Friday, November 20, 2009

গীতা দত্ত

0 comments
পুরোনো দিনের যেসব গান শুনে আজও সংগীতানুরাগীরা মুগ্ধ হন, যেসব গান আজও শ্রোতাদের বিনোদিত করে, করে নস্টালজিক, যেসব গান আজও অনেকে একলা দুপুরে বা শেষ বিকেলে আপন মনে গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, সেই সব গান যাঁরা গেয়েছেন, তাঁদের একজন গীতা দত্ত।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের কিংবদন্তি জুটি উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত এবং অজয় কর পরিচালিত অন্যতম জনপ্রিয় ছবি হারানো সুর-এ (১৯৫৬) যে সুরটি হারিয়ে যায়, যে সুরের গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছেন সুচিত্রা সেন, সেই—
তুমি যে আমার
ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বল
তুমি যে আমার।
গানটির শিল্পী গীতা দত্ত। গীতা দত্তের আরও অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে। আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনায় তাঁর অন্য সব গান যদি হারিয়ে যায়, কেবল ‘তুমি যে আমার’ বেঁচে থাকে, তবু সংগীতানুরাগীরা তাঁকে বহুদিন বিশেষভাবে মনে রাখবে। ‘তুমি যে আমার’ ছাড়াও সুচিত্রা সেন গীতা দত্তের গাওয়া আরও বেশ কিছু গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন। এর মধ্যে হসপিটাল-এর (১৯৬০) ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’ ও ইন্দ্রানীর (১৯৫৭) ‘ওগো সুন্দর জানো নাকি’ অন্যতম। এ ছাড়া বাংলায় তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ’, ‘আমি শুনেছি তোমার গান’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, ‘এই মায়াবী তিথি’, ‘যাদু ভরা ঐ বাঁশি’, ‘বাঁশি বুঝি সেই সুরে’, ‘শুধু একটুখানি চাওয়া’ ইত্যাদি। শচীন দেববর্মণসহ ভারতের প্রায় সব বিখ্যাত সুরকারের সুরে গান গেয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে ও পি নাইয়ার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ ও সুধীন দাশগুপ্ত অন্যতম। হ্যাঁ, গীতা ঘোষ রায় চৌধুরীর কথাই বলা হচ্ছে, যিনি সংগীতজগতে গীতা দত্ত নামে অধিক পরিচিত।
গীতা দত্ত ১৯৩০ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার এক ধনাঢ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি মা-বাবার সঙ্গে ভারতের মুম্বাই চলে যান।
গীতা দত্ত প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে ১৯৪৬ সালে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। বাংলা ও হিন্দিতে সমান পারদর্শিতায় গান করেছেন। তিনি সব ধরনের গান করেছেন। তাঁর মধ্যে ভজন, কীর্তন, আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান অন্যতম।
শচীন দেববর্মণের সুরে গীতা দত্তের গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলো হচ্ছে, ‘মেরা সুন্দর স্বপ্ন ভীত গাইয়া’, ‘ওহ্ স্বপ্নেওয়ালি রাত’, ‘তদবির সে বিগদি হুই তাকদির’, ‘আন মিলো আন মিলো’, ‘আজ সাজন মোহে অঙ লাগলো’, ‘হাওয়া ধীরে আনা’, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া কায়া হাসিন সিতাম’ প্রভৃতি।
ও পি নাইয়ায়ের সুরে গাওয়া গীতা দত্তের জনপ্রিয় গানগুলো হচ্ছে ‘জারা সামনে আ’, ‘বাবুজি ধীরে চল না’, ‘ঠান্ডি হাওয়া কালি ঘাটে’, ‘জব বাদল লেহরায়া’, ‘মেরে জিন্দিগি কি হামসফর’, ‘চোর, লুটেরে, ডাকু’, ‘মেরা নাম চিন চিন চো’, ‘কায়সা জাদু বালাম তুনে দরা’ প্রভৃতি।
এসব গানই জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার গান। সিনেমাগুলোর মধ্যে বাজি (১৯৫১), পয়সা (১৯৫৭), কাগজ কি ফুল (১৯৫৯), আর পার (১৯৫৪), মি. অ্যান্ড মিসেস ৫৫ (১৯৫৫) অন্যতম।
সিনেমার গান রেকর্ড করতে গিয়ে গীতা দত্ত নায়ক ও উঠতি পরিচালক গুরু দত্তের সান্নিধ্যে এসে হূদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৫৩ সালের ২৩ মে দুজন বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। গুরু দত্ত ১৯৫৭ সালে গৌরী ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। গীতা দত্ত তা মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এই বিবাহবিচ্ছেদের পর গীতা দত্ত মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং কার্যত তাঁর ক্যারিয়ারের যবনিকা ঘটে।
অন্যদিকে অতিরিক্ত মদ্যপান ও ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে ১৯৬৪ সালে গুরু দত্ত মৃত্যুবরণ (অনেকের ধারণা, এটি ছিল আত্মহত্যা) করেন। এ সময় গীতা দত্ত আরও ভেঙে পড়েন। একই সঙ্গে আর্থিক সমস্যায় পড়েন। এ সমস্যা কাটানোর জন্য তিনি আবার তাঁর গানের ক্যারিয়ারের দিকে নজর দেন। নানাভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি বধূ বরণ (১৯৬৭) নামের একটি ছবিতে অভিনয়ও করেন। গান করেন অনুভব (১৯৭১) ছবির জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আর তাঁর ক্যারিয়ারে ভালোভাবে ফিরতে পারেননি। অতিরিক্ত মদ্যপান এরই মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ ছিল না। ফলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৪১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন হারানো সুর-এর এই শিল্পী। কিন্তু তাঁর গান হারিয়ে যায়নি।
Writer: আশরাফুল হক

0 comments:

Post a Comment