Friday, April 9, 2010

লালনের দর্শন

3 comments
লিখেছেনঃ মোমেন
চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমনি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহবাঙালির ধর্ম প্রচারক কলিকালের অবতার চৈতন্য।জাত-পাতের যাঁতাকলে পিষ্ট দরিদ্র মানুষের গৌরাঙ্গ-জাতহীন। নারী পুরুষ এক দেহে ধারণ করে আবির্ভূত।সিদ্ধপুরুষ লালন বাংলা ও এর বাইরে থেকে আসা সমস্ত মতবাদ আত্তীকরণের সর্বোচ্চ বঙ্গীয় প্রকাশ।'রবি ঠাকুরকে কিছুটা আধুনিককালের লালন বলা যেতে পারে'।

আমার লালনকে জানার ক্ষুদ্র চেষ্টার প্রথম কিস্তি।
FileServe
সমগ্র সিন্দ্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে ধারণ করছে অসংখ্য মানবের জীবন।নৃতাত্বিকভাবে জন্ম হয়েছে অনেক ভাষা, সংস্কৃতি বা এর বিশেষ রূপ ধর্ম।শত শত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হাজারো রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনার যে সনাতনী সংস্কৃতি তাই পরবর্তিতে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।পারসিয়ান ও আরবীয়রা মশলার ব্যবসাসূত্রে ভারতের সাথে পরিচিত হয়। এবং সিন্দ্ধু অঞ্চলের মানুষদেরকে সিন্দ্ধ্ বা ইন্দু (Indus Valley) বা হিন্দু বলে তারা অভিহিত করে ফলশ্রুতিতে তাবত দুনিয়ার মানুষের কাছে ভারতীয়রা হিন্দু ও তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম হিন্দু ধর্ম নাম লাভ করে বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত। বহুবিধ তণ্ত্র-মণ্ত্র- ডাক-যোগ দর্শনের প্রকাশ্য ও গোপন চর্চা অথবা কপিল, বৃহস্পতিদের বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের অভূতপূর্ব ভূমি ইন্ডিয়া। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বা দার্শনিক সম্প্রদায়ের সহ অবস্থানের ফলে জীবনাচরনের মিলন (fusion), ভিন্নতা (fission), ধর্মের ক্রমবিকাশ, নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাবে ভারত যেন এক গরম তাওয়া (melting pot)।এখানে উদ্ভুত বৌদ্ধ ধর্ম পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য আর মধ্য এশিয়া বাদ দিলে সমগ্র এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।ভারতীয় ধর্ম বিস্তারিত (diffusion) হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া ধর্মের অনুপ্রবেশ আর সেমেটিক(Semitic) ধর্মসমূহ প্রবাহিত (current/tide) হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধর্ম অনুপ্রবেশ করেছে যুগপৎভাবে।দার্শনিক এই অবস্থানের কারণেই হয়তো ভারতীয়রা উপনিবেশ গড়ে তুলে নি কখনো কিন্তু উপনিবশিত হয়েছে বার বার।উপনিবেশকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মোগল আর ইংরেজরা।

সপ্তম শতকের তিরিশের দশকে মক্কা জয়ের পর আরবরা ইসলামের দর্শন হাতে নিয়ে দিগ্বিজয়ে বের হয় এবং ইসলাম ধর্ম প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে মরোক্ক পর্যন্ত পুরানো সকল সংস্কৃতি খোলনলচে পালটে ফেলে এমন কী মুখের ভাষা পর্যন্ত প্রতিস্থাপিত করে কায়েম করে আরব বিশ্ব।এ প্রবাহের অতিরিক্ত সংযোজন স্পেন, এরপর ফ্রান্সের গলে গিয়ে ক্ষান্ত হয় আরবদের পশ্চিমমূখী যাত্রা। পূর্ব প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় পারস্যে।পারসিক সংস্কৃতির কাছে মুষড়ে পড়ে আরব সংস্কৃতি।ইরানে ইসলাম রূপান্তরিত হয়। ইরানের পার্শ্বে বাগদাদ দীর্ঘ দিন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।আব্বাসীয়রা মুতাজিলাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ইসলামে যৌক্তিকভাবে আল্লার উপস্থিতি প্রমাণে প্রভাব বিস্তারকারী মুতাজিলারা ব্যর্থ হলে প্রভাব বিস্তার করে সূফীজম।যার উর্বর ভূমি হলো পারস্য বা ইরান।

সপ্তম শতক থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে এসে মুসলমানরা মোটামুটি পুরো ভারতবর্ষ দখল করে।কিন্তু ততোদিনে ইরানে দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া ইসলাম অনেকটা ভিন্নরূপে যা কীনা প্রধানত ইরানের সূফীদের দ্বারা প্রচারিত হয় ভারতে।মোহাম্মদ ও খোলেফায়ে রাশেদীনের পরে যে নামগুলেো শুনা যায় তা হলো-বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা বাবা মইনূদ্দীন চিশতী, বাবা ফরীদ, নিজাম উদ্দীন আউলিয়া, শাহ জালাল ইত্যাদি যারা সকলেই সূফী।পারস্য আর মধ্য এশিয়া থেকে ঝাকে ঝাকে পীর-আউলিয়ারা ভারতে ধর্ম প্রচার করে যাকে বলা যায় ইসলামের বিস্তার(diffusion)।
মরমি কবি ফকির লালনকে জানার চেষ্টার প্রারম্ভে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের অনিশ্চিত কৃষিভিত্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন এবং সনাতনী তথা হিন্দু , বৌদ্ধ এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের মিথষ্ক্রিয়ার মানস জগৎ বিবেচনায় রাখা দরকার। হিন্দু ধর্মজাত বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, ইসলামের সূফী মতবাদ বাংলায় যা মূলত মারেফত বা মাইজভাণ্ডারী নামে পরিচিত- এই তিন মূল ধারার মিলনের ফলে উদ্ভূত বাংলার ধর্ম হলো বাউল ধর্ম।
বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়।বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এ সমস্তই ব্যক্ত হয়েছে তাদের গানে।এই সম্প্রদা্য়ের সাধকগণের তত্ত্ব দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই বাউল গান।
রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা।

কীভাবে পুরূষ-প্রকৃতি ( জীবাত্মা-পরমাত্মা/ নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কীভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কীভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে সহজ মানুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে স্বস্থানে যেয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন- বাউল সাধনার মূলভাবটি মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত। এর থেকে বোঝা যায় বা্উল সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ সাধন পদ্ধতি।
অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রকৃতি- পুরুষ-মিলন-ঘটিত ধর্মসাধনার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের সময় হতে বাউলরা সম্প্রদায় হিসেবে প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুরু পরম্পরায় ব্যাপ্ত হয় সারা বাংলায়।
বাউল সাধনার তিন স্তর
প্রবর্ত-- ভগবানের নিকট দৈন্য ও গুরুর করুণা প্রার্থনা।
সাধক-- দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, সাধনার স্বরূপের জ্ঞান লাভ।
সিদ্ধ--সাধনার পূর্ণতার স্বরূপ।
ফকির লালন ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। বিশাখা লালনের সাধিকা।

লালন তথা বাউলদের যৌন সাধন।
বাঙালির কাছে যৌনতা বিষয়টি অনেক বড় ট্যাবু।নিয়মিত যৌন কাজে লিপ্ত হবে কিন্তু মুখে বলবেনা। চিন্তা করুন লালনের জীবন কাল আঠার শতকের শেষের দিক থেকে উনিশ শতক, সমগ্র ভারত বৃটিশদের দখলে। তথাকথিত মুসলমানদের (মোঘল) হাত থেকে নাছারারা ক্ষমতা দখল করেছে, মুসলমানরা জাত যাওয়ার ভয়ে শিক্ষা-দীক্ষা বাদ দিয়ে না বুঝে কোরান মুখস্ত করে জাত রক্ষায় ব্যস্ত।হিন্দুরা জাত-পাতের ঘেরাটোপ আর ইংরেজি শব্দ মুখস্ত করে অফিসের কেরানী বা বাবুগিরির মধ্যে ঘোড়পাক খাচ্ছে।

এমন সমাজে সম্পুর্ণ ভিন্ন স্কুল হল বাউলদের।

আধ্যাত্বিকতার চর্চায় মানবদেহকে ঈশ্বরের আবাস (বারামখানা) মনে করে বলে লালন/বাউলরা দেহ্তত্ত্বে (Physiology) ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে। লালনের গানের বিশাল অংশ জুড়ে দেহতত্ত্বের গান।দেহ থেকে দেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঈশ্বরের ধারাবাহিকতায় সঙ্গম বা নারী-পুরুষের মিলন বাউলদের সাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু।ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে-''কীভাবে পুরূষ-প্রকৃতি ( জীবাত্মা-পরমাত্মা/ নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কীভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কীভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে স্বস্থানে যেয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন- বাউল সাধনার মূলভাবটি মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত।" এর থেকে বোঝা যায় বাউল সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ সাধন পদ্ধতি।

যে কথা বলছিলাম লালনের সময়কালে বা তার আগে পরে বাউলরা সবসময় নিজেদের সাধন পদ্ধতির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতো।যেহেতু তাদের আখড়ায় অনেক সাধিকা থাকতো এবং বাইরের মানুষকে তারা নিজেদের জীবনাচরণ বলতোনা ফলে সহজেই নানারকম কুৎসা রটনা করেতে পেরেছে নিন্দুকেরা। আবদ্ধ সমাজে যৌনতা বিষয়ে গুজব ছড়ানো খুবই সহজ।আর বিশাল এই সম্প্রদায়ের কোথাও কোথাও নাকি বিপথগামী কিছু বাউল আখড়ার পাশে পতিতালয় গড়ে নিতো। এটি মূল ধারা নয়।
এবার আসা যাক সোজা কথায় তাদের সাধনা কী? লালনের গানে প্রায়ই শোনা যায় 'সহজ মানুষ' বা 'অটল রূপ' 'মনের মানুষ' 'অচিন পাখি' বা আলেকজনা এর দ্বারা কী বুঝায়? খুব সহজ ভাবে বললে এর দ্বারা গুরু, মুর্শিদ, রাসুল, আদম, ভগবান, আল্লা, ঈশ্বর ইত্যাদিকে বুঝায়। কিন্তু লালন ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রানের ধারার সাথে কীভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। লালন তথা বাউলদের এ লক্ষ্যে সাধন পদ্ধতির সম্পর্কে যৎসামান্য জানা যায় তা হলোঃ

পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম।আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে।যৌন উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে (Orgasm) সহজ মানুষ বা ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়।কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অরগাজমে থেকে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।ফকির লালন একজন সিদ্ধপুরুষ।এবার দেখি লালন তার গানে কী বলছে

আমি কী সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।

যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে (ত্রিবেণী)
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।

রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।

লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।
এমন অসংখ্য গানে গানে লালন বা বাংলার অন্যান্য বাউলরা নিজেদের প্রেম,কাম, সাধনের কথা বলে গেছেন। রূপ (ঈশ্বর বা পরমাত্মা) থেকে স্বরূপে (মানব ও ঈশ্বর লীন) ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা।
আমি আগের কিস্তিতে বলেছিলাম গুরু রবি ঠাকুর আধুনিক কালের বাউল। তার গানে গানে কবিতায় কবিতায় আধ্যাত্বিকতার সরব উপস্থিতি।সোনার তরীর হিং টিং ছট কবিতায় রাজা হবুচন্দ্র ভূপের স্বপ্নের খোয়াব নামায় দেখুন।গৌড়ের তথা বাংলার গুরুমারা চেলার উলট-পালট তাফসির-

‘ নিতান্ত সরল অর্থ , অতি পরিষ্কার ,
বহু পুরাতন ভাব , নব আবিষ্কার ।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী ।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি ।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট —
সংক্ষেপে বলিতে গেলে , হিং টিং ছট্‌ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
তাহে এক পাগলা ব্যটা বসে একা একেশ্বরে--লালন (৩য় পর্ব)
ছোটবেলা থেকে শুনতাম আল্লা থাকে সাত আসমানের উপরে।মনে করতাম আমরা তো এক আসমান দেখি তার উপরে বুঝি বাকীগুলো।বিজ্ঞানের হাতেখড়িতেই গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদি পড়ে সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেলো।হিসেব মেলে না। ছোট বেলাতেই গ্রামের লোকজনের মুখে শুনেছি 'খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়... আট কুঠুরী নয় দরজা...।' কার গান কি বলছে কিছুই বুঝতাম না।কাউকে জিজ্ঞেস করলে আমাদের দেহে আত্মার যাওয়া আসা পর্যন্ত উত্তর মিলতো।কিন্তু কোথায় আট কুঠুরী নয় দরজা বা সাত আসমান?
বাউলদের সম্পর্কে জানা খুবই কঠিন কাজ। বলা হয়ে থাকে 'শম্ভুকের মতো আত্মসংকোচনশীল, আত্মগোপনশীল জীবন যাত্রার রীতি এই বাউলদের'। বাউলরা তাদের আধ্যাত্বিকতায় ব্যবহার করেছে ভারত পারস্য ও আরবের মিথ।ভারত হলো মিথের মক্কা।ফলে ধর্মের তত্ত্ব ও মিথের সহযোগিতায় তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যেতে পারে।

লালনের খুবই পরিচিত একটি গানের কথায় আসা যাক--
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।
খুব সুন্দর বুঝা যাচ্ছে ঈশ্বর তার বারামখানা এই মানব দেহ শক্ত করে তৈরী করেছে। কিন্তু কোথায়? শুন্যের উপর। শুন্য কী? বিজ্ঞানে এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে কোন কিছুকে আমরা আপেক্ষিকভাবে শুন্য ধরতে পারি। শুন্যের জন্মভূমি ভারত।বুদ্ধের মূল দর্শনই হলো শুন্যবাদ।নাগার্জুন শুন্য সম্পর্কে বলেছেন " অস্তি-নাস্তি-তদুভয়ানুভয়চতুষ্কোটি বিনির্মুক্তং শুন্যরূপম"। সহজ ভাবে বললে দাঁড়ায়-
আছে যে তা নয়
নাই যে তাও নয়
আছে নাই উভয়ই তাও নয়
আছে নাই উভয়ই যে নয় তাও নয়। এই চার মুক্ত কোন কিছু হলো শুন্য।এরই উপর ঈশ্বর পোস্তা করে ঘর বেঁধেছে। তাই ফকির লালন বলছে-ধন্য ধন্য বলি তারে।

ঘরে মাত্র একটি খুঁটি
খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি
কিসে ঘর রবে খাড়ি
ঝড়ি-তুফান এলে পড়ে।

ঘরের একটি খুটি বলতে কী বুঝায়? প্রাণিবিজ্ঞানে পড়েছি সমস্ত প্রানিজগতকে মোটা দাগে দুভাগে ভাগ করা যায় মেরুদণ্ডী অমেরুদণ্ডী।এই মেরুদণ্ড প্রাণির বিবর্তনের খুবই বড় একটি ধাপ।মেরুদণ্ডের কশেরুকার ভিতর দিয়ে তিনটি স্নায়ু পেচিয়ে পেচিয়ে (কুণ্ডলী স্ত্রীবাচক কুণ্ডলিনী) মাথায় গিয়ে মিলেছে।যা ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছে অনেক সময় ত্রিবেণী নামেও পরিচিত।সুষুন্মা, ইড়া,পিঙ্গলা।সুষুন্মা অক্ষের মতো যাকে পেচিয়ে বাকি দুটি। ইড়া বাম শুক্রাশয় থেকে ডান নাসারন্ধ্র পর্যন্ত। শ্বেত বর্ণের শান্ত সৌম্য ও চাঁদের সাথে তুলনীয়। পিঙ্গলা (লাল) ডান শুক্রাশয় থেকে বাম নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বর্ধিত। ইহা ভয়াবহ শক্তিশালী ও সূর্যের সাথে তুলনীয়।

ত্রিবেণীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন কুঠুরী বা পদ্ম ফুলের বর্ণনা করা হয়েছে। পদ্ম গাঙ্গেয় অঞ্চলের খুব সাধারণ ফুল এবং প্রচুর মিথ। ব্রহ্মা স্বপ্ন দেখেন তার নাভিমূল থেকে পদ্ম ফুল ফুটে। স্বরস্বতী পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হন। প্রাণির দেহে ফুলের সনাক্তকরণ যাদের গ্রামদেশে বাড়ী তারা সহজেই করতে পারবেন। গরু ছাগলের বাছুর হওয়ার পর লোকজন পাহাড়া থাকে যেন ফুল না খেয়ে ফেলে। গরু তৃণভোজী কিন্তু এই আমিষ জাতীয় খাদ্য সরিয়ে না ফেললে সে অবশ্যই খায়। লালন তার গানে সরাসরি ফুল শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
কমল কোঠা কারে বলি
কোন মোকাম তার কোথা গলি
সেইখানে পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলি জনা।
একমাত্র খুঁটি সুষুন্মার শুরু থেকে শেষ অবধি কুণ্ডলিনীর (ত্রিবেণী) বিভিন্ন স্তরে সাধনার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চৈতন্য জাগ্রত করে শেষে ঈশ্বরের সাথে লীন হওয়াই দুনিয়ার সমস্ত সাধকের উদ্দেশ্য। সাধকের রূপান্তরের এই স্তর বা চক্র বা ফুল বা কুঠুরী বা আসমান উপমায় কখনও সাত কখনও আট বা নয় ধরনের স্তরের কথা বলা হয়ে থাকে। লালন ৭, ৮, ৯, সবই ব্যবহার করেছে-
দেশ দেশান্তর দৌঁড়ে কেন মরছ রে হাপিয়ে
আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
মানুষ মক্কা কুদরতি কাজ
উঠেছে আজগবি আওয়াজ সাত তলা ভেদিয়ে।
আছে সিং দরজায় তারি একজন নিদ্রা ত্যাগি হয়ে
দেখনারে মন ধ্যেয়ে।
অথবা যে গানটি ধরে আলোচনা করছি তার পরের অন্তরায়-
মূলাধার কুঠুরী নয়টা
তার উপরে চিলে কোঠা
তাহে এক পাগলা ব্যটা
বসে একা একেশ্বরে।
ভারতীয় মিথে সাধনার এই স্তরসমূহকে মুলতঃ সাত চক্রেই আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও বা উপবিভাগ করেছে আট বা নয় চক্রে।
সুষুন্মার ভিত্তি বা মূলকে বলা হয় মূলাধার চক্র।
মূলাধারের অবস্থান যৌনাঙ্গ ও পায়ু পথের মাঝে। চিত্রে বৃত্তের ভিতর চতুর্ভূজের দ্বারা বুঝানো হয়েছে পার্থিব বিষয় আশয়। হাতির পিঠের উপর নিন্মগামী ত্রিভূজ দ্বারা যোনী তথা বিশ্বমাতা, এর মাঝখানে পুরুষ প্রতীক শিবলিঙ্গ যাকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে সর্প দেবী কুণ্ডলিনী। এবার আসা যাক হাতির কথায়। হাতি ভারতে একটি মিথিক চরিত্র। মিথ অনুসারে 'একদা হাতি মেঘের মতো রূপ পরিবর্তন করতে পারতো, উড়তে পারতো।একদিন সে উড়ে গিয়ে বসলো এক ডালে। ঐ গাছের নীচে এক সাধু তার শিস্যদের পড়াচ্ছিলেন।এমন সময় ডাল ভেঙ্গে কয়েকজন শিস্য মারা গেল আর হাতি সুন্দর উড়ে গিয়ে বসলো অন্য ডালে। সাধু সাথে সাথে রেগে গিয়ে সমস্ত হাতি জাতিকে অভিশাপ দিলেন। হাতি তার রূপ পরিবর্তন ও উড়ার ক্ষমতা হারালো। এর পর থেকে হাতি পৃথিবীতে হেঁটে চলা একখণ্ড অভিশপ্ত মেঘ।' হাতির এই সিম্বল থেকে বুঝা যায় শর্তমুক্ত হলে সহজেই পৌঁচা যায় পরবর্তি কুঠুরীতে। মূলাধার স্তর সাধকদের কাছে খুবই স্থুল পর্যায়। এর দ্বারা পরিচালিত মানুষজন সক্রিয় নয়।
পরের চক্র স্বধিস্থান(Svadisthana) ।
এটি কুণ্ডলিনীর বিশেষ আবাস।শরীরের যৌনাঙ্গ বরাবর এর অবস্থান। এই চক্রে কুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয় সেক্স। চিত্রে পানির অসুর মকর এর প্রধান উপাদান। ফ্রয়েড জীবনের এই চক্রের আলোচনা করেছেন ভালোভাবে। ভারতীয় সাধকেরা এই কুঠুরী উত্তরণের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। একটি ধারা কামকে হ্যা বলেছে অন্যটি না। বাউলরা প্রথমটি।
৩য় তলা হলো মনিপুর-
নাভির লেভেলে এর অবস্থান। মানুষের ভোগবাদীতা,দখল মনোবৃত্তি ইত্যাদির প্রকাশ এখানে। বর্তমান পশ্চিমা জগতের জীবনে এই চক্রের প্রাধান্য।
উল্লেখিত চক্রসমূহ সাদামাঠা। যারা এর মধ্যে জীবন যাপন করে তাদের জাগতিক চাওয়া পাওয়াই নির্ধারণ করে জীবনের সুখ-দুঃখ।এরা নিষক্রিয় বা প্রতিক্রিয়াশীল। গুরু ঠাকুর বলেছেন 'পনের আনা মানুষ আসে খায় সন্তান উৎপাদন করে মারা যায়।'
পরবর্তি চক্র সমূহ উঁচু স্তরের।অনেকটা শরিয়ত-মারিফতের পার্থক্যের মতো। দান্তের মতে নতুন জীবনের শুরু।
চক্র চারঃ অনাহত(Anahata)
হৃদপিণ্ডের বরাবর এই পদ্ম। অনাহত মানেই আঘাত হীন।আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো আঘাত ছারা শব্দ অসম্ভব। কিন্তু বিজ্ঞানের Big Bang আল্লার কুন বা ভারতের ওঁম এই সব শব্দ আমাদের চেনা বস্তুর আগে। সাধকেরা চিরন্তন সেই আঘাতহীন শব্দ শোনার সাধনা করে। রাবেয়া বসরী বলেছেন নৈশব্দই সেরা ইবাদত। তিনি নদীর পারে বসে এই ইবাদতই করতেন।অনাহত শব্দ শুনার পরে পরবর্তি কুঠুরীতে গমন।
চক্র পাঁচ বিশুদ্ধ ( Vishuddha)
এর অবস্থান গলায়। কুণ্ডলিনী যখন এই তলে পৌঁছা্য় তখন সাধকের সাথে ঈশ্বরের কথাপকথোন হয়। চিত্রে নিন্মমূখী ত্রিভূজের ভিতর পূর্ণ বৃত্ত হলো পূর্ণ চন্দ্র। লালন তার বহু গানে বলেছে এই চাঁদের কথা। এখানকার দেবতা হলো অর্ধনরেশ্বর শিব। সাধকেরা দেখতে পান পারে যাওয়ার তরী।
লালন অসংখ্য গান লিখেছে পারাপার তত্ত্বের। চির মুক্তি লাভের এই যাত্রা খুবই বিপদ সংকুল। ঠিক সেই ফুলসেরাতের পুলের বর্ণনা।ওপারে আছে চির যৌবন অনন্ত ভূমি এক কথায় স্বর্গ।
সিদ্ধ পুরুষ হতে আর দু চক্র বাকী।
অহনা(Ajna) ষষ্ঠ চক্র
দুই ভ্রুর মাঝে উপরে মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে সেখানে এই চক্রের অবস্থান। সূফীদের ফানা ফিল্লা্হ বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বা দিদার। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় এ স্তরে কিছুটা আমি বা (Ego) থেকে যায়। তিনি বলেন এ যেন ঠিক কাঁচে ঘেরা বাতি। সবই দেখা যায় তবু থেকে যায় বাঁধা। মোহাম্মদের মিরাজে আল্লা ও তার মাঝে একটি পর্দা ছিল।
সহস্র( Sahasrara) ৭ম চক্র
এই স্তর হলো বাকা বিল্লাহ।ইউসুফ হাল্লাজের 'আয়নাল হক' বা আমিই সত্য। রামকৃষ্ণের বর্ণনায় কোন ধরণের বাঁধার অস্তিত্ত্ব নেই। শুধুই আলোর ঝলকানী। লালনের মতে দিবা রাতি নাই সেখানে। লালনের গানে দেখুন সহস্রের কথা
যে রূপে সাঁই বিরাজ করে দেহ ভূবনে
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
শহরে সহস্র পারা তিনটি পদ্মার এক মহেরা
আলেক ছোঁয়ার পবন খোড়া ফিরছে সেখানে।
গুরুর দয়া যারে হয় সেই জানে।
সহস্রের উপরে চিলে কোঠায়ই পাগলা ব্যাটা থাকেন। এর পর লালন বলে-
উপর নীচে সারি সারি
সাড়ে নয় দরজা তারি
লালন কয় যতে পারি
কোন দরজা খুলে ঘরে।
সাড়ে নয় দরজা বলতে দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, যৌনাঙ্গ, পায়ু। যৌনাঙ্গে নারীর দুই দরজা পুরুষের একটা গড়ে সাড়ে নয়।
ধন্য ধন্য বলি তারে
বেঁধেছে এমনও ঘর শুন্যের উপর
আ মরি শুন্যের উপর পোস্তা করে
ধন্য ধন্য বলি তারে।

3 comments:

Post a Comment