সংবাদপত্রের কাঠামো অনুযায়ী দেখা যায়, সেখানে বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা তাদের জন্য নির্ধারিত কাজ করে থাকেন। রেডিও, টেলিভিশন কিংবা অন্য যেকোনো গণমাধ্যমের জন্য একই কথা প্রযোজ্য।
অন্য সবার মতো একজন রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের কাজও নির্ধারিত। শিক্ষানবিশ থেকে শুরু হয় রিপোর্টারদের পদবি। এরপর স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার হয়ে স্পেশাল করেসপনডেন্ট বা বিশেষ প্রতিনিধিই এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদ। তবে চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদক বলে একটা পদ থাকে, যেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পত্রিকাগুলোয় একজন করেই প্রধান প্রতিবেদক দেখা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন, ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এ দুজন প্রধান প্রতিবেদক। এ ছাড়া ‘প্রথম আলো’সহ আরো কয়েকটি পত্রিকায় ডেপুটি চিফ রিপোর্টারের একাধিক পদ রয়েছে। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে চিফ রিপোর্টার না বলে আজকাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর হিসেবেই ডাকা হয়।
রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের যেমন নির্দিষ্ট করে দেয়া কাজ আছে, তেমনি দায়িত্ব নির্ধারিত চিফ রিপোর্টারেরও। প্রতিবেদকের কাজে যাওয়ার আগে চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বের ধরন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া দরকার।
চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদক
প্রধান প্রতিবেদককে তার প্রতিষ্ঠানের সব রিপোর্টারকে নিয়ে কাজ করতে হয়। পরের দিনের সম্ভাব্য ঘটনাগুলো নিয়ে যেমন পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়, তেমনি দিনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনাও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তার যথাযথ খোঁজ নিতে হয়। কেবল খোঁজ নেয়াই শেষ কথা নয়; ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তার জন্য উপযুক্ত এক বা একাধিক রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান নিযুক্ত করে ঘটনাটি কাভার করতে হয়। একই সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ দিন সামনে রেখে সংবাদ পরিকল্পনার কাজটিও করেন তিনি। সব মিলিয়ে বলা যায়, সংবাদ ব্যবস্থনার গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গায় থাকেন প্রধান প্রতিবেদক। বিশেষ প্রতিবেদন, দিনের ঘটনা এবং হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মালার মতো গাঁথার কাজটিই করেন তিনি।
একজন প্রধান প্রতিবেদককে চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। তার ‘সোর্স’রা যেমন তাকে সব ধরনের খবরাখবর জানান, তেমনি নির্দিষ্ট বিটের রিপোর্টারও সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে তাকে অবহিত রাখেন। আর সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা নেন। আর সংবাদ কাভার করার ক্ষেত্রে চিফ রিপোর্টার প্রয়োজনে গণমাধ্যমটির ব্যবস্থাপনার উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি, যেমন সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। তাদের নির্দেশনা নিতে পারেন।
বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে চিফ রিপোর্টারের দুটি ভালো সংজ্ঞা পাওয়া গেছে। এখানে তা উল্লেখ করা হলো:
The official head of the reporting department is called Chief reporter. He is the one who allots work for the other reporters according to their skill, ability and kind of work suits to them along with the deadline of reporting.
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের কাজের ধারা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। প্রধান প্রতিবেদকই হচ্ছেন সব রিপোর্টারের অফিসিয়াল প্রধান। প্রত্যেক রিপোর্টারের যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি কাজ ও দায়িত্ব বন্টন করেন। নির্দিষ্ট সময় পর সেই কাজ আবার বুঝেও নেন। যেকোনো ধরনের সমস্যা কিংবা কোনো কিছু বলার থাকলে একজন রিপোর্টার তা প্রধান প্রতিবেদককে অবহিত করেন।
"Chief Reporter" means a person who is in-charge of all reporters at a centre of publication, supervises their work and also regularly reports and interprets all news of legislative, political or general importance.
এখানে চিফ রিপোর্টারের কাজকে আর একটু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি কেবল অন্য রিপোর্টারদের কাজ তদারকিই করবেন না, মাঝে মাঝে গুরুত্ব বুঝে নিজেও রিপোর্টিং করবেন। বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও আইনগত ব্যাখ্যাও তুলে ধরবেন।
প্রধান প্রতিবেদকের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রিপোর্টারদের মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট বা কাজ বণ্টন।
অ্যাসাইনমেন্ট
অ্যাসাইনমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়- একটি হচ্ছে জানা ঘটনা; অন্যটি অজানা ঘটনা।
জানা ঘটনা: এ ধরনের বিষয় চিফ রিপোর্টার আগেই জেনে থাকেন। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট বিটের রিপোর্টারই তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, চিঠি কিংবা আমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা অফিস জেনে যায়। যেমন: সভা, সেমিনার, গোলটেবিল, পূর্বনির্ধারিত জনসভা, পথসভা, মিছিল, সাংস্কৃতিক আয়োজন ইত্যাদি। মোটা দাগে এগুলোকে বলা হয় ‘আগেই ঠিক হওয়া দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড’।
অজানা ঘটনা: অজানা ঘটনাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন:
• অনুসরণ: নির্ধারিত কিছু বিট বা ক্ষেত্র থাকে যা রিপোর্টাররা দিনের পর দিন অনুসরণ করেন। নিয়মিত লেগে থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসেন। এসব ক্ষেত্রে রিপোর্টারকে বিশেষ ওই জায়গার প্রতি নিয়মিত নজর রাখতে হয়। খোঁজ-খবর রাখতে হয়। এমনকি নানা ধরনের লোকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে সংবাদ বের করে আনতে হয়। এসব জায়গায় নজরদারি বাড়িয়ে বা অনুসরণের মধ্যে রেখে নিয়মিত ভালো রিপোর্ট করা সম্ভব। যেমন, সংসদ, সচিবালয়, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইত্যাদি।
• হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা: হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার সংবাদমূল্য হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে হলেও সেই ঘটনা কাভার করতে হয়। বের করে আনতে হয় ঘটনার পেছনের কারণ, ঘটনার প্রেক্ষাপট। তা ছাড়া এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানবিক বিষয়গুলোও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হয়। এর জন্য রিপোর্টিং টিমকে সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের কথা। কেউ কি জানত এখানে আগুন লাগবে? আগুন লাগার পর যখন এই খবর নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তখন সংবাদকর্মীরাও ছুটে গেলেন সেখানে।
• একইভাবে লঞ্চডুবি, সড়ক দুর্ঘটনা, ভূমিধসসহ নানা ঘটনাই হঠাৎ করে ঘটে যেতে পারে। বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা শুরু হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি মারা যেতে পারেন। কিংবা অর্জিত হতে পারে বড় কোনো সম্মান, সাফল্য। এসব কিছুই খেয়াল রাখতে হয় সাংবাদিকদের। বিশেষ করে চিফ রিপোর্টারের নেতৃত্বে রিপোর্টিং টিমকে।
অ্যাসাইনমেন্টের গুরুত্ব
অ্যাসাইনমেন্টের গুরুত্ব নির্ভর করে সেই ঘটনায় মানুষের কতটা আগ্রহ আছে তার ওপর। আর সেই ঘটনা কতটা গুরুত্ব পাবে তা নির্ভর করে কিছু নিয়ামকের ওপর। অর্থাৎ সেই ঘটনায় কতটা সংবাদ উপাদান আছে, তার ওপর।
কার্ল ওয়ারেন তার ‘মডার্ন নিউজ রিপোর্টিং’ বইয়ে সংবাদ হতে হলে আটটি উপাদান থাকতে হবে বলে আলোচনা করেছেন। উপাদানগুলো হচ্ছে:
• তাৎক্ষণিকতা (Immediacy)
• নৈকট্য (Proximity)
• খ্যাতি (Prominence)
• বিষমতা (Oddity)
• দ্বন্দ্ব (Conflict)
• বিস্ময় (Suspense)
• আবেগ (Emotions)
• পরিণাম (Consequence)
•
এর বাইরেও আরো কয়েকটি সংবাদ উপাদানকে বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন:
• আকার (Size)
• গুরুত্ব (Importance)
• তাৎপর্য (Significance)
• মানবিক আবেদন (Human Interest)
রিপোর্টার বা প্রতিবেদক
রিপোর্টার বা প্রতিবেদক হচ্ছেন একটি সংবাদমাধ্যমে সংবাদের নিজস্ব উৎস। সংবাদ পেতে অনেকাংশেই তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আগেই বলেছি, রিপোর্টার হতে পারেন শিক্ষানবিশ থেকে শুরু করে বিশেষ প্রতিনিধি পর্যন্ত। রিপোর্টারদের সরাসরি দায়বদ্ধ থাকতে হয় চিফ রিপোর্টার বা প্রধান প্রতিবেদকের কাছে।
উইকিপিডিয়ায় একজন রিপোর্টার সম্পর্কে বলা হয়েছে, A reporter is a type of journalist who researches, writes, and reports information to present in sources, conduct interviews, engage in research, and make reports. The information-gathering part of a journalist's job is sometimes called "reporting," in contrast to the production part of the job such as writing articles. Reporters may split their time between working in a newsroom and going out to witness events or interview people. Reporters may be assigned a specific beat or area of coverage.
উপরের সংজ্ঞায়ন থেকে একজন রিপোর্টারের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকটাই বোঝা যাচ্ছে। একজন রিপোর্টারকে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। কোনো একটি বিষয়ের তথ্য অনুসন্ধানে তাকে যেমন নামতে হয় গবেষণায়, তেমনি সেই তথ্য যুক্তিসঙ্গত উপায়ে লিখে উপস্থাপনও করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজনে সাক্ষাৎকার নেয়ার কাজটিও করতে হয় তাকে। রিপোর্টারকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অফিসের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক ক্ষেত্রেই নানা ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখিও হতে হয়। আর এসব কিছু মাথায় রেখেই তাকে প্রস্তুতি নিতে হয়।
রিপোর্টার বা প্রতিবেদকের প্রস্তুতি
রিপোর্টারের প্রস্তুতি নির্ভর করবে কোন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট তাকে দেয়া হয়েছে তার ওপর। অ্যাসাইনমেন্টটি কি আগেই জানা ঘটনার ওপর, নাকি হঠাৎ ঘটেছে। সেটি কি তার নির্দিষ্ট বিট অনুসরণের, নাকি হঠাৎ ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের। এমনও হতে পারে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে কোনো সভা-সমাবেশ, কিংবা প্রেস কনফারেন্স, সেমিনার কাভার করার। তা ছাড়া বিশেষ রিপোর্ট কাভার করার সময় তার প্রস্তুতি হয় আলাদা। দেশের ঘটনায় এক ধরনের প্রস্তুতি, আর দেশের বাইরে হলে তার জন্য প্রস্তুতি ভিন্ন। একজন রিপোর্টারকে সব সময়ই মানসিকভাবে কিছু একটা কাভার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভারের প্রস্তুতি
দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা অন্য দেশ থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী অতিথিদের অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হয়। আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী, রিপোর্টারকে সেই সুযোগ পেতে আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নিতে হয়। সেই সঙ্গে দরকার হয় স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবির বিশেষ নিরাপত্তা পাস। এর জন্য অফিসিয়ালি আবেদন করতে হয়। তারপর সেই রিপোর্টার সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই প্রমাণ পাওয়ার পর তাকে এসবি পাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতেই হয়।
• কঠোর নিয়ম মেনে চলার মানসিকতা তৈরি। নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে নানা ধরনের অনুশাসন মেনে চলতে হয়।
• দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম, পদবি ঠিকভাবে জানা। কার কী কাজ সে সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখা রিপোর্টারের দায়িত্ব।
• ভাষার ওপর একজন রিপোর্টারের অবশ্যই দখল থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাটা খুব জরুরি। কেননা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠান কাভার করতে হতে পারে।
• নানা বিষয়ে পড়াশোনা করে ধারণা অর্জন। কেননা, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নানা ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র্যও থাকে। ফলে রিপোটিং নির্ভুল করার জন্য পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই।
• নির্ধারিত সময়ের আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়া। কারণ, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যাওয়র পর আর কাউকেই ঢুকতে দেয়া হয় না।
• পোশাক-আশাকের দিকে খেয়াল রাখা। পরিচ্ছন্ন পোশাক, বিশেষ করে ফরমাল একটা লুক থাকতে হবে।
• নিয়মিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদির খোঁজ পেতে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক রাখতে হবে।
অনুসরণ করার সময় প্রস্তুতি
রিপোর্টারকে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিত অনুসরণ করতে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক রিপোর্টারের জন্য বিট বা ক্ষেত্র ভাগ করে দেয়া থাকে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে, সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় ইত্যাদি। মোটা দাগে, এসব বিষয় কাভার করার জন্যও রিপোর্টার নিজেকে নানাভাবে তৈরি করবেন।
• সবার আগে দরকার নিয়মিত পড়াশোনা করা। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে নজর রাখা।
• দেশের ইতিহাস, সংবিধান ও গুরুত্বপূর্ণ আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়া। বিশেষ করে যিনি সংসদ ও আদালত কাভার করবেন।
• সংসদ কাভার করার ক্ষেত্রে এর কার্যপ্রণালিবিধি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে। সংসদ কীভাবে তার কাজ পরিচালনা করে, সেটা জানা থাকতে হবে। সংসদের অধিবেশন, প্রস্তাব, বিল, আইন প্রণয়নের ধাপ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপ, বিরোধী দলের চিফ হইপ, সংসদ সদস্য- প্রত্যেকের এখতিয়ার, কাজের ধরন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সংসদীয় কমিটির গঠন ও এর ক্ষমতা সম্পর্কেও বুঝতে হবে।
• সংসদ কাভার করার ক্ষেত্রে মনোযোগ সবার আগে জরুরি। ধৈর্যও দরকার হয়। আর নিজের পোশাক-আশাকের দিকে খেয়াল রাখাও দরকার।
• আদালত কাভার করতে গেলে সংবিধান ছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো সম্পর্কে ভালো পড়াশোনা থাকতে হবে। আদালত কীভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেখানে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, তাও পরিষ্কার জানা থাকতে হবে। আদালতের ভাষা বিকৃত না করে সহজভাবে মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
• সচিবালয়ের সংবাদ কাভার করার মূল যোগ্যতা হচ্ছে রাষ্ট্রের ‘রুলস অব বিজনেস’ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট রাখা। কার কী দায়িত্ব, এটা পরিষ্কার হওয়া। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখা। নিজের অপরিহার্যতা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেন কোথাও কিছু ঘটলে খবর চলেই আসে।
সভা-সেমিনার, সংবাদ সম্মেলন কাভারের প্রস্তুতি
সভা-সেমিনার কখনো কখনো দীর্ঘ সময় ধরে চলে। নানা কঠিন বিষয়ে আলোচনা হয়। ফলে একঘেয়ে লাগার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সভা-সেমিনার থেকেও নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বের হয়ে আসতে পারে। আর সে জন্য দরকার ধৈর্য ও মনোযোগ। তা ছাড়া, বিষয় সম্পর্কে ধারণাও থাকতে হবে। বিষয় আগেই জানা থাকলে তা নিয়ে পড়াশোনা করে নেয়া যেতে পারে। কোনটা সংবাদ, আর কোনটা সংবাদ নয়- এ নিয়ে ধারণা যদি স্পষ্ট থাকে, তাহলে সভা-সেমিনার থেকেও ভালো সংবাদ তৈরি হতে পারে।
এ ছাড়া, সংবাদের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে সংবাদ সম্মেলন বা প্রেস ব্রিফিং। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় থেকে শুরু করে সাধারণ কিছু একটি আয়োজন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন হতে পারে। চলমান কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে হতে পারে এই প্রেস ব্রিফিং। কোনো নতুন উদ্ভাবন, নতুন জিনিস বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলন হতে পারে। আর এর জন্যও ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে রিপোর্টারকে। সবার আগে দরকার কোন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন তা পরিষ্কারভাবে জানা। সেই সম্পর্কে মনের মধ্যে বিস্তারিত প্রশ্ন তৈরি করা। আর বিষয় পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, সৌজন্য বজায় রেখে প্রশ্ন করা। তবে প্রশ্নের সুযোগ একতরফাভাবে নিজে না নিয়ে অন্যদেরও দেয়া। আর এর মধ্য থেকে কোনটা সংবাদ তা খুঁজে নেয়া।
বিক্ষোভ, সমাবেশ, জনসভা, দুর্ঘটনায় প্রস্তুতি
জানা ঘটনার ক্ষেত্রে :
• নিজের শারীরিক সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়া;
• কর্মসূচি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেয়া। কর্মসূচির ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়া। কর্মসূচি কোথায় হবে তা নিশ্চিত হয়ে নেয়া;
• কর্মসূচিতে কারা উপস্থিত থাকবেন, তাদের পরিচয় ভালোভাবে জেনে নেয়া;
• নিজের পরিচয়পত্র, নোটবুক, কলম, টেপরেকর্ডার ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেয়া;
• সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছানো।
অজানা ঘটনায় প্রস্তুতি
• অপরাধ, রাজনৈতিক দল কারো বিট হলে নিয়মিত চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য অনুসরণ করতে হয় এমন সব বিটের ক্ষেত্রেও। হঠাৎ কোনো খবর জানলে তা সঙ্গে সঙ্গে অফিসকে জানাতে হবে। অফিস অ্যাসাইন করলে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে হবে।
• ঘটনাস্থলে যেতে যেতে সম্ভব হলে কী হয়েছে সেটা জেনে নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হলে কারা থাকছেন, কী হতে পারে, বিটের অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা নিয়ে নেয়া ভালো।
• যেকোনো সময় সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে ধরে নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে।
• কোনো দুর্ঘটনা হলে সে সম্পর্কে দমকল বাহিনী হতে পারে খবরের প্রথম সোর্স। এরপর পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগীর আত্মীয়স্বজন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনা ও ঘটনাস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে রওয়ানা হয়ে যেতে হবে।
• ঘটনার কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেয়া। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাবধান থাকা। বিশেষ করে, দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
• নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখা।
বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল ও সংঘর্ষের ক্ষেত্রে করণীয় বিক্ষোভ সমাবেশ
• সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় সুবিধাজনক অবস্থান নেয়া;
• বক্তাদের তালিকায় চোখ বোলানো। কখন, কে বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা খেয়াল রাখা। মনোযোগ দিয়ে কথা শোনা ও ধারাবাহিকভাবে নোট নেয়া। বিশেষ করে প্রধান বক্তার বক্তব্য সতর্কভাবে নোট নেয়া। প্রয়োজনে রেকর্ড করে নেয়া;
• তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো আলাদা করা। নাম-পরিচয় সতর্কভাবে, নির্ভুল বানানে লিখে রাখা;
• সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে, মানসিক প্রস্তুতি রাখা।
বিক্ষোভ মিছিল
• সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেয়া। সেই সঙ্গে দাবিগুলো কী তা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া;
• আয়োজক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করা। একই সঙ্গে সেখানে অবস্থান নেয়া পুলিশ কর্মকর্তার নম্বর নিয়ে রাখা;
• মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজনে অগ্রভাগে থাকা। সংঘর্ষের সূত্রপাত নিয়ে মানসিক প্রস্তুতি রাখা;
• সব ক্ষেত্রেই নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা।
সংঘর্ষ
• যেকোনো জায়গায় সংঘর্ষ বেধে গেলে মনে রাখতে হবে নিজের নিরাপত্তা সবার আগে। অবশ্যই নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। সম্ভব হলে এ ক্ষেত্রে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
• সংঘর্ষের মূল জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সহিংসতার ধরন ও এতে কয়টি পক্ষ জড়িত, তার সম্পর্কে ধারণা নেয়া;
• পুলিশ ও অন্য গণমাধ্যমকর্মীরা যেখানে আছেন, সেখানে অবস্থান নেয়া। কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না। এর মধ্যে খবরও সংগ্রহ করতে হবে;
• বড় সংঘর্ষে নানা ধরনের উড়ো খবর ছড়িয়ে পড়ে। কোনো অবস্থাতেই বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। যথাসম্ভব বেশি সোর্স ব্যবহার করে হতাহতের খবর নিশ্চিত হতে হবে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে;
• ধারাবাহিকভাবে সময় ও স্থান উল্লেখ করে নোট নিতে হবে;
• পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে খোঁজ রাখতে হবে।
সব ক্ষেত্রেই টেলিভিশন রিপোর্টারের জন্য একটু বাড়তি প্রস্তুতি দরকার রয়েছে। কেননা, সংবাদ কাভার করার জন্য রিপোর্টারকে একাই ঘটনাস্থলে পৌঁছালে চলে না। তাকে সঙ্গে নিতে হয় ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নিতে হয়। সবকিছু নিয়ে যেতে দরকার গাড়ি। সেই গাড়ির চালকও এই সংবাদ দলের সদস্য। সব মিলিয়ে এই দল একটা ‘ইউনিট’। টেলিভিশন সংবাদের জন্য ‘টিমওয়ার্ক’ কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। কোনো এক জায়গায় ঘাটতি দেখা দিলে পুরো মিশনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাই ঘটনার খবর পাওয়া থেকে শুরু করে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো দলকে এক হয়ে কাজ করতে হয়। প্রস্তুতিও নিতে হয় সম্মিলিতভাবে। রিপোর্টার গাড়িতে উঠেই আগে চালক ও ক্যামেরাম্যানের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে নেবেন। এরপর ক্যামেরাম্যানকে কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেবেন। সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গেলে গাড়িটি নিরাপদ দূরত্বে রাখবেন। এরপর রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান নেমে যাবেন। খবর সংগ্রহের পাশাপাশি একে-অপরের নিরাপত্তা দেয়ার কাজটিও করবেন। কেবল সংঘর্ষ বা বিক্ষোভ নয়, যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গেলেই তাদের দুজনের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা খুবই জরুরি। কেননা, টেলিভিশন সংবাদের জন্য ছবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ছবি তোলার কাজটি যিনি করেন, তার ওপরই নির্ভর করে ভালো একটি প্রতিবেদন। ফলে দুজনে মিলে কথা বলে সব সিদ্ধান্ত নিন। তবে মনে রাখা ভালো, এ ক্ষেত্রে রিপোর্টারই ‘টিম লিডার’। পুরো টিম চালানোর কাজটি তাকে দক্ষতা ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে করতে হবে।
শামীম আল আমিন: বিশেষ প্রতিনিধি, একাত্তর টেলিভিশন
ইমেইল: amin.one007@gmail.com
0 comments:
Post a Comment