যে-ভূখণ্ডে আজকের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে ভূখণ্ডে বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানববসতি গড়ে উঠেছিল। কালে কালে এখানে নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানুষের আগমন ঘটেছিল। ফলে কালক্রমে গঠিত হতে পেরেছিল বর্ণাঢ্য ও রক্তসঙ্কর বাঙালি জাতিসত্তা।
বগুড়ার মহাস্থানগড় প্রাপ্ত আশোকের ব্রাহ্মীলিপির নিদর্শন এখানকার মানবগোষ্ঠীকে সুপ্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির অংশীদাররূপে প্রতিপন্ন করে। কারণ মানবসভ্যতায় লিপির ব্যবহারকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়রূপে গণ্য করা হয়। তৎপরবর্তী পাল ও সেন আমলের অনেক শিলা ও তাম্রলিপিও এদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। পাল আমলের তালপাতায় লিখিত পুথিও পাওয়া গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়-গ্রন্থাগারে রক্ষিত ১০৪৯ সংখ্যক তালপাতার পুথিটির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রাচীন বাংলালিপিতে লেখা এ পুথিটির লিপিকাল ৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ।
পাল ও সেন আমলে এদেশে তালপাতা, গাছের বাকল প্রভৃতি লিখন উপকরণে যে অজস্র পুথি লেখা হয়েছিল, তা অনুমান করা যায়। কারণ এ অঞ্চলের শিক্ষার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। আর শিক্ষিত মানুষ স্বাভাবিক কারণেই ‘ধর্মঅর্থকামমোক্ষ’ সাধনার জন্য প্রাচীন পুথি অনুলিখন করে ব্যবহার করত। সেন আমলের পরে এদেশে মুসলিম সাহিত্য সংস্কৃতিরও বিকাশ হয়। তাই আঠার শতক পর্যন্ত এদেশে যুগপৎ হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিমসভ্যতাসংস্কৃতি-ঐতিহ্যভিত্তিক সুবিপুল সাহিত্যসম্ভার রচিত হয়। এগুলোর প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল মূলত হস্তলিখিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপির মাধ্যমেই।
বেশ কয়েক শত বছর ধরে এদেশে হাজার হাজার পুথি এভাবে লেখা হয়েছিল ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগেই। ব্রিটিশ ভারতে উনিশ শতক থেকেই পুথিসংগ্রহের কাজ শুরু হয়। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহে এভাবে বিপুলসংখ্যক নানাউপকরণে-লেখা পুথি জমানো সম্ভব নয়। আরও কিছু ব্যক্তিগত ও সাংস্থিক সংগ্রহে বেশকিছু পুথি সংগৃহীত হয়। এভাবে পুথি সংগ্রহের উদ্যোগ-আয়োজনের একটা অনুকূল পরিবেশ উপমহাদেশে গড়ে ওঠে। আমাদের এ অঞ্চলে দুই একজন ব্যক্তিই প্রথমে এ কাজে এগিয়ে আসেন। চট্টগ্রামের প্রয়াত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবিষয়ে অগ্রণী পুরুষ ছিলেন। তাঁর কাজের অসাধারণতা এখানে যে কোনো সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই তিনি হিন্দু-মুসলিম পুথির এক বিরাট সংগ্রহভাণ্ডার গড়ে তোলেন। তাঁর সুযোগ্য ‘শিষ্য’ নোয়াখালি-কুমিল্লার প্রয়াত অধ্যাপক আলী আহমদ বিপুলসংখ্যক মুসলিম পুথি সংগ্রহ করেন। পুথিকে এঁরা পুত্রের মত আদর করতেন। তাঁদের পুথিপ্রীতি কিংবদন্তীতুল্য।
আবদুল কমির সাহিত্যবিশারদ কোনো পুথিসংগ্রহপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেননি। জীবনসায়াহ্ণে তিনি তার মুসলিম পুথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান। অধ্যাপক আলী আহমদকে, তাঁর পুথিসহ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক নিয়ে আসেন ‘কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড’-এর (এখনকার বাংলা একাডেমীর সঙ্গে একীভূত) চাকরিস্থলে। তখন (১৯৬৪ সালে) কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক। অধ্যাপক আলী আহমদ যতদিন উন্নয়ন বোর্ডের চাকরিতে ছিলেন, ততদিন সেসব পুথির যতœ তিনি যথাসাধ্য নিয়েছেন। পরে আলী আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে আসেন। আমৃত্যু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহের পুথিগুলোর সেবায় নিয়োজিত থাকেন। টাঙ্গাইলের অধ্যাপক মুফাখ্খারুল ইসলামও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু দুষ্প্রাপ্য মুসলিম পুথি সংগ্রহ করেছিলেন। সেগুলো এখনও তার বাসায় আছে।
বাংলাদেশে গোষ্ঠীগত উদ্যোগে বেশ কিছু পুথি সংগৃহীত হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহ ও বাংলা একাডেমীর সংগ্রহই প্রধান। ঢাকার জাতীয় জাদুঘর ও কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিীতে কিছু পুথি রয়েছে। ঢাকার বাইরে পূর্বোক্ত রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংগ্রহে পুথি রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ পুথি সংগৃহীত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে। কুমিল্লার রামমালা রিসার্চ লাইব্রেরিতে সুপ্রচুর প্রাচীন পান্ডুলিপির সংগ্রহ ভাণ্ডার রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি জেলা ও উপজেলার পাবলিক লাইব্রেরিতে পুথির সংগ্রহ আছে বলে আমরা জানি। এগুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি, যশোর পাবলিক লাইব্রেরী প্রভৃতির নামোল্লেখ করা যায়। একদা জানা-অজানা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ উদ্যোগী হয়ে এদেশের পুরোনো পুথি সংগ্রহ করেছিলেন। এখন আর এ ধরনের উদ্যোগের কথা শোনা যায় না।
ইতোপূর্বে আমরা দেশের পুথি সংগ্রহকার্যের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছি। দেশের ছোট-খাট পুথি সংগ্রহ ভান্ডারগুলো তাদের সীমিত আর্থিক সামর্থ্যরে কারণে এখন আর পুথি সংরক্ষণ কাজে অর্থ ব্যয় করতে পারে না। ফলে পুথিগুলো তাদের জাতশত্রু পোকামাকড়, ধুলোবালি ও উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার করাল গ্রাসে নিপতিত হয়ে ইতোমধ্যেই অংশত কিংবা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে গেছে।
পুথির সংগ্রহসংখ্যার বিপুলতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমী পুথিশালার কথা এদেশে গুরুত্বলাভ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার ত্রিশেক এবং বাংলা একাডেমীতে হাজার কয়েক পুথি রয়েছে।
[লেখক: ড. মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া
পি-এইচ.ডি (ঢাকা);
ডি.লিট. (রবীন্দ্রভারতী);
প্রফেসর, বাংলা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
উৎস: ইত্তেফাক
বিষয় সমূহ
- Animal (67)
- Artical (29)
- Education (79)
- Fitness (19)
- Food (40)
- Game (12)
- Hijra(হিজড়া) (7)
- Journalism (23)
- Law (19)
- Liberation War(মুক্তিযুদ্ধ) (34)
- Love Effect (26)
- Mosque (42)
- Music (16)
- Nobel Prize (5)
- Organization (30)
- Others (56)
- Plants(গাছ-পালা) (29)
- Politics(রাজণীতি) (22)
- Scandal Religion (1)
- Tribe (8)
- Violence (16)
- Wikileaks (3)
Like for Update
64 Districts
- Bagerhat (4)
- Bandarban (3)
- Barisal (3)
- Bhola (3)
- Bogra (11)
- Brahmanbaria (2)
- Chandpur (4)
- Chapai Nawabganj (2)
- Chittagong (6)
- Comilla (2)
- Cox's Bazar (13)
- Dhaka (65)
- Dinajpur (6)
- Faridpur (1)
- Feni (1)
- Gaibandha (1)
- Gazipur (3)
- Gopalgonj (2)
- Habiganj (2)
- Jamalpur (4)
- Jessore (3)
- Jhenidah (2)
- Khagrachari (1)
- Khulna (3)
- Kishorgonj (2)
- Kurigram (1)
- Kushtia (3)
- Lalmonirhat (2)
- Madaripur (3)
- Magura (1)
- Manikgonj (1)
- Meherpur (2)
- Moulvibazar (14)
- Munsiganj (3)
- Mymensingh (5)
- Naogaon (8)
- Narayanganj (2)
- Natore (10)
- Netrokona (1)
- Nilphamari (2)
- Noakhali (1)
- Pabna (3)
- Panchagarh (2)
- Patuakhali (7)
- Pirojpur (1)
- Rajbari (1)
- Rajshahi (8)
- Rangamati (3)
- Rangpur (5)
- Satkhira (4)
- Sherpur (2)
- Sirajganj (5)
- Sunamganj (4)
- Sylhet (11)
- Tangail (1)
Blog Archive
-
▼
2010
(616)
-
▼
April
(23)
- অটিজম
- চড়ক পূজা
- চুলের যত্ন
- ঘরোয়া রূপচর্চায় হারবাল পরিচর্যা
- লক্ষ্ণৌ
- ম্যানেজার'এর দ্বায়িত্ব
- ক্লান্তি দূর করতে স্পা
- ত্রিশোর্ধ্ব পুরুষের ত্বক-চুলের যত্ন
- বাবুনাই
- চোখগেলো
- স্কার্ট
- হিপ হোপ জাতি
- মাঘী পূর্ণিমা
- মাইজভাণ্ডারী মেলা
- পড়া মনে রাখার কৌশল
- ডিজিটাল
- লালনে দোল
- পুণ্যস্নান
- হোলি উত্সব
- শাড়ি
- লালনের দর্শন
- শেখ মুজিব ৯৩ হাজার পাক সেনাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন
- গবেষণা : বাংলাদেশে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি চর্চা
-
▼
April
(23)
Friday, April 2, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment