Wednesday, April 28, 2010

চড়ক পূজা

0 comments
প্রতিবছরেই ২শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভয়ঙ্কর গা শিউরে ওঠা চড়ক উত্সব পালন হয়ে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ফল পূজা, কাদা পূজা, নীল পূজার মতো সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজা শেষে হয় এই ভয়ঙ্কর চড়কপূজা। চড়ক পূজায় পিঠে বাণ (বিশেষ বড়শি) ফুড়িয়ে চড়ক গাছের সঙ্গে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ চরকার ঝুলন্ত মাথায় দড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয় পিঠের বড়শি। আর বাণবিদ্ধ সন্ন্যাসীরা ঝুলতে থাকে শূন্যে। রাতে নীলপূজার পর সন্ন্যাসীরা সবাই থাকেন নির্জলা উপোস। পরদিন বিকালে চড়কপূজা শেষে উপোস ভাঙেন তারা।
প্রথমে বালা (শিবপাঁচালী পাঠক) এসে মন্ত্র পড়া শুরু করলে, সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান করে ফেরার সময় প্রত্যেকে মাটির কলসি ভরে জল আনেন। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবারও শিবপাঁচালী পাঠ করতে লাগেন বালা। এবার সন্ন্যাসীরা সবাই চড়ক গাছে জল ঢেলে ভক্তি জানিয়ে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা একটি জায়গায়। সেখানে তাদেরকে বাণ বিদ্ধ তথা পিঠে বর্শি পোঠানো হয়। জলজ্যান্ত মানুষরা (সন্ন্যাসী) নিজের শরীর বানে (বড়শি) বিঁধে চড়ক গাছে ঝুলে ২৫ ফুট ওপরে শূন্যে ঘুরেন। সন্ন্যাসীর আশীর্বাদ লাভের আশায় শিশুসন্তানদের শূন্যে তুল দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। অনেক সময় কোলেও তুলে নেন। এক হাতে থাকা বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘোরান। অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশে বাতাসা ছিটান ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। দেবাদিদেব-মহাদেব শিবঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রতিবছর এদিন এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন সন্ন্যাসী শিবভক্তরা। তাদের বিশ্বাস—এ জগতে যারা স্বেচ্ছায় শিবঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন, পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
চড়কপূজার সময় : চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম পর্যন্ত ভক্তরা মহাদেব শিবঠাকুরের আরাধনা করেন। মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানা পূজার আয়োজন করেন তারা। এরই সর্বশেষ আয়োজন চড়কপূজা। প্রতিবছর ভারতীয় পঞ্জিকার ২ বৈশাখ ও বাংলাদেশের ৩ বৈশাখ এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

চড়কপূজার ইতিহাস : এই ঐতিহাসিক চড়কপূজা কবে কীভাবে শুরু হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। এই রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, আজকের মহেশপুর জেলা একসময় সুলতানপুর পরগনা নামে পরিচিত ছিল। সুলতানপুর পরগনার শাসনকর্তা ছিলেন সূর্য মাঝি নামের এক জমিদার। সে সময়ে এ এলাকারই ১৭ ব্রাহ্মণ চক্রান্ত করে সূর্য মাঝিকে হত্যা করেন এবং পরগনার মালিকানা দখল ও ভাগ করে নেন। সে সময়ের মহেশপুরের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হলেন হরিনারায়ণ চৌধুরী। তার সময় জমিদাররা মহেশপুরের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন। দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখতে বিভিন্ন ধরনের পূজার আয়োজন করেন তারা। জনশ্রুতি আছে, তত্কালীন সময়ে কপোতাক্ষ ও বেতনা নদীর সংযোগস্থলে ধীরে ধীরে একটি নতুন চর জেগে ওঠে। এই চরে স্বয়ং আবির্ভূত হন মহেশ্বর, যার অন্য নাম বুড়ো শিব। তার নামানুসারেই প্রতিষ্ঠিত হয় মহেশ্বর (শিব) মন্দির। এর কিছুকাল পর ফতেপুর কপোতাক্ষ নদের পাশে আরও একটি চর জাগে। সেই চরে ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেপুর এলাকার জমিদার বংশের লোকজন অন্যান্য পূজার সঙ্গে চড়কপূজা শুরু করেন। রাজপরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কখনই রাজ-রাজড়াদের পূজা ছিল না। এটি ছিল নিতান্তই হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি। পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের কথিত নিচু সম্প্রদায়ের মানুষ। এখনও এ পূজায় কোনো ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়ে না।

সন্ন্যাসীরা জানান, শরীরে বড়শি ফোঁড়ানোর ফলে বড় বড় ক্ষতের সৃষ্টি হলেও রক্ত বের হয় সামান্য। আর এজন্য কোনো ওষুধেরও প্রয়োজন হয় না। ক্ষতস্থানে পূজোয় ব্যবহৃত সিঁদুর টিপে দিলেই হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে ৫ দিন ধরে চলে লোকজ মেলা। ৩ বৈশাখ চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হলেও পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে ৫ বৈশাখ পর্যন্ত চড়ক মেলা চলে।
ছবি
চড়ক পূজা

0 comments:

Post a Comment