মিডিয়ার পাঁচটি কাজের মধ্যে একটি হলো মানুষকে শিক্ষিত করা। মানুষ সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রতিদিন হরেক রকম খবর জানার পাশাপাশি ভাষাও শেখে। একটি বিষয়কে ভালোভাবে, স্পষ্ট করে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে শুদ্ধ ভাষায় না লিখলে চলবে না। আমরা জানি, বাক্যের গঠনে ভুল হলে, শব্দের প্রয়োগ ভুল হলে কিংবা বানানে ভুল হলে অর্থ বদলে যায়। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই সংবাদপত্রে শুদ্ধভাবে লেখা উচিত।
সংবাদপত্রের প্রতিটি পর্যায়ের কাজ খুব ব্যস্ততার মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়। অনলাইন পত্রিকায় তো বিষয়টি আরো দ্রুত। টেলিভিশনের টিকারের জন্যও শুদ্ধ বানান ও বাক্য প্রয়োজন। এ জন্য সবাইকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। মূল কপিতে ভুল থাকলে সেই ভুল শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই সংবাদ রচনার সময় একজন রিপোর্টারকে অন্যসব বিষয়ের পাশাপাশি শুদ্ধ ভাষায় লেখার দিকে সতর্ক ও মনোযোগী থাকতে হয়। অনেক রিপোর্টার ধরে নেন তথ্য ঠিক থাকলেই হলো। বাকি কাজ বার্তা সম্পাদক, শিফট-ইনচার্জ, সিনিয়র সহ-সম্পাদক অথবা সম্পাদনা সহকারী কেউ একজন ঠিক করে দেবেন। এই ধরনের ভাবনা একজন রিপোর্টারকে দু’দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এক. তার লেখা রিপোর্টটি ভুলভাবে ছাপা হতে পারে। দুই. এতে করে রিপোর্টারের যোগ্যতা নিয়ে অফিসে প্রশ্ন উঠতে পারে, যা তার ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
ধরুন একজন রিপোর্টার লিখলেন : ‘ধানমন্ডি থানা পুলিশ গতকাল একজন দোকানদারের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়ার সময় নিউমার্কেট থেকে চুইল্ল্যা আনোয়ার (৩৮) নামের একজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে।’ এ বাক্যে মনে হয় পুলিশই বুঝি দোকানদারকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করছিল। বাক্যটি হতে পারত-‘গতকাল একজন দোকানদারের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা নেয়ার সময় নিউমার্কেট থেকে চুইল্ল্যা আনোয়ার (৩৮) নামের এক সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।’
আমরা কোনো কিছু লিখতে গেলেই শব্দের ব্যবহারের সাধুরূপ নিয়ে আসি। ‘কাছে’ না লিখে ‘নিকটে’ লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এটা ঠিক নয়। সংবাদপত্রের ভাষা মুখের ভাষার যতো কাছাকাছি হয় তত বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত। সংবাদপত্র যেমন উচ্চশিক্ষিত লোকেরা পড়েন, তেমনি স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষও পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক সিনিয়র শিক্ষকের বক্তব্য হলো- সংবাদের ভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে অষ্টম শ্রেণী পাস একজন ব্যক্তি পড়ে বুঝতে পারে।
বানানের দিকে রিপোর্টাররা মনোযোগ দিতে আগ্রহী কম। কিন্তু বানানের হেরফেরে অর্থ একদম পাল্টে যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আভাষ অর্থ ভূমিকা। কিন্তু কেউ যদি আভাস লেখেন? আভাস অর্থ ইঙ্গিত। কৃতি অর্থ কার্য; কৃতী মানে কৃতকর্মা। হ্রস্ব ই-কার ও দীর্ঘ-ইকারের কারণে অর্থ বদলে যাচ্ছে। বাধা অর্থ প্রতিবন্ধক, আর ব’র ওপর চন্দ্রবিন্দু দিলে অর্থ দাঁড়ায় বন্ধন করা। সত্ব অর্থ সত্ত্বা, অসিত্ব। আর দন্তস্য’র নিচে ব দিলে অর্থ হয়ে যায় অধিকার।
লেখার ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিককে এই বিষয়গুলো ছাড়াও হাউস স্টাইল অনুকরণ করতে হয়। পত্রিকাগুলোতে কিছু শব্দ ব্যবহারে এবং বানানে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।। পত্রিকাগুলো নিজস্ব বানান ও লেখারীতি অনুসরণ করে। এর জন্য বড় পত্রিকাগুলো নিজস্ব স্টাইল শিট তৈরি করে নেয়।
কিছু পত্রিকা বাড়ি, গুলি, পাখি লিখতে দীর্ঘ-ই-কার ব্যবহার করে। কোনো কোনো পত্রিকা ‘সাংসদ’ লিখলেও এমন পত্রিকাও আছে যারা ভুলেও এটি লিখবে না, লিখবে ‘সংসদ সদস্য’। এমন পত্রিকা আছে যারা, ‘উপাচার্য’ মরে গেলেও লিখবে না। লিখবে ‘ভাইস-চ্যান্সেলর’। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ক্রিকেট লেখে কৃকেট, ব্রিটেনকে বৃটেন ক্রিজ-এর বানান লেখে কৃজ। এই যে বানান ও শব্দের ভিন্নতা- এগুলোই হলো পত্রিকার নিজস্ব হাউস স্টাইল। একজন রিপোর্টারকে ভাষাবিদ হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যাতে শুদ্ধ ভাষা লেখা যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টা করতে দোষ কী? এক্ষেত্রে নিজ পত্রিকার স্টাইল শিট বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা রাখে। কাজেই পত্রিকাগুলোর নিজস্ব স্টাইল শিট থাকা উচিত। এটি যেমন পত্রিকাটির মর্যাদা, নির্ভরযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি স্বাতন্ত্র্য প্রকাশেরও প্রতীক হয়ে ওঠে।
-সংগৃহিত
0 comments:
Post a Comment