বাংলাদেশে আধুনিক টেলিভিশন সাংবাদিকতার বয়স বছর দশেক হলো। বছর দশেক বলছি এই কারণে যে, একুশে টেলিভিশনের প্রচার শুরু হওয়ার আগে যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যে সাংবাদিকতা হতো, তা ছিল শুধু তথ্যনির্ভর। সেই তথ্যের সঙ্গে ছবি থাকলে ভালো হতো, না থাকলে তথ্য প্রচার করা হতো ছবি ছাড়াই। সেসময় ছবি ছাড়াই চলতো ছবির সাংবাদিকতা।
অবশ্য আমার এই তথ্যের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না; বিশেষ করে সেই সময় যারা টেলিভিশন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের বোঝার জন্যে বলছি, আমি একেবারে সংবাদভিত্তিক সাংবাদিকতার কথা বলছি। কারণ সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’-এর মতো কিছু তথ্যভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার হতো । যেগুলো এখনো ছবিভিত্তিক সাংবাদিকতার মাইলফলক হয়ে আছে।
যাহোক, সে সময় যিনি বা যারা টেলিভিশনের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতেন, তিনি একইসঙ্গে কাজ করতেন অন্য পত্রিকাতেও। পত্রিকায় তিনি যে সংবাদটি ফ্যাক্স করতেন, সেটিই পাঠিয়ে দিতেন টেলিভিশনে। কখনো কখনো টেলিফোনে ঘটনার বর্ণনা দিতেন। অবশ্য সেই বর্ণনা আগে থেকেই রেকর্ড করা হতো। তারপর সেটি প্রচারিত হতো সম্পাদনা করার পর। একুশে টেলিভিশন প্রচার শুরু করার পর সেই চিত্র কিছুটা বদলালো।
তখনকার প্রযুক্তিতে ভিডিও ক্যামেরাম্যানকে টানতে হতো ৩০ কেজি ওজনের ‘একখানা বস্তু’। যার নাম ক্যামেরা । আর সেই জিনিস বাইরে বের করলেই বের করতে হতো আরো ছয়/সাতজনের লট বহর। তাই ইচ্ছে থাকলেও গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত টেলিভিশন পৌঁছাতে পারতো না।
একুশে টেলিভিশনের যুগে ভিএইচএস ক্যামেরায় কাজ করতেন রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা। তাদের ছবি তুলতেন এমন একজন মানুষ , যার অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিয়ে বাড়ির ক্যামেরা চালানো। ঝাপসা হলেও সেই ছবি ঘটনার তিন/চারদিন পর সংবাদের সঙ্গে প্রচার করা হতো। তবে রাজধানীর বাইরের সংবাদে ছবি থাকতো খুবই কম।
২০০০’র পর আসলো পরিবর্তন। শুরুতে ভিএইচএস দিয়েই ব্যাপক হারে রাজধানীর বাইরের সংবাদপ্রচার শুরু হলো। ক্যামেরাম্যানদের কাজের মানও বাড়লো। দু-এক বছরের মধ্যেই হাতে চলে আসলো ডিভি ক্যামেরা। হ্যান্ডি ক্যাম। গোটা প্রযুক্তিটাই আস্তে আস্তে চলে আসলো হাতের মুঠোয়। সুন্দর ছবি, সুন্দর দৃশ্য যুক্ত হলো টেলিভিশন সাংবাদিকতায়। সুন্দরবনের পেটের ভেতরের গ্রাম গোলাখালী । সেই গ্রামের ছবিটিও মানুষ দেখতো পারলো অনায়াসেই।
বর্তমানে একযোগে ১০/১২টি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সংবাদপ্রচার শুরু হয়েছে । রাজধানীর সঙ্গে দূরত্বের জন্যে যে বিষয়টা আগে কিছুটা দূরুহ ছিল, সেটিও সহজ করে দিয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস। এখন পঞ্চগড়ের একটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো ঘটনা ঘটার ১০ মিনিটের মধ্যেই সচিত্র প্রচার করা সম্ভব।
প্রচুর কাজ হচ্ছে গ্রামগঞ্জে। জেলা প্রতিনিধিরা তো আছেনই। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায়ও প্রতিনিধি আছে টেলিভিশনগুলোর। তথ্য এখন আসলেই অবাধ। চাইলেই হাতের মুঠোয় সবকিছু। ছাপা মাধ্যমের চেয়ে এখন অনেক বেশি এগিয়ে টেলিভিশন। এমনকি অনলাইন পত্রিকাও সংবাদপ্রচারে দ্রুততার দিয়ে টিকতে পারছে না টেলিভিশনের সঙ্গে। টেলিভিশনগুলো কোনো কোনো ঘটনা সরাসরি প্রচার করতে পারছে। সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে রাজধানীর বাইরে থেকেও। গত নির্বাচনের সময় আমরা প্রত্যন্ত সব জেলা থেকেও সরাসরি ভোট দেয়ার দৃশ্য দেখেছি।
এখন সময় এসেছে পেশায় উৎকর্ষ বাড়ানোর। টেলিভিশনগুলোকে জেলায় জেলায় বেতন দিয়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে হয়। এখন টেশিভিশনের সঙ্গে কাজ করা শুধু গর্ববোধের বিষয় নয়। রাজধানীর বাইরেও কেউ কেউ সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নিতে শুরু করেছে। এখনই সময় পুরো কাজটাকে নিয়মের মধ্যে ফেলার। আর তা করতে হলে জানতে হবে ছক, বুঝতে হবে। আর সে কাজটি যে খুব কঠিন, তা নয়।
এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার পেশাগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে হবে। কারণ আমি এই লেখার মাধ্যমে আমি আমার পেশাটাকে অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। বর্তমানে আমি কাজ করছি একটি টেলিভিশনের বার্তা বিভাগে। দায়িত্ব রাজধানীর বাইরের সংবাদ সম্পাদনার। কাজটিকে আমি সম্পাদনা না বলে প্রচার যোগ্য করে তোলা বলতে চাই। রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতা নিয়ে আমি এর আগে কাজ করেছি একুশে টিলিভিশন এবং চ্যানেল আইয়ে।
এ পর্যন্ত যদি কিছু শিখতে পারি তা রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের কাছেই শিখেছি। কাজ করতে করতেই শেখা। পুরোপুরি শিখেছি, একরম দাবি করছি না। তবে এখন কাজ চালিয়ে নিতে পারি। আমার কাজটি পুরোপুরি শেখার জন্যেই মূলত এই অভিজ্ঞতা বিনিময়।
লেখার শুরুতে আমি বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতার যে ইতিহাস বলার চেষ্টা করছিলাম, আমি সেই ইতিহাসে যোগ দিয়েছি একুশে টেলিভিশন যুগের পারপরই। তখনো ভিএইচএস-এর রাজত্ব চলছে। প্রতিদিন ২০/২৫টা টেপ আসে। অনেকটা ধস্তাধস্তি করে এর মধ্যে ছয় থেকে সাতটা প্রচারের ব্যবস্থা করা যায়। খুব বেশি যতœ নিলে কখনো কখনো দু-একটি ভালো কাজ করা যায়।
ঠিক এর কিছুদিন পরেই রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতায় পরিবর্তন শুরু হয়। খুব দ্রুত পরিবর্তন। একসময় আমূল পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ভাবতে ভালোই লাগে, বাংলাদেশে রাজধানীর বাইরের টেলিভিশন সাংবাকিতায় যত পরিবর্তন এসেছে, আমি মোটামুটি সবগুলোর সঙ্গেই ছিলাম, এখনো আছি।
রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতায় যত পরিবর্তন সেগুলোর সবটাই ইতিবাচক। কিন্তু সেখানকার সাংবাদিকরা পেশাগত দক্ষতার দিক দিয়ে রাজধানীর বাইরেরই থেকে গেছেন। ছাপার মধ্যমে যেমন অগণিত ভালো রিপোর্টার আছেন, যারা রাজধানীর বাইরে থেকেও অনেক ভালো মর্যাদা পেয়েছেন। এক্ষেত্রে আমরা প্রয়াত মোনাজাত উদ্দিন, শামসুর রহমান কেবল এবং মানিক সাহার কথা উল্লে¬খ করতে পারি। যারা বেঁচে থাকতেই সংবাদিকতার স্টার ছিলেন। এঁদের মধ্যে শামসুর রহমান কেবল এবং মানিক সাহার কাজ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি । তারা তাদের কাজটুকু যত শ্রদ্ধা নিয়ে মনোযোগের সঙ্গে করতেন, এত মনোযোগ দিয়ে এখন আর কাউকে সাংবাদিকতা করতে দেখি না।
কিন্তু টেলিভিশন মাধ্যমের বয়স ১০ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। এখনো আমারা এখানে একজন মোনাজাত উদ্দিন, শামসুর রহমান কেবল বা মানিক সাহার দেখা পাইনি। এই দোষ কার? এই দায় রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা যদি শুধু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের ওপর দিয়েই চালাতে চান, সেটা খুব অবিচার হবে। কারণ এই দোষ সাংবাদিকের নিজেরও। আমি অন্তত তাই মনে করি। অবশ্য আমরা যারা এই চর্চা নিয়মিত করছি, রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের সঙ্গে তারাও এই দায় এড়াতে পারি না।
আমার গত আট বছরের অভিজ্ঞতা অনুয়ায়ী, রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের যিনি ভালো স্ক্রিপ্ট লেখেন, তিনি ভালো ছবি তোলেন না। আবার যিনি ভালো ছবি তোলেন, তার স্ক্রিপ্টে তথ্যের ঘাটতি। যিনি মোটামুটি মানের ছবি তুলছেন এবং স্ক্রিপ্ট লিখছেন, তার গলার স্বর ব্যবহার যোগ্য না। কেউ কেউ এখনো ছবি তুলছেন ভাড়া করা লোক দিয়ে। যিনি ছবি তুলছেন, তিনি কখনই সংবাদের লোক নন। তার কাজ বিয়ে বাড়ির ছবি, জন্মদিনের ছবি অথবা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি তোলা। কাজেই তিনি নিউজের জন্যে যে ছবি তুলছেন, সে ছবিও হচ্ছে ওই সব অনুষ্ঠানের মত। ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে উঠছে না। এখন কোনোরকম ওইসব ছবি দিয়েই টাইম লাইনের শূন্য স্থান পূরণ করতে হচ্ছে।
আর রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারদের গলার স্বর প্রচার অনুপযোগী হওয়ার ঘাটতি মেটাচ্ছি আমরা যারা ডেস্কে কাজ করছি। সবকিছুই কাজ চালানোর মতো কাজ। এভাবে করা কোনো কাজকে ঠিক মানসম্মত বলা যায় না।
আমার এই পুরো লেখাটায় উদ্দেশ্য ওই রকম একটা জায়গা থেকে বাংলাদেশের টিভি সাংবাদিকতাকে বের করে আনা। লেখার আরেকটি উদ্দেশ্য, জেলায় জেলায় টিভি সাংবাদিকদের হাতে ক্যামেরা তুলে দেয়া। কারণ যিনি সংবাদটি ভেবেছেন, তিনি যদি ক্যামেরার ফ্রেমে চোখ রাখেন তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। সারা জীবন যে লোকটা তথ্য প্রচার বা প্রকাশের সঙ্গে কাজই করেননি, তার তোলা ছবি কখনই যে সংবাদের ছবি হয়ে উঠবে না, এ বিষয়টি আমি নিশ্চিত।
এ নিয়ে আমি এত কথা বলতাম না, যদি না রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতার কোনো সম্ভাবনা না দেখতাম। চাইলেই রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আর বর্তমান সময়টা তাদের জন্যে খুবই সহায়ক। প্রযুক্তি প্রসারের এই যুগে পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি রাজধানীর বাইরের সাংবাদিক বলে সাংবাদিকদের কোনো জাত আছে, বিশ্বাস করি না। সবাই সাংবাদিক। কাজের ধরনের কারণে কেউ রাজধানীতে কাজ করেন, আবার কেউ রাজধানীর বাইরে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমি যতদূর জানি, সেখানেও সাংবাদিকদের মধ্যে এরকম কোনো বিভাজন নেই। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও নেই। সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা অনুশীলন নিয়ে। আমাদের অনুশীলন অনুযায়ী রাজধানীতে টেলিভিশন অথবা পত্রিকায় যারা কাজ করছেন, রিপোর্টার অথবা সাব এডিটার, এরাই জাতের। আর অন্যরা বিজাতীয়। সেই শুরু থেকেই এই অনুশীলনের কারণে, আমাদের সংবাদ-সংস্কৃতিতে এই অশ্লীল ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। আর রাজধানীর বাইরে যারা কাজ করেন তারাও বিষয়টি অবলীলায় মেনে নিয়েছেন।
এছাড়া ঢাকার বাইরের সাংবাদিকতা চর্চার যে সংস্কৃতি, সেখানেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে। যেমন রাজধানীর বাইরে যারা দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন, তাদের শতকরা ৯৫ জনই করেছেন শখে। অন্য আরো অনেক কারণেও করেছেন কেউ কেউ। তবে এই কারণগুলোর কোনোটিই পেশাগতভাবে সাংবাদিকতা করা নয়। সাংবাদিকতাই পেশা, রাজধানীর বাইরে এরকম সাংবাদিকের সংখ্যা এখনো অনেক কম। এরা কেউ শিক্ষক, কেউ অ্যাডভোকেট কেউ এনজিওকর্মী অথবা অন্য কোনো পেশাজীবী। দিনভর চাকুরি করেন। তারপর সন্ধ্যায় প্রেস ক্লাবে এসে করেন সাংবাদিকতা। আবার কেউ আছেন যিনি অন্য কোনো কাজ না পেয়ে সাংবাদিকতা করছেন। যাই পাওয়া যায় তাই লাভ। যে কারণে ওইভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকজন রাজধানীর বাইরের সাংবাকিতায় যোগ দেননি দীর্ঘদিন। পত্রিকাগুলোও কোনো রকম কাজ চালিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীতে সাংবাদিকতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া তরুণ-তরুণীরা। বন্ধুদের কেউ সরকারি অথবা বিভিন্ন সওদাগরি অফিসের কর্মকর্তা, আর কেউ সাংবাদিক। সাংবাদিক হিসাবেই কর্মজীবন শুরু। তাদের এটাই করতে হয়। এর ওপর নির্ভর করে তাদের পরিবার। এটাই পেশা। তাই রাজধানীতে সাংবাদিকতা করতে হলে কাজের মান বাড়াতে হয়। পরিশ্রম করতে হয় কঠোর। নিউজরুমে যে যতবড় বন্ধুই হোন না কেন পেশাগত প্রতিযোগিতা থাকেই। সারাক্ষণই একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। যে কারণে রাজধানীতে যারা সাংবাদিকতা করছেন, তাদের কাজের মান বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আর এই কাজের মানের কারণে আমাদের সাংবাদিকতার দুটি শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। যা আসলে গোটা সাংবাদিকতার জন্য ঠিক শুভ নয়।
রাজধানীর টিভি সাংবাদিকতা এবং রাজধানীর বাইরের প্রতিনিধিদের টিভি সাংবাদিকতা চর্চার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য একবারে আকাশ আর পাতালের। রাজধানীতে একটা নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে খুব ভালো ক্যামেরায় ক্যামেরাপার্সনের তোলা মাপা ছবি নিয়ে সাংবাদিকতা করেন সাংবাদিকরা। আর বাইরের সাংবাদিকদের যুদ্ধ ছোট ক্যামেরায় নিজের কাঁপা হাতে তোলা ছবি নিয়ে। পার্থক্য তো থাকবেই।
রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টারকে যদি শুধু স্থান পরিবর্তন করে দেয়া হয়, তাহলে কাজের মনে একদিনেই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে রাজধানীর রিপোর্টারের মতো চকচকে ঝকঝকে রিপোর্টার হয়ে উঠবেন, আমি অন্তত এ ব্যাপারে নিশ্চিত।
আমরা যদি রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতা বিকাশ না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে প্রথমেই আসে প্রযুক্তিগত অভাবের কথা। রাজধানীর বাইরের একজন সাংবাদিক প্রথমে একটি খবর পাওয়ার পর সেখানে কত দ্রুত পৌঁছাতে পারবেন, সেটা নির্ভর করে ঘটনাস্থল থেকে তিনি কত দূরে আছেন সেটির ওপর। তাছাড়া তিনি কী যানবাহন ব্যবহার করছেন, সেটির ওপরও বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল।
তারপর ধরা যাক, তিনি এলাকায় গেলেন ছবি তুলতে। তার ফিরে আসার বিষয়টিও নির্ভর করবে ওই স্থানের দূরত্বের ওপর। যাহোক তিনি ঘটনাস্থলে গেলেন, ছবি তুললেন এবং তার নিজের কার্যালয়ে ফিরলেন। এবার ছবি পাঠাতে হবে। এখন প্রয়োজন ইন্টারনেট। ইন্টারনেট সার্ভিস এখন সব জেলায় থাকলেও সবার গতি সমান নয়। ছবি নিজের মতো করে সম্পাদনা করে পাঠিয়েছেন, কিন্তু কখন সেটি অফিসে পৌছাবে, কিংবা আদৌ পৌঁছাবে কি না সেটি নির্ভর করে অনেকটা ভাগ্যের ওপর।
যাহোক, হয়তো সব প্রযুক্তিগত বাধা পেরিয়ে সেটি অফিসে অফিসে পৌঁছাল। এর পরের সমস্যা আমলাতান্ত্রিক। প্রথম প্রশ্ন, ছবি পাঠানোর পর সংশ্লি¬ষ্ট নিউজরুম এডিটর নিউজটি দেখছেন কি না। হয়তো দেখলেন, কিন্তু প্রচার করলেন না অথবা প্রচার করতে পারলেন না। একজন রিপোর্টারের সারা দিনের কাজ বরবাদ হয়ে গেল।
রিপোর্টার এলাকায় গেছেন, তার পরিচয় দিয়েছেন, ছবি তুলেছেন। এলাকার লোকদের বলেও এসেছেন, “আজ অমুক সময় আপনাদের এই ছবিটি দেখানো হবে।” কিন্তু ছবিটি প্রচারিত হলো না। আমরা রাজধানীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বিষয়টি জানলামও না। কিন্তু এলাকার লোকজনের কাছে ছোট হয়ে গেলেন ওই সাংবাদিক।
অবশ্য ওই একটি সংবাদ নানা কারণে প্রচারিত না হতে পারে। এর কোনো কোনো কারণ হয়তো যৌক্তিক। তাই সমস্যা এড়াতে আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের সবসময় বলি, বার্তাকক্ষের সঙ্গে কথা না বলে কোনো সংবাদের পিছনে ছুটবেন না।
সমস্যা আরো আছে, আমরা রাজধানীতে ডেস্কে যারা কাজ করি, তারা খুব দ্রুত নিজেদের সুপ্রিম ভাবতে শুরু করি। আমি দেখেছি, দু্ই মাস কাজ করেই অনেকে ১৫ বছরের পুরানো রিপোর্টাররের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, তা কোনো রকম সভ্যতার ধারকাছ দিয়েও যায় না। সমস্যা আসলে প্রতি পদে পদে।
রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতা এগিয়ে নিতে সাংবাদিকদের রীতিমতো বিনিয়োগ করতে হয়। ছবি তোলার ক্যামেরাটি কিনতে হয়। তোলা ছবি অফিসের পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। নিজস্ব কম্পিউটার থাকলে ভালো, না থাকলে এর জন্যে টাকা গুনতে হয়। আর নিজস্ব কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হলে বিনিয়োগ করতে হয় আরো বেশি। সাংবাদিকদের ছবি তুলতে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। টিভি সাংবাদিকতা একা করা যায় না। যখন তিনি নিজে কোনো খবরের ছবি তুলতে যান, তখন সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় বুম ধরার জন্যে হলেও কাউকে সঙ্গে রাখতে হয়। সব মিলিয়ে বেশ খরচ। এখন অবশ্য বেশিরভাগ সাংবাদিকের নিজের ক্যামেরা থাকায় খরচ কিছুটা কমে এসেছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা ক্যামেরা ভাড়া করে কাজ করতেন।
যাহোক, এই খরচা করে তিনি যে খরবটি পাঠালেন, তা যদি প্রচারিত হয় তাহলে বিল পাবেন। আমি যতদূর জানি, ঢাকা শহরের প্রায় সব টেলিভিশন একটি রিপোর্টের জন্যে যা বিল দেন তা তার মোট খরচের অর্ধেক। তাও নিয়মিত নয়। একজন রাজধানীর বাইরের রিপোর্টার এ মাসের বিল পাবেন অন্তত ছয় মাস পর। এতকিছুর পরেও তারা বেতন পান রাজাধানীর সাংবাদিকদের চার ভাগের একভাগ। অথচ তাকে একাধারে কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অপরাধ ও খেলার রিপোর্ট করতে হচ্ছে। তার কোনো বিট নেই।
এখন কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকরা কাজ করছেন কীভাবে? এর উত্তর হচ্ছে, তারা আসলে এক ধরনের ‘সিন্ডিকেটেড জার্নালিজম’ করছেন। গত পাঁচ/সাত বছর টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়তে থাকায় রিপোর্টারের সংখ্যা বেড়েছে। এখন কোনো স্পটে যেতে হলে সবাই একসঙ্গে যেতে পারছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ক্যামেরার তোলা ছবিই সবাই ব্যবহার করছেন। সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয়ার ফলে খরচও কমে যাচ্ছে।
কিন্তু এতে সমস্যা হলো, ছবির মান বাড়ছে না। সব টেলিভিশনে আমরা দেখছি একই ছবি। ‘সিন্ডিকেটেড জার্নালিজমে’ হয়তো কাজ চালিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু এখানে রিপোর্টারের বিশেষত্ব বলে কিছু থাকে না।
এতো গেল রাজধানীর বাইরের টিভি সংবাদের সাধারণ কিছু সমস্যার কথা, রাজধানীর বাইরে সাংবাদিকতা চর্চার বাধা-বিপত্তির কথা। এবার বলতে চাই, ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের কিছু ভুল চর্চার কথা।
টানা আট বছর তিনটি টেলিভিশনের ন্যাশনাল ডেস্কে কাজ করার পর আমি কিছু ‘সার্বজনীন সমস্যা’ চিহ্নিত করেছি। এই সমস্যাগুলো ঢাকার বাইরের বেশিরভাগ টেলিভিশন সাংবাদিকের থাকে। এগুলো দূর করা খুব জটিল কাজ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো একটি কাজ করলে অথবা না করলেই সমস্যাগুলো দূর হবে। অভ্যেস বদলাতে হবে শুধু। আমি মনে করি, এই সমস্যাগুলো না থাকলে রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকতার দূরত্ব কমে যাবে প্রায় ষাট ভাগ।
টেলিভিশন সাংবাদিকতা আসলে তিনটি উপাদানের সমন্বয়। প্রথমটি হচ্ছে তথ্য, দ্বিতীয়টি ছবি এবং তৃতীয়টি উপস্থাপন। রাজধানীর বাইরে থেকে পাঠানো সংবাদগুলোতে এই তিনটি শাখায়ই ভয়বহ সব সমস্যা থাকে। ডেস্কের লোকজনের কাজই মূলত তাদের পাঠানো সংবাদের ঘাটতিগুলো পূরণ করা। আমি একেবারে নিজের মতো করে ওই ৩টি শাখার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছি। অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন।
১.পত্রিকার মতো করে সংবাদ পাঠানো।
আবারো বলছি, রাজধানীর বাইরের বেশিরভাগ টেলিভিশন সাংবাদিক বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তাই তারা টেলিভিশনের জন্য আলাদা করে লেখেন না। পত্রিকায় যে কপিটি পাঠান, ওই কপিটি টেলিভিশনে ফ্যাক্স অথবা ইমেইল করার সংস্কৃতি এখনো রয়ে গেছে। একটি ঘটনার জন্য তিনি যে সংবাদটি পত্রিকায় পাঠান সেটি ৪০০ থেকে ৬০০ শব্দের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি। অথচ টেলিভিশনে ওই সংবাদটি প্রচার হয় ৩০ থেকে ৪০ শব্দের মধ্যে। এখন এই ৬০০ শব্দের একটি কপি থেকে ৪০ শব্দ বের করার কাজটি খুবই দুরুহ। তাই খুব জরুরি না হলে বার্তাসম্পাদক খবরটি দিতেই চাইবেন না। রাজধানীর বাইরের নিউজ যেসব কারণে প্রচার হয় না সেগুলির মধ্যে এই কারণটি অন্যতম। তাই টেলিভিশনের স্ক্রিপ্ট লেখার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যে তথ্যটি না দিলেই নয়, সেই তথ্যটিই টেলিভিশন সংবাদে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে সংবাদ তৈরির ‘ষড় ক’ (ফাইভ ডবলিউ ওয়ান এইচ) পদ্ধতি। সবচেয়ে সুখের বিষয় গত কয়েক বছরে টেলিভিশন সংবাদের একটি কাঠামোগত ভাষা তৈরি হয়েছে। এখন শুধু কাঠামো অনুসরণ করলেই হবে।
২.দেরি করে সংবাদ পাঠানো।
টেলিভিশন হচ্ছে তাৎক্ষণিক সাংবাদিকতার মাধ্যম। এই মুহূর্তে যে ঘটনাটি ঘটলো সেটি এই মুহুর্তেই প্রচার করতে হবে। এখন যে টেলিভিশন যত দ্রুত একটি সংবাদ প্রচার করতে পারে, বুঝতে হবে ওই টেলিভিশনের নিউজ তত বেশি কার্যকর। বাংলাদেশে এখন ২৫টি টেলিভিশন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এখন প্রতিযোগিতা, কারা কত দ্রুত নিউজ প্রচার করতে পারছে। আর দ্রুত নিউজ প্রচার করার প্রধান শর্ত হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলটিকে তার রিপোর্টারের কাছ থেকে দ্রুত সংবাদটি পেতে হবে। সুতরাং এখন নিউজ পাঠাতে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। যখনই ঘটনা তখনই পাঠাতে হবে। যেটুকু জানা যায়, সেটুকু পাঠাতে হবে। পরে আবার পাঠাতে হবে। নিউজ পাঠাতেই থাকতে হবে ঘটনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এটাই টেলিভিশন সাংবাদিকতা। এ নিয়ে আমার অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। দেখা গেল, ঢাকায় বসে অন্য কোনো সোর্সে খবর পেয়ে সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আমার রিপোর্টারকে ফোন করছি। দেখলাম, তিনি ঘটনাটি তখনো জানেন না। আমার কাছেই প্রথম শুনলেন। আবার সেই পুরানো দিনের পত্রিকা স্টাইল, ‘সন্ধ্যার পরে একটি ফ্যাক্স করলেই হবে।’ অবশ্য এই সমস্যা সবার নয়, কারো কারো। অনেকেই ভালো কাজ করেন, যখনকার ঘটনা তখনই জানান। তাদেরই করো কারো অভিযোগ আছে, সময়মতো নিউজটি দেয়ার পরেও প্রচারিত হয় না। অন্য টেলিভিশনে তার পরে পাঠিয়েও প্রচারিত হয়ে গেছে। টেলিভিশন সাংবাদিকতা সবসময় তাৎক্ষণিক। আপনি যত দ্রুত পাঠাতে পারবেন তত ভালো। প্রতিযোগিতা তো। দেখা গেল, আপনি একটা নিউজ দিতে পারলেন না। আপনার পরবর্তী সংবাদ আরো দুই ঘণ্টা পর। আপনার কাছে তথ্য আছে, কিন্তু আপনি সেটি প্রচার করতে পারছেন না। কিন্তু এর মধ্যে অন্যসব টেলিভিশন খবরটি প্রচার করে বাসি করে ফেলবে। অর্থাৎদুই ঘণ্টা পেছানো মানে, কোনো কোনো সময় নিউজটি প্রচার অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।
৩. তথ্য আছে, ছবি নেই।
বাংলাদেশের একেকটি জেলায় বহু দূর্গম উপজেলা রয়েছে। এমন উপজেলাও আছে যেখান থেকে জেলা সদরে যাওয়ার চেয়ে ঢাকা যাওয়া সহজ। টেলিভিশনগুলো সাধারণত জেলার বাইরে লোক নেয় না। জেলার লোকদেরই উপজেলায় যেতে হয়। এমন উপজেলা আছে, যেখানে জেলা সদর থেকে যেতে যেতে দিন পার। তার পর সেখান থেকে জেলায় ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। অথবা রিপোর্টার খবরের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘটনা শেষ। তখন হয়তো আর ধরার মতো ছবি নেই। অথবা ছবি ধরার মতো আলো নেই। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ছবি পাঠানো সম্ভব হয় না। পরে খবরের গুরুত্বের কারণে ছবি ছাড়াই খবরটি পাঠাতে হয়। আর নিউজটি প্রচারিত হয় গ্র্যাফিক্স দিয়ে। কিন্তু ছবির গণমাধ্যমে ছবি তো থাকতেই হবে। ছবি ছাড়া টিভি মিডিয়ার কাজ বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। দিন যত যাবে, খবরের সঙ্গে সঙ্গে ছবির গুরুত্ব আরো বাড়বে। আধুনিক টিভি সাংবাদিকতায় পর্দায় একই ছবি কখনো টানা ২০ সেকেন্ডের বেশি ব্যাকরণসম্মত নয়। অবশ্য আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন দিনের ছবি দিনে দেখাতে পারলেই মনে করা হতো সাফল্যের সঙ্গে নিউজটি প্রচার হয়েছে। এর আগে কখনো গ্র্যাফিক্স কখনো টিকার আর কখনো বা শুধু সংবাদপাঠকের মুখ দিয়ে পড়িয়ে খবরটি ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু প্রযুক্তি যত এগিয়েছে ছবি ও তথ্য তত কাছে এসেছে। এখন তারা অনেক কাছাকাছি। আমি আশা করছি, ভবিষ্যতে এই দূরত্ব আরো কমে আসবে। হয়তো উপজেলায় সাংবাদিক নিয়োগ দেবে টেলিভিশনগুলো। আমি আমার রিপোর্টারদের সবসময় ছবি আর তথ্যের দূরত্ব কমাতে ব্যক্তিগত আর্কাইভ সমৃদ্ধ করতে বলি। যদি অন্য সময়ে তোলা ওই এলাকার ছবি হাতে থাকে তাহলে যখন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সেই ছবিটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে একঘেঁয়েমি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যায়। শুধু ছবিটি ব্যবহারের সময় সেটি কখন তোলা, সে কথাটি একটি ব্যান্ডে লিখে ছবির সঙ্গে প্রচার করলেই হবে।
৪. ছবি আছে তথ্য নেই।
এটি ঢাকার বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ সংবাদের এটি একটি সাধারণ সমস্যা। ছবি আছে হয়তো অনেক, কিন্তু দেখা যাচ্ছে গল্পে ব্যবহার করার মতো ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ গল্পের ছবি কী হবে, ছবি পাঠানোর সময় তা ভাবেননি রিপোর্টার। হয়তো তথ্যের সঙ্গে ছবির কোনো মিল নেই। অথবা যে ছবি আছে তা ব্যবহার করতে কোনো গল্পই পাওয়া যাচ্ছে না। একবার উত্তরাঞ্চলের কোনো এক একটি চরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে একটি সংবাদ পেলাম। পাণ্ডুলিপি দেখে আমি যথেষ্ট আগ্রহী হলাম রিপোর্টটি করার জন্যে। কিন্তু সম্পাদনা টেবিলে যাওয়ার পর পুরো আগ্রহটাই মিইয়ে গেল। কারণ রিপোর্টার শুধু কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং ভক্সপপ রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন আমি কী করব? কীভাবে আমার গল্পে সাক্ষাৎকার গুলোকে জোড়া দেবো? কোনো সুযোগ যখন পেলাম না, তখন রিপোর্টটি বাদ দিতে হলো। বহু খেলার খবর পেয়েছি, যেখানে খেলার ছবি আছে। আর তথ্য আছে- কে কে খেলার উদ্বোধন করেছেন এবং খেলা শেষের অনুষ্ঠানে কে পুরস্কার বিতরণ করেছেন। কিন্তু ৪০০ শব্দের গোটা পাণ্ডুলিপিতে কোথাও খেলার ফলাফল নেই।
৫. ছবি আছে অনেক বেশি।
এবারের সমস্যাটা একেবারে আগেরটার উল্টো। রিপোর্টার ছবি তুলেছেন ক্যামেরা ভর্তি করে। একটা দেড় মিনিটের রিপোর্টের জন্যে ছবি তুলেছেন পুরো ৩০ মিনিটের। ছবি যদি টেপে থাকে, তাহলে ছবিটি সম্পাদনার জন্যে কম্পিউটারে নিতেই (ডিজিটাইজ) ৩০ মিনিট সময় লাগবে। সব মিলিয়ে রিপোর্টটি বানাতে সময় দরকার হবে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ৩০ মিনিট। কিন্তু এত সময় নেই বর্তমান টিভি মিডিয়ায়। এখানে যতটুকু দরকার ততটুকু পাঠাতে হবে। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে নিলে সুবিধা হয়, যেটি এই লেখাতে আগেও বলেছি। সেটি হচ্ছে, ঢাকার বাইরে এখন যিনি ক্যামেরা চালান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিই রিপোর্টার। তবে ক্যামেরা চালানোর কাজটি বিশ্বব্যাপী একটি পেশাদার কাজ। এর অনেক খুঁটিনাটি দিক আছে যা না জেনে কাজটি করা ঠিক না। উপায় না থাকার কারনে যখন কোনো রকমে কাজটি করা হয় তখন ছবিও হয় সেরকম। দর্শক হয়তো কিছু দেখলো, কিন্তু সেটি ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে উঠলো না। আবার ক্যামেরা যদি অন্য কেউও চালান, সেক্ষেত্রে আরো সমস্যা থাকে। যেমন রাজধানীর বাইরে যিনি বা যারা ক্যামেরা চালান তারা সংবাদের ক্যামেরাম্যান নন। যে কারণে তার তোলা ছবি, ছবি হলেও ঠিক সংবাদের ছবি হয়ে ওঠে না। এর জন্য দরকার প্রশিক্ষণ। কোনোরকম নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকরা। কিন্তু এখন অনেক প্রতিযোগিতা। টিআরপির বিষয় আছে। দর্শকদের হাতে আছে রিমোর্ট কন্ট্রোল। এখন তারা অনেক বোঝে। ভালো ছবি এবং খারাপ ছবির পার্থক্য ধরতে পারে । সুতরাং যেনতেন প্রক্রিয়ায় কাজ করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায়।
৬. উপস্থাপন সমস্যা।
টিভি সাংবাদিকতায় বলার গুরুত্ব অনেক। ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হলে অনেক সময় তা ফোনে জানাতে হয় তার দর্শকদের। তাছাড়া নিজের রিপোর্ট নিজে বলাটাই সংবাদসম্মত। তাই টিভি স্ক্রিপ্ট বলার জন্য শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলাটা জরুরি। আমাদের দেশের আঞ্চলিকতার প্রভাবের কারণে উচ্চারণে সমস্যা থাকে সাংবাদিকদের। উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে নিয়মিত চর্চার উপর। এই চর্চা সবার থাকে না। এটা দোষেরও নয়। চর্চা করতে গেলে শুরুতেই রিপোর্টারকে নানান সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এটা কাটিয়ে ওঠার বিকল্প নেই। এই সমস্যা থাকলে রিপোর্টারের হয়ে কণ্ঠ দিয়ে দেন আরেকজন। কিন্তু একসময় নিজের রিপোর্ট নিজেই করতে হবে। কারণ যার রিপোর্ট , তিনি রিপোর্টে কণ্ঠ না দিলে অনেক সমস্যা হয়। যার রিপোর্ট তার কণ্ঠে রিপোর্টটি যত তীক্ষ্ন, অন্যের কণ্ঠে তা কমে যায় অর্ধেক। যিনি কণ্ঠ দেন, তিনি ঘটনাস্থলে যান না। পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন মাত্র। তিনি কখনই পুরোটা ধারণ করতে পারবেন না। তাই ঘটনাস্থলে না গেলে গোটা পরিস্থিতি অন্যের কণ্ঠে আসে না। এছাড়া কখনো কখনো রিপোর্টের প্রয়োজনে রিপোর্টারের পর্দায় আসা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু যার ভয়েস ব্যবহার যোগ্য না, তার পক্ষে পর্দায় আসাও অসম্ভব। যে কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট কখনো কখনো গুরুত্বহীন হয়ে যায়। অথবা সম্পাদক যেভাবে রিপোর্টটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন সেভাবে পারেন না। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত থাকেন ভয়েস দিতে না পারা রিপোর্টারের ওপর। তাই সংবাদ সংগ্রহ এবং ভালোভাবে লেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভালোভাবে সংবাদটি বলতে পারাটা টিভি সাংবাদিকদের অতিরিক্ত যোগ্যতা।
৭. ঘটনার গভীরে না যাওয়া।
এই সমস্যাটি অবশ্য আমাদের গোটা টিভি সাংবাদিকতার। অনেকে মনে করেন, যে তথ্যটির ছবি দেখানো সম্ভব সেই তথ্যটিই শুধু প্রকাশ করা হবে। ছবি না থাকলে তথ্যটি অপ্রকাশিত থাকবে। আমি মনে করি, এটা এক ধরনের ফাঁকিবাজি। যেকোনো ঘটনা প্রতিষ্ঠা করতে যে ছবি দরকার তা রিপোর্টারকে যোগাড় করতে হবে। তা সে যেভাবেই হোক। প্রথমেই রিপোর্টারকে রিপোর্টটি ভাবতেই হবে ছবিসহ। কোনো সময় যদি ছবি না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ব্যবহার করতে হবে। আর যে ঘটনার ছবি হয় না বা ইতিহাসভিত্তিক তথ্য অথবা তথ্যটি দৃশ্যমান নয়, সেক্ষেত্রে তথ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এমন কোনো ছবি ব্যবহার করতে হবে। আর একেবারেই কিছু না পাওয়া গেলে, ব্যাকারণ হচ্ছে, রিপোর্টার নিজেই পর্দায় চলে আসবেন এবং তথ্যের বর্ণনা ক্যামেরায় রেকর্ড করবেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, রিপোর্টারকে ভাষা ব্যাবহারে কৌশলী হতে হবে। ভাষা ব্যাবহারে মুন্সিয়ানা থাকলে তিনি যেকোনো তথ্য ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারবেন। এটিই মূলত রিপোর্টারের কাজ। সাধারণ মানুষের বর্ণনার সঙ্গে রিপোর্টারের বর্ণনার পার্থক্য এখানেই। ভাসাভাসা কোনো রিপোর্ট করে লাভ নেই। ছবি না থাকার দোহাই দিয়ে কোনো তথ্য রিপোর্ট থেকে বাদ দেয়াটা ঠিক সাংবাদিকতা নয়। সিনেমা, নাটক,আর টিভি সাংবাদিকতার পার্থক্য এখানেই। যেকোনো পদ্ধতিতে আমাকে ঘটনার ভেতরে ঢুকতে হবে। পড়াশোনা থাকতে হবে সাংবাদিকদের। থাকতে হবে নিজস্ব লাইব্রেরি ও আর্কাইভ। যেন প্রয়োজন হলেই যে কোন তথ্য যোগাড় করা যেতে পারে। একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সাংবাকিতার নিয়ম কানুন হয়তো শেখানো যায়। কিন্তু কাউকে সাংবাদিকতার মুন্সিয়ানা শেখানো যায় না। এটা রিপোর্টারের নিজস্ব। এই মুন্সিয়ানায় যে রিপোর্টার যত পারদর্শী সেই তত দক্ষ সাংবাদিক। সাংবাদিকদের কাজের মান নির্ধারণের যায়গা মূলত এটাই।
৮. ফলোআপ হচ্ছে না।
এই সমস্যাটিও আমাদের গোটা সাংবাদিকতার। অবশ্য ছাপার মাধ্যমেও এই সমস্যা আছে। কোনো একটি ঘটনা ঘটলো, অথবা কোনো সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করা হলো। পরে রিপোর্টার সে ব্যাপারে খোঁজই নিলেন না। ভাবখানা যেন এমন, ‘রিপোর্টটি প্রচার বা প্রকাশ হওয়ার পর পরই সাংবাদিকদের দায়িত্ব শেষ’। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে ফলোআপ হচ্ছে না তা নয়। ভালো বার্তাসম্পাদকের অধীনে কাজ করলে নিশ্চই হয়। কিন্তু সে হার খুবই কম। টিভি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তো একবারেই কম। ধরা যাক, রিপোর্ট প্রচারিত হলো ‘একটি সেতুর কারণে জনসাধারনের দুর্ভোগ’ বিষয়ক। রিপোর্টটি প্রচারের পর হয়তো সেতু সংস্কার হলো। দুর্ভোগ কমলো জনসাধারণের। অথবা সেতুটি সংস্কারই হলো না। কিন্তু রিপোর্টার আর খবর নিলেন না। অথচ এখানে খবর নিলে অবশ্যই একটি প্রচার যোগ্য খবর হতে পারে। যেকোনো একটি ঘটনাই তো ঘটবে। হয় সেতুটি সংস্কার হবে, নয়তো হবে না। সংস্কার হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আর না হলে বারবার রিপোর্ট করার পরেও সেতুটি সংস্কার না হওয়ার বিষয়টি ছাপা বা প্রচার যোগ্য। কিন্তু আমাদের রাজধানীর বাইরের বন্ধুদের ফলোআপের ব্যাপারে আগ্রহ কম। কিন্তু আমি মনে করি, এটি কোনো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়। অবশ্য অনেকে পজিটিভ সাংবাদিকতা করাটাকে নেগেটিভভাবেই দেখে। কিন্তু খবর সবসময় কষ্টের, সমস্যার, অপরাধের হতে হবে এমনটি কিন্তু কোথাও বলা নেই। যেকোনো আনন্দের ঘটনাও অনেক গুরুত্বসহ প্রচারিত হতে পারে। হয়ও। আর ফলোআপের ফলাফল যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে তো সেটি ফলোআপ না করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কারণ সংবাদটি যতবার ফলোআপ হবে, আমি নিশ্চিত যে, সমস্যাটি সমাধানের দিকে একধাপ করে এগোবে।
৯. সাক্ষাৎকার নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা।
সাক্ষাৎকার নেয়া টিভি সাংবাদিকতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদে রিপোর্টার যে তথ্য দেন, সেই তথ্যকে সমর্থন করে সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার কখনো ভক্সপপ, কখনো সিংক নামে ব্যবহৃত হয় রিপোর্টে। সাংবাদিকতার নিয়মানুযায়ী, যে তথ্য কেউ সমর্থন করে না তা আসলে রিপোর্টারের নিজস্ব মতামত। রিপোর্টার কখনো তার নিজের মন্তব্য প্রকাশ করেন না। তার কাজ মানুষের কথা প্রচার করা। এতেই বোঝা যায়, সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। আর টিভি সাংবাদিকতায় তো আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে সংবাদটি প্রচার না করলেই নয় সেটিই কেবল সাক্ষাৎকার ছাড়া প্রচার করা হয়। কিন্তু রাজধানীর বাইরে থেকে আসা সংবাদগুলোতে এই সাক্ষাৎকারটি থাকে খুবই আগোছালো অবস্থায়।
প্রথমত, প্রয়োজনীয় সাক্ষাতকার থাকে না। দ্বিতীয়ত, যে তথ্যটি সমর্থন করা উচিত সাক্ষাতকারে সেটি সমর্থন করা হচ্ছে না। সাক্ষাৎকার যিনি দিচ্ছেন তিনি কথা বলছেন ভিন্ন প্রসঙ্গে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তিনি যা বলছেন তার সবই অপ্রয়োজনীয়। আর কথা যদি থাকেও, তাহলে এত বেশি থাকে যে প্রয়োজনীয় কথাটি খুঁজতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে। রিপোর্ট তৈরির সময় সেটি খুঁজেই পাওয়া যায় না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় যখন রিপোর্টার সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় নিজে ফ্রেমে থাকার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো খুবই নির্লজ্জভাবেই তিনি কাজটি করেন। যেটি পর্দায় খুবই হাস্যকর। এরকম থার্ডক্লাস ফ্রেমের কারণে আমি এ পর্যন্ত কত সংবাদ ফেলে দিয়েছি গুণে শেষ করা যাবে না। আবার কখনো কখনো রিপোর্টার তার চ্যানেলের লোগোসহ মাইক্রোফোনটি দিয়ে দিচ্ছেন যিনি সাক্ষাতকার দিচ্ছেন তার হাতে। আর মাইক্রোফোন হাতে পেয়েই তিনি লম্বা একটা বক্তৃতা ঝাড়লেন। যেটি আসলে কোনো কাজেই লাগলো না। রিপোর্টারকে বুঝতে হবে, এই লোগো হাতে নিয়ে কথা বলার অধিকার একমাত্র তারই। এটিই রিপোর্টারের পরিচয়।
আসলে টিভি সাক্ষাৎকারটি হওয়া উচিত খুবই মার্জিত। আর এজন্যে শুধু রিপোর্টারের কয়েকটি কৌশল জানা থাকাই যথেষ্ট। রিপোর্টারের দক্ষতা এখানে মুখ্য বিষয়। তার কৌশলী প্রশ্নেই সাক্ষাৎকার দাতার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে প্রয়োজনীয় কথা, সে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার সময়ই পাবেন না তিনি। এক্ষেত্রে মৌলিক যে নিয়মটি মানা হয় সেটি হচ্ছে, সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যার উত্তর ‘হ্যা’অথবা ‘না’তে দেয়া যায়। তবে সবচেয়ে মুখ্য বিষয়, সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে যে রিপোর্টার যত প্রস্তুতি নেন, তার নেয়া সাক্ষাতকারগুলো তত ভাল হয়। আর তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার বা সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া বা ভক্সপপ রেকর্ডের বিষয়টি নির্ভর করে রিপোর্টারের উপস্থিত বুদ্ধির ওপর। তবে ভক্সপপ কখনো শিখিয়ে দেয়া উচিত নয়। শেখানো কথা ক্যামেরার বললেই বোঝা যায়। সবচেয়ে সমস্যা হয় যদি শিশুদের ভক্সপপ নেয়ার আগে কী বলতে হবে, শিখিয়ে দেয়া হয়।
১০. গতানুগতিক কিছু ভুল।
এছাড়াও সাংবাদিকতা চর্চার সংস্কৃতির কারণে রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকরা গতানুগতিক কিছু ভুল করেন। যেগুলো না করলে কোনো সমস্যা নেই। যেমন নদীভাঙনের রিপোর্টের ছবিতে ‘নদীর পাড়ে একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার মুখে হাত দিয়ে বসে থাকার ছবি থাকবেই। ভাঙনের আরেকটি কমন ছবি হচ্ছে ‘মাটির বড় একটি চাঁই বিকট শব্দ করে নদীতে পড়ছে’। ছবিগুলো যে বানানো তা কোনো প্রমাণ না থাকলেও বোঝা যায়। আমি নিজে ভাঙনের রিপোর্টে করতে গিয়ে দেখেছি, বড় মাটির চাঁই নদীতে পড়ছে, কিন্তু ক্যামেরাপার্সনের অসাবধানতার কারণে ফ্রেম সরে গেল, দেখা গেল ওপাশ থেকে আরেকজন বড় বাঁশ দিয়ে মাটির ফাটলে ধাক্কা দিচ্ছে। বন্যার ছবিতে দেখা যাবে ‘বুক পানিতে নেমে এক কিশোর অথবা কিশোরী খাবার নিয়ে আসছে’। আমার মনে হয় না, এই বানানো সাংবাদিকতার দরকার আছে। তাহলে আপনি যখন সত্যিই মুন্সীগঞ্জের হাসাইল বানারিতে গিয়ে ছবি তুলবেন, দেখবেন সারাক্ষণ মাটির বড় চাঁই নদীতে পড়ছে, সে ছবিও দর্শকরা বানানো মনে করবে। এরকম আরো কিছু গতানুগতিক ভুল আছে রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের।
মোদ্দাকথা, টিভি সাংবাদিকতা, সর্বোচ্চ আধুনিক সাংবাদিকতা। এখানে পুরোনো ধ্যান-ধারণা ভাঙার চেষ্টাই হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতার সম্ভাবনা
সমস্যা ছিল, সমস্যা আছে এবং সমস্যা থাকবে। কিন্ত রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতা থেমে থাকবে না। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক এগিয়েছে। সেই শুরু হয়েছিল কোনো ছবি না দেখিয়ে ছবির সাংবাদিকতা দিয়ে। আর এখন বহু জেলা থেকে রিপোর্টাররা ভয়েস দিয়ে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন। এবং তা প্রচারিত হচ্ছে। এছাড়া ঢাকার বাইরের টিভি সাংবাদিকরা ফোনে রিপোর্ট দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কেউ কেউ সরাসরি অনলাইন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন । কিন্তু এত জল্পনা-কল্পনা তখনই, যখন তাদের তুলনা করা হচ্ছে ঢাকার রিপোর্টারদের সঙ্গে। একটি নিউজরুমে সবসময় কাজ আর কাজ। প্রচণ্ড ব্যস্ততা। এর মধ্যে নিউজ এডিটরদের ধমক শুনতে শুনতে কাজ করতে হচ্ছে রাজধানীর রিপোর্টারদের। ঢাকায় কোনো নতুন টিভি রিপোর্টারের নিয়তি হচ্ছে, ‘এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে কেউ হয় কাজ শেখো না হলে ঝরে যাও’। রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারদের প্রেক্ষাপট তো সেরকম নয়। যে কারণে একটি টিভি চ্যানেলের নিউজরুমে যতগুলা দক্ষ রিপোর্টার থাকে, রাজধানীর বাইরে এত বেশি দক্ষ রিপোর্টার থাকে না। কিন্তু এর মধ্য থেকেই কাজ হচ্ছে। সারাদেশে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন চ্যানেলের অন্তত ২০ জন টিভি রিপোর্টারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যাদের আজই ঢাকায় নিয়ে আসলে আজই কাজ করতে পারবে। অন্যরাও যে পারবে না তা নয়। তারা একটু সময় নিয়ে হলেও পারবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এখন যারা রাজধানীর বাইরে কাজ করেন তাদের ঢাকায় এনে তিন মাস কাজ করালে যে কেউ ঢাকার রিপোর্টারের সমমানের কাজ করবেন। আর এই তিন মাসের সুযোগ পান রাজধানীর সবাই। প্রথম কোনা টিভিতে কাজ করতে আসলে রাজধানীর আজকের দক্ষ রিপোর্টার, নিউজরুম এডিটর, এমনকি নিউজ এডিটররাও এই সুযোগ পান।
এরই মধ্যে প্রযুক্তির কারণে অনেক বদলে গেছে আমাদের টিভি সাংবাদিকতা। এখন ঢাকার বাইরের অনেক রিপোর্টার কোনো বিশেষ রিপোর্ট করতে হলে শুরুতেই বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশনা নেন। পরে সে অনুযায়ী ছবি তোলেন, সাক্ষাৎকার, ভক্সপপ রেকর্ড করেন। তারপর স্ক্রিপ্ট লেখেন। মেইল করেন বিভাগীয় প্রধানকে। বিভাগীয় প্রধান তার স্ক্রিপটি সম্পাদনা করে আবার তাকে মেইল করেন। এরপর ওই স্ক্রিপ্টে তিনি ভয়েস দেন। ছবি ভয়েস সাক্ষাৎকার ভক্সপপ সব মিলেয়ে তিনি আবার নিউজ এডিটরের বরাবরে পাঠান।
ছবি পাঠাতে এখন রিপোর্টার বেশিরভাগ সময় ই-মেইল ব্যবহার করেন। এই ই- মেইলে পাঠানোর প্রক্রিয়াটিও দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে জেনারেল মেইল, অন্যটি এফটিপি অথবা ফাইল ট্রান্সফার প্রটোকল। আমি এই প্রযুক্তিগত বিষয়টি জানি না। তবে সাদা চোখে এফটিপি হচ্ছে একটি ভাড়া করা ইন্টারনেট পথ। যিনি ওই পথটি ভাড়া করেছেন, তিনি ছাড়া ওই পথে বৈধভাবে কেউ হাঁটতে পারবেন না। তবে রাজধানীর বাইরের রিপোর্টাররা ভিডিও টেপ পাঠাতে এখনো কুরিয়ার বা পোস্ট অফিস ব্যবহার করেন। যে টেপটিতে প্রথম কিছু রেকর্ড করা হয় সেটিকে বলা হয় মাস্টার টেপ। যে রিপোর্টের ছবির মান খুব ভালো হতে হবে, সে রিপোর্টের ক্ষেত্রে এখনো মাস্টার টেপের বিকল্প নেই। যে কারণে প্রযুক্তি যতই আসুক , মাস্টার টেপের আবেদন কখনো শেষ হবে না।
এতো গেলো বিশেষ রিপোর্টের চিত্র। কিন্তু রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টার প্রতিদিন আরো অনেক কাজ করেন। কোনো ঘটনা ঘটলেই মোবাইলের কল্যাণে সেটি নিউজরুমে পৌঁছৈ দেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রচার হয় টিকার বা স্ক্রলে। তার পর আস্তে আস্ত নিউজটি ডেভেলপড হতে থাকে। প্রথমবার নিউটি প্রচারিত হতে হতে আসে ছবি। ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী ওই সংবাদের মান নির্ধারণ করেন বার্তা সম্পাদক। তারপর সিদ্ধান্ত নেন, এই খবরটি কোন মানে প্রচার করা উচিত। সে অনুযায়ী কোনো রিপোর্ট দিনভর প্রচার হয়, কোনো রিপোর্ট দু-একবার প্রচার হওয়ার পর বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর বাইরের টিভি নিউজ এভাবে গতি পায় এবং পাচ্ছে।
সাংবাদিকতার সঙ্গে উন্নয়ন যতটুকু জড়িত তার বেশিরভাগ ইস্যুই আছে রাজধানীর বাইরে। রাজধানীর বাইরের প্রকৃত চিত্রটা দক্ষতার সঙ্গে উঠে আসলে দেশের বেশিরভাগ মৌলিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আগে একটা ভালো টিভি রিপোর্ট অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। আর এই সংবাদগুলোর বেশিরভাগই আসা উচিত রাজধানীর বাইরে থেকে। রাজধানীর রিপোর্ট মানেই তো সেই অপরাধ রাজনীতি অর্থনীতি কঠিন কঠিন সব বিষয়। সব সংবাদের একই রকম ছবি। শুধু তথ্যটাই আলাদা। সংবাদের স্বার্থে এ খবর রাখতেই হবে। কিন্তু রাজধানীর বাইরের একটি ভালো সংবাদ একজন দর্শকের জন্যে যেমন বৈচিত্র্য হতে পারে, তেমনি দেশের জন্যে হতে পারে সার্বিক উন্ন্য়নের মৌলিক সূত্র।
সুপারিশ
রাজধানীর বাইরের টিভি সাংবাদিকতার উন্নয়নের জন্যে আমার বিছু সুপারিশ আছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে টিভি সাংবাদিকতায় ঢাকার সাংবাদিক এবং ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের তথাকথিত যে পার্থক্য তা কমে যাবে।যেমন-
১. রাজধানীর বাইরের সাংবাদিকদের বেতন বিল নিশ্চিত করতে হবে।
রাজধানীর বাইরের প্রত্যেকটি সাংবাদিককে কী করতে হয় না। সব সংবাদের দিকে মনোযোগ তার। দিনভর ছুটছেন। এতে প্রতিদিনই তার বেশ খরচ হচ্ছে। কিন্তু মাস শেষে শুধু বেতনটাই পাচ্ছেন বেশিরভাগ টেলিভিশনের সাংবাদিকরা। বিল অনিয়মিত প্রায় সবারই। দু-একটি টেলিভিশনের বেতন নিয়ে প্রচণ্ড নাখোশ রিপোর্টাররা। এমন চ্যানেলও আছে যেখানকার সংবাদিকরা আজ থেকে ৯ বছর আগে যে বেতনে শুরু করেছিলেন, আজো সেই বেতনই পান। কেউ লজ্জায় বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করেন না।
২. আধুনিক প্রশিক্ষণ।
প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। টিভি মিডিয়া খুবই দ্রুত পরিবর্তনশীল। যখন যে পরিবর্তন আসছে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে রাজধানীর বাইরের রিপোর্টারের পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তো টিভি চ্যানেলগুলোরই। তাছাড়া ব্যাকারণসম্মত ক্যামেরা চালানো, রিপোর্ট লেখা এবং শুদ্ধ উচ্চারণে বলতে পারাটা আসলে শেখারই বিষয়। জন্মের সময় সবকিছু সবাই শিখে আসেন না। কেউ সুযোগ পেয়ে সময়মতো শেখে। আর কেউ সুযোগের অভাবে অসময়ে শেখে। শিখতে আসলে হয়ই। চলতে গেলে শিখতে হবে।
৩. মাঝেমধ্যে ঢাকায় এনে কাজ করানো।
এই কাজটি বাংলাদেশে যদিও এখনো কোন টিভি চ্যানেল করেনি, কিন্তু করা উচিত। কারণ রাজধানীর বাইরে বসে অনেক সময় নিউজরুমের সমস্যা বোঝা যায় না। ঢাকার বাইরের কোনো রিপোর্টার যদি ঢাকার একজন রিপোর্টারের সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্টে যান, তাহলে উনি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারবেন কীভাবে ধাপে ধাপে কাজটি করা উচিত। অথবা উনি যদি ডেস্কেও কাজ করেন, তাহলেই বুঝবেন সমস্যাটা কোন যায়গায়। আমি নিশ্চিত, তিনি যখন এ অভিজ্ঞতা নিয়ে তার জেলার পৌঁছাবেন, তারপর থেকে নিউজরুমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে তার কোন সমস্যা হবে না।
৪. জেলায় জেলায় প্রযুক্তি চর্চার সুবিধা।
টিভি সাংবাদিকতার অর্ধেকেরই বেশি প্রযুক্তি। বাকিটা সাংবাদিকতা। এই দুটি উপাদানের প্রতিটিই এক অপরের পরিপূরক। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় থাকতেই হবে। তবে ঢাকার বাইরে এখনো মোবাইল মতো সবার হাতে কম্পিউটার পৌঁছায়নি। যে কারণে অন্তত প্রতিটি জেলা শহরে একটি সরকারি সাইবার ক্যাফে থাকা উচিত। সেখান থেকে সাংবাদিকরা যেন তার নিজের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে রাজধানীর বাইরের একজন রিপোর্টার সারা বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক মিডিয়ার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারবেন।
পলাশ আহসান: গণমাধ্যমকর্মী