প্রতিটি খবরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো ঘটনা থেকে বিশেষ কিছু বের করে আনার মধ্যেই রিপোর্টারের কৃতিত্ব। আমরা জানি, প্রতিটি সংবাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্থিতাবস্থার বিঘ্ন ঘটা বা সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। সাংবাদিক যদি বুঝতে পারেন কোন বিষয়টিতে পাঠকের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি- তাহলে বলা যায় তার নিউজ নোজ আছে। তিনি সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি ধরতে পেরেছেন।
সংবাদপত্রে কোনো নিউজ পাঁচ কলামে প্রথম পাতায় ছাপা হয়, কোনো নিউজ আবার সিঙ্গেল কলামে ভেতরের পাতায় প্রকাশিত হয়। এমনটি হওয়ার নিশ্চয় যৌক্তিক কারণ আছে। কোন নিউজ কোন পাতায় কিভাবে ঠাঁই পাবে তা নির্ভর করে ওই নিউজটির ব্যাপারে আগ্রহী মানুষের সংখ্যার ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায় একটি বোমা ফাটলে সেটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়। কিন্তু কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে চারটি বোমা ফাটলেও সেই খবরটির জায়গা হয় শেষের পাতায় অথবা ভেতরের পাতায় কিংবা মফস্বল পাতায়। কেন এমনটি হয়? এর সহজ জবাব হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা বিস্ফারণের ঘটনাটি যত মানুষকে আগ্রহী কিংবা উদ্বিগ্ন করে, ভিক্টোরিয়া কলেজের একই ঘটনা ততসংখ্যক মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সংবাদ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এটিই অবশ্য চরম সত্য কিছু নয়। কোনো সংবাদপত্রের পলিসির ওপরও সংবাদ মূল্যায়নের বিষয়টি নির্ভরশীল। উত্তরবঙ্গে কানসাটের ঘটনা আওয়ামী-ঘরানার পত্রিকা যেভাবে ফলাও করে প্রচার করছে, সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো সে রকমটি করছে না। কয়েকটি খবরের শিরোনাম দিয়ে ব্যাপারটি আরেকটু খোলাসা করা যাক: কানসাট জনতার দখলে (সংবাদ), কানসাটে ঊনসত্তরের হাতছানি (ভোরের কাগজ)। আবার একই তারিখেএকটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম: সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চট্টগ্রামে এখন সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি। এ ধরনের শিরোনাম দিয়ে ফলাও করে নিউজ করার পেছনে সংবাদমূল্যের চেয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ কিংবা পত্রিকার পলিসিই বেশি গুরুত্ব বহন করে। এখানে পাঠকের আগ্রহ-অনাগ্রহ বিষয়টি চূড়ামত্মভাবে অনুপস্থিত।
রাজনৈতিক পÿপাত থেকে সংবাদের মূল্য নির্ধারণের অতি সাম্প্রতিক আরো একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বিশ্বে সর্বশীর্ষে অবস্থানকারী সাময়িকী ‘টাইম’-এর সর্বশেষ (১০ এপ্রিল ২০০৬) সংখ্যার কভার স্টোরি নিয়ে পত্রিকাগুলো যেভাবে পÿপাতমূলক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। টাইমের কভারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি ছাপা হয়। ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ বা পুনর্গঠন বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক কভার স্টোরি হয়েছে। সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলো বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে। কিন্তু বিরোধী দলের সমর্থক পত্রিকা ও কলামিস্টরা এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তারা বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে এগুলো করাচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশী পত্রিকা কেন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো বলল- এটিই তাদের রাগের কারণ। টাইমে এ রিপোর্টটি লেখেন সাংবাদিক অ্যালেক্স কেরি।
এই অ্যালেক্স কেরিই যখন ২০০২ সালের ১৪ এপ্রিল এই ম্যাগাজিনেই ‘ডেডলি কার্গো’ শিরোনামে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট লিখেছিলেন, তখন আওয়ামী-ঘরানার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা উল্লসিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সরকার। তারা অ্যালেক্স কেরির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে।
সে যাক। আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক আনুগত্যশীল মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা না বাড়িয়ে সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য খোঁজার দিকে আবার মনোযোগ দিই। স্টাফ রিপোর্টাররা কোনো ঘটনার বিশেষ দিক খুঁজে বের করতে প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হন। একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক সহজেই সংবাদের এমন বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে। ঘটনা থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বের করতে পারলে সংবাদ-সূচনা (ইনট্রো) লেখা সহজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো চেনার উপায় কী, এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সংজ্ঞাই বা কী?
একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এর জবাবে বলেছেন, বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো ঘটনাপ্রবাহ বা সজ্জিত ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতর, বিশিষ্ট এবং সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ঘটনাংশ বা উপাদান। আসলে বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কোনো রহস্য নেই, নেই কোনো সূক্ষ্ম চাতুর্যের বা কলাকৌশলের প্রয়োগ, এমনকি কোনো নিয়মকানুন বা রীতিপদ্ধতিও নেই, পুরোটাই উপলব্ধির অন্তর্গত।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সময়। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিনই বক্তৃতা দেন। একই কথা হয়তো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে বলেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন, ‘১৭ আগস্টের আগে সরকার জঙ্গি সম্পর্কে জানত না’ (বিশ্বখ্যাত সাময়িকী টাইমকে দেয়া সাক্ষাৎকার) তখন এটিই হয়ে যায় সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অর্থমন্ত্রী কত কথাই না বলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রায়ই এমনসব কথা বলে বসেন যা তার বক্তৃতারই নয়- সেটা সেমিনারের সংবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার পরামর্শ কিংবা পেঁয়াজ না খেলে কী হয় ইত্যাদি। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীর তো কথাই নেই।
সংসদ চলাকালীন তর্ক-বিতর্ক হয়, ওয়াকআউটের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু যদি কেউ রিভলবার নিয়ে সংসদে ঢোকেন, এমপিরা যদি মারামারি করেন কিংবা এক এমপি আরেক এমপিকে মা-বাবা তুলে গালি দেন তাহলে সেদিনের অধিবেশনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হবে এসব ঘটনা।
0 comments:
Post a Comment