নিজ নিজ পেশার মানুষ সহজেই কাছে আসে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে চিন্তা ও চেতনার ঐক্য। মতবিনিময় সহজ হয়। ভাববিনিময়ে ভালো লাগার পরিবেশ থাকে অনুকূল।
এ কারণেই রাজধানী থেকে বাইরে গেলেই জেলা-উপজেলার সাংবাদিকদের সাথে আড্ডা হয়। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি দারুণভাবে লাভবান হই। উপকৃত হই। সমৃদ্ধ তো হই-ই। কাছ থেকে জানা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের দুঃখ-বঞ্চনা, না পাওয়ার বেদনা। আবার তাদের পাওয়ার অভাবনীয় আনন্দের কথা জেনে বিস্মিত হতে হয়।
এই পাওয়ার ধরন এবং রকম একেবারেই ভিন্ন। ঢাকার সাংবাদিকদের ভাগ্যে এসবের কিছুই জোটে না।
মফস্বল সাংবাদিকদের বঞ্চনার অন্ত নেই। পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ অপ্রাপ্তির বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু অনেক কষ্টে পাঠানো কোনো খবর যখন ছাপা হয় না অথবা চ্যানেলে প্রচার হয় না, তখন তাদের দুঃখবোধের মাত্রার সীমা-পরিসীমা থাকে না। হতাশ হন। ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। নিজেকে অক্ষম এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্যর্থ মনে হয়।
মফস্বলের সাংবাদিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য পরস্পরের সাথে সংবাদ বিনিময় করেন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ এক সাধারণ রীতি। লক্ষ্য একটাই- খবর যাতে মিস না হয়। দেখা গেল যিনি খবরটির মূল সংগ্রাহক তার নিজের পত্রিকাতেই নিউজটি ছাপা হলো না। অথচ যিনি তার কাছ থেকে খবরটি নিয়ে পাঠালেন, সেই সাংবাদিকের পত্রিকায় ছাপা হলো। সংবাদের মূল সংগ্রাহক তখন পড়েন বিড়ম্বনায়। হন বিব্রত। এ ধরনের ঘটনার প্রায়ই শিকার হন মফস্বলের সাংবাদিকরা।
‘ভাত দেবার মুরোদ নেই- কিল দেবার গোঁসাই’- এ প্রবাদ বাক্যটির প্রায় শিকার হন মফস্বল সাংবাদিকরা। নিউজ মিস করলে ঝাড়ি খেতে হয়। কিন্তু বেতন, মোবাইল ও ফ্যাক্স বিলের কথা বললেই কর্তৃপক্ষ নারাজ হন। বাদ দেয়ার হুমকি দেন। নিউজে ভুল হলে খবর আছে। ভালো হলে কখনোই ধন্যবাদ জোটে না। এ এক উদ্ভট ব্যাপার।
সাংবাদিকতা করো ঠিক আছে, কিন্তু কাজ তো একটা কিছু করতে হবে- মফস্বল সাংবাদিকদের সম্পর্কে বেশিরভাগ পিতা-মাতা ও মুরবিবদের এটিই চূড়ান্ত মন্তব্য। তাদের অনেকেই মনে করেন, সাংবাদিকতা কোনো কাজ না। স্রেফ নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো। একবার নয়া দিগমেত্মর এক উপজেলা সংবাদদাতার বাবা টেলিফোন করেন। তিনি জানতে চাইলেন, তার তরুণ ছেলেটি যে নিউজ পাঠানোর কাজ করে এটি কী কোনো চাকরি? না শুধু শুধু পয়সা খরচ করা। তিনি অনুরোধ করলেন, আমরা যাতে তার ‘পাগল’ ছেলেকে কোনো কিছু করতে বলি। কারণ তিনি তার ছেলেকে বিয়ে করানোর চিন্তা করছেন।
বলা হয়ে থাকে, দু’টি পেশা আছে এমন, যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। একটি শিক্ষকতা, অপরটি সাংবাদিকতা। এ দু’টি পেশাতেই এক ধরনের মোহ আছে। মোহ সম্মান এবং সালামের। সামাজিক মর্যাদার। এ এক সর্বনাশা নেশা। বলা যায়, মফস্বল সাংবাদিকদের অনেকেই এই ‘সর্বনাশা নেশায়’ হাবুডুবু খান। কিন্তু ছাড়েন না। সরেন না। আসলে ছাড়তে পারেন না। সরা যায় না।
ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে হিংসা, রেষারেষি, সহযোগিতা সবই হয়। এসব হয় কৌশলে। গোপনে। ধূর্ততার সাথে। অনেকেই জানতে পারেন না। মফস্বলেও এ ধরনের অবস্থা বিরাজমান। তবে সবই হয় প্রকাশ্যে। পক্ষ দুটো। হয় শত্রু, নয় বন্ধু। মাঝামাঝি সম্পর্ক বলে কিছু নেই। গ্রুপিংয়ের মাত্রা এবং অবস্থান অনেক বেশি শক্ত, কঠোর। প্রয়োজনে কঠোরতর।
ভালো-মন্দ এসব মিলিয়ে মফস্বল সাংবাদিকরা সরবভাবেই আছেন। আছেন সবকিছুতেই। আছেন স্থানীয় রাজনীতিতে, প্রশাসনে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। তারা এলাকার কোন কোন জায়গায় আছেন তার খোঁজ নিলে কূলকিনারা পাওয়া কঠিন। বরং কোন জায়গায় নেই তার তত্ত্বতালাশ পাওয়াই সহজ।
লিখে সাধারণ মানুষের উপকার করার কিংবা স্থানীয় কোনো বিগম্যানকে ধসিয়ে দেয়ার যে পরিমাণ ক্ষমতা একজন জেলা সংবাদদাতার আছে তার হাজার ভাগের এক ভাগও ঢাকার কোনো চালু পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতারও নেই। নিঃসন্দেহে এই দিকটি থেকে মফস্বল সাংবাদিকরা অনেক বেশি ক্ষমতাধর। সম্ভবত এটিই মফস্বল সাংবাদিকদের সবচেয়ে ভালো লাগা ও তৃপ্তির বিষয়। এ ক্ষমতা তার অনেক অপ্রাপ্তির শূন্যতা পূরণ করে দেয়।
0 comments:
Post a Comment