কাব্যে উপেক্ষিতা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে ঊর্মিলা সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখেননি বলে। ঊর্মিলা ছিলেন রামের অনুজ লক্ষ্মণের স্ত্রী। কবি ও সাহিত্যিকদের কলমে আরেক উপেক্ষিত হচ্ছে হিজড়া সম্প্রদায়। তাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি; ব্যতিক্রম নাসিমা আনিসের সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘মোহিনীর থান’। হিজড়াদের নিয়ে ইংরেজি উপন্যাসও চোখে পড়েনি। খুশবন্ত সিংহের দিল্লি উপন্যাস এক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ভাগবতী হিজড়া। হিজড়ারা সমাজে থার্ড জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি চায়। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখেছেন ঝর্না রায়
শৈশবে ওদের শারীরিক ত্রুটি তেমনভাবে ধরা পড়ে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ত্রুটি ধরা পড়ে। ছোটবেলার আদরের নামও অনেক ক্ষেত্রে ঘুচে যায়। পরিবর্তন হয় পরিচয়। ওদের পরিচয় হয় ‘হিজড়া’। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে তো বটেই, পরিবারের কাছেও তখন এরা নেহাত ফালতু ছাড়া আর কিছুই নয়। শুরু হয় এক অভিশপ্ত জীবন। ওদের প্রতি নিজেদের বাবা-মায়ের আচরণও পাল্টে যায়। পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে দিনের পর দিন অবহেলা, অবজ্ঞা সয়ে সয়ে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এক সময় এই হিজড়া সন্তানটি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মিশে যায় তার মতো যারা, তাদের দলে। মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে দুই-এক টাকা চেয়ে কিংবা নাচ-গান করে বাঁচার লড়াই শুরু করে। হিজড়াদের দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে বর্তমানে দেড় লাখ হিজড়া রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে প্রায় পনের হাজার। দিন দিনই ওরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। দাবি জানাচ্ছে ওদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। লৈঙ্গিক ত্রুটির জন্য হিজড়ারা পুরোপুরি পুরুষও নয়, নারীও নয়। ওরা ভিন্ন ধরনের মানুষ।
এদের শারীরিক গঠন ছেলেদের মতো হলেও মন-মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে নারীর মতো। সে সর্বক্ষণ নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ নারী হিসাবে দেখতে পছন্দ করে।
বিভিন্ন সূত্রমতে, হিজড়ার দুইটি বৈশিষ্ট্যগত ধরন রয়েছে। মেয়ে ও পুরুষ। নারী হিজড়ার মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও তার স্ত্রীজননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অস্বাভাবিক। একই অবস্থা পুরুষ হিজড়াদেরও। হিজড়া নারী বা পুরুষই হোক, নিজেদের নারী হিসাবে বিবেচনা করে। জীববিদ ও চিকিৎসাবিদরা লৈঙ্গিক, মনসত্মাত্ত্বিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রকৃতি প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যের হিজড়াদের ৬টি ধরন চিহ্নিত করেছেন। সারা পৃথিবীর প্রকৃতি প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যের হিজড়াদের ধরন একই রকম। যারা শারীরিকভাবে পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে নারী স্বভাবের তাদের বলা হয় অকুয়া। অন্য হিজড়াদের বলা হয় ‘জেনানা’। মানুষের হাতে সৃষ্ট হিজড়াদের চিন্নি বলা হয়। এরা সামাজিক প্রথার শিকার হয়ে খোজা পুরুষে পরিণত হয়।
রাজতন্ত্র চালু হওয়ার পর অভিজাত সমাজ তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই ক্লীবপুরুষ সৃষ্টি করে। এরা খোজা হিসাবে পরিচিত। হিজড়ারা এদের বলে চিন্নি। খোজারা কাজ করত হেরেমের প্রহরী হিসাবে। এমন কথাও চালু রয়েছে যে দল ভারী করার জন্য হিজড়ারাও সুশ্রী শিশুপুত্র অপহরণ এবং তাদের খোজা বা পুরুষত্বহীন করে।
চেহারা বা আচরণ দেখে হিজড়া বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ চিহ্নিত করা যায়। স্বভাবত নারীদের ঢং, পোশাক পরিচ্ছদ ও গহনা সাজগোজ তাদের প্রিয়। তারা কৃত্রিম স্তন এবং চাকচিক্যময় পোশাক ব্যবহার করে। তারা নিজেকে একজন পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তারা স্বাভাবিক শ্রমজীবীদের মতো উপার্জনের জন্য কাজ করতে চায় না। স্বকীয় পন্থায় তারা জীবিকা অর্জন করে। নাচ-গান আর বাজারে তোলা আদায় তাদের প্রধান আয়ের উৎস। তারা হাটে-বাজারে তোলা উঠানোর পাশাপাশি বিনামূল্যে নানা ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানে কমেডিয়ান বা চিত্তরঞ্জক হিসাবে তাদের আমন্ত্রণ করা হয়। আবার এদের মধ্যে কিছু হিজড়া যৌন পেশাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
তারাও মানুষ
শারীরিক অস্বাভাবিকতার কারণে হিজড়ারা জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তাদের কামনা-বাসনা আছে, নেই ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্র। তাদের জীবনের একটা হচ্ছে এক গভীর গোপন ট্র্যাজেডি। জীবনের প্রয়োজনে, আর্থিক প্রয়োজনে কেউ কেউ সমর্পিত হয় সুস্থ মানুষগুলোর বিকৃত রুচির কাছে। ব্যবহৃত হয় ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসাবে। পুরুষের কাছে নিজেকে নারী হিসাবে উপস্থাপন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এ কারণে সমাজের সাধারণ নারী পুরুষের ওপর ক্ষিপ্ত থাকে সারাক্ষণ। নিজেদের যেহেতু মেয়ে মনে করে, সেহেতু একজন হিজড়া একজন পুরুষকেই তার জীবনসঙ্গী হিসাবে দেখতে চায়। কেউ কেউ পুরুষদের সঙ্গে সেক্স পার্টনার হিসাবে দিনের পর দিন বসবাস করে।
যেভাবে পরিবার ছাড়ে
নিজের জন্মের জন্য দায়ী না হলেও সমাজ মনে করে হিজড়ারা অভিশপ্ত। সমাজ তো দূরের কথা ভাই-বোন, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরাও তাদের ফালতু ভাবে। সবাই তাদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়, কানাকানি, হাসি-তামাশার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। গালি দেয় হিজড়া বলে। একজন হিজড়া ব্যক্তিগতভাবে যেমন প্রতিষ্ঠা পায় না, তেমনি কোনও প্রতিষ্ঠা পায় না সমাজ, সরকারের কাছ থেকেও। এই সমাজের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে হিজড়া বলে শিশুটিকে কোনও স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। তার সঙ্গে নিজের সন্তানদের খেলতে দেওয়া যাবে না। এমনকি পরিবারের লোকজন হিজড়া সন্তান হওয়ার লজ্জা ঘোচাতে হিজড়া সন্তানটিকে ছেলে সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা আর কতদিন। তার শরীর, মন তো হিজড়ার মতো আচরণ করে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, লোকলজ্জা, কুসংস্কারের কারণে ওই হিজড়া সন্তানটির আর পড়াশোনা হয় না। সে শৈশবে তার ইচ্ছাগুলো পূরণ না করতে পেরে একসময় সুযোগ বুঝে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে। মিশে যায় এদের মতো কোনও হিজড়ার দলে। তারপর বাড়ি বাড়ি নাচ-গান করে মানুষের কাছে হাত পেতে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে। চিরদিনের মতো এই পরিবার তার আদরের সন্তানটিকে হারিয়ে ফেলে।
রাখিবন্ধন
একজন হিজড়ার কাছে তার রক্তের সম্পর্ক বড় নয়। তার কাছে গুরুই সব। দলে ভিড়ে সে গ্রহণ করে বয়স্ক হিজড়ার শিষ্যত্ব। তাকে শ্রদ্ধা করে গুরু বলে। কারণ দলভুক্ত হয়ে থাকতে হলে তাকে গুরুর শিষ্য হতেই হবে। এই গুরুকে কেউ কেউ নানি, দাদি বলেও ডাকে। তিনিই তখন শিষ্যদের সব। শিষ্য হওয়ার সময় গুরু তার কাপড়ের আঁচল শিষ্যের মাথায় স্পর্শ করে দেয় মন্ত্রজপের মাধ্যমে। এবং সাধারণ ছেলের পোশাকগুলো খুলে পরিয়ে দেয় নতুন শাড়ি। সেই শাড়ি পরতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। এসব নিয়মের পর থেকেই হয়ে যায় ‘রাখি বন্ধন’। রাখি বন্ধনের ব্যাপারটি হিজড়াদের কাছে খুবই পবিত্র। এই রাখি বন্ধন অনুষ্ঠান নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে উৎসবের মতো। ওদের বিশ্বাস কোনও শিষ্য যদি তার শাড়ির আঁচল গুরুর মাথায় ছুঁয়ে দেয় তবে সেই শিষ্যও গুরু হয়ে যেতে পারবে। গুরু তার শিষ্যদের সব কিছুর হর্তাকর্তা। অন্যায়, অবিচার, বিরোধের বিচারক। তার আদেশ, নিষেধ শিষ্যদের অবশ্যই মান্য। শিষ্যরাই তাকে আয়-উপার্জন করে খাওয়ায়। গুরু তার শিষ্যদের নিয়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকবেন। এক এলাকার অধীনস্থ হিজড়া শিষ্যরা অন্য এলাকায় গিয়ে উপার্জন বা নাচ-গান করবে না।
হিজড়ারা নিজস্ব সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলায় কঠোর। হিজড়াদের শাসন পদ্ধতি ভিন্ন প্রকৃতির। রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় একজন করে সর্দার থাকে। তারা সাধারণ হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করে। জানা যায়, রাজধানীতে পাঁচ গুরুর আওতায় প্রায় পনের হাজার হিজড়া রয়েছে। সর্দারের বা গুরুর আদেশ ছাড়া কোনও দোকানে কিংবা কারও কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে পারবে না। গুরুই শিষ্যদের এলাকা ভাগ করে দেয়। প্রতিটি গুরুর অধীনে ৮/১০টি দল থাকে। একটি দলে ৫/৬ জন থাকে। প্রতিদিন সকালে গুরুর সঙ্গে দেখা করে দিক-নির্দেশনা শুনে প্রতিটি দল টাকা তোলার জন্য বের হয়ে পড়ে। বিকাল পর্যন্ত যে টাকা তোলা হয়। প্রতিটি দল ওই টাকা সর্দারের সামনে এনে রেখে দেয়। গুরু ওই টাকার অর্ধেক নিয়ে বাকি টাকা শিষ্যরা ভাগ করে নেয়। প্রতি সপ্তাহে হিজড়াদের সালিশি বৈঠক হয়। ১৫/২০ সদস্যের সালিশি বৈঠকে গুরুর নির্দেশ অমান্যকারী হিজড়াদের কঠোর শাস্তি পর্যন্ত দেওয়া হয়। বেত দিয়ে পেটানোসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা তোলার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জরিমানা হয় অপরাধের ধরন অনুযায়ী ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। দন্ডিত হিজড়াকে তার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ শাস্তি হিজড়ারা মাথা পেতে মেনে নেয় এবং কোনও ধরনের প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না।
পঞ্চগুরুর রাজধানী
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হিজড়ারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সাধারণভাবে অধিকাংশ হিজড়ার নোংরা বস্তিতেই বসবাস ও আড্ডা। রাজধানীর শ্যামপুর, সূত্রাপুর, ডেমরা, আজিমপুর, খিলগাঁও, ধামরাই, মিরপুর এলাকা ঘুরে জানা যায়, পুরো রাজধানীকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবং এর দায়িত্বে রয়েছে পাঁচজন হিজড়া গুরু। একেকজন গুরুর আওতায় অর্ধশতাধিক হিজড়া শিষ্য রয়েছে বলে জানা যায়। কেউ কারও এলাকায় যাবে না এবং তোলা ওঠাবে না- এমনকি নাচ-গান পর্যন্ত করবে না।
পাঁচ গুরুর একজন গুরু লায়লা হিজড়া। রাজধানীর শ্যামপুর, ডেমরা এবং ফতুল্লার কিছু অংশের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তার রয়েছে অর্ধশতাধিক শিষ্য বা সাগরেদ। শিষ্যরা সপ্তাহে ১ দিন বাজারে তোলা উঠিয়ে এনে গুরুকে খাওয়ায়। শিষ্যদের বিপদে-আপদ সকল উদ্ধারকর্তা তিনি। লায়লা হিজড়া জানান, কাজ করতে গিয়ে যত বিপদ আপদ ঝক্কি ঝামেলা সব আমাকে সামলাতে হয়।
তিনি জানান, তার পৈতৃক বাড়ি ছিল শ্যামপুরে। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা যান। এরপর থেকে তিনি হিজড়াদের দলে যোগ দেন। দেশে বিদেশের অনেক হিজড়াদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। রাজধানীর শ্যামলী,আদাবর, মোহাম্মদপুর, মিরপুরের গুরু হামিদা। মোহাম্মদ হামিদ থেকে তার নাম হয় হামিদা। তার রয়েছে প্রায় ২শ শিষ্য। সাভার, ধামরাই এলাকা মনু হিজড়ার দখলে। আরামবাগের এক খানসামা তার পিতা ছিলেন বলে জানা যায়। চার সন্তানের মধ্যে মনু ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি জানান তিনি পড়াশোনা করেননি। ৬/৭ বছর থেকেই তার আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করে বাবা-মা যতই তাকে ছেলে হিসেবে রাখতে চায় ততই সে মেয়েদের সাজগোজ, মেয়েলি আচরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এরপর দশবছর বয়সে এলাকায় আসে যাত্রাদল। যাত্রা শিল্পীদের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে যাত্রাদলে যাবার ইচ্ছা হয়। পালিয়ে তিনবছর যাত্রা দলে কাটান। এরপর যখন নিজের শারীরিক অস্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করেন তখনই হিজড়ার দল খোঁজেন এবং দলে যোগ দেন। এখন তিনি গুরু। তার আওতায় রয়েছে প্রায় অর্ধশত হিজড়া শিষ্য। তিনি জানান, এদেশে হিজড়াদের মূল্য নেই, তাদের সম্মান করে না। সব সময় হিজড়া বলে গাল দেয়। ছেলেরা অশ্লীল কথা বলে। তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা চান। পুরনো ঢাকা ও সূত্রাপুরের দায়িত্বে রয়েছেন দিপালী হিজড়া। তারও রয়েছে বিশাল হিজড়া বাহিনী। তার গুরুর মৃত্যুর পরে তিনিই গুরুর দায়িত্ব পান। মাওয়া নয়াবাজারসহ কোতোয়ালির দায়িত্বে রয়েছেন সাধু হিজড়া।
হিজড়াদের জীবনযাপনএই অস্বাভাবিক হিজড়া মানুষদের জীবনাচরণ যেমন কৌতূহল উদ্দীপক তেমনি তাদের মনমানসিকতাও অস্বাভাবিক। এরা যেহেতু নিজেদের নারী মনে করে, সেহেতু নিজেকে সুন্দরী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে মৃত্যু পর্যন্ত। হিজড়ারা সাধারণত বস্তি বা নোংরা এলাকায় বসবাস করে। কারণ সাধারণ বাড়ি মালিকরা তাদেরকে বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ফলে দালালের মাধ্যমে বস্তি এলাকায় কম খরচে ১/২টি রুম ভাড়া নিয়ে কয়েকজন মিলে একত্রে থাকে। হিজড়ারা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাতক কোলে নিয়ে নাচ গান করে আর বাজারের দোকানপাট থেকে তোলা উঠিয়ে যা আয় করে তার অর্ধেক পান হিজড়া গুরু। আর বাকি টাকা শিষ্যরা ভাগ করে নেয়। দৈনন্দিন খাবারের বাজারও তোলা থেকেই ওঠানো হয়। নিজেদের রান্না নিজেরাই করে। সকালে গুরুকে সালাম করে দিকনির্দেশনা নিয়ে শুরু হয় ওদের কর্মযজ্ঞ। যা আয় হয় তা দিয়ে কসমেটিকস ক্রয় করে আর ব্যাংকে জমা রাখে। প্রায় হিজড়ার ব্যাংকে সঞ্চয় রয়েছে। এরা চাকচিক্যময় শাড়ি গহনা আর সাজগোজ পছন্দ করে।
তবে সাধারণ মানুষের লজ্জা, রম্নচি ও সৌজন্যবোধ থাকে। কিন্তু হিজড়াদের মধ্যে এসব আশা করা অবান্তর। কারণ শারীরিক দিক দিয়ে অঙ্গহীন হওয়ায় তাদের মনে প্রচন্ডভাবে দুঃখ কষ্ট ক্ষোভ থাকে। ফলে লজ্জাহীনতাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে অশ্লীলতা, উৎপাত, ব্যভিচারের ঘটনাও শোনা যায়। কোনও বাড়িতে সন্তান জন্ম হলে উৎসবের অংশ হিসাবে হিজড়াদের আসর বসে। তারপর গৃহকর্তা হিজড়াদের চাহিদা অনুযায়ী সন্তুষ্ট করতে না পারলে দলবেধে চলে এসে নগ্ন হয়ে নাচতে শুরু করে।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হিজড়া
হিজড়া হওয়ার কারণ সম্পর্কে নানা কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। কেউ এটাকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলে, কেউ বলে পিতামাতার দোষ কিংবা প্রকৃতির খেয়াল। কিন' আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা পেতে ২৮০ দিন সময়ের প্রয়োজন। এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বাণু বর্ধিত হয়ে জন্ম দেয় নারী শিশুর। আর এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রূণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অন্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন। পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। ভ্রূণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। প্রথমত ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন এক্স-ওয়াই ওয়াই অথবা এক্স এক্স, ওয়াই। এক্স ওয়াই ওয়াই প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী শিশুর মতো। কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী হিজড়াও বলে। আবার এক্স এক্স ওয়াই প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পৌরুষ প্রকাশে বিঘ্নিত হয়। একে পুরুষ হিজড়াও বলে। প্রকৃতির খেয়ালে হোক আর অভিশাপেই হোক এই হিজড়া ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা বলেন, আমরা একেবারে পরিণত বয়সে হিজড়াদের হাতে পাই। তখন এদের চিকিৎসা করতে সমস্যা হয়। হিজড়া শিশুটিকে তার অভিভাবক যদি ৪/৫ বছর বয়সে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসে তাহলে এই শিশুটি অন্তত রাস্তায় নামতে পারে না। অপারেশনের পর সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পড়াশুনা করে জীবন যাপন করতে পারে। সে হয়তো সন্তান ধারণ করতে পারবে না। আসলে তাকে এমন একটা পর্যায়ে আমরা হাতে পাই যেখানে সে পরিবারের বাইরে চলে যায়। তবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানগুলো বাইরে কম যায়। নিম্নশ্রেণীগুলোই বাইরে যায়। তখন তার জীবনধারা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। না পারে নারী হতে না পারে পুরুষ হতে। তারা হোমোসেক্সে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
হিজড়াদের সংগঠন
হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো ইত্যাদি সংগঠন। কয়েকটি সংগঠনের কর্ণধারও হিজড়া। তারা সমাজে চলার জন্য সামাজিক নিয়মকানুন, মানুষকে কোনও কিছুতে বাধ্য না করাসহ হিজড়া থেকেই সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন, যৌন সচেতনতা ও নাচ-গান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও তারা এখন এগিয়ে। এ প্রসঙ্গে হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে লাইট হাউসের নির্বাহী পরিচালক মোঃ হারম্নন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠন হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজের পরিধিও ব্যাপক নয়। আমরা যারা এই গোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করি তারা শুধু একটা অংশ নিয়ে কাজ করি। সঙ্গত কারণেই পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারি না। এ জন্য টাকার প্রয়োজন। হিজড়াদের জন্য সরকারি/ বেসরকারিভাবে কোনও ফান্ড নেই। আমরা এদের নিয়ে কাজগুলো করে থাকি সেটা এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রাম। এদের একটা বিরাট অংশ সমকামিতার সঙ্গে যুক্ত। এইচআইভি ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে এবং সচেতন করতে আমরা এদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দিয়ে সচেতনতার বিষয়টি জানানো হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের বিনামূল্যে কনডমসহ যাবতীয় সামগ্রী দিয়ে সচেতনতা করা হয়। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ পেলে অবশ্যই আমরা এদের নিয়ে কাজ করব।
সরকারের কর্মসূচি
হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনও কার্যক্রম নেই। দেশের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন কারণে একটা ছোট অংশ অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। যুগ যুগ ধরে অবহেলা অবজ্ঞা আর ঘৃণা টিটকারী টিপ্পনি খেয়ে এই সমাজেই বেঁচে আছে এই গোষ্ঠী। এমনকি হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনও পরিসংখ্যানও নেই। নেই অর্থ বরাদ্দ। অন্যের কাছে হাত পেতে টাকা চেয়ে নিজের খাবার জোগাড় করে। পরিবারের সমাজের হেলা-ফেলায় হিজড়া দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। নাগরিক হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এতে তারা খুশি নন, তারা হিজড়া বা থার্ড জেন্ডার হিসাবে স্বীকৃতি চায়। হিজড়াদের দেওয়া তথ্যে বাংলাদেশে বর্তমানে হিজড়ার সংখ্যা দেড় লাখ, এদের মধ্যে শুধু রাজধানীতে আছে প্রায় পনেরো হাজার হিজড়া।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একটা সময় ছিল হিজড়াদের কেউ মানুষ হিসাবেই ধরত না। এখন তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারা ভোটার হচ্ছে। ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনও প্রকল্প নেই এদের নিয়ে। পরিকল্পনা আছে এদের নিয়ে কিছু একটা করার, সেমিনারে-সভায় কথা উঠেছে এদের বিষয়ে।
ওদের দাবি
ওরা চায় সমাজে ওদের মানুষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ওরা সমাজের সঙ্গে, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে বসবাস করতে চায়। ওরা দেশ ও দশের সেবা করতে চায়। চায় একটা সামাজিক, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ওরা হিজড়া নামেই স্বীকৃতি চায়। হিজড়াদের মধ্যে কেউ কেউ নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একটু-আধটু পড়াশোনা করেছে। এরা বিভিন্ন এনজিওর হয়ে কাজও করছে। এদের মধ্যে কথা হিজড়া একজন। বাবা-মা যার নাম রেখেছিলেন ইভান মাহমুদ। তিনি কাজ করছেন নারীপক্ষ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে। কথা বলেন, ফার্স্ট ও সেকেন্ড জেন্ডার নারী ও পুরুষ আমরা ‘থার্ড জেন্ডার’ চাই। আমাদের ‘থার্ড জেন্ডার’ বলতে অসুবিধা কোথায়?
ওরা এইডস সচেতন
হিজড়াদের একটা বড় অংশ পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। এরা সস্তা দামের পারফিউম দিয়ে দিনে রাতে পার্কে কিংবা জনবহুল জায়গাগুলোতে খদ্দেরের আশায় ঘুরে বেড়ায়। সামান্য কয়েক টাকার জন্য বিকৃত রুচির কিছু পুরুষের কয়েক মুহূর্তের শয্যাসঙ্গী হয়। ফলে এরা এইচআইভি/এইডস ঝুঁকিপূর্ণ। এদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং এইচআইভি ভাইরাস যাতে না ছড়ায় এ বিষয়ে সচেতন করতে কয়েকটি সংগঠন কাজে করছে। ওরা এখন অনেক সচেতন।
শেষ কথা
মানুষ হিসাবে অবশ্যই হিজড়াদের জীবন-যাপনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমান সমাজে এরা বাস করে খুবই অবহেলিতভাবে। সরকার যেখানে প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবছে সেখানে মানবাধিকারের দিক চিন্তা করে হিজড়াদের জন্যও পুনর্বাসন কর্মসূচি ও তাদের থার্ড জেন্ডার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
0 comments:
Post a Comment