Friday, November 27, 2009

মনপুরার পরি ফারহানা মিলি

13 comments
ছোট ছোট স্বপ্ন তাঁর; আকাশ ছোঁয়ার সাধও নেই।
খুব বেশি কাজ করার ইচ্ছাও করে না তাঁর। যে কাজটুকু করতে চান, সেটুকু ভালোভাবে করতে পারলেই তিনি খুশি থাকেন।
মনপুরার মিলি জানালেন কথাগুলো।
মনপুরা যখন আকাশচুম্বী ব্যবসায়িক সাফল্য পেল, তখনো মিলি স্বাভাবিক,
এ নিয়ে খুব হইচই করেননি। বাইরে বেরিয়েছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই।
অনেকেই মিলিকে দেখেছেন আর বলেছেন, আপনি সেই পরি?
মিলি মাথা নেড়ে সম্মতি দেন, কখনো এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে মুখে। এতটুকুই।
ফেইসবুকে যখন শত শত বন্ধু অভিনন্দন জানাচ্ছে, তখনো মিলি এ নিয়ে মাতামাতি করেননি।
বলেছেন, সব কৃতিত্ব নির্মাতার।
প্রচারবিমুখ মিলি খুঁজছেন আরও কিছু ভালো কাজ, যে কাজ তাঁকে আনন্দ দেবে; তবে সে আনন্দ নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান তিনি।
মিলির শুরুটাও ছিল একদম সাদামাটা।

নবাবপুরের মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বাবা-মা দুজনেই চাইতেন, মেয়ে নাচ, গান, অভিনয়—সবই করুক। ছোটবেলাতেই কিশোর থিয়েটারে মিলিকে ভর্তির সুযোগ করে দেন। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মিলি থিয়েটারের নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত হয়ে যেতেন। আবার গানও শিখতেন। একসময় মা মনে করলেন, মিলি অভিনয়টা কি ঠিকমতো করতে পারবে? বড় হলে কীভাবে তখন নিজেকে সামলাবে? মিলি ঠিকই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। মিলির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাইও একই অঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়েছেন।
মিলির অভিনয়ের সাফল্যটা আসে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়। জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় অভিনয় শাখায় চ্যাম্পিয়ন হলেন। পরিবারের মানুষগুলোর খুশি আর দেখে কে? মিলি সেদিনও ছিলেন নির্বিকার। তাঁর মনে হয়েছিল, এখনই সন্তুষ্টি নয়। সন্তুষ্টি এলেই আর কাজ ভালো হবে না।
পরের বছর আবারও একই অভিনয়ে স্বীকৃতি পেলেন মিলি। পরপর দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মিলি অনেকটাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কোনটা করবেন— অভিনয়, নাকি গান? পড়াশোনা তো করতেই হবে তাঁকে। অবশ্য তত দিনে মা-বাবা মিলিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। মিলি যেটা করে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, তাতেই তাঁদের সম্মতি আছে।
‘এইচএসসি পরীক্ষার আগে আগে একটি নাটকের জন্য কথা হলো। নাটকের নাম জননী ও জাতিকা। এটি পরিচালনা করেছিলেন নাহিদ আহমেদ। মাত্র কয়েকটি সংলাপ ছিল আমার। এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। এরপরই একুশে টেলিভশন থেকে ডাক এল। তথ্যপ্রযুক্তির একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করলাম। কাজটা উপভোগই করছিলাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর একদিন ডাক এল তারিক আনাম খানের কাছ থেকে। একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করলাম। তত দিনে মিডিয়া জগত্টাকে বুঝতে শিখলাম। দেখলাম, মজা তো! যে কাজটাই করছি, সেই কাজটার এক ধরনের প্রতিক্রিয়া পেতে শুরু করলাম। একটু একটু করে উত্সাহ পেলাম। একটা কাজ করি তো আরেকটা কাজে জড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু তখনো জানি না যে আমার সামনেই একটি সুযোগ অপেক্ষা করছে। যে সুযোগটি আসলে আমার সব চিন্তাভাবনাতেও ছিল না।’ বলছিলেন মিলি।
বিনোদন মাধ্যমের প্রায় সব শাখাতেই কাজ করলেন তিনি। বাকি ছিল চলচ্চিত্র। পরিচয় হলো গিয়াসউদিন সেলিমের সঙ্গে। মিলি তখন পড়াশোনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে। সেলিম মিলিকে বললেন এক পরির গল্প। মিলি ভেবেচিন্তেই কাজটা করতে সম্মতি দিলেন।
বড় ক্যানভাসে এটিই ছিল মিলির প্রথম কাজ। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন হলো। কিন্তু মেলা পরিশ্রম। তবু কোথায় যেন ভালো লাগার একটা স্বাদ খুঁজে পান মিলি। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে থাকা, কাজ করা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে শুটিং করা—সব মিলিয়ে মিলির কাছে ছিল উপভোগ্য একটি কাজ। সারা দিনের কাজ শেষে রাতের বেলা আবার নিজের কাজের খুঁত ধরা, এভাবেই একটি মনপুরার পরি হিসেবে নিজেকে সাজিয়ে তুললেন মিলি।
‘যখন কাজ করেছি, তখন মিলি যে একদিন এতটাই আলোচনা তুলবে, এত বেশি হূদয়বিদারক একটি পরিস্থিতির চরিত্র হিসেবে মানুষের কাছে আসবে, এটি কেউই জানতাম না। আমরা একটি ছবিতে কাজ করেছি, সবাই মনোযোগ দিয়ে কাজটা করার চেষ্টা করেছি। চেয়েছি যেন একটি ভালো ছবি হয়, মানুষ ছবিটি উপভোগ করে। ছবি মুক্তির পর দেখলাম, তা-ই হয়েছে।’ বললেন তিনি।
মনপুরার মতো এত বড় একটি ছবিতে অভিনয়ের পর মিলি এখনো কেন অন্তর্মুখী?
মিলি প্রশ্ন শুনে দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘কই, আমি তো আমার মতোই আছি। ভালো কাজের জন্য অপেক্ষা করছি। যে কাজগুলো একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে, সেই কাজগুলোই করছি। আবার একটা সমস্যাও হয়েছে। মনপুরায় গ্রামের চরিত্রে কাজ করে খ্যাতি পেয়েছি, এখন সবাই আমার কাছে গ্রামের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য গল্প নিয়ে আসে। এসব পড়তে পড়তে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। তার মধ্যে থেকেও দু-একটা চরিত্র যখন আমাকে টানে, সেগুলোতে কাজ করছি। তবে সেই অর্থে চলচ্চিত্রে কাজ করার গল্প পাইনি। কাজ অবশ্যই করব। বাণিজ্যিক ছবিতেও কাজ করব। কিন্তু সেটি অবশ্যই হতে হবে ভালো গল্পের কাজ। হতে হবে সুনির্মিত। কিন্তু যেনতেন কাজ করে শুধু কাজের সংখ্যা বাড়াতে চাই না। মনপুরা সুপারহিট হয়েছে আর একেই পুঁজি করে সস্তা জনপ্রিয়তায় নিজেকে ভাসাতে চাই না। ’
মিলি সম্প্রতি কাজ করেছেন অমিতাভ রেজার একটি নাটকে। ‘এ কাজটি করে নিজের কাছে অনেক ভালো লেগেছে। যদি অন্যদেরও ভালো লাগে, তবে কাজে আরও বেশি উত্সাহ পাব।’ বললেন মিলি।
ব্যক্তিজীবন নিয়ে মিলির কাছে প্রশ্ন ছিল, এত বড় একটি ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিলেন। ভক্তরা কী বলে?
মিলি হাসেন। ‘আরে যারাই আমার সঙ্গে কথা বলে, তারা প্রথমেই আপু ডাকে। বুঝলাম না, কেউ কেন সেই রকমভাবে নায়িকা সম্বোধন করে না। আর ভালো লাগার কথাও দেখি কেউ বলে না।’
কেউ ভালোবাসার কথা বলেনি?
মিলি বলেন, ‘না’।
কাউকে ভালোবেসেছেন?
মিলি উত্তর দেন না।
আবার প্রশ্ন করি।
‘সে তো একসময় ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই একজনকে ভালো লেগেছিল। তারও পছন্দের ছিলাম আমি। কিন্তু একসময় দেখলাম যে আসলে অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না। তাই সমঝোতার ভিত্তিতেই আমরা দুজনেই সেই সম্পর্কের ইতি টেনেছি। এর পরে আসলে এ বিষয়টি নিয়ে আর ভাবিনি। ভাবতেও চাই না। ভাবনার মধ্যে আছে কাজ। তবে আহামরি প্রত্যাশা করি না। দু-একটি ভালো কাজ পেলেই আমি খুশি।’
এভাবেই কথা বলেন মিলি। কোনো রকম ঘোরপ্যাঁচ করেন না। করতে পছন্দও করেন না। যেটা করতে মন চায় না, তা তিনি কখনোই করেন না। যা কিছু করেন, তা নিজের বিবেচনায় করেন।
হাতঘড়ির দিকে তাকান মিলি। বললেন, ‘যে কাজই করছি, সেই কাজটাকে গুরুত্ব দিয়ে করি। এ জন্যই সেই কাজের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসার মায়া সৃষ্টি করে।’
মিলি এমন মায়া নিয়েই কাজ করেছেন বলেই হয়তো পরির আত্মত্যাগের ঘটনা সবার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। পরি সবার কাছেই হয়েছে অনন্য এক চরিত্র। এমনিভাবে মিলি আরও অনেকবার পরি হয়ে আসবেন পর্দায়, এটাই সবার প্রত্যাশা।

13 comments:

Post a Comment