা প্রেস কনফারেন্স, সেমিনার কাভার করার। তা ছাড়া বিশেষ রিপোর্ট কাভার করার সময় তার প্রস্তুতি হয় আলাদা। দেশের ঘটনায় এক ধরনের প্রস্তুতি, আর দেশের বাইরে হলে তার জন্য প্রস্তুতি ভিন্ন। একজন রিপোর্টারকে সব সময়ই মানসিকভাবে কিছু একটা কাভার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভারের প্রস্তুতি
দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য দেশ থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী অতিথিদের অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হয়। আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী, রিপোর্টারকে সেই সুযোগ পেতে আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নিতে হয়। সেই সঙ্গে দরকার হয় স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবির বিশেষ নিরাপত্তা পাস। এর জন্য অফিসিয়ালি আবেদন করতে হয়। তারপর সেই রিপোর্টার সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই প্রমাণ পাওয়ার পর তাকে এসবি পাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতেই হয়।

• কঠোর নিয়ম মেনে চলার মানসিকতা তৈরি। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে নানা ধরনের অনুশাসন মেনে চলতে হয়।
• দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম, পদবি ঠিকভাবে জানা। কার কী কাজ সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখা রিপোর্টারের দায়িত্ব।
• ভাষার ওপর একজন রিপোর্টারের অবশ্যই দখল থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাটা খুব জরুরি। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভার করতে হতে পারে।
• নানা বিষয়ে পড়াশোনা করে ধারণা অর্জন। কেননা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নানা ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র্যও থাকে। ফলে রিপোটিং নির্ভুল করার জন্য পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।
• নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়া। কারণ, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যাওয়র পর আর কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয় না।
• পোশাক-আশাকের দিকে খেয়াল রাখা। পরিচ্ছন্ন পোশাক, বিশেষ করে ফরমাল একটা লুক থাকতে হবে।
• নিয়মিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদির খোঁজ পেতে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রাখতে হবে।

অনুসরণ করার সময় প্রস্তুতি
রিপোর্টারকে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিত অনুসরণ করতে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক রিপোর্টারের জন্য বিট বা ক্ষেত্র ভাগ করে দেয়া থাকে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় ইত্যাদি। মোটা দাগে, এসব বিষয় কাভার করার জন্যও রিপোর্টার নিজেকে নানাভাবে তৈরি করবেন।

• সবার আগে দরকার নিয়মিত পড়াশোনা করা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে নজর রাখা।

• দেশের ইতিহাস, সংবিধান ও গুরুত্বপূর্ণ আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়া। বিশেষ করে যিনি সংসদ ও আদালত কাভার করবেন।

• সংসদ কাভার করার ক্ষেত্রে এর কার্যপ্রণালিবিধি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। সংসদ কীভাবে তার কাজ পরিচালনা করে, সেটা জানা থাকতে হবে। সংসদের অধিবেশন, প্রস্তাব, বিল, আইন প্রণয়নের ধাপ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপ, বিরোধী দলের চিফ হইপ, সংসদ সদস্য- প্রত্যেকের এখতিয়ার, কাজের ধরন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সংসদীয় কমিটির গঠন ও এর ক্ষমতা সম্পর্কেও বুঝতে হবে।

• সংসদ কাভার করার ক্ষেত্রে মনোযোগ সবার আগে জরুরি। ধৈর্যও দরকার হয়। আর নিজের পোশাক-আশাকের দিকে খেয়াল রাখাও দরকার।


• আদালত কাভার করতে গেলে সংবিধান ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো সম্পর্কে ভালো পড়াশোনা থাকতে হবে। আদালত কীভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেখানে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, তাও পরিষ্কার জানা থাকতে হবে। আদালতের ভাষা বিকৃত না করে সহজভাবে মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

• সচিবালয়ের সংবাদ কাভার করার মূল যোগ্যতা হচ্ছে রাষ্ট্রের ‘রুলস অব বিজনেস’ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট রাখা। কার কী দায়িত্ব, এটা পরিষ্কার হওয়া। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। নিজের অপরিহার্যতা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেন কোথাও কিছু ঘটলে খবর চলেই আসে।

সভা-সেমিনার, সংবাদ সম্মেলন কাভারের প্রস্তুতি
সভা-সেমিনার কখনো কখনো দীর্ঘ সময় ধরে চলে। নানা কঠিন বিষয়ে আলোচনা হয়। ফলে একঘেয়ে লাগার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সভা-সেমিনার থেকেও নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বের হয়ে আসতে পারে। আর সে জন্য দরকার ধৈর্য ও মনোযোগ। তা ছাড়া, বিষয় সম্পর্কে ধারণাও থাকতে হবে। বিষয় আগেই জানা থাকলে তা নিয়ে পড়াশোনা করে নেয়া যেতে পারে। কোনটা সংবাদ, আর কোনটা সংবাদ নয়- এ নিয়ে ধারণা যদি স্পষ্ট থাকে, তাহলে সভা-সেমিনার থেকেও ভালো সংবাদ তৈরি হতে পারে।

এ ছাড়া, সংবাদের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন বা প্রেস ব্রিফিং। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় থেকে শুরু করে সাধারণ কিছু একটি আয়োজন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন হতে পারে। চলমান কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে হতে পারে এই প্রেস ব্রিফিং। কোনো নতুন উদ্ভাবন, নতুন জিনিস বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলন হতে পারে। আর এর জন্যও ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে রিপোর্টারকে। সবার আগে দরকার কোন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন তা পরিষ্কারভাবে জানা। সেই সম্পর্কে মনের মধ্যে বিস্তারিত প্রশ্ন তৈরি করা। আর বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, সৌজন্য বজায় রেখে প্রশ্ন করা। তবে প্রশ্নের সুযোগ একতরফাভাবে নিজে না নিয়ে অন্যদেরও দেয়া। আর এর মধ্য থেকে কোনটা সংবাদ তা খুঁজে নেয়া।

বিক্ষোভ, সমাবেশ, জনসভা, দুর্ঘটনায় প্রস্তুতি
জানা ঘটনার ক্ষেত্রে :
• নিজের শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়া;
• কর্মসূচি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া। কর্মসূচির ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়া। কর্মসূচি কোথায় হবে তা নিশ্চিত হয়ে নেয়া;
• কর্মসূচিতে কারা উপস্থিত থাকবেন, তাদের পরিচয় ভালোভাবে জেনে নেয়া;
• নিজের পরিচয়পত্র, নোটবুক, কলম, টেপরেকর্ডার ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেয়া;
• সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছানো।

অজানা ঘটনায় প্রস্তুতি
• অপরাধ, রাজনৈতিক দল কারো বিট হলে নিয়মিত চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য অনুসরণ করতে হয় এমন সব বিটের ক্ষেত্রেও। হঠাৎ কোনো খবর জানলে তা সঙ্গে সঙ্গে অফিসকে জানাতে হবে। অফিস অ্যাসাইন করলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে হবে।
• ঘটনাস্থলে যেতে যেতে সম্ভব হলে কী হয়েছে সেটা জেনে নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হলে কারা থাকছেন, কী হতে পারে, বিটের অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা নিয়ে নেয়া ভালো।
• যেকোনো সময় সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে ধরে নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে।
• কোনো দুর্ঘটনা হলে সে সম্পর্কে দমকল বাহিনী হতে পারে খবরের প্রথম সোর্স। এরপর পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগীর আত্মীয়স্বজন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনা ও ঘটনাস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রওয়ানা হয়ে যেতে হবে।
• ঘটনার কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেয়া। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাবধান থাকা। বিশেষ করে, দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
• নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখা।

বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও সংঘর্ষের ক্ষেত্রে করণীয় বিক্ষোভ সমাবেশ
• সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় সুবিধাজনক অবস্থান নেয়া;
• বক্তাদের তালিকায় চোখ বোলানো। কখন, কে বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা খেয়াল রাখা। মনোযোগ দিয়ে কথা শোনা ও ধারাবাহিকভাবে নোট নেয়া। বিশেষ করে প্রধান বক্তার বক্তব্য সতর্কভাবে নোট নেয়া। প্রয়োজনে রেকর্ড করে নেয়া;
• তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো আলাদা করা। নাম-পরিচয় সতর্কভাবে, নির্ভুল বানানে লিখে রাখা;
• সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে, মানসিক প্রস্তুতি রাখা।

বিক্ষোভ মিছিল
• সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেয়া। সেই সঙ্গে দাবিগুলো কী তা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া;
• আয়োজক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা। একই সঙ্গে সেখানে অবস্থান নেয়া পুলিশ কর্মকর্তার নম্বর নিয়ে রাখা;
• মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজনে অগ্রভাগে থাকা। সংঘর্ষের সূত্রপাত নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি রাখা;
• সব ক্ষেত্রেই নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা।

সংঘর্ষ
• যেকোনো জায়গায় সংঘর্ষ বেধে গেলে মনে রাখতে হবে নিজের নিরাপত্তা সবার আগে। অবশ্যই নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। সম্ভব হলে এ ক্ষেত্রে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
• সংঘর্ষের মূল জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সহিংসতার ধরন ও এতে কয়টি পক্ষ জড়িত, তার সম্পর্কে ধারণা নেয়া;
• পুলিশ ও অন্য গণমাধ্যমকর্মীরা যেখানে আছেন, সেখানে অবস্থান নেয়া। কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না। এর মধ্যে খবরও সংগ্রহ করতে হবে;
• বড় সংঘর্ষে নানা ধরনের উড়ো খবর ছড়িয়ে পড়ে। কোনো অবস্থাতেই বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। যথাসম্ভব বেশি সোর্স ব্যবহার করে হতাহতের খবর নিশ্চিত হতে হবে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে;
• ধারাবাহিকভাবে সময় ও স্থান উল্লেখ করে নোট নিতে হবে;
• পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে খোঁজ রাখতে হবে।

সব ক্ষেত্রেই টেলিভিশন রিপোর্টারের জন্য একটু বাড়তি প্রস্তুতি দরকার রয়েছে। কেননা, সংবাদ কাভার করার জন্য রিপোর্টারকে একাই ঘটনাস্থলে পৌঁছালে চলে না। তাকে সঙ্গে নিতে হয় ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নিতে হয়। সবকিছু নিয়ে যেতে দরকার গাড়ি। সেই গাড়ির চালকও এই সংবাদ দলের সদস্য। সব মিলিয়ে এই দল একটা ‘ইউনিট’। টেলিভিশন সংবাদের জন্য ‘টিমওয়ার্ক’ কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। কোনো এক জায়গায় ঘাটতি দেখা দিলে পুরো মিশনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাই ঘটনার খবর পাওয়া থেকে শুরু করে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো দলকে এক হয়ে কাজ করতে হয়। প্রস্তুতিও নিতে হয় সম্মিলিতভাবে। রিপোর্টার গাড়িতে উঠেই আগে চালক ও ক্যামেরাম্যানের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে নেবেন। এরপর ক্যামেরাম্যানকে কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেবেন। সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গেলে গাড়িটি নিরাপদ দূরত্বে রাখবেন। এরপর রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান নেমে যাবেন। খবর সংগ্রহের পাশাপাশি একে-অপরের নিরাপত্তা দেয়ার কাজটিও করবেন। কেবল সংঘর্ষ বা বিক্ষোভ নয়, যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গেলেই তাদের দুজনের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা খুবই জরুরি। কেননা, টেলিভিশন সংবাদের জন্য ছবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ছবি তোলার কাজটি যিনি করেন, তার ওপরই নির্ভর করে ভালো একটি প্রতিবেদন। ফলে দুজনে মিলে কথা বলে সব সিদ্ধান্ত নিন। তবে মনে রাখা ভালো, এ ক্ষেত্রে রিপোর্টারই ‘টিম লিডার’। পুরো টিম চালানোর কাজটি তাকে দক্ষতা ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে করতে হবে।

শামীম আল আমিন: বিশেষ প্রতিনিধি, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: amin.one007@gmail.com

মফস্বল সাংবাদিকদের সুখ-দুঃখ - সরদার ফরিদ আহমদ

0 comments
নিজ নিজ পেশার মানুষ সহজেই কাছে আসে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে চিন্তা ও চেতনার ঐক্য। মতবিনিময় সহজ হয়। ভাববিনিময়ে ভালো লাগার পরিবেশ থাকে অনুকূল।

এ কারণেই রাজধানী থেকে বাইরে গেলেই জেলা-উপজেলার সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা হয়। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি দারুণভাবে লাভবান হই। উপকৃত হই। সমৃদ্ধ তো হই-ই। কাছ থেকে জানা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের দুঃখ-বঞ্চনা, না পাওয়ার বেদনা। আবার তাদের পাওয়ার অভাবনীয় আনন্দের কথা জেনে বিস্মিত হতে হয়।

এই পাওয়ার ধরন এবং রকম একেবারেই ভিন্ন। ঢাকার সাংবাদিকদের ভাগ্যে এসবের কিছুই জোটে না।


মফস্বল সাংবাদিকদের বঞ্চনার অন্ত নেই। পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ অপ্রাপ্তির বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু অনেক কষ্টে পাঠানো কোনো খবর যখন ছাপা হয় না অথবা চ্যানেলে প্রচার হয় না, তখন তাদের দুঃখবোধের মাত্রার সীমা-পরিসীমা থাকে না। হতাশ হন। ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। নিজেকে অক্ষম এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ মনে হয়।

মফস্বলের সাংবাদিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য পরস্পরের সাথে সংবাদ বিনিময় করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ এক সাধারণ রীতি। লক্ষ্য একটাই- খবর যাতে মিস না হয়। দেখা গেল যিনি খবরটির মূল সংগ্রাহক তার নিজের পত্রিকাতেই নিউজটি ছাপা হলো না। অথচ যিনি তার কাছ থেকে খবরটি নিয়ে পাঠালেন, সেই সাংবাদিকের পত্রিকায় ছাপা হলো। সংবাদের মূল সংগ্রাহক তখন পড়েন বিড়ম্বনায়। হন বিব্রত। এ ধরনের ঘটনার প্রায়ই শিকার হন মফস্বলের সাংবাদিকরা।
‘ভাত দেবার মুরোদ নেই- কিল দেবার গোঁসাই’- এ প্রবাদ বাক্যটির প্রায় শিকার হন মফস্বল সাংবাদিকরা। নিউজ মিস করলে ঝাড়ি খেতে হয়। কিন্তু বেতন, মোবাইল ও ফ্যাক্স বিলের কথা বললেই কর্তৃপক্ষ নারাজ হন। বাদ দেয়ার হুমকি দেন। নিউজে ভুল হলে খবর আছে। ভালো হলে কখনোই ধন্যবাদ জোটে না। এ এক উদ্ভট ব্যাপার।

সাংবাদিকতা করো ঠিক আছে, কিন্তু কাজ তো একটা কিছু করতে হবে- মফস্বল সাংবাদিকদের সম্পর্কে বেশিরভাগ পিতা-মাতা ও মুরবিবদের এটিই চূড়ান্ত মন্তব্য। তাদের অনেকেই মনে করেন, সাংবাদিকতা কোনো কাজ না। স্রেফ নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো। একবার নয়া দিগমেত্মর এক উপজেলা সংবাদদাতার বাবা টেলিফোন করেন। তিনি জানতে চাইলেন, তার তরুণ ছেলেটি যে নিউজ পাঠানোর কাজ করে এটি কী কোনো চাকরি? না শুধু শুধু পয়সা খরচ করা। তিনি অনুরোধ করলেন, আমরা যাতে তার ‘পাগল’ ছেলেকে কোনো কিছু করতে বলি। কারণ তিনি তার ছেলেকে বিয়ে করানোর চিন্তা করছেন।

বলা হয়ে থাকে, দু’টি পেশা আছে এমন, যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। একটি শিক্ষকতা, অপরটি সাংবাদিকতা। এ দু’টি পেশাতেই এক ধরনের মোহ আছে। মোহ সম্মান এবং সালামের। সামাজিক মর্যাদার। এ এক সর্বনাশা নেশা। বলা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের অনেকেই এই ‘সর্বনাশা নেশায়’ হাবুডুবু খান। কিন্তু ছাড়েন না। সরেন না। আসলে ছাড়তে পারেন না। সরা যায় না।

ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে হিংসা, রেষারেষি, সহযোগিতা সবই হয়। এসব হয় কৌশলে। গোপনে। ধূর্ততার সাথে। অনেকেই জানতে পারেন না। মফস্বলেও এ ধরনের অবস্থা বিরাজমান। তবে সবই হয় প্রকাশ্যে। পক্ষ দুটো। হয় শত্রু, নয় বন্ধু। মাঝামাঝি সম্পর্ক বলে কিছু নেই। গ্রুপিংয়ের মাত্রা এবং অবস্থান অনেক বেশি শক্ত, কঠোর। প্রয়োজনে কঠোরতর।


ভালো-মন্দ এসব মিলিয়ে মফস্বল সাংবাদিকরা সরবভাবেই আছেন। আছেন সবকিছুতেই। আছেন স্থানীয় রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। তারা এলাকার কোন কোন জায়গায় আছেন তার খোঁজ নিলে কূলকিনারা পাওয়া কঠিন। বরং কোন জায়গায় নেই তার তত্ত্বতালাশ পাওয়াই সহজ।


লিখে সাধারণ মানুষের উপকার করার কিংবা স্থানীয় কোনো বিগম্যানকে ধসিয়ে দেয়ার যে পরিমাণ ক্ষমতা একজন জেলা সংবাদদাতার আছে তার হাজার ভাগের এক ভাগও ঢাকার কোনো চালু পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতারও নেই। নিঃসন্দেহে এই দিকটি থেকে মফস্বল সাংবাদিকরা অনেক বেশি ক্ষমতাধর। সম্ভবত এটিই মফস্বল সাংবাদিকদের সবচেয়ে ভালো লাগা ও তৃপ্তির বিষয়। এ ক্ষমতা তার অনেক অপ্রাপ্তির শূন্যতা পূরণ করে দেয়।

সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য - সরদার ফরিদ আহমদ

0 comments
প্রতিটি খবরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো ঘটনা থেকে বিশেষ কিছু বের করে আনার মধ্যেই রিপোর্টারের কৃতিত্ব। আমরা জানি, প্রতিটি সংবাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্থিতাবস্থার বিঘ্ন ঘটা বা সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। সাংবাদিক যদি বুঝতে পারেন কোন বিষয়টিতে পাঠকের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি- তাহলে বলা যায় তার নিউজ নোজ আছে। তিনি সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ধরতে পেরেছেন।

সংবাদপত্রে কোনো নিউজ পাঁচ কলামে প্রথম পাতায় ছাপা হয়, কোনো নিউজ আবার সিঙ্গেল কলামে ভেতরের পাতায় প্রকাশিত হয়। এমনটি হওয়ার নিশ্চয় যৌক্তিক কারণ আছে। কোন নিউজ কোন পাতায় কিভাবে ঠাঁই পাবে তা নির্ভর করে ওই নিউজটির ব্যাপারে আগ্রহী মানুষের সংখ্যার ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায় একটি বোমা ফাটলে সেটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। কিন্তু কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে চারটি বোমা ফাটলেও সেই খবরটির জায়গা হয় শেষের পাতায় অথবা ভেতরের পাতায় কিংবা মফস্বল পাতায়। কেন এমনটি হয়? এর সহজ জবাব হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা বিস্ফারণের ঘটনাটি যত মানুষকে আগ্রহী কিংবা উদ্বিগ্ন করে, ভিক্টোরিয়া কলেজের একই ঘটনা ততসংখ্যক মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সংবাদ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এটিই অবশ্য চরম সত্য কিছু নয়। কোনো সংবাদপত্রের পলিসির ওপরও সংবাদ মূল্যায়নের বিষয়টি নির্ভরশীল। উত্তরবঙ্গে কানসাটের ঘটনা আওয়ামী-ঘরানার পত্রিকা যেভাবে ফলাও করে প্রচার করছে, সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো সে রকমটি করছে না। কয়েকটি খবরের শিরোনাম দিয়ে ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করা যাক: কানসাট জনতার দখলে (সংবাদ), কানসাটে ঊনসত্তরের হাতছানি (ভোরের কাগজ)। আবার একই তারিখেএকটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম: সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে এখন সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি। এ ধরনের শিরোনাম দিয়ে ফলাও করে নিউজ করার পেছনে সংবাদমূল্যের চেয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ কিংবা পত্রিকার পলিসিই বেশি গুরুত্ব বহন করে। এখানে পাঠকের আগ্রহ-অনাগ্রহ বিষয়টি চূড়ামত্মভাবে অনুপস্থিত।

রাজনৈতিক পÿপাত থেকে সংবাদের মূল্য নির্ধারণের অতি সাম্প্রতিক আরো একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বিশ্বে সর্বশীর্ষে অবস্থানকারী সাময়িকী ‘টাইম’-এর সর্বশেষ (১০ এপ্রিল ২০০৬) সংখ্যার কভার স্টোরি নিয়ে পত্রিকাগুলো যেভাবে পÿপাতমূলক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। টাইমের কভারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি ছাপা হয়। ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ বা পুনর্গঠন বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক কভার স্টোরি হয়েছে। সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে। কিন্তু বিরোধী দলের সমর্থক পত্রিকা ও কলামিস্টরা এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তারা বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে এগুলো করাচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশী পত্রিকা কেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো বলল- এটিই তাদের রাগের কারণ। টাইমে এ রিপোর্টটি লেখেন সাংবাদিক অ্যালেক্স কেরি।

এই অ্যালেক্স কেরিই যখন ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল এই ম্যাগাজিনেই ‘ডেডলি কার্গো’ শিরোনামে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট লিখেছিলেন, তখন আওয়ামী-ঘরানার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা উল্লসিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সরকার। তারা অ্যালেক্স কেরির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে।

সে যাক। আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক আনুগত্যশীল মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা না বাড়িয়ে সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য খোঁজার দিকে আবার মনোযোগ দিই। স্টাফ রিপোর্টাররা কোনো ঘটনার বিশেষ দিক খুঁজে বের করতে প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হন। একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক সহজেই সংবাদের এমন বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে। ঘটনা থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বের করতে পারলে সংবাদ-সূচনা (ইনট্রো) লেখা সহজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো চেনার উপায় কী, এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সংজ্ঞাই বা কী?

একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এর জবাবে বলেছেন, বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো ঘটনাপ্রবাহ বা সজ্জিত ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতর, বিশিষ্ট এবং সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ঘটনাংশ বা উপাদান। আসলে বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কোনো রহস্য নেই, নেই কোনো সূক্ষ্ম চাতুর্যের বা কলাকৌশলের প্রয়োগ, এমনকি কোনো নিয়মকানুন বা রীতিপদ্ধতিও নেই, পুরোটাই উপলব্ধির অন্তর্গত।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সময়। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিনই বক্তৃতা দেন। একই কথা হয়তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে বলেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন, ‘১৭ আগস্টের আগে সরকার জঙ্গি সম্পর্কে জানত না’ (বিশ্বখ্যাত সাময়িকী টাইমকে দেয়া সাক্ষাৎকার) তখন এটিই হয়ে যায় সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অর্থমন্ত্রী কত কথাই না বলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রায়ই এমনসব কথা বলে বসেন যা তার বক্তৃতারই নয়- সেটা সেমিনারের সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার পরামর্শ কিংবা পেঁয়াজ না খেলে কী হয় ইত্যাদি। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীর তো কথাই নেই।

সংসদ চলাকালীন তর্ক-বিতর্ক হয়, ওয়াকআউটের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু যদি কেউ রিভলবার নিয়ে সংসদে ঢোকেন, এমপিরা যদি মারামারি করেন কিংবা এক এমপি আরেক এমপিকে মা-বাবা তুলে গালি দেন তাহলে সেদিনের অধিবেশনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হবে এসব ঘটনা।

রাজধানীর বাইরের টেলিভিশন সাংবাদিকতা - পলাশ আহসান

0 comments
বাংলাদেশে আধুনিক টেলিভিশন সাংবাদিকতার বয়স বছর দশেক হলো। বছর দশেক বলছি এই কারণে যে, একুশে টেলিভিশনের প্রচার শুরু হওয়ার আগে যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যে সাংবাদিকতা হতো, তা ছিল শুধু তথ্যনির্ভর। সেই তথ্যের সঙ্গে ছবি থাকলে ভালো হতো, না থাকলে তথ্য প্রচার করা হতো ছবি ছাড়াই। সেসময় ছবি ছাড়াই চলতো ছবির সাংবাদিকতা।

অবশ্য আমার এই তথ্যের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না; বিশেষ করে সেই সময় যারা টেলিভিশন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের বোঝার জন্যে বলছি, আমি একেবারে সংবাদভিত্তিক সাংবাদিকতার কথা বলছি। কারণ সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’-এর মতো কিছু তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার হতো । যেগুলো এখনো ছবিভিত্তিক সাংবাদিকতার মাইলফলক হয়ে আছে।

যাহোক, সে সময় যিনি বা যারা টেলিভিশনের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতেন, তিনি একইসঙ্গে কাজ করতেন অন্য পত্রিকাতেও। পত্রিকায় তিনি যে সংবাদটি ফ্যাক্স করতেন, সেটিই পাঠিয়ে দিতেন টেলিভিশনে। কখনো কখনো টেলিফোনে ঘটনার বর্ণনা দিতেন। অবশ্য সেই বর্ণনা আগে থেকেই রেকর্ড করা হতো। তারপর সেটি প্রচারিত হতো সম্পাদনা করার পর। একুশে টেলিভিশন প্রচার শুরু করার পর সেই চিত্র কিছুটা বদলালো।

তখনকার প্রযুক্তিতে ভিডিও ক্যামেরাম্যানকে টানতে হতো ৩০ কেজি ওজনের ‘একখানা বস্তু’। যার নাম ক্যামেরা । আর সেই জিনিস বাইরে বের করলেই বের করতে হতো আরো ছয়/সাতজনের লট বহর। তাই ইচ্ছে থাকলেও গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত টেলিভিশন পৌঁছাতে পারতো না।

একুশে টেলিভিশনের যুগে ভিএইচএস ক্যামেরায় কাজ করতেন রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা। তাদের ছবি তুলতেন এমন একজন মানুষ , যার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিয়ে বাড়ির ক্যামেরা চালানো। ঝাপসা হলেও সেই ছবি ঘটনার তিন/চারদিন পর সংবাদের সঙ্গে প্রচার করা হতো। তবে রাজধানীর বাইরের সংবাদে ছবি থাকতো খুবই কম।

২০০০’র পর আসলো পরিবর্তন। শুরুতে ভিএইচএস দিয়েই ব্যাপক হারে রাজধানীর বাইরের সংবাদপ্রচার শুরু হলো। ক্যামেরাম্যানদের কাজের মানও বাড়লো। দু-এক বছরের মধ্যেই হাতে চলে আসলো ডিভি ক্যামেরা। হ্যান্ডি ক্যাম। গোটা প্রযুক্তিটাই আস্তে আস্তে চলে আসলো হাতের মুঠোয়। সুন্দর ছবি, সুন্দর দৃশ্য যুক্ত হলো টেলিভিশন সাংবাদিকতায়। সুন্দরবনের পেটের ভেতরের গ্রাম গোলাখালী । সেই গ্রামের ছবিটিও মানুষ দেখতো পারলো অনায়াসেই।

বর্তমানে একযোগে ১০/১২টি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সংবাদপ্রচার শুরু হয়েছে । রাজধানীর সঙ্গে দূরত্বের জন্যে যে বিষয়টা আগে কিছুটা দূরুহ ছিল, সেটিও সহজ করে দিয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস। এখন পঞ্চগড়ের একটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো ঘটনা ঘটার ১০ মিনিটের মধ্যেই সচিত্র প্রচার করা সম্ভব।

প্রচুর কাজ হচ্ছে গ্রামগঞ্জে। জেলা প্রতিনিধিরা তো আছেনই। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায়ও প্রতিনিধি আছে টেলিভিশনগুলোর। তথ্য এখন আসলেই অবাধ। চাইলেই হাতের মুঠোয় সবকিছু। ছাপা মাধ্যমের চেয়ে এখন অনেক বেশি এগিয়ে টেলিভিশন। এমনকি অনলাইন পত্রিকাও সংবাদপ্রচারে দ্রুততার দিয়ে টিকতে পারছে না টেলিভিশনের সঙ্গে। টেলিভিশনগুলো কোনো কোনো ঘটনা সরাসরি প্রচার করতে পারছে। সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে রাজধানীর বাইরে থেকেও। গত নির্বাচনের সময় আমরা প্রত্যন্ত সব জেলা থেকেও সরাসরি ভোট দেয়ার দৃশ্য দেখেছি।

এখন সময় এসেছে পেশায় উৎকর্ষ বাড়ানোর। টেলিভিশনগুলোকে জেলায় জেলায় বেতন দিয়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে হয়। এখন টেশিভিশনের সঙ্গে কাজ করা শুধু গর্ববোধের বিষয় নয়। রাজধানীর বাইরেও কেউ কেউ সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নিতে শুরু করেছে। এখনই সময় পুরো কাজটাকে নিয়মের মধ্যে ফেলার। আর তা করতে হলে জানতে হবে ছক, বুঝতে হবে। আর সে কাজটি যে খুব কঠিন, তা নয়।

এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার পেশাগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে হবে। কারণ আমি এই লেখার মাধ্যমে আমি আমার পেশাটাকে অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। বর্তমানে আমি কাজ করছি একটি টেলিভিশনের বার্তা বিভাগে। দায়িত্ব রাজধানীর বাইরের সংবাদ সম্পাদনার। কাজটিকে আমি সম্পাদনা না বলে প্রচার যোগ্য করে তোলা বলতে চাই। রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতা নিয়ে আমি এর আগে কাজ করেছি একুশে টিলিভিশন এবং চ্যানেল আইয়ে।

এ পর্যন্ত যদি কিছু শিখতে পারি তা রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের কাছেই শিখেছি। কাজ করতে করতেই শেখা। পুরোপুরি শিখেছি, একরম দাবি করছি না। তবে এখন কাজ চালিয়ে নিতে পারি। আমার কাজটি পুরোপুরি শেখার জন্যেই মূলত এই অভিজ্ঞতা বিনিময়।

লেখার শুরুতে আমি বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতার যে ইতিহাস বলার চেষ্টা করছিলাম, আমি সেই ইতিহাসে যোগ দিয়েছি একুশে টেলিভিশন যুগের পারপরই। তখনো ভিএইচএস-এর রাজত্ব চলছে। প্রতিদিন ২০/২৫টা টেপ আসে। অনেকটা ধস্তাধস্তি করে এর মধ্যে ছয় থেকে সাতটা প্রচারের ব্যবস্থা করা যায়। খুব বেশি যতœ নিলে কখনো কখনো দু-একটি ভালো কাজ করা যায়।

ঠিক এর কিছুদিন পরেই রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতায় পরিবর্তন শুরু হয়। খুব দ্রুত পরিবর্তন। একসময় আমূল পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ভাবতে ভালোই লাগে, বাংলাদেশে রাজধানীর বাইরের টেলিভিশন সাংবাকিতায় যত পরিবর্তন এসেছে, আমি মোটামুটি সবগুলোর সঙ্গেই ছিলাম, এখনো আছি।

রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতায় যত পরিবর্তন সেগুলোর সবটাই ইতিবাচক। কিন্তু সেখানকার সাংবাদিকরা পেশাগত দক্ষতার দিক দিয়ে রাজধানীর বাইরেরই থেকে গেছেন। ছাপার মধ্যমে যেমন অগণিত ভালো রিপোর্টার আছেন, যারা রাজধানীর বাইরে থেকেও অনেক ভালো মর্যাদা পেয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা প্রয়াত মোনাজাত উদ্দিন, শামসুর রহমান কেবল এবং মানিক সাহার কথা উল্লে¬খ করতে পারি। যারা বেঁচে থাকতেই সংবাদিকতার স্টার ছিলেন। এঁদের মধ্যে শামসুর রহমান কেবল এবং মানিক সাহার কাজ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি । তারা তাদের কাজটুকু যত শ্রদ্ধা নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে করতেন, এত মনোযোগ দিয়ে এখন আর কাউকে সাংবাদিকতা করতে দেখি না।

কিন্তু টেলিভিশন মাধ্যমের বয়স ১০ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। এখনো আমারা এখানে একজন মোনাজাত উদ্দিন, শামসুর রহমান কেবল বা মানিক সাহার দেখা পাইনি। এই দোষ কার? এই দায় রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা যদি শুধু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের ওপর দিয়েই চালাতে চান, সেটা খুব অবিচার হবে। কারণ এই দোষ সাংবাদিকের নিজেরও। আমি অন্তত তাই মনে করি। অবশ্য আমরা যারা এই চর্চা নিয়মিত করছি, রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের সঙ্গে তারাও এই দায় এড়াতে পারি না।

আমার গত আট বছরের অভিজ্ঞতা অনুয়ায়ী, রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের যিনি ভালো স্ক্রিপ্ট লেখেন, তিনি ভালো ছবি তোলেন না। আবার যিনি ভালো ছবি তোলেন, তার স্ক্রিপ্টে তথ্যের ঘাটতি। যিনি মোটামুটি মানের ছবি তুলছেন এবং স্ক্রিপ্ট লিখছেন, তার গলার স্বর ব্যবহার যোগ্য না। কেউ কেউ এখনো ছবি তুলছেন ভাড়া করা লোক দিয়ে। যিনি ছবি তুলছেন, তিনি কখনই সংবাদের লোক নন। তার কাজ বিয়ে বাড়ির ছবি, জন্মদিনের ছবি অথবা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি তোলা। কাজেই তিনি নিউজের জন্যে যে ছবি তুলছেন, সে ছবিও হচ্ছে ওই সব অনুষ্ঠানের মত। ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে উঠছে না। এখন কোনোরকম ওইসব ছবি দিয়েই টাইম লাইনের শূন্য স্থান পূরণ করতে হচ্ছে।

আর রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারদের গলার স্বর প্রচার অনুপযোগী হওয়ার ঘাটতি মেটাচ্ছি আমরা যারা ডেস্কে কাজ করছি। সবকিছুই কাজ চালানোর মতো কাজ। এভাবে করা কোনো কাজকে ঠিক মানসম্মত বলা যায় না।

আমার এই পুরো লেখাটায় উদ্দেশ্য ওই রকম একটা জায়গা থেকে বাংলাদেশের টিভি সাংবাদিকতাকে বের করে আনা। লেখার আরেকটি উদ্দেশ্য, জেলায় জেলায় টিভি সাংবাদিকদের হাতে ক্যামেরা তুলে দেয়া। কারণ যিনি সংবাদটি ভেবেছেন, তিনি যদি ক্যামেরার ফ্রেমে চোখ রাখেন তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। সারা জীবন যে লোকটা তথ্য প্রচার বা প্রকাশের সঙ্গে কাজই করেননি, তার তোলা ছবি কখনই যে সংবাদের ছবি হয়ে উঠবে না, এ বিষয়টি আমি নিশ্চিত।

এ নিয়ে আমি এত কথা বলতাম না, যদি না রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতার কোনো সম্ভাবনা না দেখতাম। চাইলেই রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আর বর্তমান সময়টা তাদের জন্যে খুবই সহায়ক। প্রযুক্তি প্রসারের এই যুগে পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি রাজধানীর বাইরের সাংবাদিক বলে সাংবাদিকদের কোনো জাত আছে, বিশ্বাস করি না। সবাই সাংবাদিক। কাজের ধরনের কারণে কেউ রাজধানীতে কাজ করেন, আবার কেউ রাজধানীর বাইরে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমি যতদূর জানি, সেখানেও সাংবাদিকদের মধ্যে এরকম কোনো বিভাজন নেই। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও নেই। সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা অনুশীলন নিয়ে। আমাদের অনুশীলন অনুযায়ী রাজধানীতে টেলিভিশন অথবা পত্রিকায় যারা কাজ করছেন, রিপোর্টার অথবা সাব এডিটার, এরাই জাতের। আর অন্যরা বিজাতীয়। সেই শুরু থেকেই এই অনুশীলনের কারণে, আমাদের সংবাদ-সংস্কৃতিতে এই অশ্লীল ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। আর রাজধানীর বাইরে যারা কাজ করেন তারাও বিষয়টি অবলীলায় মেনে নিয়েছেন।

এছাড়া ঢাকার বাইরের সাংবাদিকতা চর্চার যে সংস্কৃতি, সেখানেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। যেমন রাজধানীর বাইরে যারা দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন, তাদের শতকরা ৯৫ জনই করেছেন শখে। অন্য আরো অনেক কারণেও করেছেন কেউ কেউ। তবে এই কারণগুলোর কোনোটিই পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা করা নয়। সাংবাদিকতাই পেশা, রাজধানীর বাইরে এরকম সাংবাদিকের সংখ্যা এখনো অনেক কম। এরা কেউ শিক্ষক, কেউ অ্যাডভোকেট কেউ এনজিওকর্মী অথবা অন্য কোনো পেশাজীবী। দিনভর চাকুরি করেন। তারপর সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে এসে করেন সাংবাদিকতা। আবার কেউ আছেন যিনি অন্য কোনো কাজ না পেয়ে সাংবাদিকতা করছেন। যাই পাওয়া যায় তাই লাভ। যে কারণে ওইভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকজন রাজধানীর বাইরের সাংবাকিতায় যোগ দেননি দীর্ঘদিন। পত্রিকাগুলোও কোনো রকম কাজ চালিয়ে নিয়েছে।

অন্যদিকে রাজধানীতে সাংবাদিকতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া তরুণ-তরুণীরা। বন্ধুদের কেউ সরকারি অথবা বিভিন্ন সওদাগরি অফিসের কর্মকর্তা, আর কেউ সাংবাদিক। সাংবাদিক হিসাবেই কর্মজীবন শুরু। তাদের এটাই করতে হয়। এর ওপর নির্ভর করে তাদের পরিবার। এটাই পেশা। তাই রাজধানীতে সাংবাদিকতা করতে হলে কাজের মান বাড়াতে হয়। পরিশ্রম করতে হয় কঠোর। নিউজরুমে যে যতবড় বন্ধুই হোন না কেন পেশাগত প্রতিযোগিতা থাকেই। সারাক্ষণই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। যে কারণে রাজধানীতে যারা সাংবাদিকতা করছেন, তাদের কাজের মান বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আর এই কাজের মানের কারণে আমাদের সাংবাদিকতার দুটি শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। যা আসলে গোটা সাংবাদিকতার জন্য ঠিক শুভ নয়।

রাজধানীর টিভি সাংবাদিকতা এবং রাজধানীর বাইরের প্রতিনিধিদের টিভি সাংবাদিকতা চর্চার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য একবারে আকাশ আর পাতালের। রাজধানীতে একটা নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে খুব ভালো ক্যামেরায় ক্যামেরাপার্সনের তোলা মাপা ছবি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন সাংবাদিকরা। আর বাইরের সাংবাদিকদের যুদ্ধ ছোট ক্যামেরায় নিজের কাঁপা হাতে তোলা ছবি নিয়ে। পার্থক্য তো থাকবেই।

রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টারকে যদি শুধু স্থান পরিবর্তন করে দেয়া হয়, তাহলে কাজের মনে একদিনেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে রাজধানীর রিপোর্টারের মতো চকচকে ঝকঝকে রিপোর্টার হয়ে উঠবেন, আমি অন্তত এ ব্যাপারে নিশ্চিত।

আমরা যদি রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতা বিকাশ না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে প্রথমেই আসে প্রযুক্তিগত অভাবের কথা। রাজধানীর বাইরের একজন সাংবাদিক প্রথমে একটি খবর পাওয়ার পর সেখানে কত দ্রুত পৌঁছাতে পারবেন, সেটা নির্ভর করে ঘটনাস্থল থেকে তিনি কত দূরে আছেন সেটির ওপর। তাছাড়া তিনি কী যানবাহন ব্যবহার করছেন, সেটির ওপরও বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল।

তারপর ধরা যাক, তিনি এলাকায় গেলেন ছবি তুলতে। তার ফিরে আসার বিষয়টিও নির্ভর করবে ওই স্থানের দূরত্বের ওপর। যাহোক তিনি ঘটনাস্থলে গেলেন, ছবি তুললেন এবং তার নিজের কার্যালয়ে ফিরলেন। এবার ছবি পাঠাতে হবে। এখন প্রয়োজন ইন্টারনেট। ইন্টারনেট সার্ভিস এখন সব জেলায় থাকলেও সবার গতি সমান নয়। ছবি নিজের মতো করে সম্পাদনা করে পাঠিয়েছেন, কিন্তু কখন সেটি অফিসে পৌছাবে, কিংবা আদৌ পৌঁছাবে কি না সেটি নির্ভর করে অনেকটা ভাগ্যের ওপর।

যাহোক, হয়তো সব প্রযুক্তিগত বাধা পেরিয়ে সেটি অফিসে অফিসে পৌঁছাল। এর পরের সমস্যা আমলাতান্ত্রিক। প্রথম প্রশ্ন, ছবি পাঠানোর পর সংশ্লি¬ষ্ট নিউজরুম এডিটর নিউজটি দেখছেন কি না। হয়তো দেখলেন, কিন্তু প্রচার করলেন না অথবা প্রচার করতে পারলেন না। একজন রিপোর্টারের সারা দিনের কাজ বরবাদ হয়ে গেল।

রিপোর্টার এলাকায় গেছেন, তার পরিচয় দিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। এলাকার লোকদের বলেও এসেছেন, “আজ অমুক সময় আপনাদের এই ছবিটি দেখানো হবে।” কিন্তু ছবিটি প্রচারিত হলো না। আমরা রাজধানীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বিষয়টি জানলামও না। কিন্তু এলাকার লোকজনের কাছে ছোট হয়ে গেলেন ওই সাংবাদিক।

অবশ্য ওই একটি সংবাদ নানা কারণে প্রচারিত না হতে পারে। এর কোনো কোনো কারণ হয়তো যৌক্তিক। তাই সমস্যা এড়াতে আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের সবসময় বলি, বার্তাকক্ষের সঙ্গে কথা না বলে কোনো সংবাদের পিছনে ছুটবেন না।

সমস্যা আরো আছে, আমরা রাজধানীতে ডেস্কে যারা কাজ করি, তারা খুব দ্রুত নিজেদের সুপ্রিম ভাবতে শুরু করি। আমি দেখেছি, দু্ই মাস কাজ করেই অনেকে ১৫ বছরের পুরানো রিপোর্টাররের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, তা কোনো রকম সভ্যতার ধারকাছ দিয়েও যায় না। সমস্যা আসলে প্রতি পদে পদে।

রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতা এগিয়ে নিতে সাংবাদিকদের রীতিমতো বিনিয়োগ করতে হয়। ছবি তোলার ক্যামেরাটি কিনতে হয়। তোলা ছবি অফিসের পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। নিজস্ব কম্পিউটার থাকলে ভালো, না থাকলে এর জন্যে টাকা গুনতে হয়। আর নিজস্ব কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হলে বিনিয়োগ করতে হয় আরো বেশি। সাংবাদিকদের ছবি তুলতে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। টিভি সাংবাদিকতা একা করা যায় না। যখন তিনি নিজে কোনো খবরের ছবি তুলতে যান, তখন সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় বুম ধরার জন্যে হলেও কাউকে সঙ্গে রাখতে হয়। সব মিলিয়ে বেশ খরচ। এখন অবশ্য বেশিরভাগ সাংবাদিকের নিজের ক্যামেরা থাকায় খরচ কিছুটা কমে এসেছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা ক্যামেরা ভাড়া করে কাজ করতেন।

যাহোক, এই খরচা করে তিনি যে খরবটি পাঠালেন, তা যদি প্রচারিত হয় তাহলে বিল পাবেন। আমি যতদূর জানি, ঢাকা শহরের প্রায় সব টেলিভিশন একটি রিপোর্টের জন্যে যা বিল দেন তা তার মোট খরচের অর্ধেক। তাও নিয়মিত নয়। একজন রাজধানীর বাইরের রিপোর্টার এ মাসের বিল পাবেন অন্তত ছয় মাস পর। এতকিছুর পরেও তারা বেতন পান রাজাধানীর সাংবাদিকদের চার ভাগের একভাগ। অথচ তাকে একাধারে কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অপরাধ ও খেলার রিপোর্ট করতে হচ্ছে। তার কোনো বিট নেই।

এখন কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা কাজ করছেন কীভাবে? এর উত্তর হচ্ছে, তারা আসলে এক ধরনের ‘সিন্ডিকেটেড জার্নালিজম’ করছেন। গত পাঁচ/সাত বছর টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকায় রিপোর্টারের সংখ্যা বেড়েছে। এখন কোনো স্পটে যেতে হলে সবাই একসঙ্গে যেতে পারছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ক্যামেরার তোলা ছবিই সবাই ব্যবহার করছেন। সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয়ার ফলে খরচও কমে যাচ্ছে।

কিন্তু এতে সমস্যা হলো, ছবির মান বাড়ছে না। সব টেলিভিশনে আমরা দেখছি একই ছবি। ‘সিন্ডিকেটেড জার্নালিজমে’ হয়তো কাজ চালিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু এখানে রিপোর্টারের বিশেষত্ব বলে কিছু থাকে না।

এতো গেল রাজধানীর বাইরের টিভি সংবাদের সাধারণ কিছু সমস্যার কথা, রাজধানীর বাইরে সাংবাদিকতা চর্চার বাধা-বিপত্তির কথা। এবার বলতে চাই, ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের কিছু ভুল চর্চার কথা।

টানা আট বছর তিনটি টেলিভিশনের ন্যাশনাল ডেস্কে কাজ করার পর আমি কিছু ‘সার্বজনীন সমস্যা’ চিহ্নিত করেছি। এই সমস্যাগুলো ঢাকার বাইরের বেশিরভাগ টেলিভিশন সাংবাদিকের থাকে। এগুলো দূর করা খুব জটিল কাজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো একটি কাজ করলে অথবা না করলেই সমস্যাগুলো দূর হবে। অভ্যেস বদলাতে হবে শুধু। আমি মনে করি, এই সমস্যাগুলো না থাকলে রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতার দূরত্ব কমে যাবে প্রায় ষাট ভাগ।

টেলিভিশন সাংবাদিকতা আসলে তিনটি উপাদানের সমন্বয়। প্রথমটি হচ্ছে তথ্য, দ্বিতীয়টি ছবি এবং তৃতীয়টি উপস্থাপন। রাজধানীর বাইরে থেকে পাঠানো সংবাদগুলোতে এই তিনটি শাখায়ই ভয়বহ সব সমস্যা থাকে। ডেস্কের লোকজনের কাজই মূলত তাদের পাঠানো সংবাদের ঘাটতিগুলো পূরণ করা। আমি একেবারে নিজের মতো করে ওই ৩টি শাখার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছি। অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন।

১.পত্রিকার মতো করে সংবাদ পাঠানো।
আবারো বলছি, রাজধানীর বাইরের বেশিরভাগ টেলিভিশন সাংবাদিক বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তাই তারা টেলিভিশনের জন্য আলাদা করে লেখেন না। পত্রিকায় যে কপিটি পাঠান, ওই কপিটি টেলিভিশনে ফ্যাক্স অথবা ইমেইল করার সংস্কৃতি এখনো রয়ে গেছে। একটি ঘটনার জন্য তিনি যে সংবাদটি পত্রিকায় পাঠান সেটি ৪০০ থেকে ৬০০ শব্দের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। অথচ টেলিভিশনে ওই সংবাদটি প্রচার হয় ৩০ থেকে ৪০ শব্দের মধ্যে। এখন এই ৬০০ শব্দের একটি কপি থেকে ৪০ শব্দ বের করার কাজটি খুবই দুরুহ। তাই খুব জরুরি না হলে বার্তাসম্পাদক খবরটি দিতেই চাইবেন না। রাজধানীর বাইরের নিউজ যেসব কারণে প্রচার হয় না সেগুলির মধ্যে এই কারণটি অন্যতম। তাই টেলিভিশনের স্ক্রিপ্ট লেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যে তথ্যটি না দিলেই নয়, সেই তথ্যটিই টেলিভিশন সংবাদে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে সংবাদ তৈরির ‘ষড় ক’ (ফাইভ ডবলিউ ওয়ান এইচ) পদ্ধতি। সবচেয়ে সুখের বিষয় গত কয়েক বছরে টেলিভিশন সংবাদের একটি কাঠামোগত ভাষা তৈরি হয়েছে। এখন শুধু কাঠামো অনুসরণ করলেই হবে।

২.দেরি করে সংবাদ পাঠানো।
টেলিভিশন হচ্ছে তাৎক্ষণিক সাংবাদিকতার মাধ্যম। এই মুহূর্তে যে ঘটনাটি ঘটলো সেটি এই মুহুর্তেই প্রচার করতে হবে। এখন যে টেলিভিশন যত দ্রুত একটি সংবাদ প্রচার করতে পারে, বুঝতে হবে ওই টেলিভিশনের নিউজ তত বেশি কার্যকর। বাংলাদেশে এখন ২৫টি টেলিভিশন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এখন প্রতিযোগিতা, কারা কত দ্রুত নিউজ প্রচার করতে পারছে। আর দ্রুত নিউজ প্রচার করার প্রধান শর্ত হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলটিকে তার রিপোর্টারের কাছ থেকে দ্রুত সংবাদটি পেতে হবে। সুতরাং এখন নিউজ পাঠাতে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। যখনই ঘটনা তখনই পাঠাতে হবে। যেটুকু জানা যায়, সেটুকু পাঠাতে হবে। পরে আবার পাঠাতে হবে। নিউজ পাঠাতেই থাকতে হবে ঘটনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এটাই টেলিভিশন সাংবাদিকতা। এ নিয়ে আমার অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। দেখা গেল, ঢাকায় বসে অন্য কোনো সোর্সে খবর পেয়ে সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আমার রিপোর্টারকে ফোন করছি। দেখলাম, তিনি ঘটনাটি তখনো জানেন না। আমার কাছেই প্রথম শুনলেন। আবার সেই পুরানো দিনের পত্রিকা স্টাইল, ‘সন্ধ্যার পরে একটি ফ্যাক্স করলেই হবে।’ অবশ্য এই সমস্যা সবার নয়, কারো কারো। অনেকেই ভালো কাজ করেন, যখনকার ঘটনা তখনই জানান। তাদেরই করো কারো অভিযোগ আছে, সময়মতো নিউজটি দেয়ার পরেও প্রচারিত হয় না। অন্য টেলিভিশনে তার পরে পাঠিয়েও প্রচারিত হয়ে গেছে। টেলিভিশন সাংবাদিকতা সবসময় তাৎক্ষণিক। আপনি যত দ্রুত পাঠাতে পারবেন তত ভালো। প্রতিযোগিতা তো। দেখা গেল, আপনি একটা নিউজ দিতে পারলেন না। আপনার পরবর্তী সংবাদ আরো দুই ঘণ্টা পর। আপনার কাছে তথ্য আছে, কিন্তু আপনি সেটি প্রচার করতে পারছেন না। কিন্তু এর মধ্যে অন্যসব টেলিভিশন খবরটি প্রচার করে বাসি করে ফেলবে। অর্থাৎদুই ঘণ্টা পেছানো মানে, কোনো কোনো সময় নিউজটি প্রচার অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।

৩. তথ্য আছে, ছবি নেই।
বাংলাদেশের একেকটি জেলায় বহু দূর্গম উপজেলা রয়েছে। এমন উপজেলাও আছে যেখান থেকে জেলা সদরে যাওয়ার চেয়ে ঢাকা যাওয়া সহজ। টেলিভিশনগুলো সাধারণত জেলার বাইরে লোক নেয় না। জেলার লোকদেরই উপজেলায় যেতে হয়। এমন উপজেলা আছে, যেখানে জেলা সদর থেকে যেতে যেতে দিন পার। তার পর সেখান থেকে জেলায় ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। অথবা রিপোর্টার খবরের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘটনা শেষ। তখন হয়তো আর ধরার মতো ছবি নেই। অথবা ছবি ধরার মতো আলো নেই। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ছবি পাঠানো সম্ভব হয় না। পরে খবরের গুরুত্বের কারণে ছবি ছাড়াই খবরটি পাঠাতে হয়। আর নিউজটি প্রচারিত হয় গ্র্যাফিক্স দিয়ে। কিন্তু ছবির গণমাধ্যমে ছবি তো থাকতেই হবে। ছবি ছাড়া টিভি মিডিয়ার কাজ বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। দিন যত যাবে, খবরের সঙ্গে সঙ্গে ছবির গুরুত্ব আরো বাড়বে। আধুনিক টিভি সাংবাদিকতায় পর্দায় একই ছবি কখনো টানা ২০ সেকেন্ডের বেশি ব্যাকরণসম্মত নয়। অবশ্য আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন দিনের ছবি দিনে দেখাতে পারলেই মনে করা হতো সাফল্যের সঙ্গে নিউজটি প্রচার হয়েছে। এর আগে কখনো গ্র্যাফিক্স কখনো টিকার আর কখনো বা শুধু সংবাদপাঠকের মুখ দিয়ে পড়িয়ে খবরটি ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু প্রযুক্তি যত এগিয়েছে ছবি ও তথ্য তত কাছে এসেছে। এখন তারা অনেক কাছাকাছি। আমি আশা করছি, ভবিষ্যতে এই দূরত্ব আরো কমে আসবে। হয়তো উপজেলায় সাংবাদিক নিয়োগ দেবে টেলিভিশনগুলো। আমি আমার রিপোর্টারদের সবসময় ছবি আর তথ্যের দূরত্ব কমাতে ব্যক্তিগত আর্কাইভ সমৃদ্ধ করতে বলি। যদি অন্য সময়ে তোলা ওই এলাকার ছবি হাতে থাকে তাহলে যখন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সেই ছবিটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একঘেঁয়েমি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যায়। শুধু ছবিটি ব্যবহারের সময় সেটি কখন তোলা, সে কথাটি একটি ব্যান্ডে লিখে ছবির সঙ্গে প্রচার করলেই হবে।

৪. ছবি আছে তথ্য নেই।
এটি ঢাকার বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ সংবাদের এটি একটি সাধারণ সমস্যা। ছবি আছে হয়তো অনেক, কিন্তু দেখা যাচ্ছে গল্পে ব্যবহার করার মতো ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ গল্পের ছবি কী হবে, ছবি পাঠানোর সময় তা ভাবেননি রিপোর্টার। হয়তো তথ্যের সঙ্গে ছবির কোনো মিল নেই। অথবা যে ছবি আছে তা ব্যবহার করতে কোনো গল্পই পাওয়া যাচ্ছে না। একবার উত্তরাঞ্চলের কোনো এক একটি চরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে একটি সংবাদ পেলাম। পাণ্ডুলিপি দেখে আমি যথেষ্ট আগ্রহী হলাম রিপোর্টটি করার জন্যে। কিন্তু সম্পাদনা টেবিলে যাওয়ার পর পুরো আগ্রহটাই মিইয়ে গেল। কারণ রিপোর্টার শুধু কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং ভক্সপপ রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন আমি কী করব? কীভাবে আমার গল্পে সাক্ষাৎকার গুলোকে জোড়া দেবো? কোনো সুযোগ যখন পেলাম না, তখন রিপোর্টটি বাদ দিতে হলো। বহু খেলার খবর পেয়েছি, যেখানে খেলার ছবি আছে। আর তথ্য আছে- কে কে খেলার উদ্বোধন করেছেন এবং খেলা শেষের অনুষ্ঠানে কে পুরস্কার বিতরণ করেছেন। কিন্তু ৪০০ শব্দের গোটা পাণ্ডুলিপিতে কোথাও খেলার ফলাফল নেই।

৫. ছবি আছে অনেক বেশি।
এবারের সমস্যাটা একেবারে আগেরটার উল্টো। রিপোর্টার ছবি তুলেছেন ক্যামেরা ভর্তি করে। একটা দেড় মিনিটের রিপোর্টের জন্যে ছবি তুলেছেন পুরো ৩০ মিনিটের। ছবি যদি টেপে থাকে, তাহলে ছবিটি সম্পাদনার জন্যে কম্পিউটারে নিতেই (ডিজিটাইজ) ৩০ মিনিট সময় লাগবে। সব মিলিয়ে রিপোর্টটি বানাতে সময় দরকার হবে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট। কিন্তু এত সময় নেই বর্তমান টিভি মিডিয়ায়। এখানে যতটুকু দরকার ততটুকু পাঠাতে হবে। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে নিলে সুবিধা হয়, যেটি এই লেখাতে আগেও বলেছি। সেটি হচ্ছে, ঢাকার বাইরে এখন যিনি ক্যামেরা চালান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিই রিপোর্টার। তবে ক্যামেরা চালানোর কাজটি বিশ্বব্যাপী একটি পেশাদার কাজ। এর অনেক খুঁটিনাটি দিক আছে যা না জেনে কাজটি করা ঠিক না। উপায় না থাকার কারনে যখন কোনো রকমে কাজটি করা হয় তখন ছবিও হয় সেরকম। দর্শক হয়তো কিছু দেখলো, কিন্তু সেটি ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে উঠলো না। আবার ক্যামেরা যদি অন্য কেউও চালান, সেক্ষেত্রে আরো সমস্যা থাকে। যেমন রাজধানীর বাইরে যিনি বা যারা ক্যামেরা চালান তারা সংবাদের ক্যামেরাম্যান নন। যে কারণে তার তোলা ছবি, ছবি হলেও ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে ওঠে না। এর জন্য দরকার প্রশিক্ষণ। কোনোরকম নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকরা। কিন্তু এখন অনেক প্রতিযোগিতা। টিআরপির বিষয় আছে। দর্শকদের হাতে আছে রিমোর্ট কন্ট্রোল। এখন তারা অনেক বোঝে। ভালো ছবি এবং খারাপ ছবির পার্থক্য ধরতে পারে । সুতরাং যেনতেন প্রক্রিয়ায় কাজ করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়।

৬. উপস্থাপন সমস্যা।
টিভি সাংবাদিকতায় বলার গুরুত্ব অনেক। ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হলে অনেক সময় তা ফোনে জানাতে হয় তার দর্শকদের। তাছাড়া নিজের রিপোর্ট নিজে বলাটাই সংবাদসম্মত। তাই টিভি স্ক্রিপ্ট বলার জন্য শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলাটা জরুরি। আমাদের দেশের আঞ্চলিকতার প্রভাবের কারণে উচ্চারণে সমস্যা থাকে সাংবাদিকদের। উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে নিয়মিত চর্চার উপর। এই চর্চা সবার থাকে না। এটা দোষেরও নয়। চর্চা করতে গেলে শুরুতেই রিপোর্টারকে নানান সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এটা কাটিয়ে ওঠার বিকল্প নেই। এই সমস্যা থাকলে রিপোর্টারের হয়ে কণ্ঠ দিয়ে দেন আরেকজন। কিন্তু একসময় নিজের রিপোর্ট নিজেই করতে হবে। কারণ যার রিপোর্ট , তিনি রিপোর্টে কণ্ঠ না দিলে অনেক সমস্যা হয়। যার রিপোর্ট তার কণ্ঠে রিপোর্টটি যত তীক্ষ্ন, অন্যের কণ্ঠে তা কমে যায় অর্ধেক। যিনি কণ্ঠ দেন, তিনি ঘটনাস্থলে যান না। পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন মাত্র। তিনি কখনই পুরোটা ধারণ করতে পারবেন না। তাই ঘটনাস্থলে না গেলে গোটা পরিস্থিতি অন্যের কণ্ঠে আসে না। এছাড়া কখনো কখনো রিপোর্টের প্রয়োজনে রিপোর্টারের পর্দায় আসা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু যার ভয়েস ব্যবহার যোগ্য না, তার পক্ষে পর্দায় আসাও অসম্ভব। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট কখনো কখনো গুরুত্বহীন হয়ে যায়। অথবা সম্পাদক যেভাবে রিপোর্টটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন সেভাবে পারেন না। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত থাকেন ভয়েস দিতে না পারা রিপোর্টারের ওপর। তাই সংবাদ সংগ্রহ এবং ভালোভাবে লেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোভাবে সংবাদটি বলতে পারাটা টিভি সাংবাদিকদের অতিরিক্ত যোগ্যতা।

৭. ঘটনার গভীরে না যাওয়া।
এই সমস্যাটি অবশ্য আমাদের গোটা টিভি সাংবাদিকতার। অনেকে মনে করেন, যে তথ্যটির ছবি দেখানো সম্ভব সেই তথ্যটিই শুধু প্রকাশ করা হবে। ছবি না থাকলে তথ্যটি অপ্রকাশিত থাকবে। আমি মনে করি, এটা এক ধরনের ফাঁকিবাজি। যেকোনো ঘটনা প্রতিষ্ঠা করতে যে ছবি দরকার তা রিপোর্টারকে যোগাড় করতে হবে। তা সে যেভাবেই হোক। প্রথমেই রিপোর্টারকে রিপোর্টটি ভাবতেই হবে ছবিসহ। কোনো সময় যদি ছবি না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ব্যবহার করতে হবে। আর যে ঘটনার ছবি হয় না বা ইতিহাসভিত্তিক তথ্য অথবা তথ্যটি দৃশ্যমান নয়, সেক্ষেত্রে তথ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এমন কোনো ছবি ব্যবহার করতে হবে। আর একেবারেই কিছু না পাওয়া গেলে, ব্যাকারণ হচ্ছে, রিপোর্টার নিজেই পর্দায় চলে আসবেন এবং তথ্যের বর্ণনা ক্যামেরায় রেকর্ড করবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, রিপোর্টারকে ভাষা ব্যাবহারে কৌশলী হতে হবে। ভাষা ব্যাবহারে মুন্সিয়ানা থাকলে তিনি যেকোনো তথ্য ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারবেন। এটিই মূলত রিপোর্টারের কাজ। সাধারণ মানুষের বর্ণনার সঙ্গে রিপোর্টারের বর্ণনার পার্থক্য এখানেই। ভাসাভাসা কোনো রিপোর্ট করে লাভ নেই। ছবি না থাকার দোহাই দিয়ে কোনো তথ্য রিপোর্ট থেকে বাদ দেয়াটা ঠিক সাংবাদিকতা নয়। সিনেমা, নাটক,আর টিভি সাংবাদিকতার পার্থক্য এখানেই। যেকোনো পদ্ধতিতে আমাকে ঘটনার ভেতরে ঢুকতে হবে। পড়াশোনা থাকতে হবে সাংবাদিকদের। থাকতে হবে নিজস্ব লাইব্রেরি ও আর্কাইভ। যেন প্রয়োজন হলেই যে কোন তথ্য যোগাড় করা যেতে পারে। একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সাংবাকিতার নিয়ম কানুন হয়তো শেখানো যায়। কিন্তু কাউকে সাংবাদিকতার মুন্সিয়ানা শেখানো যায় না। এটা রিপোর্টারের নিজস্ব। এই মুন্সিয়ানায় যে রিপোর্টার যত পারদর্শী সেই তত দক্ষ সাংবাদিক। সাংবাদিকদের কাজের মান নির্ধারণের যায়গা মূলত এটাই।

৮. ফলোআপ হচ্ছে না।
এই সমস্যাটিও আমাদের গোটা সাংবাদিকতার। অবশ্য ছাপার মাধ্যমেও এই সমস্যা আছে। কোনো একটি ঘটনা ঘটলো, অথবা কোনো সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করা হলো। পরে রিপোর্টার সে ব্যাপারে খোঁজই নিলেন না। ভাবখানা যেন এমন, ‘রিপোর্টটি প্রচার বা প্রকাশ হওয়ার পর পরই সাংবাদিকদের দায়িত্ব শেষ’। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ফলোআপ হচ্ছে না তা নয়। ভালো বার্তাসম্পাদকের অধীনে কাজ করলে নিশ্চই হয়। কিন্তু সে হার খুবই কম। টিভি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তো একবারেই কম। ধরা যাক, রিপোর্ট প্রচারিত হলো ‘একটি সেতুর কারণে জনসাধারনের দুর্ভোগ’ বিষয়ক। রিপোর্টটি প্রচারের পর হয়তো সেতু সংস্কার হলো। দুর্ভোগ কমলো জনসাধারণের। অথবা সেতুটি সংস্কারই হলো না। কিন্তু রিপোর্টার আর খবর নিলেন না। অথচ এখানে খবর নিলে অবশ্যই একটি প্রচার যোগ্য খবর হতে পারে। যেকোনো একটি ঘটনাই তো ঘটবে। হয় সেতুটি সংস্কার হবে, নয়তো হবে না। সংস্কার হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আর না হলে বারবার রিপোর্ট করার পরেও সেতুটি সংস্কার না হওয়ার বিষয়টি ছাপা বা প্রচার যোগ্য। কিন্তু আমাদের রাজধানীর বাইরের বন্ধুদের ফলোআপের ব্যাপারে আগ্রহ কম। কিন্তু আমি মনে করি, এটি কোনো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়। অবশ্য অনেকে পজিটিভ সাংবাদিকতা করাটাকে নেগেটিভভাবেই দেখে। কিন্তু খবর সবসময় কষ্টের, সমস্যার, অপরাধের হতে হবে এমনটি কিন্তু কোথাও বলা নেই। যেকোনো আনন্দের ঘটনাও অনেক গুরুত্বসহ প্রচারিত হতে পারে। হয়ও। আর ফলোআপের ফলাফল যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে তো সেটি ফলোআপ না করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কারণ সংবাদটি যতবার ফলোআপ হবে, আমি নিশ্চিত যে, সমস্যাটি সমাধানের দিকে একধাপ করে এগোবে।

৯. সাক্ষাৎকার নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা।
সাক্ষাৎকার নেয়া টিভি সাংবাদিকতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদে রিপোর্টার যে তথ্য দেন, সেই তথ্যকে সমর্থন করে সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার কখনো ভক্সপপ, কখনো সিংক নামে ব্যবহৃত হয় রিপোর্টে। সাংবাদিকতার নিয়মানুযায়ী, যে তথ্য কেউ সমর্থন করে না তা আসলে রিপোর্টারের নিজস্ব মতামত। রিপোর্টার কখনো তার নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেন না। তার কাজ মানুষের কথা প্রচার করা। এতেই বোঝা যায়, সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। আর টিভি সাংবাদিকতায় তো আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে সংবাদটি প্রচার না করলেই নয় সেটিই কেবল সাক্ষাৎকার ছাড়া প্রচার করা হয়। কিন্তু রাজধানীর বাইরে থেকে আসা সংবাদগুলোতে এই সাক্ষাৎকারটি থাকে খুবই আগোছালো অবস্থায়।

প্রথমত, প্রয়োজনীয় সাক্ষাতকার থাকে না। দ্বিতীয়ত, যে তথ্যটি সমর্থন করা উচিত সাক্ষাতকারে সেটি সমর্থন করা হচ্ছে না। সাক্ষাৎকার যিনি দিচ্ছেন তিনি কথা বলছেন ভিন্ন প্রসঙ্গে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তিনি যা বলছেন তার সবই অপ্রয়োজনীয়। আর কথা যদি থাকেও, তাহলে এত বেশি থাকে যে প্রয়োজনীয় কথাটি খুঁজতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। রিপোর্ট তৈরির সময় সেটি খুঁজেই পাওয়া যায় না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যখন রিপোর্টার সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় নিজে ফ্রেমে থাকার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো খুবই নির্লজ্জভাবেই তিনি কাজটি করেন। যেটি পর্দায় খুবই হাস্যকর। এরকম থার্ডক্লাস ফ্রেমের কারণে আমি এ পর্যন্ত কত সংবাদ ফেলে দিয়েছি গুণে শেষ করা যাবে না। আবার কখনো কখনো রিপোর্টার তার চ্যানেলের লোগোসহ মাইক্রোফোনটি দিয়ে দিচ্ছেন যিনি সাক্ষাতকার দিচ্ছেন তার হাতে। আর মাইক্রোফোন হাতে পেয়েই তিনি লম্বা একটা বক্তৃতা ঝাড়লেন। যেটি আসলে কোনো কাজেই লাগলো না। রিপোর্টারকে বুঝতে হবে, এই লোগো হাতে নিয়ে কথা বলার অধিকার একমাত্র তারই। এটিই রিপোর্টারের পরিচয়।

আসলে টিভি সাক্ষাৎকারটি হওয়া উচিত খুবই মার্জিত। আর এজন্যে শুধু রিপোর্টারের কয়েকটি কৌশল জানা থাকাই যথেষ্ট। রিপোর্টারের দক্ষতা এখানে মুখ্য বিষয়। তার কৌশলী প্রশ্নেই সাক্ষাৎকার দাতার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে প্রয়োজনীয় কথা, সে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার সময়ই পাবেন না তিনি। এক্ষেত্রে মৌলিক যে নিয়মটি মানা হয় সেটি হচ্ছে, সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যার উত্তর ‘হ্যা’অথবা ‘না’তে দেয়া যায়। তবে সবচেয়ে মুখ্য বিষয়, সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে যে রিপোর্টার যত প্রস্তুতি নেন, তার নেয়া সাক্ষাতকারগুলো তত ভাল হয়। আর তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার বা সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া বা ভক্সপপ রেকর্ডের বিষয়টি নির্ভর করে রিপোর্টারের উপস্থিত বুদ্ধির ওপর। তবে ভক্সপপ কখনো শিখিয়ে দেয়া উচিত নয়। শেখানো কথা ক্যামেরার বললেই বোঝা যায়। সবচেয়ে সমস্যা হয় যদি শিশুদের ভক্সপপ নেয়ার আগে কী বলতে হবে, শিখিয়ে দেয়া হয়।

১০. গতানুগতিক কিছু ভুল।
এছাড়াও সাংবাদিকতা চর্চার সংস্কৃতির কারণে রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকরা গতানুগতিক কিছু ভুল করেন। যেগুলো না করলে কোনো সমস্যা নেই। যেমন নদীভাঙনের রিপোর্টের ছবিতে ‘নদীর পাড়ে একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার মুখে হাত দিয়ে বসে থাকার ছবি থাকবেই। ভাঙনের আরেকটি কমন ছবি হচ্ছে ‘মাটির বড় একটি চাঁই বিকট শব্দ করে নদীতে পড়ছে’। ছবিগুলো যে বানানো তা কোনো প্রমাণ না থাকলেও বোঝা যায়। আমি নিজে ভাঙনের রিপোর্টে করতে গিয়ে দেখেছি, বড় মাটির চাঁই নদীতে পড়ছে, কিন্তু ক্যামেরাপার্সনের অসাবধানতার কারণে ফ্রেম সরে গেল, দেখা গেল ওপাশ থেকে আরেকজন বড় বাঁশ দিয়ে মাটির ফাটলে ধাক্কা দিচ্ছে। বন্যার ছবিতে দেখা যাবে ‘বুক পানিতে নেমে এক কিশোর অথবা কিশোরী খাবার নিয়ে আসছে’। আমার মনে হয় না, এই বানানো সাংবাদিকতার দরকার আছে। তাহলে আপনি যখন সত্যিই মুন্সীগঞ্জের হাসাইল বানারিতে গিয়ে ছবি তুলবেন, দেখবেন সারাক্ষণ মাটির বড় চাঁই নদীতে পড়ছে, সে ছবিও দর্শকরা বানানো মনে করবে। এরকম আরো কিছু গতানুগতিক ভুল আছে রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের।

মোদ্দাকথা, টিভি সাংবাদিকতা, সর্বোচ্চ আধুনিক সাংবাদিকতা। এখানে পুরোনো ধ্যান-ধারণা ভাঙার চেষ্টাই হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতার সম্ভাবনা
সমস্যা ছিল, সমস্যা আছে এবং সমস্যা থাকবে। কিন্ত রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতা থেমে থাকবে না। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক এগিয়েছে। সেই শুরু হয়েছিল কোনো ছবি না দেখিয়ে ছবির সাংবাদিকতা দিয়ে। আর এখন বহু জেলা থেকে রিপোর্টাররা ভয়েস দিয়ে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। এবং তা প্রচারিত হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বাইরের টিভি সাংবাদিকরা ফোনে রিপোর্ট দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ সরাসরি অনলাইন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন । কিন্তু এত জল্পনা-কল্পনা তখনই, যখন তাদের তুলনা করা হচ্ছে ঢাকার রিপোর্টারদের সঙ্গে। একটি নিউজরুমে সবসময় কাজ আর কাজ। প্রচণ্ড ব্যস্ততা। এর মধ্যে নিউজ এডিটরদের ধমক শুনতে শুনতে কাজ করতে হচ্ছে রাজধানীর রিপোর্টারদের। ঢাকায় কোনো নতুন টিভি রিপোর্টারের নিয়তি হচ্ছে, ‘এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে কেউ হয় কাজ শেখো না হলে ঝরে যাও’। রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারদের প্রেক্ষাপট তো সেরকম নয়। যে কারণে একটি টিভি চ্যানেলের নিউজরুমে যতগুলা দক্ষ রিপোর্টার থাকে, রাজধানীর বাইরে এত বেশি দক্ষ রিপোর্টার থাকে না। কিন্তু এর মধ্য থেকেই কাজ হচ্ছে। সারাদেশে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন চ্যানেলের অন্তত ২০ জন টিভি রিপোর্টারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যাদের আজই ঢাকায় নিয়ে আসলে আজই কাজ করতে পারবে। অন্যরাও যে পারবে না তা নয়। তারা একটু সময় নিয়ে হলেও পারবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এখন যারা রাজধানীর বাইরে কাজ করেন তাদের ঢাকায় এনে তিন মাস কাজ করালে যে কেউ ঢাকার রিপোর্টারের সমমানের কাজ করবেন। আর এই তিন মাসের সুযোগ পান রাজধানীর সবাই। প্রথম কোনা টিভিতে কাজ করতে আসলে রাজধানীর আজকের দক্ষ রিপোর্টার, নিউজরুম এডিটর, এমনকি নিউজ এডিটররাও এই সুযোগ পান।


এরই মধ্যে প্রযুক্তির কারণে অনেক বদলে গেছে আমাদের টিভি সাংবাদিকতা। এখন ঢাকার বাইরের অনেক রিপোর্টার কোনো বিশেষ রিপোর্ট করতে হলে শুরুতেই বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশনা নেন। পরে সে অনুযায়ী ছবি তোলেন, সাক্ষাৎকার, ভক্সপপ রেকর্ড করেন। তারপর স্ক্রিপ্ট লেখেন। মেইল করেন বিভাগীয় প্রধানকে। বিভাগীয় প্রধান তার স্ক্রিপটি সম্পাদনা করে আবার তাকে মেইল করেন। এরপর ওই স্ক্রিপ্টে তিনি ভয়েস দেন। ছবি ভয়েস সাক্ষাৎকার ভক্সপপ সব মিলেয়ে তিনি আবার নিউজ এডিটরের বরাবরে পাঠান।

ছবি পাঠাতে এখন রিপোর্টার বেশিরভাগ সময় ই-মেইল ব্যবহার করেন। এই ই- মেইলে পাঠানোর প্রক্রিয়াটিও দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে জেনারেল মেইল, অন্যটি এফটিপি অথবা ফাইল ট্রান্সফার প্রটোকল। আমি এই প্রযুক্তিগত বিষয়টি জানি না। তবে সাদা চোখে এফটিপি হচ্ছে একটি ভাড়া করা ইন্টারনেট পথ। যিনি ওই পথটি ভাড়া করেছেন, তিনি ছাড়া ওই পথে বৈধভাবে কেউ হাঁটতে পারবেন না। তবে রাজধানীর বাইরের রিপোর্টাররা ভিডিও টেপ পাঠাতে এখনো কুরিয়ার বা পোস্ট অফিস ব্যবহার করেন। যে টেপটিতে প্রথম কিছু রেকর্ড করা হয় সেটিকে বলা হয় মাস্টার টেপ। যে রিপোর্টের ছবির মান খুব ভালো হতে হবে, সে রিপোর্টের ক্ষেত্রে এখনো মাস্টার টেপের বিকল্প নেই। যে কারণে প্রযুক্তি যতই আসুক , মাস্টার টেপের আবেদন কখনো শেষ হবে না।

এতো গেলো বিশেষ রিপোর্টের চিত্র। কিন্তু রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টার প্রতিদিন আরো অনেক কাজ করেন। কোনো ঘটনা ঘটলেই মোবাইলের কল্যাণে সেটি নিউজরুমে পৌঁছৈ দেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রচার হয় টিকার বা স্ক্রলে। তার পর আস্তে আস্ত নিউজটি ডেভেলপড হতে থাকে। প্রথমবার নিউটি প্রচারিত হতে হতে আসে ছবি। ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী ওই সংবাদের মান নির্ধারণ করেন বার্তা সম্পাদক। তারপর সিদ্ধান্ত নেন, এই খবরটি কোন মানে প্রচার করা উচিত। সে অনুযায়ী কোনো রিপোর্ট দিনভর প্রচার হয়, কোনো রিপোর্ট দু-একবার প্রচার হওয়ার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর বাইরের টিভি নিউজ এভাবে গতি পায় এবং পাচ্ছে।


সাংবাদিকতার সঙ্গে উন্নয়ন যতটুকু জড়িত তার বেশিরভাগ ইস্যুই আছে রাজধানীর বাইরে। রাজধানীর বাইরের প্রকৃত চিত্রটা দক্ষতার সঙ্গে উঠে আসলে দেশের বেশিরভাগ মৌলিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আগে একটা ভালো টিভি রিপোর্ট অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আর এই সংবাদগুলোর বেশিরভাগই আসা উচিত রাজধানীর বাইরে থেকে। রাজধানীর রিপোর্ট মানেই তো সেই অপরাধ রাজনীতি অর্থনীতি কঠিন কঠিন সব বিষয়। সব সংবাদের একই রকম ছবি। শুধু তথ্যটাই আলাদা। সংবাদের স্বার্থে এ খবর রাখতেই হবে। কিন্তু রাজধানীর বাইরের একটি ভালো সংবাদ একজন দর্শকের জন্যে যেমন বৈচিত্র্য হতে পারে, তেমনি দেশের জন্যে হতে পারে সার্বিক উন্ন্য়নের মৌলিক সূত্র।

সুপারিশ
রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতার উন্নয়নের জন্যে আমার বিছু সুপারিশ আছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে টিভি সাংবাদিকতায় ঢাকার সাংবাদিক এবং ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের তথাকথিত যে পার্থক্য তা কমে যাবে।যেমন-

১. রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের বেতন বিল নিশ্চিত করতে হবে।
রাজধানীর বাইরের প্রত্যেকটি সাংবাদিককে কী করতে হয় না। সব সংবাদের দিকে মনোযোগ তার। দিনভর ছুটছেন। এতে প্রতিদিনই তার বেশ খরচ হচ্ছে। কিন্তু মাস শেষে শুধু বেতনটাই পাচ্ছেন বেশিরভাগ টেলিভিশনের সাংবাদিকরা। বিল অনিয়মিত প্রায় সবারই। দু-একটি টেলিভিশনের বেতন নিয়ে প্রচণ্ড নাখোশ রিপোর্টাররা। এমন চ্যানেলও আছে যেখানকার সংবাদিকরা আজ থেকে ৯ বছর আগে যে বেতনে শুরু করেছিলেন, আজো সেই বেতনই পান। কেউ লজ্জায় বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করেন না।


২. আধুনিক প্রশিক্ষণ।
প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। টিভি মিডিয়া খুবই দ্রুত পরিবর্তনশীল। যখন যে পরিবর্তন আসছে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারের পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তো টিভি চ্যানেলগুলোরই। তাছাড়া ব্যাকারণসম্মত ক্যামেরা চালানো, রিপোর্ট লেখা এবং শুদ্ধ উচ্চারণে বলতে পারাটা আসলে শেখারই বিষয়। জন্মের সময় সবকিছু সবাই শিখে আসেন না। কেউ সুযোগ পেয়ে সময়মতো শেখে। আর কেউ সুযোগের অভাবে অসময়ে শেখে। শিখতে আসলে হয়ই। চলতে গেলে শিখতে হবে।

৩. মাঝেমধ্যে ঢাকায় এনে কাজ করানো।
এই কাজটি বাংলাদেশে যদিও এখনো কোন টিভি চ্যানেল করেনি, কিন্তু করা উচিত। কারণ রাজধানীর বাইরে বসে অনেক সময় নিউজরুমের সমস্যা বোঝা যায় না। ঢাকার বাইরের কোনো রিপোর্টার যদি ঢাকার একজন রিপোর্টারের সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টে যান, তাহলে উনি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারবেন কীভাবে ধাপে ধাপে কাজটি করা উচিত। অথবা উনি যদি ডেস্কেও কাজ করেন, তাহলেই বুঝবেন সমস্যাটা কোন যায়গায়। আমি নিশ্চিত, তিনি যখন এ অভিজ্ঞতা নিয়ে তার জেলার পৌঁছাবেন, তারপর থেকে নিউজরুমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে তার কোন সমস্যা হবে না।

৪. জেলায় জেলায় প্রযুক্তি চর্চার সুবিধা।
টিভি সাংবাদিকতার অর্ধেকেরই বেশি প্রযুক্তি। বাকিটা সাংবাদিকতা। এই দুটি উপাদানের প্রতিটিই এক অপরের পরিপূরক। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় থাকতেই হবে। তবে ঢাকার বাইরে এখনো মোবাইল মতো সবার হাতে কম্পিউটার পৌঁছায়নি। যে কারণে অন্তত প্রতিটি জেলা শহরে একটি সরকারি সাইবার ক্যাফে থাকা উচিত। সেখান থেকে সাংবাদিকরা যেন তার নিজের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টার সারা বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক মিডিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারবেন।

পলাশ আহসান: গণমাধ্যমকর্মী