বাংলা কবিতার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) নানা কারণে প্রাতিস্বিকতার পরিচয় দিয়েছেন। চর্যাকারদের থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা কবিতার যে ধারা তিরিশোত্তর কালের কবিরা সে ধারায় নতুন বাঁক সৃষ্টি করেন। মূলত, মেধা-মননের পরিচর্যায় এ সময়ের কবিরা কবিতাকে করে তোলেন অতি উচ্চ মার্গের শিল্পপ্রতিমারূপে ...এক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন সুধীন দত্ত। তার কবিচিত্ত সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মা- ঘুরে বীজ সংগ্রহ করেই নির্মাণ করেছে কাব্যের কল্পতরু। তিনি জগৎকে দেখেছেন নেতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে। ফলে তার কবিতার সর্বত্রই নৈরাশ্য, হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদের ছাপ স্পষ্টরূপে প্রতিভাত। জীবনানন্দ দাশ এ জন্যই বোধ করি তাঁকে 'আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা বলে অভিহিত করেছিলেন'। পুঁজিবাদী শোষণের বৈনাশিকতায় তিনি যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছেন, ফলে সমাজ, সংসার, ধর্ম, ঈশ্বর, প্রেম, প্রকৃতি- সব কিছুকেই না-বোধক দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন। শূন্যমনস্ক ও ক্ষণবাদী, গণতন্ত্র ও মানবতন্ত্রে শ্রদ্ধাশীল অথচ গণবিচ্ছিন্ন ও আত্মমুখী এই কবি সংযত ও দৃঢ় ভাষাশৈলীর অাঁধারে তীব্রবেগবান অনুভূতির আলোকে তাঁর কাব্যের জগৎ নির্মাণ করেছেন 'অর্কেস্ট্রা' (১৯৩৫), 'ক্রন্দসী' (১৩৩৭), 'উত্তরফাল্গুনী' (১৩৪৭), 'তন্বী' (১৩৩৭) প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থে তাঁর নৈরাশ্যবাদী কবিসত্তার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। দীপ্তি ত্রিপাঠী বলেছেন: 'সুধীন্দ্রনাথের কাব্য যেন ভ্রষ্ট আদমের আর্তনাদ। তিনি স্বর্গচ্যুত কিন্তু মর্ত্যে অবিশ্বাসী। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞতা আছে কিন্তু শান্তি নেই, যুক্তি আছে কিন্তু মুক্তি নেই। তাঁর কাব্য কোনো আশ্বাসের আশ্রয়ে আমাদের পেঁৗছে দেয় না। সুধীন্দ্রনাথের নঞ্র্থক ও পরে ক্ষণবাদী জীবনদর্শন আমাদের ধর্মপুষ্ট বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযোজন।...সুধীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠকালে মনে হয়, কবি যেন এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে আধুনিক জীবনের নিঃসীম শূন্যতা নৈরাশ্যভারাতুর নয়নে অবলোকন করেছেন।'
সমকালীন যুগের অস্থিরতা সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে যন্ত্রণা দিয়েছে। যুগের বৈরী পরিবেশে তিনি নিজেকে অসহায় ভেবেছেন, নিজেকে কল্পনা করেছেন সমাজ-সংসারের সকল কিছু থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র এক মানুষ হিসেবে। পৃথিবীকে তাঁর মনে হয়েছে শূন্য, বন্ধ্যা এবং নাস্তিময়। এজন্য তাঁর মধ্যে বাসা বেঁধেছে সংশয় ও অবিশ্বাস। কবিতায় শূন্যতাদ্যোতক উপমা হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন বন্ধ্যা ফণিমনসা, শূন্য মরুপ্রান্তর, উপহাস্য মরুমায়া ও নিষ্ফলা মরুভূমি। তিনি নিরালম্ব নৈরাশ্যের জ্বালায় উচ্চারণ করেছেন : 'মনে হয়/অতল শূন্যের শেষে পড়ে আছি আমি নিরাশ্রয়/দেখিতেছি ভ্রমিভ্রান্ত চোখে/গতাসু আলোর প্রেত বিচরিছে স্তবকে স্তবকে/নিরালম্ব নৈরাশ্যের নিঃসঙ্গ অাঁধারে। 'তিনি জন্মগ্রহণ করেন ভারতবর্ষের এক যুগ-সংক্রান্তির কালে। নানা আন্দোলন-সংগ্রাম, যুদ্ধ-মহামারী এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে ভাঙা-গড়া চলছিল তখন। এক কথায় তাঁর সমকাল ছিল নানাবিধ সমস্যা-সঙ্কটে নিমজ্জিত। তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যুগের সেসব ঘটনা ও প্রবণতাকে। পেশাগত জীবনে একজন বিত্তবান সাংবাদিক হিসেবে তিনি যেতে পেরেছিলেন নগ্ন-রূঢ় বাস্তবের কাছাকাছি। যুদ্ধের বিভীষিকা, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তাঁর সংবেদনশীল মনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দির সমান বয়সী এই কবি সজাগ দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করে দুঃসহ যাতনা ভোগ করেছেন। তিনি জন্মাবধি দেখেছেন যুদ্ধ বিপ্লব, বিনষ্টিজ্জ তাই মেকি সভ্যতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছেন: 'আমি বিংশ শতাব্দীর/ সমান বয়সী; মজ্জমান বঙ্গোপসাগরে; বীর/নই, তবু জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে/বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী, প্রগতিতে/যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।'সুধীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছেন তাঁর সমসাময়িক যুগ নিষ্ঠুরতায় বিপর্যস্ত। বিশ্বের সকল স্থিতি লুপ্তপ্রায়; মানুষের মনুষ্যত্বহীনতা, বর্বরতা আর তা-বে সবকিছু যেন রসাতলে যাচ্ছে। এজন্য পৃথিবীর শান্তি বিনষ্টকারী স্বার্থপর এবং যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের তিনি 'তৃষিত মড়কের পিশাচ' বলেছেন। চারিদিকে সম্ভাবনাহীন জগৎ, কোন সুস্থিরতা নেই, নেই জীবনে কোন স্বস্তি। এক ধরনের অবলম্বনহীন, নিরাশ্রয়, হতাশাগ্রস্ত ভাবনা কবিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ফলে বিনষ্ট মূল্যবোধ, আদর্শ ও অবক্ষয়ী সমাজের বাণীমূর্তি তিনি নির্মাণ করেছেন। উটপাখির প্রতীকে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত যুগ, সমাজ এবং নিহত সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছেন। উটপাখি যেমন ঝড়ের সম্ভাবনায় মরুভূমির বালিতে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষার বৃথা চেষ্টা করে; যুদ্ধ, মারি-মন্বন্তরে বিধ্বস্ত মানুষও তেমনি কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। যুগ জটিলতায় উদ্ভূত সঙ্কট থেকে তাঁর সত্তায় শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে নৈরাশ্যের ভয়াবহ রূপ। দিগভ্রান্ত মানুষের সেই নৈরাশ্যকে মরুভূমির উটপাখির প্রতীকে তুলে ধরেছেন: 'কোথায় পালবে? ছুটবে বা আর কত?/উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা/প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত/বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা' তিনি লক্ষ্য করেছেন তাঁর যুগে মানুষের বেঁচে থাকবার মতো রসদ নেই, মনের তৃষ্ণা দূর করবার মতো সৌন্দর্য নেই, মানবধর্ম টিকিয়ে রাখবার মতো সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিব্যক্তিবাদ নেই। শুধু রয়েছে রাজনীতির সর্বনাশা পাশা খেলা। সকল শুভবোধের বিলোপ ঘটেছে, পৃথিবীতে জাগ্রত হয়েছে কেবল অমঙ্গলের চিহ্নসমূহ। সেই নেতিবাচক বিনষ্ট যুগকে কবি উপস্থাপন করেছেন অমঙ্গলসূচক সব প্রতীক আর চিত্রকল্পের মাধ্যমে: 'নিশ্চিহ্ন সে-নচিকেতা; নৈরাশ্যের নির্বাণী প্রভাবে/ধূমাঙ্কিত চৈত্যে আজ বীতাগি্ন দেউটি,/আত্মহা অসূর্যলোক, নক্ষত্রেও লেগেছে নিদুটি।/কালপেঁচা, বাদুড়, শৃগাল/ জাগে শুধু সে-তিমিরে; প্রাগ্রসর রক্তিম মশাল /আমাকে অবিল করে; একচক্ষু ছায়া, /দীপ্ত-নখ, স্ফীত-নাশা, নিরিন্দ্রীয় বৈদ্যুতিক কায়া /চতুর্দিকে চক্রবূ্যহ বাঁধে।'
সুধীন দত্ত চেতনায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেছেন বিধায় সবকিছু সম্পর্কেই তাঁর অবিশ্বাস, অবিশ্বাস ঈশ্বরেও। তাঁর কবিতায় ঈশ্বর জিজ্ঞাসা দ্বন্দ্বমুখর হলেও তা মানবতন্ত্রী অথচ শূন্য ও নাস্তিবাদী বৈনাশিক চেতনায় পরিব্যাপ্ত। বাল্যকালে পিতার অদ্বৈতশিক্ষার পাঠে সংশয় তাঁকে অনেকটাই জড়বাদে উপনীত করেছিল। পরবর্তীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্য-দর্শন অনুশীলন তাঁর এ চেতনাকে আরও শানিত করে। বৌদ্ধদর্শনের শূন্যবাদ থেকে তিনি নাস্তিক্যবাদের রসদ পেয়েছিলেন। বৈরী বিশ্বের প্রতিকূলতা ও ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতাও তাঁর মধ্যে নাস্তিক্যবাদী ভাবনা উপ্ত করেছে। তিনি অর্জন করেছেন সোহংবাদ বিষয়ে ধারণা। শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধদর্শনের ক্ষণবাদে আস্থাশীল হয়েছেন। ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে এই অবিশ্বাস আধুনিক মানুষের চিত্তে সৃষ্টি করে প্রবল সংশয়। এযুগের কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস করেছেন, এমনকি ঈশ্বর সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি। ভগবানকে কখনো তিনি 'য়িহুদির হিংস্র ভাগবান, কখনো 'যাযাবর অর্থের বিধাতা,' কখনো বা 'লুপ্তবংশ কুলীনের কল্পিত ঈশান' বলে অভিহিত করেছেন। প্রথম থেকেই তাঁর কাব্যভাবনায় ঈশ্বর বিচ্ছিন্নতা দানা বাঁধতে থাকে। তিনি ঈশ্বরের প্রতি নিক্ষেপ করেছেন সংশয় মিশ্রিত নেতিবাচক বিদ্রূপ। কোন কবিতায় সন্দিগ্ধচিত্তে বলেছেন: 'নিরাকার নির্গুণের করিতেছি সন্দিগ্ধ অন্বেষ।' আবার কোন কবিতায় নেতিবাচক মনোভাবের দ্যোতক হিসেবে উচ্চারণ করেছেন: 'অলীক, অনাম কোন বিধাতার অলখ আসন।' ভগবানের উপর চরম অনাস্থা প্রকাশ করে লিখেছেন :'শ্বেত শুদ্ধ দেবতাত্মা? সে তো শুধু পীত পুরাতন/পুরাণের আখ্যায়িকা, চিরাভ্যন্ত অপলাপ শত '। তাঁর কবিহৃদয়ের 'জ্যোতির্ময় সিংহাসনখানি ডুবেছে নাস্তির গর্ভে।' তাঁর সংশয় জেগেছে 'হয়তো ঈশ্বর নেই' কিংবা তিনি কল্পনা করেছেন 'অপমৃত ভগবানকে'। নাস্তিক্য বিশ্বাসের অতলে ঈশ্বরকে ডুবিয়ে দিয়ে নীটশের মতো বলে উঠেছেন : 'উড়ায়ে মরুর বায়ে ছিন্ন বেদ- বেদান্তের পাতা, /বলেছি পিশাচ হস্তে নিহত বিধাতা\\' পুঁজিবাদের দোর্দ- প্রতাপে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অসুর শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানবের উপর। এমতাবস্থায় ঈশ্বরের মঙ্গলময় রূপ পরাহত হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ অসুর শক্তির তা-বলীলার জন্য ঈশ্বরের অক্ষমতা ও অসম্পূর্ণতাকে দায়ী করেছেন। তিনি ঈশ্বরের নিত্য রূপকে যেমন স্বীকার করেননি, তেমনি স্বীকার করেননি তার মঙ্গলময় ও সত্য রূপকে। ধ্বংসের বিভীষিকার উপর দাঁড়িয়ে ভগবানকে উপহাস করে বলেছেন: ' হায়, ভগবান।/ হায়, হায় ব্যর্থ ভগবান,/তোমার অমিত ক্ষমা, সে কি শুধু অসুরের তরে? /কিন্তু যারা প্রহরে প্রহরে/ উৎসর্গিছে অকাতরে অতিমূল্য প্রাণ / সুপ্রতিষ্ঠ করিবারে মরলোক সিংহাসন তব,/তারা অবজ্ঞার পাত্র। সুধীন্দ্রনাথ নানা বিশেষণে ঈশ্বরের প্রতি বিদ্রূপ করে তাঁর নাস্তিক্যবাদী ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। 'উদাসীন বিধাতা', ব্যর্থ ভগবান', 'কুটিল দেবতা', 'আশ্রিত বিধি', 'রুক্ষ বিধাতা', 'পৈতৃক বিধাতা', 'অলীক আত্মীয় ভগবান,' 'ক্রূর ভগবান' প্রভৃতি সম্বোধনের মধ্যে ভগবান সম্পর্কে কবির বিদ্রূপ বর্ষিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতিও তিনি অন্বয় স্থাপন করতে পারেননি। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা বৃথা জেনে উচ্চারণ করেছেন : 'তিলভা- সর্বনাশ; অতিদৈব বিশ্বের দেউল: / প্রার্থনা বা অভিযোগ বৃথা: / প্রতিজ্ঞাবিস্মৃত কল্কি; কিংবদন্তী শিবের ত্রিশূল, /শূন্যকুম্ভ পুরাণ, সংহিতা। নাস্তিবাদী ভাবনা সুধীন দত্তের মনে যে সকরুণ বেদনা ও দ্বিধা সৃষ্টি করেছে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি 'নিখিল নাস্তির মৌনে সোহংবাদ ধ্বনিত' করেছেন। তিনি স্বীয় চৈতন্যের মর্মমূলে প্রবেশ করেছেন ব্যক্তিস্বরূপের অন্বেষায়। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ঈশ্বর-সংক্রান্ত ভাবনায় সুধীন্দ্রনাথের যে জিজ্ঞাসা, অবিশ্বাস, যন্ত্রণা ও দাহ তাতে তাঁর নিরীশ্বর জড়বাদী মনোভাব প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে নিরীশ্বর বৌদ্ধদর্শন দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বৌদ্ধদর্শনের শূন্যবাদ ছাড়াও ক্ষণবাদী চেতনা সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় নৈরাশ্য রূপায়ণে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছিল। ক্ষণবাদী দর্শনকে তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন বলেই লিখতে পেরেছিলেন: 'ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর যথাশক্তি অনুশীলনের ফলে আজ আমি যে দার্শনিক মতে উপনীত, তা যখন প্রাচীন ক্ষণবাদেরই সামপ্রতিক সংস্করণ, তখন না মেনে উপায় নেই যে আমার রচনামাত্রেই অতিশয় অস্থায়ী। এই ক্ষণবাদী কবি দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন : 'আমি ক্ষণবাদী : অর্থাৎ আমার মতে হয়ে যায় / নিমেষে তামাদী আমাদের ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ, তথা /তাতে যার জের, সে-সংসারও। '
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রেম ভাবনায় এসেছে নৈরাশ্যের ছাপ। তাঁর হৃদয় নিরাশা ও নেতিবাচক ভাবনায় ভরপুর। পুঁজিবাদী সমাজের একজন পোড়খাওয়া মানুষ বলে তাঁর হৃদয় থেকে প্রেম অপসৃত। বিরহ, শূন্যতা, হতাশা, বিলাপ, দীর্ঘশ্বাস এবং শেষ পর্যন্ত একাকিত্বের দুর্বিষহ যন্ত্রণা সুধীন্দ্রনাথের প্রেমভাবনায় স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতায় 'এক বন্ধ্যা নায়কের হাহাকার শোনা যায়। ফলে 'ঘৃণা, ক্লান্তি, অবিশ্বাসের প্রাবল্যে কবি সমস্ত আদর্শবাদ, শাশ্বত প্রেমকে নিয়ে উপহাস বিদ্রূপ করেন।' তার প্রেমের কবিতায় নায়ক যৌবন অতিক্রম করে বার্ধক্যে উপনীত। এই যৌবনগত নায়ক বন্ধ্যাত্ব এবং অক্ষমতা নিয়ে নষ্ট-ভ্রষ্ট সভ্যতার নায়িকার প্রেমকে অবলোকন করে মর্মযাতনা পায়। তাঁর প্রেমচৈতন্যে বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা এবং নির্বেদ শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। 'এ শূন্যতা আগুনের মতো জ্বালাময় স্বপ্নহীন বিক্ষুব্ধ অশান্ত শূন্যতা।' বৌদ্ধদর্শনের নাস্তিবাদী শূন্যতা থেকে সুধীন্দ্রনাথের প্রেমভাবনায় রিক্ততা ও বিচ্ছিন্নতার সংক্রাম ঘটেছে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে প্রেম মানুষকে আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। কিন্তু যুগের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে নৈতিক মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রেমে ফাটল ধরেছে। প্রেমের সি্নগ্ধ রূপ হারিয়ে দৈহিক কামনার দিকে মানুষ ধাবিত হয়েছে। পুঁজিশাসিত বিশ্বে মানুষের আবেগ-অনুভূতি ক্রমে ক্ষণকায় হওয়ায় তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে প্রেমহীনতা। 'প্রেমিক- প্রেমিকার পারস্পরিক ভালোবাসা এ যুগের অদৃশ্য দৈত্য নিয়েছে হরণ করে। ' প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন শিথিল হওয়ায় পুঁজিবাদী যুগের মানুষ নিঃসঙ্গতার জ্বালা ভোগ করেছে। সুধীন্দ্রনাথ জেনেছেন ধনতান্ত্রিক 'যুগে প্রেমে নিষ্ঠা, তপস্যা, স্মরণ, অঙ্গীকার সবই মিথ্যা।' সেখানে তিনি নেতি ছাড়া কিছুই পান না। প্রেয়সীর আবির্ভাব তাঁর হৃদয়ে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে : 'তোমার উদীর্ণ আবির্ভাবে / মোর শূন্য পরিপূর্ণ হয় নাই কভু;/অবলুপ্ত অতল অভাবে/তোমার অজস্র দান/ বরঞ্চ গিয়েছে রেখে নেতির প্রমাণ।/ সুধীন্দ্রনাথ শাশ্বত প্রেম কল্পনা করতে পারেননি। ভালেরির মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন মানুষের পক্ষে পরস্পরকে ভালোবাসা অসম্ভব। প্রিয়ার নিবিড় সানি্নধ্যে তিনি পূর্ণতা পাননি। বিগত যৌবন নায়ক এবং মধুরিক্তা নায়িকার কল্পনা করে তিনি তাদের মধ্যে শাশ্বত প্রেমের সন্ধান পাননি্ত দেখেছেন কেবল ক্ষণবিলাস। শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুর নৈরাশ্যে উচ্চারণ করেছেন: 'হে মোর ক্ষণিকা,/তোমার অরূপ স্মৃতি, সে নহে শাশ্বত।' আরো বলেছেন :' অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ;/ অসঙ্গত চিরপ্রেম; সংবরণ অসাধ্য, অন্যায়;' সুধীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনায় সুগভীর বিষাদ পরিদৃশ্যমান। বস্তুত, প্রেমের বঞ্চনা-মূর্তি তাঁকে নৈরাশ্য ভারাতুর করেছে। প্রেমের আধার তাঁর কাছে নিত্য সৃষ্টির সুষমা না হয়ে হয়েছে যৌবনের ভ্রান্তি :'নাস্তিক বুদ্ধির বশে কোনও দিনও যেন নাহি মানি, /হে অস্ত রতমা,/তুমি ভ্রান্তি যৌবনের, নও নিত্য সৃষ্টির সুষমা \\' বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ও বিরহের হাহাকার সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রবল। তাঁর প্রেমভাবনা বারংবার অতীতমুখী হয়েছে। হারানো প্রেমের দাহ তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। বিরহের জ্বালা তাঁর হৃদয়ে মরণ-যন্ত্রণা জাগিয়ে তুলেছে বলেই তিনি লিখেছেন: 'অভাবে তোমার/অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যৎ বন্ধ অন্ধকার,/ কাম্য শুধু স্থবির মরণ।' আশাহত কবি বিরহে কাতর এবং বিষাদমগ্ন হয়ে বলেছেন : 'কী যেন হারায়ে গেছে জীবন হতে/কী যে তা বুঝিবে কে বা কেমন মতে।/ শুধু জানি এই টুকু/ কী এক বিপুল দুখ/ ভ'রে গেছে সারা বুক গোপন ক্ষতে। / কী যেন হারায়ে গেছে জীবন হ'তে।' তাঁর প্রেমের কবিতার নামকরণে যেমন নেতিবাদী ভাবনা কাজ করেছে তেমনি কবিতার বিষয়বস্তুতেও নৈরাশ্যবাদী ভাবনা প্রবলভাবে উপস্থিত হয়েছে। 'পলাতকা' 'মৃতপ্রেম' 'ভ্রষ্টলগ্ন' নামাগুলো ইতিবাচক কোন ইঙ্গিত দেয় না। এসব কবিতায় অতৃপ্ত প্রেম কল্পনা ও ব্যর্থতার বেদনা চূড়ান্ত হতাশায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে। এজন্য 'সকলি আজ লুপ্ত মোদের চিত্তদেশে/প্রেমের চিতাভস্ম শেষে' ৫৮ বলে কবি হাহাকার করতে পারেন। তাঁর মানসী স্বপ্নেই বিরাজ করেছে, বাস্তবে কেবল বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বের যন্ত্রণা দিয়েছে। কবির ভাষ্য : ' মানসীর দিব্য আবির্ভাব, সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে, জাগরণে আমরা একাকী; /তাহার বিখ্যাত রাখি, / সে নহে মঙ্গলসূত্র কেবল কুটিল নাগপাশ; /মলময় তাহার উচ্ছ্বাস /বোনে শুধু উর্ণাজালে অসতর্ক মক্ষিকার পথে। ' প্রিয়ার অদর্শনে তিনি নরকযাতনা ভোগ করেছেন; ফলে আর্তনাদ করে জানিয়েছেন: 'পাপ ও আশিস, সুধা আর বিষ/একত্রে বিধি বিতরে মোরে।' প্রেয়সীর সঙ্গে মিলনেও সুখ নেই, কারণ তার ভেতরে বাসা বেঁধেছে রিক্ততা ও ক্লেদ। স্বপ্ন ভঙ্গের হাহাকার আর সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত কবির উক্তি: 'মন্থর কালের স্রোতে সতূপীকৃত হয় সর্বনাশ; /মোদের বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুপম ব্যবধী দুস্তর \\/অপ্রাপনীয় প্রেমের দাহে সুধীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে দেখা দিয়েছে নৈঃসঙ্গ্য ও শূন্যতাবোধের আর্তি, আত্মধিক্কার ও অনুতাপ, বিতৃষ্ণা ও নির্বেদ। নিরুদ্বেগ প্রেমিকার পাশে উপবিষ্ট কবি অনুভব করেন বিশ্ব চরাচর অরাজক ও উচ্ছৃঙ্খল এবং তিনি একা। এই একাকিত্ব চারিয়ে যায় তাঁর সমগ্র অস্তিত্বে; পরম রিক্ততায় তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় : 'চারিপাশে মোর মরু করে ধূজ্জধূ ; /আমি অবলোকি তার করপুটে /দমহীন মালাখানি।' ক্ষণিক প্রেমের স্তবগানে তিনি যেমন বলেছেন: 'মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে';৬৪ তেমনি শূন্যতায় মিলে যাওয়া নিরুপম আননের স্মৃতি স্মরণ করে লিখেছেন : 'শুধু নিরুপম /এখন আননখানি সীমাশূন্য শূন্যে যে লুকালে \\/ তাই আজি তব স্মৃতি, মগ্নতরী জঞ্জালের মতো, সহে না আশার ভার, করে, হায়, বিদ্রূপে বিব্রত\\ /সুধীন্দ্রনাথের নঞ্র্থক জীবনবোধ, বিষণ্নতা, সংহত প্রকরণ সবই প্রেমের রূপকে ৬৬ ফোটাতে সহায়তা করেছে। বিচ্ছেদে পূর্ণতার কোন ইঙ্গিত তিনি পাননি এমনকি মিলনেও; পেয়েছেন কেবল সর্বব্যাপী রিক্ততা ও যন্ত্রণার হাহাকার। শাশ্বত প্রেম অকল্পনীয়, প্রেমের ক্ষণবিলাসই মুখ্য বলে তাঁর বোধ কেবল নিঃসঙ্গতায় হাহাকার করেছে। প্রেমসূত্রে জাত নৈঃসঙ্গ্যবোধ সুধীন্দ্র হৃদয়ে উত্তরোত্তর পুষ্টিলাভ করেছে; শুধু নৈঃসঙ্গ্য নয় সুধীন্দ্রনাথ মুখোমুখি হয়েছেন শূন্যতা, নৈরাশ্য ও ভবিতব্যের।'
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় নৈরাশ্য রূপায়ণে ইউরোপীয় সাহিত্য ও দর্শনের প্রভাব বিদ্যমান। শিল্পবিপ্লবের উন্মাদনায় পুঁজি নিয়ে ইউরোপ যতই বিংশ শতাব্দীর দিকে এগোচ্ছিল ততই তার কৃষ্টি সভ্যতা জীবনদর্শন ধর্মীয় চেতনা প্রভৃতি সম্পর্কিত প্রাচীন মূল্যবোধের নমনীয়তায় চরম টান পড়ছিল। যুদ্ধের তা-বলীলায় ইউরোপের প্রাচীন মূল্যবোধে ফাটল ধরল। ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি কেঁপে উঠল, জীবনের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলে গেল। ফলস্বরূপ, সচেতন মানবচিত্তে এক অনিবার্য শূন্যতার সৃষ্টি হলো। সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে যুদ্ধপরবর্তী যুগ-জটিলতায় ইউরোপের কবি-সাহিত্যিকগণ বেদনা-ভারাক্রান্ত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হলেন। নৈরাশ্যদীর্ণ কবিসত্তার বাণীরূপ তাঁরা সাহিত্যে প্রকাশ করলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত গভীরভাবে ইউরোপীয় সাহিত্য আত্মস্থ করে নৈরাশ্যের পঙ্কে নিমজ্জিত হলেন। মালার্মে, হাইনরিখ হাইনে, টিএস এলিয়ট প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকের জীবনবোধ ও সাহিত্যচেতনা তাঁকে নৈরাশ্যবাদী করেছে। এছাড়া ইউরোপের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক নীট্শে' আলবের কাম্যু, হাইডেগার, সার্ত্রের ধ্যান-ধারণা কবির নাস্তিক্যবাদী চিন্তা- চেতনাকে সৃদৃঢ় করে তাঁর মধ্যে নিরালম্ব মনোভাব জাগিয়ে তুলল। সুধীন্দ্রনাথ টিএস এলিয়টের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর অবক্ষয়, নৈরাশ্য, মূল্যবোধের সঙ্কট, প্রেমহীন, ধর্মহীন, নিরাপত্তাহীন অস্তিত্বের মর্মযাতনা এলিয়টের কাব্য কবিতায় বিপন্নতা ও নাস্তির যে ছায়াপাত ঘটিয়েছিল সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেও তা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এলিয়টের 'দি ওয়েস্ট ল্যান্ড' কাব্যে নৈরাশ্য-হতাশা এবং বিচ্ছিন্নতার যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে, তা সুধীন্দ্রনাথের কবিভাবনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। কুন্তল চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন : 'ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যে রূপকের অন্তরালে শতাব্দীর অবক্ষয়ী ও বিপর্যস্ত রূপের যে চেহারাটি এলিয়ট চিত্রিত করেছিলেন, বন্ধ্যাত্ব, মরুময়তা, শূন্যতা, নাগরিক জীবনের নৈরাশ্য ও বেদনার যে আর্তি তাতে অভিব্যক্ত হয়েছিল, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় সেই এলিয়টের মন ও মননের রূপ নানাভাবে জড়িয়ে আছে। বস্তুতপক্ষে, সুধীন্দ্রনাথের রচনায় যে মরু-ধূসরতা, হতাশা ও নাস্তির বলয়গ্রাস আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাতে এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ডের বন্ধ্যাভূমির রিক্ততা বিশেষ আভাস বিস্তার করেছে বলে মনে হয়েছে।' যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উদ্ভূত এলিয়টের পোড়োজমির ভাবনা সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। উটপাখি' কবিতায় তিনি যে নেতিবাচক মরুভূমির বন্ধ্যাত্ব, শূন্যতার ও বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প এঁকেছিলেন, তাতে এলিয়টের ভাবধর্মের ছাপ পড়েছে। এলিয়ট লিখেছেন : ' ডযধঃ ধৎব ঃযব ৎড়ড়ঃং ঃযধঃ পষঁঃপয, যিধঃ নৎধহপযবং মৎড় ি/ঙঁঃ ড়ভ ঃযরং ংঃড়হু ৎঁননরংয? ঝড়হ ড়ভ সধহ, /ণড়ঁ পধহহড়ঃ ংধু, ড়ৎ মঁবংং, ভড়ৎ ুড়ঁ শহড় িড়হষু /অ যবধঢ় ড়ভ নৎড়শবহ রসধমবং, যিবৎব ঃযব ংঁহ নবধঃং, / অহফ ঃযব ফবধফ ঃৎবব মরাবং হড় ংযবষঃবৎ, ঃযব পৎরপশবঃং হড় ৎবষরবভ / অহফ ঃযব ফৎু ংঃড়হব হড় ংড়ঁহফ ড়ভ ধিঃবৎ. সুধীন্দ্রনাথের ভাষ্য : ' কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি ; / ক্ষ'য়ে ক্ষ'য়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।/আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই ; / নির্বাক, নীল, নির্মম, মহাকাশ। '
এলিয়ট ্তুফবধফ ষধহফ্থ, ্তুঈধপঃঁং ষধহফ্থ শব্দ ব্যবহার করে যুগের বন্ধ্যা ও রিক্ত অবস্থার বর্ণনা করেছেন। এর প্রভাবে সুধীন্দ্রনাথ 'শূন্য মরুভূমি', বন্ধ্যা ফণিমনসা', 'দূরত্যয় মরুভূমি', 'উপহাস্য মরুছায়া' প্রভৃতি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে স্বীয়
নৈরাশ্যকে প্রকাশ করেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপের বিধ্বস্ত রূপ দেখে এলিয়ট পোড়োজমির রূপকটি ব্যবহার করেছিলেন। এলিয়টের 'দি ওয়েস্ট ল্যান্ড' কিংবা 'প্রুফক' কবিতায় নৈঃসঙ্গ্যতার যে চিত্র রূপায়িত হয়েছে, তা কবি সুধীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেছিল। মর্মাহত সত্তা থেকে তাঁর কাব্যে এসেছিল নৈরাশ্যবোধ। এজন্য লিখেছিলেন: 'ভিড়ের সংসর্গ মোরে করে সদা নৈঃসঙ্গ্যবিব্রত'। তাঁর 'উটপাখী', 'যযাতি', 'সংবর্ত', এবং 'প্রতীক্ষা' কবিতাতেও এলিয়টের প্রভাব আছে। 'প্রতীক্ষা' কবিতায় যে আর্তনাদ তাতে এলিয়টীয় বক্তব্যেরই অনুরণন : ' / বনের বাহিরে ক্ষওয়া মাটি ধূ ধূ করে ; /নেই ফসলের দুরাশাও অম্বরে ; / যা ছিল বলার, কবে হয়ে গেছে বলা সে \\
সুধীন্দ্রনাথের কবিমানসে সবচেয়ে বেশি রেখাপাত করেছে ফরাসি কবি স্টেফান মালার্মের প্রভাব। তিনি বলেছেন: 'মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট'। মালার্মের অনিকেত মনোভাব এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সুধীন্দ্রনাথকে বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় জর্জরিত করেছিল। শুধু তাই নয়, কবিতার ভাবদ্যোতনা, শব্দচয়ন এবং চিত্রকল্প নির্মাণে সুধীন্দ্রনাথ যে বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন মালার্মের কবিতার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। দীপ্তি ত্রিপাঠী জানাচ্ছেন : 'মালার্র্মের নেতিবাদী জীবনদর্শনও সুধীন্দ্রনাথের কাব্যকে প্রভাবিত করেছে। মালার্মের কবিতায় যেমন বারংবার গোরস্থান, কবর, মৃত্যু, ভাঙা জাহাজ, অবসাদ, নিখিল নাস্তি কথাগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় এবং তারা সড়ৎনরফরঃু বা বিষাদ তিক্ততা বহন করে, সুধীন্দ্রনাথেও তেমনি দেখা যায় 'মরুভূমি,' 'নরক', 'শব', 'প্রাবরণী' (ঝযৎড়ঁফ) 'পিশাচ', 'শটিত' প্রভৃতি শব্দগুলির প্রয়োগ। মালার্মে যেমন 'বহহঁর' কথাটির একাধিকবার প্রয়োগে জীবন সম্বন্ধে অবসাদ, ক্লান্তি, আত্মগ্লানি ও বিরক্তির ভাব একসঙ্গে দ্যোতিত করেছেন কিংবা 'হবধহঃ' কথাটির মধ্যে দিয়েছেন নাস্তির ইঙ্গিত, সুধীন্দ্রনাথও তেমনি 'নির্বেদ', 'বিবিক্তি'জ্জ এই শব্দগুলির মধ্যে ঐ একই মনোভাব ব্যঞ্জিত করতে চেয়েছেন।' মালার্মে বিশ্বজগৎ শূন্য হিসেবেই দেখেছিলেন: তাঁর কল্পনায় ও কাব্যতত্ত্বে সবকিছু শেষ পর্যন্ত এই শূন্য হয়ে যায় অথবা এই শূন্যতায় এসে মিলে যায়। সুধীন্দ্রনাথের কবিতায়ও স্বপ্ন-রাত্রি-অন্ধকার-আত্মরতি- নেতি-শূন্যতা, শুক্রের শুদ্ধতা সবকিছুর সমবায়ে শেষ পর্যন্ত এক ভীষণ সুন্দর পৃথিবীর নির্মাণ হয় যা মালার্মের পৃথিবীর সঙ্গে তুলনীয়। যে নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কবিভাবনায় নৈরাশ্যের বিস্তার ঘটিয়েছে, তার মূলচেতনা এসেছে মালার্মের কবিতা থেকে। মালার্মের প্রভাবে তিনি লিখেছেন: 'নৌজীবী অগত্যা পান্থ; অনন্য সম্বল/মজ্জমান সাধের তরণী /উত্তরঙ্গ জলোচ্ছ্বাস তাই তার সমগ্র ধরণী / উদ্বৃত্ত মঙ্গল\\'
মালার্মের কবিতায় ব্যবহৃত ্তুরিঃযড়ঁঃ সধংঃ,্থ ্তুরহারঃরহম ঃবসঢ়বংঃ্থ, ্তুংযরঢ়ৎিবপশ্থ আর সুধীন্দ্রনাথের কবিতার 'মজ্জমান সাধের তরণী','উত্তরঙ্গ জলোচ্ছ্বাস' প্রভৃতির উল্লেখ নেতিবাচক ভাবকে সুস্পষ্ট করে। মালার্মের 'কুসুম' (খবং ঋবঁৎ)ি কবিতায় বৎসরের তুষারপাতের সঙ্গে যুক্ত বিচ্ছিন্ন যে কবি-আত্মার শূন্যতাবোধ-বেদনাবোধ আছে, সুধীনদত্তের 'কুক্কুট' কবিতাটিতেও একই আরতি আছে। বলা যায় মালার্মে ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উভয়েই জীবনের বেদীমূলে বিষাদ ও নিষ্ক্রিয়ের পুঞ্জীভূত অঞ্জলি প্রদান করেছেন। বস্তুত, মালার্মের কবিতার প্রভাব সুধীন্দ্রনাথের জীবনে নেতিবাদী ভাবনা জাগ্রত করেছিল। হাইনরিখ হাইনে, ভালেরি, প্রুস্তের কবিতাও সুধীন্দ্রনাথের চেতনাজগতে নৈরাশ্য রূপায়ণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এসব কবি ফ্যাসিবাদী শক্তির হিংস্রতা ও নাৎসীবাদের বর্বরতা এবং বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা দেখে জীবনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলেছিলেন। হাইনে দেখেছিলেন পৃথিবীতে জীবনের সদর্থক (বিষঃ) কিছু নেই, সুধীন্দ্রনাথও দেখেছেন: 'বিশ্বজগৎ হিম কুয়াশায় ঢাকা'। নৈরাশ্যভাবনা সুধীন্দ্রনাথ কতকটা পেয়েছিলেন ভালেরির কাব্য পাঠ করে। ভালেরির 'চষধস' কবিতায় রিক্ততা, বিচ্ছিন্নতা প্রকটিত হয়েছে মরুভূমির চিত্রকল্পে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'উটপাখী' কবিতায় জীবনে একইভাবে বন্ধ্যা মরুভূমির শূন্যতা প্রত্যক্ষ করে নৈরাশ্যের ভয়াবহ রূপ নির্মাণ করেছেন : ' / কোথায় লুকারে? ধূ ধূ করে মরুভূমি, /ক্ষ'য়ে ক্ষ'য়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।/আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই; / নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ। /মালার্মের অনুগামী প্রুস্তের প্রভাব সুূধীন্দ্রনাথ দত্তের নৈরাজ্যবাদী কবিমানসে নৈরাশ্য ছায়াপাত ঘটিয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের চেতনার মূলে আত্মার আসল অস্তিত্বকে অস্বীকার করার যে প্রবণতা তা প্রুস্তের ধ্যান-ধারণা থেকেই প্রাপ্ত। বিরূপ বিশ্বের নিঃসঙ্গ পথিক সুধীন্দ্রনাথ মানব-সংসারের সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে হয়ে প্রুস্তের মতোই গ্লানি ছাড়া আর কিছু পাননি। এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য : '/সুধীনবাবুও প্রুস্তের মতো জীবনে ফুটোফাটা জোড়াতালি (দৈন্য-দারিদ্র্য, পীড়া- বেদনা, পাপ-অপরাধ, ধ্বংস-বিস্মৃতি)-বিদীর্ণ বিচ্ছিন্ন করিয়া মহাকালে পৌঁছাইয়া জীবনের তাৎপর্য খুঁজিয়াছেন এবং ফলে পাইয়াছেন প্রধানত আত্মগ্লানী। '
ইউরোপীয় কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি ইউরোপীয় দার্শনিকদের বিভিন্ন তত্ত্ব-মতবাদের প্রভাব সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নৈরাশ্যের রূপ নির্মাণে সহায়তা করেছে। বিশেষ করে নীটসে, আলবের কাম্যু, হাইডেগার এবং সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল এবং ক্রমে নিঃসঙ্গতার পথে ধাবিত করেছিল। অস্তিত্ববাদী মানুষের জীবন এক নিখিল নাস্তির দেয়ালে আঘাত খেয়ে ফিরে আসে, ফলে তাঁর অন্তর্লোকে উপ্ত হয় নৈরাশ্যের ভ্রূণকোষ। অস্তিত্ববাদী সার্ত্র অদৃষ্টবাদে আস্থাশীল নন, এমনকি স্বপ্নময় আদর্শবাদেও। এহাড়া ভগবান কিংবা শাশ্বত মূল্যবোধের মূল্য নেই সার্ত্রের কাছে। মানুষই চরম সত্য এবং সত্য মানুষের দায়িত্বজ্ঞান। দায়িত্বজ্ঞান থেকেই মানবচিত্তে জন্মে বিষণ্নতা আর তিক্ততা। শেষপর্যন্ত মানুষ উপনিত হয় নঞ্র্থক জীবন ভাবনায়। অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল্যচেতনা সুধীন্দ্রনাথকে নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত করেছে। তাঁর কাছে পাপ-পূণ্য, ভালো মন্দ সবকিছু তুল্যমূল্যজ্জবিশুদ্ধ চৈতন্যকেই তিনি একমাত্র সত্য জ্ঞান করেছেন। বিশুদ্ধ চৈতন্যের সন্ধানে গিয়েই তিনি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। অস্তিত্ব-বাদী দর্শনের আতঙ্ক, উদ্বেগ, মনস্তাপ, ব্যর্থতা, একাকিত্ব, আত্মপ্রকাশ, প্রেম-ভালোবাসা, হিংসা-ভয়, ঘৃণা, লজ্জা, অর্থহীনতা, অসঙ্গতি, বিচ্ছিন্নতা-বিচ্যুতি, মৃত্যুভাবনা প্রভৃতি সুধীন্দ্রনাথের কাব্যে নানামাত্রিক ভাব-ভাবনার আলোকে রূপলাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে সঞ্জীব ঘোষের মন্তব্য : 'তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু জীবনের মৌল সত্যজ্জপ্রেম, কাল, ঈশ্বরের অনুসন্ধান, অক্ষমতা, মনস্তাপ, হাহাকার, নৈরাশ্য, সসীমতা, নিঃসঙ্গতা প্রভৃতি। অস্তিত্ববাদেও এগুলিকেই জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলে গণ্য করা হয়েছে এবং এগুলিকে বাদ দিয়ে যে যথার্থ জীবনের ছবি অাঁকা যায় না তা স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। সেদিক থেকে অস্তিত্ববাদীদের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের আশ্চর্য রকমের মিল আমরা লক্ষ করি।'
জৈবনিক অর্থহীনতা ও সভ্যতার কপটাচার সুধীন্দ্রনাথের 'নিখিল নাস্তি' চেতনা বা সর্বব্যাপ্ত শূন্যতাবোধের জন্য দায়ী। বিজ্ঞান-দর্শনজাত ক্ষণকালীন নৈরাশ্যনুভব তাঁর মতো আর কোন কবির কবিতায় পরিলক্ষিত হয় না। সকল ঐশ্বরিক প্রত্যয়ে তাঁর অনাস্থা, সকল রকম মূঢ় প্রত্যয় তাঁর কাছে শূন্যতাগর্ভ। জীবনের সকল রকম সদর্থক ভাবনা মানুষের অলীক স্বপ্ন আর কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। সর্বত্র কেবল শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহ আরতি। কবির হৃদয় থেকে শান্তির কপোত উড়ে গেছে, সেখানে বাসা বেঁধেছে নির্বাক নিঃসঙ্গতা : ' মোর মনে / হয়তো বা শান্তি নেই তাই। / তাই বুঝি বোধ হয় নিতান্ত বৃথাই / অন্ধকার বন্ধ ঘরে শ্বাস টেনে বাঁচা কোনও মতে;/ উন্মার্গ হয়েছে নদী, বর্জিত এ-শ্মশানসৈকতে/ নির্বিকার ঊষরতা শুধু; / যতদূর দৃষ্টি যায় করে ধূ-ধূ / ভ্রাম্যমাণ পিঞ্জরের দুর্লঙ্ঘ্য প্রসার /নিঃসঙ্গ, নির্বাক, নিরাকার।' সুধীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকেও দেখেছেন নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টি দিয়ে। প্রকৃতির দিকে চেয়ে তিনি সদর্থক রূপ দেখতে পান নি। তাঁর মনে হয়েছে: 'গ্রহ, তারা, নীহারিকা ধায় নিত্য বিয়োগের পথে।' স্তব্ধ, রিক্ত, শূন্য প্রকৃতিই তার মানসপটে ভেসে ওঠে : 'হেমন্তের বেলা প'ড়ে আসে: /ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটা হয়ে গেছে সারা, /খামারে খামারে সোনা, ভারা ভারা খর আশে, পাশে; /স্তব্ধ ঘাট, রিক্ত বাট; একমাত্র তারা/অনুমিত পা-ুর আকাশে\\
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যবিষয়ে যেমন নৈরাশ্য প্রকটিত হয়েছে, তেমনি নৈরাশ্যের রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর কাব্যের প্রকরণশৈলীতে। তাঁর কাব্য-কবিতার নামকরণ থেকে শুরু করে ভাষা নির্মাণ, শব্দচয়ন্ত এমনকি অলঙ্কার সনি্নবেশেও নৈরাশ্যের প্রকাশ স্পষ্ট। তাঁর কাব্যের 'ক্রন্দসী' নামের মধ্যে নৈরাশ্যের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি কবিতার নামকরণ করেছেন 'অপচয়', 'প্রুশ্রম', 'বিকলতা,' 'প্রলাপ,' 'উদ্ভ্রান্তি,' 'দৈন্য,' 'ধিক্কার,' 'সর্বনাশ,' 'প্রত্যাখ্যান,' 'নরক,' 'মৃত্যু,' 'সংশয়,' 'দুঃসময়,' 'বিপ্রলাপ,' 'উন্মার্গ,' 'লগ্নহারা,' 'অনিকেত,' 'ভ্রষ্টতরী,' 'নষ্টনীড়,' 'মৃত প্রেম,' 'ভ্রষ্ট লগ্ন', 'চ্যুতকুসুম', প্রভৃতি। নৈরাশ্য, নাস্তি, নেতি, শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা এবং বিচ্ছিন্নতার আবহ এসব কবিতার নামের মধ্যে উঠে এসেছে। কবির শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও বিবিক্তি-বিযুক্তি-বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। রিক্ত মাঠ, মস্নান চেতনা, মদমত্ত সর্বনাশ, শূন্যগর্ভ বহ্নি, বন্ধ্য স্পর্শে, নিঃস্ব জগতে, মুমূর্ষার প্ররোচনা, প্রেতসঞ্চরিত ধ্বংস, অস্থির মরীচিকা, অন্তিম আশ্লেষে, বুভুক্ষু দেহ, পরিত্যক্ত স্থানটুকু, শূন্য চক্রবালে, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়, ঊষর সঙ্গমে, সীমাশূন্য শূন্যতার, বিচ্ছেদের রাতি, উপহাস্য মরুমায়া, নৈরাশ্যের পারে, অনন্ত বিয়োগে, বিরহসংপ্ত শূন্যতা, নিরলস শূন্যে, অসহ্য অধুনা, বিচ্ছেদবিধুর লগ্নে, পথশূন্য বনের নির্জনে, অতল শূন্যের নিঃসঙ্গ অাঁধারে, ধূ ধূ মরুভূমি, নিখিল নাস্তি, দহনক্লান্ত দুপুর্ত এ জাতীয় অসংখ্য শব্দের ব্যবহার সুধীন্দ্রনাথের কবিমানসে বিচ্ছিন্নতার প্রকাশকে সুস্পষ্ট করে তোলে। অলংকার, চিত্রকল্প এবং প্রতীক ব্যবহারেও সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় নিরাশার সুর শোনা যায়। অনুপ্রাস, উপমা, রূপক প্রতিটি অলঙ্কারই নৈরাশ্যের রূপকে মূর্ত করে।
সুধীন্দ্রনাথ নৈরাশ্যের যন্ত্রণায় কখনো কখনো মৃত্যুচিন্তা করেছেন। যন্ত্রণা-জর্জর কবি বলেছেন: 'মৃত্যু,কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা,/ যাতনা শুধুই যাতনা সুচির সাথী\\ নিদারুণ মর্মবেদনা তাকে স্বস্তি দেয়নি। যান্ত্রিক সভ্যতার নির্মমতা, পাশবিকতা তাকে মানুষের প্রতি অনাস্থা এনে দিয়েছে। জনতার জঘন্য মিতালী তাঁর সহ্য হয়নি, প্রেমের মমতাময় বন্ধন তাঁকে টানতে পারেনি। তাই ব্রহ্মা-কে আচম্বিতে অমায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছেন এবং মরণের তরণীতে জীবনের পসরা তুলে দিয়ে বিচ্ছিন্নতার জ্বালায় মৃত্যু কামনা করেছেন : 'মরণ, তোমার উদ্দাম তরী / লেগেছে কি ফের ঘাটে? / শুনি কি তোমারই বিদেশী বাঁশরী / তেপান্তরের মাঠে? / আজ যদি তুমি এসে থাকো ঠিক, / তুলে দেব সবই তোমারে, বণিক; /প্রাণের পসরা ফেরি ক'রে আর /ফিরিব না ভাঙা হাটে।' সুধীন্দ্রনাথ নৈরাশ্যের যন্ত্রণায় মৃত্যু কামনা করলেও তাতে সমাধান খুঁজে পাননি। কারণ নিদ্রার মতো মৃত্যুকে স্বপ্নগর্ভ বলে মনে হয়েছে তাঁর। তাঁর প্রত্যয় জন্মেছে এ মৃত্যু যুগের বর্তমান কৃত্রিম ও যান্ত্রিক মানুষদের সংসর্গে পীড়িত এবং বেদনায় বিহ্বল, তাই মৃত্যু তাঁর কাছে নৈরাশ্য মুক্তির একমাত্র পথ নয়। তিনি নির্গুণ নির্বাণের মাধ্যমেই নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পথ খোঁজেন : 'চাহি না মৃত্যুরে আমি ; স্বপ্নগর্ভ সেও নিদ্রাসম, / সখার সংসর্গে দুঃস্থ, আত্মীয়ের বিলাপে বিহ্বল। /হানো তীক্ষ্ন সর্বনাশ, তীব্র ক্ষতি, বৈরিতা নির্মম; /জুগুপ্সার শক্তি দাও, দাও মোরে নির্গুণ নির্বাণ\\' তিনি বৌদ্ধদর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বৌদ্ধদর্শনে মোক্ষলাভের চূড়ান্ত উপায় নির্বাণ। কবি কামনা-বাসনারূপ দুঃখ মোচন করতে নির্বাণপ্রয়াসী হয়েছেন। নির্বাণ লাভের মাধ্যমেই তিনি নৈরাশ্য থেকে মুক্তি লাভ করতে চান। বৌদ্ধদর্শনের জন্মান্তরবাদে আস্থাশীল হয়ে উচ্চারণ করেছেন: ' নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জলন্ত হৃদয়; / হয়তো মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয়, / জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ\\ / বুদ্ধদেবের অনুসারীরা নির্বাণের মাধ্যমে শূন্যতা উপলব্ধির মাধ্যমে অস্তিত্বকে অনস্তিত্বের মধ্যে বিলোপ করে দেন। সুধীন্দ্রনাথ 'শোধবোধ শূন্যে অবসিত' করে নিজের অস্তিত্বের যাতনা তথা নৈরাশ্যের বেদনা থেকে মুক্তি লাভ করেন। নির্বাণে সংশয় থাকলেও তার মাধ্যমে সুধীন্দ্রনাথ নৈরাশ্যের জ্বালা নিবারণ করেছেন। নির্বাণে আস্থাশীল হয়ে তিনি নৈরাশ্য মুক্তির পথ পেয়েছেন।
কাজেই আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, কাব্যের বিষয় এবং শিল্পের পরিসর সবক্ষেত্রেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নৈরাশ্যের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। প্রখর মেধা, পরিশীলিত মনন এবং বহুমাত্রিক চেতনার বিন্যাসে তাঁর কাব্যে বিচ্ছিন্নতা, শূন্যতা ও একাকিত্বের শিল্পরূপ নির্মিত হয়েছে। সিদ্দিকা মাহমুদা যথার্থই বলেছেন: 'ফ্রয়েড-বিদ্ধ, মার্কস-অনাগ্রহী, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনপুষ্ট সুধীন্দ্রনাথ মানসদিগন্তে নিরালম্ব, নিঃসঙ্গ, শূন্যমনস্ক এবং মুহূর্তচারী; গণতন্ত্র ও মানবতন্ত্রে শ্রদ্ধাপোষণ সত্ত্বেও বিচ্ছিন্ন এবং আত্মমুখী'। যুগের বৈরী পরিবেশ তাঁকে নৈরাশ্যবাদী ও অবিশ্বাসী করে তুলেছে। যুগ-সংঘাতে তিনি অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। অস্তিবাদ, ক্ষণবাদ, সোহংবাদ এসব দর্শন; এলিয়ট, মালার্মে প্রমুখের সাহিত্যরাজি; যুগের বিনষ্টি; বৌদ্ধদর্শন্ত সবকিছুই তাঁর নেতিবাদী মনে নৈরাশ্যের সংক্রমণ ঘটিয়েছে। ফলে কবিতার আভ্যন্তর এবং উপরিকাঠামোকে তিনি সাজিয়েছেন রিক্ততা এবং শূন্যতার প্রলেপনে। অবিনাশী নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতায় কখনো মৃত্যুমুখী, আবার কখনো সংশয় সন্দেহ নিয়ে শূন্যবাদ তথা নির্বাণতত্ত্বে সমর্পিত। এভাবেই বিরূপ বিশ্বের একাকী পথিক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নিরাশাকরোজ্জ্বল কবিসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ধূধূ মরুপ্রান্তরে তাকিয়ে ফণিমনসার প্রতীকে বন্ধ্যা যুগের নেতিবাচক ভাবকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। কোনও আশা নেই; নৈরাশ্যের কর্কটরোগ যেন তাঁর কবিচেতনায় সর্বত্র সংক্রমিত; ঈশ্বরেও বিশ্বাস নেই্ত সমস্ত সত্তা জুড়ে কেবল নাস্তি আর নাস্তি। ফলে নিরাশাকরোজ্জ্বল কবিসত্তা হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠেন।