Sunday, November 10, 2013

গ্রে স্ট্রিট, কলকাতা

0 comments
কলকাতার গোড়াপত্তনের একদম শুরুর দিকে সুতানটি ছিল ব্যবসায়ীদের সুতোর হাট। সুতো ব্যবসায়ীদের বাসস্থানগুলিও পরবর্তীকালে তাঁদের ব্যবসার স্থান হয়ে দাঁড়ায়। ওই এলাকার রাস্তা তৈরি ও মেরামতির কাজের দায়িত্ব তাঁরা নিয়েছিলেন। পাশাপাশি খরচ চালানোর জন্য তাঁরা সেইসময় কর ছাড়ের সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলেন। সেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জনার্দন শেঠ ও গোবিন্দরাম মিত্র। সেই সময়ে কলকাতা বন্দরে বিদেশ থেকে অনেক জাহাজ আসত তবে সব জাহাজগুলি সবসময়ে পণ্যভর্তি থাকত না। হালকা জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া অসম্ভব, তাই জাহাজের বাকি অংশে বালি বোঝাই করা হত। কিন্তু পরে এই ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন সেই বালি বন্দর থেকে নিয়ে এসে শহর লাগোয়া মেঠো রাস্তায় ফেলে দেওয়া হত। শহরের প্রতিরক্ষার জন্য সুতানটির দিক থেকে ঘুরে এসে গোবিন্দপুরের দক্ষিণ পর্যন্ত একটি পরিখা খনন করা হয়েছিল। ১৭৪২ সালে মাত্র ছ’মাসের মধ্যে পরিখাটি খোড়ার কাজ শেষ হয়েছিল। এই কাজ দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনশো ইউরোপীয় ও তিনশো ভারতীয়কে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মরাঠা ডিচ ক্যানেল’,পরে এই পরিখা বুজিয়ে দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়। বর্তমানে সেই রাস্তার নাম সার্কুলার রোড। মধ্য কলকাতায় সেই রাস্তার নাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোড ও উত্তর কলকাতায় সেই রাস্তার নাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড। কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা এই সাকুর্লার রোড। উত্তর কলকাতার এই লোয়ার সাকুর্লার রোড বা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের উপরই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা গ্রে স্ট্রিট। গ্রে স্ট্রিট আদতে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চালর্স আর্ল গ্রে-র নামানুসারে তৈরি রাস্তা। কলকাতার আদি ইতিহাসের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই রাস্তার নাম। ১৯০৮ সালের ৮ মে ঋষি অরবিন্দ এই বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন। আলিপুর বোমার মামলায় গ্রেফতার করা হয় ঋষি অরবিন্দকে। সে বাড়ি আজও রয়েছে এই গ্রে স্ট্রিটে। পরে এই গ্রে স্ট্রিটের নামও হয়ে যায় অরবিন্দ সরণি।
গ্রে স্ট্রিটে রয়েছে প্রসিদ্ধ হাতিবাগান বাজার। রয়েছে সুপ্রাচীন হাতিবাগান টোল। হাতিবাগান বাজারেরও রয়েছে এক ইতিহাস। ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। এই সময়ই নবাবের হাতিদেরকে রাখা হয়েছিল এই অঞ্চলেরই এক বাগানে ইতিহাসের সেই নাম নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে হাতিবাগান।
গ্রে স্ট্রিটে আরো দু’টি সুবিখ্যাত রাস্তা হল হরি ঘোষ স্ট্রিট ও রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট। হরি ঘোষ স্ট্রিট খুবই পুরোনো রাস্তা। বলরাম ঘোষের চার ছেলে ছিল। তাঁদের নাম রামহরি, শ্রীহরি, নরহরি এবং শিবহরি। হরিহর শেঠের বিবরণে জানা যায় যে শেষ দু’জন অকালেই প্রয়াত হন। রামহরি সম্পর্কে তেমন বিশেষ কোনও খবর নেই। শ্রীহরি পেশাগত ভাবে ছিলেন মুঙ্গের দূর্গের দেওয়ান। এই দূর্গটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে। শ্রীহরি অসহায় মানুষদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন। তাঁর বাড়ি সবসময় লোকজনের কোলাহলে মুখরিত থাকত। এই কোলাহলের জন্য আশেপাশের বাড়ি থেকে শ্রীহরি ঘোষের বাড়িকে উদ্দেশ্য করে বলা হত ‘হরি ঘোষের গোয়াল’।
রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট শুরু হয়েছে হরি ঘোষ স্ট্রিট যেখানে গ্রে স্ট্রিট-এর সঙ্গে মিশেছে, তার উত্তর দিক থেকে। রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন শোভাবাজারের দেব রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বেহালা থেকে কুলপি পর্যন্ত প্রায় ষোল কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছিলেন। সেই রাস্তা ‘রাজার জঙ্গল’ নামে পরিচিত। নিজের বাড়ির সামনে নিজের খরচেই যে রাস্তাটি তিনি তৈরি করেন তা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট নামে পরিচিত। রাধাকান্ত দেবের বাড়ির সামনে দিয়েই গিয়েছে এই রাস্তা। ১৮৫৬ সালের তৈরি ‘ক্যালকাটা ডাইরেক্টরি’ অনুযায়ী ওই রাস্তার এক নম্বরে কোন বাড়ি ছিল না। সেখানে ছিল বস্তি। দ্বিতীয় নম্বরে ছিলেন মহারাজের দলবল, রাজা শিবকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজা কালীকৃষ্ণ, রাজা দেবকৃষ্ণ, রাজা অপূর্বকৃষ্ণ, রাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ, রাজা কমলকৃষ্ণ এবং সদর দেওয়ানী আদালতের উকিল হরকালী ঘোষ। বারো নম্বরে ছিল `শ্যামপুকুর’ নামে একটি পুকুর।
পরবর্তীকালে গ্রে স্ট্রিটের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন বহু নামী ব্যক্তিবর্গ। কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের `স্টার’ থিয়েটারে এসেছেন গিরিশ ঘোষ। শ্যামপুকুরের বাটিতে ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। আরও পরে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৮৬০) চলে আসেন ৯০/১ গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে। স্মৃতির সরণিতে তাই আজও অম্লান গ্রে স্ট্রিট।

0 comments:

Post a Comment