সাব-এডিটর হচ্ছেন সংবাদপত্রের নেপথ্য নায়ক। তিনি তার সম্পাদনার দক্ষতার বৈচিত্র্য দিয়ে সংবাদপত্রের ভাবমর্যদা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সংবাদ কপির একটি অপরিচ্ছন্ন, দুর্বল ও দুর্বোধ্য লেখাও তার হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে পরিপাটি, পরিশুদ্ধ, যথার্থ ও সুপাঠ্য।
সাব-এডিটরকে তাই বলা হয় ‘King of the news desk'; কেননা সাব-এডিটররা তাদের অসাধারণ সম্পাদনা দক্ষতা দিয়ে নানা ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রতিবেদনকে পাঠকের কাছে ত্রুটিমুক্ত করে পরিবেশন করতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সে কারণে বলা হয়ে থাকে, ‘Reporters write the paper but sub-editors make it.’
এতসব কাজ করেন সাব-এডিটররা, অথচ তাদের কথা জানেন না কেউ। একজন রিপোর্টারের জীবনে অসংখ্যবার ছাপা হয় বাইলাইন স্টোরি। সফল রিপোর্টার তার করা স্টোরির জন্য অসংখ্যবার হয়তো পান অনেক মানুষের বাহবা। কিন্তু সাব-এডিটর, যিনি প্রতিটি প্রতিবেদনকে পাঠযোগ্য, যথার্থ ও নির্ভুল করাসহ এত অসংখ্য কাজ করেন, তিনি চিরকাল থেকে যান পর্দার অন্তরালে। পত্রিকায় তার নাম ছাপা হয় না। কোনো টেলিফোন বেজে ওঠে না তার প্রশংসায়। পাঠক তার নামে উচ্চারণ করেন না কোনো মঙ্গলধ্বনি।
আর এ কারণে সাব-এডিটরকে বলা হয় `Unsung hero of the newspaper'. সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে যেকোনো সংবাদ কপি তার হাতেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছোঁয়া পায় বলেই তাকে বলা হয় ‘সীমান্তের শেষ ফাঁড়ি’ ( Last cheek post)।
বার্তা বিভাগের সবাই এক একজন সাব-এডিটর। এমনকি বার্তা সম্পাদকও তাদের মধ্যে একজন। বার্তা সম্পাদক বার্তা বিভাগের প্রধান। তার অধীনে শিফট-ইন-চার্জ, চিফ সাব-এডিটর, সিনিয়র সাব-এডিটর এবং অন্যসব সাব-এডিটর কাজ করেন।
সাব-এডিটটের যোগ্যতা ও গুণাবলি :
সাব-এডিটরের কাজের ফিরিস্তি থেকে নিশ্চয় অনুমান করা যায়, এতসব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হলে কী ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন। সাব-এডিটরকে ‘সব কাজের কাজি’ হতে হয়। এবং অবশ্যই বেশকিছু বিষয়ে তার থাকতে হয় পাণ্ডিত্য। সাব-এডিটরের থাকতে হয় সুশৃঙ্খল মন। তার মনের সুশৃঙ্খলাই তাকে সহায়তা করে কপি সম্পাদনা করতে।
১. সংবাদ চেতনা : নানা সোর্স থেকে অসংখ্য খবর আসে সংবাদকক্ষে। এসব থেকেই সাব-এডিটরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোনটি সংবাদ আর কোনটি নয়। আর যেটি সংবাদ সেটি সংবাদপত্রের কোথায়, কত কলাম জুড়ে যাবে, সেটি তাকেই নির্ধারণ করতে হয়। সাব-এডিটরের এসব সিদ্ধান্ত নিতে যে বোধ বা চেতনার প্রয়োজন হয়, তা-ই হলো সংবাদ চেতনা ( News Sence )। সাব-এডিটররা এই সংবাদ চেতনা দিয়ে সংবাদের মূল্য নির্ণয় করে থাকেন।
২. সন্দেহবাতিক মন : সাব-এডিটরের মন সুশৃঙ্খল হলেই চলে না, তার মনে সন্দেহের একটি স্থায়ী আবাসও থাকতে চাই। সবকিছুতে সন্দেহ করার একটি বাতিক থাকা চাই তার। কপির যেখানেই সন্দেহ হবে সেখানেই চলবে তার কলম/কম্পিউটারে আঙুল।
৩. বিশ্লেষণ ক্ষমতা : সাব-এডিটরের বিশ্লেষণী ক্ষমতা থাকা চাই। যেকোনো কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তার থাকতে হবে। তিনি হবেন খুঁটিনাটি বিষয়ের মাস্টার। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি নাম, সম্ভব হলে প্রতিটি শব্দ তিনি তার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চ্যালেঞ্জ করবেন।
সাব-এডিটরের ক্ষমতা থাকতে হয় সংবাদ থেকে মতামত পৃথক করে ফেলার। স্টোরির মধ্যে লুকিয়ে থাকে মতামত, লৈঙ্গিক ও সামাজিক পক্ষপাতিত্ব, এসব কিছু বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগ করে শনাক্ত করতে জানতে হয় তাকে। বিচার-বিশ্লেষণ করে যেকোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব শনাক্ত করার ক্ষমতা তার থাকা চাই।
৪. বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার : সাব-এডিটরের থাকতে হবে একটি বড় জ্ঞানভাণ্ডার। সব ধরনের, সব বিষয়ের স্টোরিই তো তার চেকপোস্টে ছাড়পত্র নিতে হাজির হয়। কাজেই সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ইস্যু আর প্রবণতাগুলো সম্পর্কে তাকে জানতে হয় বেশ ভালোভাবে। জানতে হয় তার নিজের সংবাদপত্র আর নীতি সম্পর্কেও। সাব-এডিটরের জ্ঞানভান্ডারে থাকতে হয় বই-পুস্তক, নাটক-উপন্যাস, ম্যাগাজিন-রিভিউ ইত্যাদি থেকে শুরু করে আইন ও সরকার সম্পর্কেও ভালো জানা-শোনা। তার জানা থাকতে হয় খ্যাতিমান সম্পর্কে, এমনকি জানতে হয় বিভিন্ন স্থান সম্পর্কেও। রাজনৈতিক আর সামাজিক সম্পর্কগুলোও রাখতে হয় মাথায়। ভূগোল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কেও তাকে জানতে হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ। সবচেয়ে বেশি জানতে হয় নিজের চারপাশ সম্পর্কে। নিজের ইন্টারনেট কানেকশন থাকা মহা জরুরি।
৫. সময় সচেনতা : সাব-এডিটরকে হতে হয় অত্যন্ত সময় সচেতন। সময় হচ্ছে সংবাদপত্র জগতে গুরত্বপূর্ণ বিবেচনা। সাব-এডিটরের কাছে যখন কপি পৌঁছে, তখনো বাকি থাকে অনেক কাজ, কিন্তু সময় থাকে খুবই কম। ডেড লাইন অতিক্রম করার আগেই কপি ছাপার উপযুক্ত করে ফেলার কাজটি সমাপ্ত করতে তাই সাব-এডিটরকে সময় সম্পর্কে হতে হয় অত্যন্ত সতর্ক।
৬. ভাষা ও ব্যাকরণ জ্ঞান : সাব-এডিটরকে ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা চাই। তিনি যেন অতি সহজেই বাক্য গঠনের দুর্বলতা চট করে ধরতে পারেন। কী ধরনের শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করলে সংবাদটি সহজপাঠ্য ও অর্থবহ হয় তা তাকে দ্রুতই বুঝতে হবে। তাকে আরো বুঝতে হবে, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ভাষা আলাদা। সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে পারসোনাল স্টাইল বলতে কিছু নেই। অথচ সাহিত্যে তা আছে। সঙ্গত কারণে সংবাদ লেখা ও সম্পাদনায় যথার্থ, নির্মোহ ও বস্ত্তনিষ্ঠ শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করার ব্যাপারে সাব-এডিটরকে বিশেষ পারদর্শী হতে হবে। অনেক শব্দভাণ্ডার তার থাকা চাই। চাই সব লেখাকে তার পত্রিকার স্টাইল অনুসরণ করে সংক্ষিপ্ত করার ক্ষমতা।
৭. বন্ধুভাবাপন্ন : জীবন ও জগত সম্পর্কে অনেক কিছু জানার পরও মানুষের কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু সদা মিশুক ও বন্ধুবৎসল হলে সাব-এডিটর তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা মাত্রায় সহযোগিতা পেতে পারেন। আর বন্ধুবৎসল না হলে ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি কর্মস্থলেও তাকে বহু সমস্যা ও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
৮. উদ্যমী ও সৃজনশীল : সাব-এডিটর হবেন একজন সৃজনশীল, উদ্যমী ও উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ। কপি পরিশুদ্ধ ও পরিমার্জন করার সময় তাকে যেমন সৃজনশীল, বৈচিত্র অন্বেষী ও উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন হতে হবে, তেমনি তাকে সম্পাদনা কাজে পর্যাপ্ত উদ্যম ও আনন্দ খুঁজে পেতে হবে।
৯. রুচিবোধ : সংবাদপত্রের সুনাম ও পাঠকের রুচি ক্ষুণ্ন করে এমন যেকোনো স্পর্শকাতর তথ্য সম্পর্কে সাব-এডিটরকে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি, সংবাদ পরিবেশনে এবং সংবাদের সঙ্গে পরিবেশিত ছবি যাতে গ্রহণযোগ্য রুচির মানদণ্ডের মধ্যে থাকে, সেদিকে তাকে বিশেষ লক্ষ রেখে পত্রিকার যাবতীয় তথ্য উপকরণ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সুস্থ রুচিবোধের পরিচয় দিতে হবে।
১০. শারীরিক সামর্থ্য : শারীরিকভাবে সুস্থ হতে হবে। দুর্বল স্বাস্থ্যের ব্যক্তির পক্ষে সাব-এডিটরগিরি করা সম্ভব নয়। দিনে-রাতে যেকোনো শিফটে তাকে কাজ করতে হতে পারে।
১১. দ্বিমুখী মন : এই সবকিছুর সাথে সাব-এডিটরকে হতে হয় দ্বিমুখী মনের অধিকারী। সাব-এডিটরের এই গুণটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘বাইফোকাল মাইন্ড’। একদিকে খুঁটিনাটি বিবরণ যাচাই করবেন সাব-এডিটর, আবার একইসাথে নিমিষের মধ্যে তিনি চলে যাবেন সামগ্রিক ঘটনায় বা বিস্তারিততে। দ্বিমুখী মন হচ্ছে এমন মন `one that can be shifted instantly from meticulous examination of details to the overall story'। দ্বিতল লেন্স বা বাইফোকাল লেন্সের কথা আমরা জানি, এই লেন্সের চশমার অধিকারী যেমন কাছের জিনিস দেখতে দেখতে সহসাই চলে যেতে পারেন দূরের কিছু দেখায়, আবার চাওয়ামাত্রই প্রত্যাবর্তন করতে পারেন কাছের দৃশ্যে; তেমনই বাইফোকাল মাইন্ডের অধিকারী সাব-এডিটর স্টোরির খুঁটিনাটি যাচাই করতে করতেই তাকাতে পারেন স্টোরির সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে। অবিরামভাবে চলে সাব-এডিটরের দ্বিমুখী মনের ব্যবহার।
নিচের স্টোরিটি লক্ষ করুন :
গতকাল এক সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন শিশু ও একজন মহিলা। নিহতদের নাম লারা (৮), বিপু (১৯), দিশা (৩) ও জিনা (৩৪)।
উপরের সংবাদ সূচনায় দেখা যাচ্ছে, কোথায় সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে তা বলা হয়নি, সাব-এডিটর এই ত্রুটি দূর করার পদক্ষেপ নেবেন। আরো দেখা যাচ্ছে, পাঁচজন নিহতের কথা বলা হলেও নাম আছে চার জনের, নিহতের তিনজন শিশু বলা হলেও একজনের বয়স দেয়া হয়েছে ১৯। স্টোরি পড়তে পড়তেই তথ্যের স্বল্পতা থেকে ভ্রান্তি এবং অসামঞ্জস্য সব কিছু সংশোধন করতে হবে সাব-এডিটরকে। এখন যদি তিনি দ্বিমুখী মনের অধিকারী হন তাহলে তিনি ওপরের ত্রুটিগুলো ধরতে পারবেন। একদিকে তিনি প্রাপ্ত তথ্যের দিকে নজর দেবেন, একজনের নাম জিনা না জিনাত তা যাচাই করবেন, অন্যদিকে চিন্তা করে দেখবেন, একজনের নাম কি বাদ পড়েছে না কি মারা গেছে চার জন, ভুলক্রমে নিহতের সংখ্যা লেখা হয়েছে পাঁচ। সাব-এডিটরের এই এক সাথে দুইদিকে মনোনিবেশ করার ক্ষমতা হচ্ছে দ্বিমুখী মনের বহিঃপ্রকাশ।
সংগৃহিত
Good one