বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশে একটি নূতন সমুদ্র বন্দরের যাত্রা শুরু হইয়াছে। ২০০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার রামনাবাদ চ্যানেলে পায়রা সমুদ্র বন্দরের শুভ উদ্বোধন করেন। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের পর ইহা বাংলাদেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর। আপাতত লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইলেও বন্দরের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হইলে এই বন্দর জেটিতে সরাসরি মাদার ভেসেল ভিড়িতে পারিবে। এই বন্দরে গভীর সমুদ্রে বিচরণক্ষম ৮-১০ ড্রাফটের জাহাজ ধারণের পরিকল্পনা রহিয়াছে। আগামী দশ বত্সরের মধ্যে পায়রা সমুদ্র বন্দরের পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হইবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ইহার ফলে দেশের দক্ষিণ মধ্যবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হইবে বলিয়া আশা করা যাইতেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি এবং সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার হইতেছে। যেহেতু সারাবিশ্বে নৌপথে পণ্য পরিবহন সবচাইতে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব, তাই আমাদের বন্দর সুবিধাদি বৃদ্ধি করাটাও জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। যে কোন দেশের বন্দর, তাহা স্থল, সমুদ্র বা বিমান যাহাই হউক না কেন, সেই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। তন্মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমুদ্র বন্দরের ভূমিকাই সর্বাধিক। একই কারণে যুগে যুগে গানবোট ডিপ্লোমেসিও গুরুত্ব পাইয়া আসিতেছে। নদী ও সমুদ্র ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বের পরাশক্তিগুলি বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। আমাদের জন্য আশার কথা হইল, এই দেশের প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল রহিয়াছে। এই সুদীর্ঘ উপকূলবর্তী এলাকায় রহিয়াছে অসংখ্য চ্যানেল যাহা আশীর্বাদ স্বরূপ। তাই শুধু পায়রা সমুদ্র বন্দরই নহে, এতদঞ্চলের পাথরঘাটায় আরেকটি সমুদ্র বন্দর নির্মিত হইতে পারে। এই ব্যাপারে এখন হইতেই পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়া অগ্রসর হইতে হইবে। কেননা ইহাও দক্ষিণাঞ্চলবাসীর প্রাণের দাবি।
জানা মতে, বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ৯৫ শতাংশ সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হইয়া থাকে। তন্মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবদান ৯২ ভাগ। একটি বন্দরের উপর এই পরিমাণ চাপ ও নির্ভরশীলতা কোন শুভ লক্ষণ নহে। তাহাছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও চট্টগ্রাম বন্দরের সমপ্রসারণ সীমিত হইয়া আসিতেছে। এমতাবস্থায় পায়রা সমুদ্র বন্দর পূর্ণাঙ্গরূপে কাজ শুরু করিতে পারিলে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর হইতে চাপ কমিয়া যাইবে বহুলাংশে। দক্ষিণাঞ্চল হইতে মত্স্য প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিকরণ সহজ হইবে। শিল্প-কল-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে বৃদ্ধি পাইবে কর্মসংস্থান। ইহাতে এখানকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটিবে। এই সমুদ্র বন্দরের পাশেই 'বানৌজা শের-ই-বাংলা' নামে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নৌঘাঁটিও নির্মাণ করা হইতেছে। ইহাতে থাকিবে নৌ কমান্ড, এভিয়েশন, জাহাজ ও সাবমেরিন বাথিং সুবিধা। ফলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হইবে এবং দুর্যোগকালে এই এলাকার মানুষের জান ও মালের হেফাজত হইবে। উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকা হইতে রাবনাবাদ চ্যানেলের দূরত্ব প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার। ফলে তুলনামূলক কম সময়ে রাজধানীর সহিত সংযোগ স্থাপনের কারণে পায়রা সমুদ্র বন্দরের ভবিষ্যত্ খুবই উজ্জ্বল। এই সমুদ্র বন্দরকে ঘিরিয়া দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যে স্বপ্ন দেখিতে শুরু করিয়াছেন, আমরা তাহার সাফল্য কামনা করি। তাই বন্দর সংক্রান্ত পরিকল্পনার যথাযথ ও দ্রুত বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। আমরা বন্দর নির্মাণের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
-ইত্তেফাক সম্পাদকীয়
0 comments:
Post a Comment